বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ॥ ক্ষমা ও সহিষ্ণতা

 ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা সাধুজীবনের বিশেষ লক্ষণ। এই দুইটি সদগুণে লোকের চিত্ত যেরূপ আকৃষ্ট হয়, এরূপ আর কিছুতেই হয় না। অপরে যখন আমাদিগের কোন অনিষ্ট সাধন করে, অথবা আমাদিগকে নানা প্রকারে উৎপীড়িত করিবার প্রয়াস পায়, তথন বৈর-নির্যাতন বাসনায় হৃদয় কলুষিত করা আমাদিগের পক্ষে নিতান্ত অনুচিত। যারা সহিষ্ণুতাশূন্য হইয়া ক্রোধে উত্তেজিত হয়, সেই আত্মসংযম-শক্তিবিরহিত ব্যক্তিবর্গের প্রকৃতি অতিশয় ঘৃণার্হ। আত্মসংযম-ক্ষমতাই মহত্ত্বের পরিচায়ক। কেহ আমাদিগের অপবাদ ঘোষণা করিলে, সাধারণতঃ তাহার প্রতি আমরা ক্রদ্ধ হইয়া থাকি, কেহ আমাদিগের প্রতি অত্যাচার করিলে, তাহার বিপৎকালে আমরা আনন্দ অনুভব করি; কিন্তু এই সকল ব্যাপার, আমাদিগের লঘুচিত্ততারই সাক্ষ্যদান করিয়া থাকে। সামান্য বায়ুভরে তৃণই বিচলিত হয়; ভয়ঙ্কর ঝটিকার সময়েও অচলরাজি স্থানচ্যুত হয় না। সামান্য কারণেই লঘু, হৃদয় বিচলিত ও অসহিষ্ণু হইয়া পড়ে, কিন্তু মহৎ হৃদয় কিছুতেই ক্রোধ বা বৈরনির্যাতনবাসনা দ্বারা চঞ্চল ও বিকৃত হইয়া পড়ে না।

 যাহারা ক্রোধপরতন্ত্র হইয়া, অত্যাচারীর দণ্ডবিধান করিতে অগ্রসর হয়, তাহারা দণ্ড প্রদান করিবার প্রকৃত অধিকারী নহে; কিন্তু প্রশান্ত হৃদয়ে অপরাধীর কল্যাণসাধনকামনায় যাঁহারা দণ্ডবিধান করিতে পারেন, তাঁহারাই কেবল শাসন ও দণ্ডবিধানের অধিকারী। যে সকল ব্যক্তি ক্ষমাশীল ও সহিষ্ণ নহে, অপরকে শাসন করিবার অধিকার গ্রহণ করা তাহাদিগের পক্ষে ন্যায়সঙ্গত কি? মানবমাত্রেরই সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল হওয়া উচিত। ক্ষমাতে একদিকে যেমন হৃদয়ের উদারতা প্রকাশিত হয়, অপরদিকে তেমনই দয়া ও লোকানুরাগ প্রদর্শিত হইয়া থাকে। আমরা যদি ক্রমাগত আমাদিগের শত্রুগণের প্রতি ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করিতে থাকি, তাহা হইলে কোন না কোন দিন তাহাদিগের হৃদয় অনুরাগে আর্দ্র হইয়া পড়িবে। শত্রুবিজয়ের এরূপ সহজ ও সুন্দর পন্থা আর কুত্রাপি দৃষ্টিগোচর হয় না।

 বিধবাবিবাহবিষয়ে গ্রামবাসিগণের মধ্যে যাঁহারা বিরোধী ছিলেন, তাঁহারা সুযোগ পাইলেই ঠাকুরদাসের উপর অত্যাচার করিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। একদিন প্রাতে উঠিয়া ঠাকুরদাস ও ভগবতী দেখিতে পাইলেন, রজনীযোগে বিরুদ্ধবাদীরা কণ্টকবৃক্ষের শাখা প্রশাখা স্তুপাকার করিয়া তাঁহাদের দ্বারদেশ রুদ্ধ করিয়া গিয়াছে। অতি কষ্টে ঠাকুরদাস ও ভগবতী গমনাগমনের জন্য নীরবে পথ পরিষ্কার করিয়া লইলেন। একদিন প্রাতে উঠিয়া দেখিলেন, বিপক্ষ দলের লোকেরা কতকগুলি মৃত জীব জন্তু তাঁহাদের দ্বারদেশে নিক্ষিপ্ত করিয়া গিয়াছে। ঠাকুরদাস সেই সময়ে একখানি গৃহ নির্ম্মাণের আয়োজন করিতেছিলেন। একদিন রজনীতে সুযোগক্রমে শত্রুপক্ষীয়েরা সেই গৃহের সমস্ত উপাদান অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছিল। এইরূপে ঠাকুরদাস ও ভগবতী তাহাদিগের উৎপীড়নে ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিলেন। এই সংবাদ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের শ্বশুর, ক্ষীরপাইনিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের নিকট প্রেরিত হইলে, তিনি একদিন বীরসিংহে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য্য অতিশয় তেজস্বী, ক্রোধী ও বলশালী ছিলেন। তৎকালে তাঁহার স্বীয় গ্রামে ও পার্শ্বর্বত্তী গ্রামসমূহে তাঁহার বলবত্তার তুলনা ছিল না। অথচ তিনি সহায়তা ও উদারতা গুণে সর্ব্বজনের ভক্তি ও প্রীতি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের ভয়ে তৎকালে ঐ প্রদেশের দস্যু তস্করেরা সতত শঙ্কিত থাকিত। সেই সময়ে ঐ প্রদেশের কোন বলশালী সঙ্গোপ—এক দস্যুদল গঠন করিয়াছিল। তাহাদের অত্যাচারে লোকে সদা ভয়ে দিন যাপন করিত। একদিন শত্রুঘ্ন, জ্যেষ্ঠের অনুরোধে একাকী সেই দস্যুদলকে এমন শিক্ষা দিয়াছিলেন যে, তদবধি তাহারা আর নিকটবর্ত্তী গ্রামসমূহের উপর কোন প্রকার অত্যাচার করিত না। তাঁহার দৈহিক বলের জন্য ঐ প্রদেশের সকল তাঁহাকে ‘কলির ভীম’ বলিত।

 পরদিবস ভট্টাচার্য মহাশয় বিরুদ্ধবাদীদিগকে ডাকাইয়া বলিলেন, “দেখ, যদি সকলে প্রাণের মমতা রাখ, তবে নিরন্ত হও। বৈবাহিক মহাশয় অতিশয় নিরীহ ও সদাশয় ব্যক্তি। ইঁহার দ্বারা তোমাদের কখনও কোন প্রকার অনিষ্ট সাধিত হয় নাই। ইনি সতত তোমাদের মঙ্গলচিন্তায় নিরত। ঈদৃশ হিতাকাঙ্ক্ষী নিরীহ গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার করা লোকতঃ ধর্ম্মতঃ অতীব গহিত কার্য্য। তোমাদিগকে সাবধান করিয়া দিতেছি, অতঃপর আর ইঁহার উপর কোন প্রকার অত্যাচার করিও না। আর যাবৎ ইঁহার গৃহ নির্মাণ না হয়, তাবৎ আমি বীরসিংহে অবস্থিতি করিব। আমার বল বিক্রমের কথা তোমাদের অবিদিত নাই। আমি স্বগ্রামে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া যদি শুনিতে পাই যে, তোমরা পুনরায় ইঁহার উপর কোন অত্যাচার করিয়াছ, তাহা হইলে আমি তোমাদিগকে এরপ শিক্ষা দিব যে, সকলে বীরসিংহের পৈতৃক বাস্তুু ত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হইবে।” যাহা হউক ভট্টাচার্য্য মহাশয়ের তেজ ও সহৃদয়তা মিশ্রিত উক্তি শ্রবণে অতঃপর বিরুদ্ধবাদীরা ঠাকুরদাসের উপর অত্যাচার করিতে নিরস্ত হইয়াছিল।

 সেই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষাল জাহানাবাদের ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট্ ছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় একসময় প্রসঙ্গক্রমে এই সকল অত্যাচারের কথা তাঁহার কর্ণগোচর করেন। ঘোষাল মহাশয় মফঃস্বল ভ্রমণ কালে একদিন ছদ্মবেশে বীরসিংহে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুরদাস পরম সমাদরে তাঁহার পরিচর্য্যা করিলেন। শেষে ঘোষাল মহাশয় বলিলেন, “আমি এখানে আসিয়াছি কেন কিছু, কি জানিতে পারিয়াছেন?” ঠাকুরদাস বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “না, আমি ত তাহার কিছুই জানি না।” তখন ঘোষাল মহাশয় বলিলেন, “আমি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নিকট শনিলাম যে, বিধবাবিবাহসম্বন্ধে বিরুদ্ধবাদীরা আপনার উপর অমানুষিক অত্যাচার করে। আপনি তাহাদের নাম বলুন। আমি শাসনের ব্যবস্থা করিব।” ঠাকুরদাস বিষন্নবদনে বলিলেন, “ঈশ্বর ছেলেমানুষ, সে বিদেশে থাকে, দেশের কোন সংবাদ রাখে না। কাহার মুখে কি শুনিয়াছে, তাহাই আপনাকে বলিয়াছে। গ্রামের কাহারও সহিত আমার অসদ্ভাব নাই। তাহার কথা শুনিয়া নিরীহ গ্রামবাসীদিগকে শাসন করা আপনার ন্যায় বুদ্ধিমান ব্যক্তির কর্ত্তব্য নহে।” ঘোষাল মহাশয় ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, “সমস্তই বুঝিলাম। আপনার ন্যায় পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন বলিয়াইবিদ্যাসাগর দয়ার সাগর হইতে পারিয়াছেন। যাহা হউক, আপনি যদি প্রমাণ করিতে পারেন যে, গ্রামবাসীসকলে আপনার সহিত সদ্ভাবে আছে, তাহা হইলে আমি আর তাহাদের উপর কোন প্রকার উৎপীড়ন করিব না।”

 অতঃপর ঠাকুরদাস দ্রুতপদে অতঃপুরে প্রবেশ করিয়া ভগবতী দেবীকে বলিলেন, “মনসা, গ্রামের লোকেরা আমাদের উপরে অত্যাচার করে, হাকিম কাহার নিকট শুনিতে পাইয়াছেন।” ভগবতী দেবী এই কথা শুনিয়া অশ্রুপূর্ণলোচনে বলিতে লাগিলেন, “তাহা হইলে ত সর্ব্বনাশ উপস্থিত দেখিতে পাইতেছি। আহা! এখন লোকগুলিকে রক্ষা করিবার উপায় কি? হাকিম যখন জানতে পারিয়াছেন, তখন ত আর উহাদের নিস্তার নাই। উহাদের উপর ভয়ানক অত্যাচার হইবে। উহারা যেন না বুঝিয়া আমাদের উপর অত্যাচার করে, কিন্তু আমরা উহাদের উপর অত্যাচার কিরূপ করিয়া দেখিব? এখন উপায় কি? তুমি হাকিমকে কি বলিলে?” তদুত্তরে ঠাকুরদাস বলিলেন, “মনসা, আমি হাকিমকে বুঝাইয়া দিয়াছি, গ্রামবাসীসকলের সহিত আমার সম্ভাব আছে। এখন তুমি তাহাদিগের সকলকে একবার সাবধান করিয়া দিয়া আইস, তাহারা যেন সন্ধ্যার সময় আমাদের বাটীতে আসিয়া হাকিমের সহিত একবার সাক্ষাৎ করিয়া যায়।”

 ভগবতী দেবী এই কথা শ্রবণ করিয়া দ্রুতপদে বিরুদ্ধবাদীদিগের প্রত্যেকের বাটীতে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “দেখ, হাকিম তোমাদের অত্যাচারের কথা কাহার নিকট শুনিয়া তদন্ত করিতে আসিয়াছেন। আমাদের নিকট তোমাদের নাম চাহিয়াছিল, কিন্তু আমরা দিই নাই। আমরা বলিয়াছি, গ্রামের সকল লোকই আমাদের সঙ্গে সদ্ভাবে আছে। তোমরা সকলে সন্ধ্যার সময় আমাদের বাটীতে গিয়া হাকিমের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করিয়া আসিলেই সমস্ত গোলযোগ নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে। আর তোমাদের সকলের নিমন্ত্রণ রহিল। রাত্রিতে সকলে আমাদের বাটীতে ভোজন করিবে।” গ্রামবাসীরা ভগবতীর উপদেশমত কার্য্য করিয়া ঘোষাল মহাশয়ের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছিল। এরূপ দৃষ্টান্ত জগতে অতি দুর্লভ!

 ফলতঃ বিধবাবিবাহ সম্বন্ধে বিরুদ্ধবাদীরা খড়্গহস্ত হইয়া ঠাকুরদাসের উপর এরূপ আমানুষিক অত্যাচার করিয়াছিল যে, সে সকল অত্যাচারে পর্ব্বতও বিচলিত হয়, হিমশিলাও অগ্নিময় হয়। কিন্তু তিনি ও ভগবতী দেবী সেই সকল অত্যাচার যে ভাবে সহ্য করিয়াছিলেন এবং অত্যাচারীদিগের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিলে মনে হয়, দ্বিতীয় যীশু খ্রীষ্ট বা হরিদাস, ঠাকুরদাস ও ভগবতীরূপ যুগল মূর্ত্তি ধারণ করিয়া বীরসিংহে অবস্থিতি করিতেছিলেন।