বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/নৈতিক বাধ্যতা বা কর্ত্তব্যবুদ্ধি

ষোড়শ পরিচ্ছেদ॥ নৈতিক বাধ্যতা বা কর্ত্তব্যবুদ্ধি

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অন্তঃকরণ স্বতঃই হিন্দু, বালবিধবাদিগের দুঃখে বিগলিত হইত। কোন বালিকা বিধবা হইয়াছে শ্রবণ করিলে, বিদ্যাসাগর হৃদয়ের আবেগ কিছুতেই সম্বরণ করিতে পারিতেন না, উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিতেন। তিনি বাল্যকাল হইতেই বিধবা-বিবাহ প্রচলনের পক্ষপাতী ছিলেন। কালসহকারে বিদ্যাসাগর বুঝিতে পারিলেন, শাস্ত্রপ্রমাণ ব্যতীত বিধবাবিবাহ প্রচলন করা দুরূহ। সুতরাং তিনি শাস্ত্রপ্রমাণ সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইলেন। শাস্ত্রানুসারে বিধবাবিবাহের শাস্ত্রীয়তা সপ্রমাণ করা বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্য হইলেও প্রথমতঃ তিনি শাস্ত্রীয় প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারেন নাই। পরে একদিন রজনী যোগে একখানি পুঁথি পাঠ করিতে করিতে তিনি হঠাৎ আনন্দবেগে উঠিয়া বলিলেন,—“পাইয়াছি, পাইয়াছি।” উপস্থিত সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি পাইয়াছেন? তখন তিনি পরাশরসংহিতার সেই শ্লোকটি আবৃত্তি করিলেন:—

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যোবিধিরতে।”

 এইরূপে তিনি যখন মনে ও জ্ঞানে স্থির করিলেন, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসঙ্গত, তখন তিনি ঐ প্রথা প্রচলন জন্য মন, প্রাণ, ধন সব সমর্পণ করিলেন। তৎপরে মাতাপিতার আশীর্বাদ গ্রহণ করিবার জন্য দেশে গমন করিলেন। ভগবতী দেবীর নিকট সমস্ত বিষয় নিবেদন করিলে, তিনি হৃষ্টচিত্তে উত্তর করিলেন, ‘বাবা, তুমি কি আমার যে সে ছেলে? তুমি যখন বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসঙ্গত স্থির করিয়াছ, তখন আমি প্রসন্নমনে তোমাকে আশীর্বাদ করিতেছি। আহা! যদি জন্মদুঃখিনীদের কোন গতি করিতে পার, তাহা বাবা এখনই কর। কিন্তু বাবা, একবার কাজে হাত দিলে, তখন সমাজের ভয়ে, এমন কি কর্ত্তা বারণ করিলেও তুমি কোন মতে নিবৃত্ত হইবে না।”

 তৎপরে বিদ্যাসাগর পিতাকে জিজ্ঞাসা করিলেও তিনি ঐরূপ উত্তরই দিয়াছিলেন। অধিকন্তু তিনি বলিয়াছিলেন, ‘'কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবার পুর্ব্বে তুমি আর একবার উত্তমরুপে শাস্ত্রীয় প্রমাণগুলি দেখিবে।”

 মাতাপিতৃভক্ত সন্তান বিদ্যাসাগর মাতাপিতার আদেশ স্বীয় জীবনাপেক্ষাও অধিকতর মূল্যবান বলিয়া মনে করিতেন। দশের সমষ্টি লইয়া সমাজ, দশের কল্যাণের জন্য সন্তানকে প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর বস্তু বলি দিতে উপদেশ দেওয়া জগতে এক বিচিত্র ব্যাপার! ধন্য ভগবতী দেবী! ধন্য তোমার কর্ত্তব্যবুদ্ধি! ধন্য তোমার কর্তব্যশিক্ষা! একে বাল্যবিধবাদিগের দুঃখে বিদ্যাসাগরের হৃদয় দগ্ধীভূত হইতেছিল, সেই দগ্ধহৃদয়ে মাতাপিতার আশীর্বাদরূপ পুণ্যহুতি প্রক্ষিপ্ত হওয়ায়, দ্বিগুণতর প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। কর্মবীর বিদ্যাসাগর কর্ত্তব্যবুদ্ধিরূপ আয়ুধে সন্নধ হইয়া অপ্রতিহত গতিতে কর্মক্ষেত্রে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, জগৎ তাঁহার প্রতিকূলে দণ্ডায়মান হইয়াও তাঁহাকে সঙ্কল্পচ্যুত করিতে পারে নাই। ফলতঃ কর্ত্তব্যবুদ্ধির কি মহীয়সী শক্তি। যে কর্ত্তব্যজ্ঞানপ্রণোদিত হইয়া মহাজ্ঞানী সক্রেটিস তাঁহার প্রিয় শিষ্যকে বলিয়াছিলেন,—“ক্রিটো। আমি সর্বজনাধিগত অপরিবর্ত্তনীয় নিয়তি পরিহারার্থ কোথায় গমন করিব?” যে নৈতিক বাধ্যতাপ্রণোদিত হইয়া ধর্মবীর ঈশা অসহ্য ক্রুশ যন্ত্রণা সহ্য করিয়াছিলেন; মহাত্মা সেণ্ট পল রোমনগরস্থ কারাগৃহে সিংহমখে নিক্ষিপ্ত হইবার জন্য নির্ভীক হৃদয়ে প্রতীক্ষা করিয়াছিলেন; বীরহৃদয় মাটিন লুথার পোপের ধর্ম্মমতের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করিয়াছিলেন; ধর্মবীর পার্কার মাকিন দেশে বিশুদ্ধ ধর্ম্মমত প্রচার করিতে এবং কাফ্রিদাসদিগের দাসত্বশৃঙ্খল মুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া মত্যুকে পর্যন্ত অগ্রাহ্য করিয়াছিলেন; চিরস্মরণীয় গ্যালিলিও আপনার বিচারকদিগের সম্মুখে রক্ত মাংসের দুর্ব্বলতাবশতঃ স্বীয় আবিষ্কৃত সতাকে অস্বীকার করিয়া আবার তৎক্ষণাৎ পৃথ্বীতলে পদাঘাত করিয়া বলিলেন, “ইহা এখনও চলিতেছে।” যে কর্ত্তব্যবুদ্ধিপ্রণোদিত হইয়া নানক পাঞ্জাবে একেশ্বরবাদ প্রচার করিতে গিয়া কোন প্রকার বাধাবিঘ্নে, ভ্রুক্ষেপ করেন নাই; শ্রীচৈতন্য শান্তিপুরে ইষ্টকবৃষ্টির মধ্য দিয়া হরিনাম কীর্ত্তন করিতে করিতে গমন করিয়াছিলেন; রাজা রামমোহন রায় প্রাণহানির সম্ভাবনা সত্ত্বেও অকুণ্ঠিতচিত্তে উদ্দেশ্যপথে অগ্রসর হইয়াছিলেন, সেই কর্ত্তব্যজ্ঞান প্রণোদিত হইয়া কর্ম্মবীর বিদ্যাসাগর কর্ত্তব্যকার্য্য সম্পাদনার্থ যে মন, প্রাণ, ধন, সর্ব্বস্ব উৎসর্গ করিবেন ইহাতে আর বিচিত্র কি? বিধবাবিবাহ ব্যাপারে তাঁহার অসাধারণ অধ্যবসায়, আত্মোৎসর্গ, অবিশ্রাত পরিশ্রম ও বিশাল করুণ হৃদয়ের জন্য মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা না করিয়া কেহই নিরস্ত থাকিতে পারেন না। বিধবাদিগের বিবাহ দিতে প্রচুর ব্যয়ে তিনি ঋণগ্রস্ত হইয়া পড়েন। প্যারিচরণ সরকার প্রমুখ কতিপয় দেশবিখ্যাত ব্যক্তি, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, বিদ্যাসাগরের অজ্ঞাতসারে, তাঁহার ঋণজাল মোচনের জন্য, চাঁদা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু বিদ্যাসাগর ইহা জানিতে পারিয়া বলিলেন, “আমার ঋণ আমিই পরিশোধ করিব, তাহার জন্য অন্য কাহাকেও দায়ী করিতে চাহি না।”

 এই বিধবাবিবাহ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে যে কত নির্য্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। তিনি সেই সকল নির্যাতন ধীর ভাবেই সহ্য করিয়াছিলেন। শিষ্টসমাজের বিরাগ বহন করা দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তির পক্ষে সেরুপ কঠিন নহে। কারণ, উহাদিগের ক্রোধও কখন বিবেক বা ব্যবহার মর্যাদা অতিক্রম করে না; এবং দেশকালপাত্র বিবেচনায়, অন্যের উপর রোষপ্রকাশ করিতেও ভীত হয়। কিন্তু যখন শিষ্টজনের এই ভীরু কোপানলে, ইতর লোকের রোষোচ্ছ্বাস আসিয়া সম্মিলিত হয়, যখন মূর্খ ও ইতরজনের ক্রোধবহ্নি উদ্দীপিত হয়, এবং সমাজতলস্থ অজ্ঞানান্ধ পশুপ্রকৃতি উত্তেজিত হইয়া ভীষণ গম্ভীরনাদ করিতে থাকে, তখন কেবল মহৎ ঔদার্য্য ও ধর্ম্মপ্রাণতাই, দেবতার ন্যায়, উহার প্রতি অব্যাকুল দষ্টিপাত করিতে সমর্থ হয়, এবং উহাকে নিতান্ত তুচ্ছ জ্ঞান করিতে পারে।