বিদ্যাসাগর/ত্রিচত্বারিংশ অধ্যায়
ত্রিচত্বারিংশ অধ্যায়।
শেষ।
এইবার শেষ। শূন্য-দেহের শ্মশানসৎকার। নিত্য মৃতগ্রাসী নিমতলা ঘাটে বিদ্যাসাগরের সৎকার হইয়াছিল। দুই দিন পূর্ব্বে এই নিমতলার শ্মশান-শয্যায় বঙ্গের অন্যতম শক্তিশালী পুরুষ রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র বাহাদুর শেষ শয়ন করিয়াছিলেন।
বিদ্যাসাগর যে সুন্দর সুশোন খট্টাঙ্গে শয়ন করিতেন, সেই খট্টাঙ্গেই তাঁহার শব-দেহ শায়িত হইয়াছিল। পুত্র, ভ্রাতা, দৌহিত্র, আত্মীয়বর্গ এবং ভক্তবৃন্দ খট্টাঙ্গ স্কন্ধে লইয়া রাত্রি প্রায় চারি ঘটিকার সময় নিমতলাভিমুখে যাত্রা করেন। মেট্রপলিটন ইন্ষ্টিটিউসনের সম্মুখে উপস্থিত হইলে, পুত্র নারায়ণ বাষ্পাকুলিতলোচনে উচ্চ কণ্ঠে বলিয়াছিলেন,—“বাবা, এই তোমার সাধের মেট্রপলিটন। আশীর্ব্বাদ কর, যেন তোমার এই কীর্ত্তি বজায় রাখিতে পারি।” সেই শোকপরীত কাতর ক্রন্দনে উপস্থিত কেহই অশ্রু সম্বরণ করিতে পারেন নাই।
নিশার শেষভাগে অনেকেই এই শোকময় সংবাদ শুনিয়া, শেষ দেখা দেখিবার জন্য উৰ্দ্ধশ্বাসে ধাবিত হইয়াছিল। অনেক ভক্ত খট্টাঙ্গ স্পর্শ করিয়া জীবনকে সার্থক জ্ঞান করিয়াছিল। সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে শব শ্মশানে উপস্থিত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভ্রাতৃবর্গ সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বেই সৎকার করিবার সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। দৌহিত্রগণ কিন্তু শব-দেহের শেষ ফটোগ্রাফ তুলিবার জন্য উদ্যোগী হইয়াছিলেন। তাঁহারা বিখ্যাত ফটোপ্রাফার শরৎচন্দ্র সেন মহাশয়কে ডাকাইয়া আনাইয়া ঠিক সুর্য্যোদয়ে ফটোগ্রাফ তুলাইয়া লন।
দেখিতে দেখিতে, ক্রমে শ্মশান ঘাট অসংখ্য জনসমাগমে পূর্ণ হইল। সকলেই বিদ্যাসাগরকে শেষ দেখা দেখিবার জন্য উদগ্রীব। অনেক স্ত্রীলোেক দেখিতে গিয়াছিল। যাঁহারা প্রত্যহ প্রাতঃস্নানে যাইয়া থাকেন, তাঁহারা সংবাদ পাইবামাত্র সর্ব্বাগ্রে শ্মশানে গিয়া উপস্থিত হন। সেই সময় প্রকৃতি, প্রকৃতই একটা বিশ্বব্যাপিনী সৌম্য-গম্ভীর শোকময়ী মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছিল। ভাগীরথীর কলকলনাদে সমাগত ব্যক্তিবর্গের হাহাকার-আর্ত্তনাদ এবং অশ্রুভারাবনত আত্মীয়বর্গের নীরব দীর্ঘশ্বাস মিশিয়া কি যেন এক অপূর্ব্ব দৃশ্যের আবির্ভাব হইল।
ফটোগ্রাফ তুলাইতে এবং সমাগত ব্যক্তিবর্গের দর্শনাকাঙ্খা মিটাইতে সৎকারের বিলম্ব হইয়াছিল। সূর্য্যোদয়ের পর শবদেহ চিতা-শয্যায় শায়িত হয়। চিতার অন্য বড়বাজার প্রভৃতি স্থান হইতে যথাসম্ভব চন্দনকাঠ সংগৃহীত হইয়াছিল। মুহূর্ত্তে চিতা জ্বলিল! পুত্র নারায়ণ মুখাগ্নি করিলেন।[১] বেলা প্রায় ১১টা পর্যন্ত চিতা জ্বলিয়াছিল। ক্রমে সব ফুরাইল। চিতা নিবিল। অনেক ভক্ত অস্থি ও ভস্ম সংগ্রহ করিয়াছিলেন। দৌহিত্রদ্বয় দুই কলস ভস্ম সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন। যাহা অবশিষ্ট ছিল, তাহাও দুই দিন পরে জাহ্নবী জলে মিশাইল। কিছুই রহিল না! রহিল কীর্ত্তি! আর রহিল স্মৃতি! কবি মানকুমারী শ্মশানে স্বচক্ষে বিদ্যাসাগরের সংস্কার দেখিয়া মর্ম্মস্পর্শিনী ভাষায় লিখিয়াছিলেন,—“অই জাহ্নবী-বক্ষে ধূ ধূ করিয়া চিতার আগুন জ্বলিতেছে! ঐ আগুনে বাঙ্গালার সর্বনাশ হইতেছে! বাঙ্গালীর পিরামিড ভস্মসাৎ হইতেছে! ঐ ধু ধু করিয়া আগুন জ্বলিতেছে! ঐ আগুনে বাঙ্গালার সম্মান-গৌরব পুড়িয়া ছাই হইতেছে। ঐ জ্বলন্ত আগুনে বাঙ্গালীর প্রধান গর্ব্ব— প্রধান অহঙ্কার পুড়িয়া যাইতেছে। ঐ চিতার আগুনে আজ কত কি ফুরাইল। কত কাঙ্গাল গরীবের মাতা পিতা হারাইল। কত হৃদয় আজি আশা-ভরসা হারা হইল। শ্রাবণের মেঘ স্তম্ভিত হইয়া দেখিতেছে! বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্তম্ভিত হইতেছে! ঐ চিহ্ন ফুরাইয়া আসিতেছে।”
সৎকারান্তে কাঙ্গালী বিদায় করিয়া সকলেই বেলা প্রায় দুই প্রহরের সময় বাড়ী ফিরিয়া আসেন। প্রায় দশ বার দিন বিদ্যাসাগরের ভক্তবৃন্দ মধ্যে মধ্যে শ্মশানে চিতা-চিহ্নের পার্শ্বে সকীর্ত্তন করিয়াছিলেন।
- ↑ বিদ্যাসাগর মহাশয়, মুমূর্ষু পত্নীর নিকট যে প্রতিশ্রুতি করিয়াছিলেন, ফরাসডাঙ্গায় শেষ প্রবাসে তৎপালনের প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল। নারায়ণ বাবু পিতৃ শুশ্রূষার অধিকার পাইয়াছিলেন।