বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/সন্তানবাৎসল্য
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ॥ সন্তানবাৎসল্য
ভগবতী দেবীর ন্যায় উন্নতহৃদয়া, উদারপ্রকৃতি গুণবতী রমণী সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় না। এমন মা না হইলে কি বিদ্যাসাগরের ন্যায় পুত্র জন্মে? মাতার সেই উন্নত হৃদয়ভাব সম্পূর্ণরূপে বিদ্যাসাগরে সংক্রামিত হইয়াছিল। তাঁহার ন্যায় মাতৃভক্ত পুত্রও অতি বিরল। বৃদ্ধ বয়সেও মাতার নাম করিলে তাঁহার চক্ষুদ্বয় অশ্রুপূর্ণ হইত। কেহ তাঁহার নিকট ভিক্ষা করিতে আসিয়া যদি বলিত, ‘আমার মা নাই', তাহা হইলে অশ্রুধারায় তাঁহার বক্ষঃস্থল প্লাবিত হইত। ‘মা’ নাম শ্রবণ করিলে বিদ্যাসাগর মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় হইতেন। ‘মা' নামই যেন তাঁহার জীবনের সাধন মন্ত্র ছিল। তিনি সঙ্গীতবিদ্যা জানিতেন না। কিন্তু যে সঙ্গীতে ‘মা’ নাম আছে, সেই সঙ্গীত শ্রবণ করিতে তিনি অতিশয় ভাল বাসিতেন। ‘মা’ নামপূর্ণ সঙ্গীত শ্রবণে তাঁহার ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ের ভক্তিরস উদ্বেল হইয়া উঠিত। গণ্ডস্থল বহিয়া প্রবলবেগে অশ্রুধারা নিপতিত হইত। এই মাতাপিতৃভক্ত ঈশ্বরচন্দ্রই একদিন কাশীধামের ব্রাহ্মণদিগকে মাতাপিতার উদ্দেশে বলিয়াছিলেন, ‘তোমাদের বিশ্বেশ্বর, অন্নপূর্ণা কি তাহা আমি জানি না। আমার বিশ্বেশ্বর এই−আর আমার অন্নপূর্ণা এই।” বিদ্যাসাগর আজীবন প্রত্যুষে শয্যা,ত্যাগ করিয়া মাতাপিতার প্রতিকৃতি প্রণাম না করিয়া গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত, হইতেন না।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ের তৃতীয় ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিবাহ উপলক্ষ্যে বাটী যাইবার জন্য তাঁহার প্রতি জননীর সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ ছিল। সেই সময়ে তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে কর্ম্ম করিতেন। মাতৃ-আজ্ঞা পালন করবার জন্য তিনি উপরিতন কর্ম্মচারী মার্সেল সাহেবের নিকট ছুটির প্রার্থনা করিলেন। কিন্তু ছুটি পাইলেন না। ছুটি না পাইলে, মাতার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা হইবে; এই দুঃখে মাতৃভক্ত বিদ্যাসাগর কিছুক্ষণ নীরবে রোদন করিলেন। পরে মাতার আজ্ঞা পালন করা কর্ত্তব্য স্থির করিয়া, পদত্যাগপত্র হস্তে সাহেবের নিকট উপস্থিত হইলেন। সাহেব তদ্দর্শনে বিস্মিত হইয়া ছুটি দিতে আর দ্বিরুক্তি করিলেন না। দুটি পাইয়া তদ্দণ্ডেই ভৃত্য সমভিব্যাহারে বিদ্যাসাগর গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন। এদিকে ঘোর বর্ষাকাল। আকাশ ঘন ঘটায় আচ্ছন্ন, সম্মুখে উচ্ছলিত ভয়াবহ দামোদর নদ, পারের কোন উপায় নাই। কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মাতৃভক্ত ঈশ্বরচন্দ্র, জননীর চরণ স্মরণ করিয়া সেই প্রবল স্রোতোমালাবিশিষ্ট ভয়াবহ দামোদর নদ সন্তরণপূর্ব্বক পার হইলেন। পথে তাঁহাকে দারুকেশ্বর নদও এইরপে উত্তীর্ণ হইতে হইয়াছিল। এবং আর্দ্র বস্ত্রে দৌড়িতে দৌড়িতে বাটী গিয়া উপস্তি হইলেন। দেখিলেন, ভ্রাতা বিবাহ করিতে গিয়াছেন; তিনি বাটী যান নাই বলিয়া মাতৃদেবী গৃহদ্বার রুদ্ধ করিয়া ক্রন্দন করিতেছেন। গৃহপ্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান হইয়া উচ্চৈঃস্বরে ‘মা’ ‘মা’ বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। পুত্রবৎসলা জননী তাঁহার কণ্ঠস্বর শ্রবণমাত্র শশব্যস্ত হইয়া বাহিরে আসিলেন। মাতা ও পুত্র উভয়ে উভয়কে তদবস্থ দেখিয়া এক সঙ্গে রোদন করিতে লাগিলেন। সে রোদনের আর নিবৃত্তি নাই! কি অপূর্ব্ব স্বর্গীয় দৃশ্য! কি অপূর্ব্ব সম্মিলন!
বহুতর বিদেশীয় মাতৃভক্ত মহাপুরুষের কথা শুনা যায়, কিন্তু তাঁহাদের সহিত মাতৃভক্ত বীর বিদ্যাসাগরের তুলনা সম্ভবে কি? ইতিহাসে উল্লেখ আছে, রোমের প্রসিদ্ধ সেনাপতি এবং সম্রাট জুলিয়াস্ সীজর যখন ইংলণ্ড বিজয়মানসে সাগর পার হইবার জন্য অর্ণবপোতে সসৈন্যে আরোহণ করেন, তখন ভয়ানক ঝড় বৃষ্টি উপস্থিত হইয়াছিল। প্রবল বাত্যাবিক্ষোভিত সিন্ধুর প্রলয় মূর্ত্তি দর্শনে নাবিকগণ ভীত হইলে, সীজর সদর্পে বলিয়াছিলেন, “ভয় নাই, এ তরি সীজরের সৌভাগ্য বহন করিতেছে।” পাঠকগণ! স্থিরচিত্তে প্রনিধান করুন এই দুই বীরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে? একপক্ষে ভাবী বিজয়দপ্ত হৃদয়ের দুঃসাহসিকতা,—অপর পক্ষে মাতৃভক্ত বীরের মাতৃপূজার জন্য আত্মবলিদান! কোন্ বীর পুজার যোগ্য? কোন্ বীর প্রশংসনীয়? কোন বীর প্রাতঃস্মরণীয়?
পাঠকগণ! ধর্ম্মজগতে এইরুপ ব্যাপারই একদিন সংঘটিত হইয়াছিল বটে। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ ভূভারহরণজন্য হরিবিদ্বেষী দুর্ব্বৃত্ত কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করিলে, পিতা বসুদেব যখন পাপাত্মার হস্ত হইতে সন্তানকে রক্ষা করিবার জন্য সেই সদ্যোজাত শিশুকে বক্ষে ধারণ করিয়া পলায়ন সময়ে কালিন্দী তটে আসিয়া উপস্থিত হন, তখন তাঁহারও এই অবস্থা! চতুর্দিক ঘন ঘটায় আচ্ছন্ন-মুহমুর্হু মেঘগর্জ্জন-মুষলধারে বারিবর্ষণ—কালিন্দীর প্রবল জলোচ্ছ্বাস! পত্রবৎসল পিতা পরপারে উত্তীণ হইবার মানসে কালিন্দীর প্রবল জলস্রোতে বাহ্যজ্ঞানশুন্য হইয়া ঝাঁপ দিলেন। প্রেমভক্তির পরীক্ষার শেষ হইল! বসুদেব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন। আধ্যাত্মিক জগতে উভয় ব্যাপারই একরপ! একপক্ষে প্রেমের পরীক্ষা!—অপর পক্ষে ভক্তির পরীক্ষা! কিন্তু ভক্তি, প্রেম, প্রণয়, স্নেহাদি সকলই সেই এক অনুরাগ মহোদধিরই ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গ মাত্র! সেইজন্য মনে হয়, ইহা দামোদরের জলোচ্ছ্বাস নহে!—ইহা প্রেমভক্তির কঠোর পরীক্ষা! মাতৃভক্ত বীর বিদ্যাসাগর কঠোর পরীক্ষায় উত্তীণ হইবার জন্য বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া মাতৃপদ স্মরণ করিতে করিতে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে যখন ঝাঁপ দিলেন, তখনই মাতৃরূপিণী আদ্যাশক্তি তাঁহাকে বক্ষে করিয়া পরপারে উত্তীর্ণ হইলেন। ভক্ত জীবনের পরীক্ষাই এইরপ! সষ্টির বিনাশ আছে—কিন্তু ভক্তের বিনাশ নাই! ভক্তের রক্ষার জন্য ভগবানের সুকোমল পবিত্র হস্ত সর্ব্বস্থানে সতত প্রসারিত! ভক্ত,—অক্ষয় অব্যয়-অবিনবর!
পাঠকগণ! একবার হৃদয়ে উপদ্ধি করুন, স্নেহ ভক্তির কিরূপ সন্নিপাতে, কিরূপ বিনিময়ে এরূপ মাতৃভক্ত বীর সন্তানের সষ্টি হইতে পারে! ধন্য সন্তানবাৎসল্য! ভগবতী দেবী, তোমার সমস্তই বিচিত্র! তোমার তুলনা একমাত্র তোমাতেই সম্ভবে!