বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/সময়ের সদ্ব্যবহার

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ॥ সময়ের সদ্ব্যবহার

 একজন ইউরোপীয় প্রসিদ্ধ পণ্ডিত বলিয়াছেন, “লোকে সময়ের অভাব বলিয়া আক্ষেপ করিয়া থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহাদের কার্য্যের তুলনায় এত অধিক সময় রহিয়াছে যে, তাহার ব্যবহার সম্বন্ধে তাহারা নিতান্ত অনভিজ্ঞ। তাহারা হয় নিতান্ত অলসভাবে সময় নষ্ট করে, না হয় নিতান্ত উদ্দ্যেশ্যবিহীন কার্য্যে সময় অতিবাহিত করিয়া থাকে। লোকে আপনাদিগের জীবিত কাল অতি সঙ্কীর্ণ বলিয়া সাতিশয় ক্ষোভ প্রকাশ করে বটে, কিন্তু কার্য্যক্ষেত্রে তাহারা সময়ের প্রতি এতদূর অবজ্ঞা ও অনাদর প্রকাশ করিয়া থাকে, যেন বোধ হয়, তাহাদের জীবিতকাল: অনন্ত ও নিত্যস্থায়ী।”

 দীর্ঘ জীবনাকাঙ্ক্ষা মানবজাতির সাধারণ ধর্ম্ম। সকলেই দীর্ঘ জীবনের জন্য নিরতিশয় আগ্রহ প্রকাশ করিয়া থাকে বটে, কিন্তু সময়ের যে সকল অংশের সমষ্টি দ্বারা জীবিতকাল পূর্ণ হয়, তৎসমুদয় ইহার অতিশয় অবহেলার সহিত নষ্ট করিয়া ফেলে। পল, দণ্ড, প্রহর প্রভৃতি সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগলি একত্র হইয়া দিন, মাস, বর্ষ, যুগ প্রভৃতি হয়, এবং এই দিন, মাস প্রভৃতির সমষ্টিই মনুষ্যের জীবিতকাল বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। যাহারা পল, দণ্ড, প্রহর প্রভৃতির অপব্যয় করে, তাহারা ক্রমে বর্ষ,যুগ প্রভৃতিরও অপব্যয়ের কারণ হয়, অথাৎ তাহারা আপনাদিগের অমূল্য জীবন বৃথাই নষ্ট করে।

 পথিক যেমন দেশপর্যটনকালে, বিশ্রামস্থান বা পান্থনিবাস পাইবার আশায়, জনপ্রাণিশন্য প্রান্তর দ্রুতবেগে অতিক্রম করিয়া যায়, মানবগণ সেইরপ সখ বা লাভের কামনায়, সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ এবং পরিশেষে বর্ষ পর্যন্ত অবলীলাক্রমে বৃথা যাপন করে। জীবৎকালের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলি নষ্ট করিয়া দীর্ঘ জীবন কামনা করা এবং সময় হারাইয়া কার্য্যের অনুষ্ঠান করা, উভয়ই তুল্যরপ নির্বুদ্ধিতা ও অপরিণামদর্শিতার কার্য্য।

 এই বিশ্বসংসারে মানবজাতির যত প্রকার কর্তব্য কার্য্য আছে, তন্মধ্যে নিঃস্বার্থ পরোপকাররুপ পুণ্যকার্য্যই সর্বশ্রেষ্ঠ। মানবসমাজে এতাদৃশ পুণ্যব্রতের কিছুমাত্র অভাব নাই। অজ্ঞানকে জ্ঞানদান, দরিদ্রের অভাববিমোচন, বিপন্নের বিপদধার, শোকার্ত্তের শোকাপনোদন, রগ্নের শুশ্রষা ইত্যাদি পবিত্র কর্ম ভগবতী দেবীর জীবনে নিত্যই সংঘটিত হইত। পরস্পরবিরুদ্ধ পক্ষের বিবাদভঞ্জনপূর্ব্বক তাহাদিগের মধ্যে সৌহার্দ্যস্থাপন, চরিত্রবান লোকের প্রতি শ্রধাপ্রদর্শন, মাৎসর্য্যশালীর বিষেষভাব সংযমনের চেষ্টা, কোপন ব্যক্তির ক্রোধোপশমন, এবং কুসংস্কারাপন্ন লোকের মতসংশোধন ইত্যাদি নানাবিধ সৎকার্য্যে সময়ক্ষেপ করিয়া মনে মনে অপরিসীম আনন্দ উপভোগ করিবার সুবিধা তাঁহার জীবনে প্রায় সর্ব্বদাই উপস্থিত এই সমস্ত সামাজিক পুুণ্যকার্ষ্যের অনুষ্ঠানে যিনি কালযাপন করেন তাঁহার সময় কি কখন অলসভাবে অতিবাহিত হইতে পারে?

 ভগবতী দেবী অতি প্রত্যুষে শয্যা পরিত্যাগ করিয়া সাংসারিক কার্ষ্যে মনোনিবেশ করিতেন। এবং কোন না কোন পারিবারিক সদনুষ্ঠানে দিবাভাগ অতিবাহিত হইত। তিনি স্বহস্তে রন্ধন করিতেন এবং সকলকে সমভাবে পরিবেশন করিতেন। অতিথি, কুটম্ব, আত্মীয় স্বজনের পরিচর্য্যা তাঁহার নিত্য নৈমিত্তিক কার্য্য ছিল। রজনীর দেড় ঘটিকা পর্য্যন্ত তিনি বিবিধ গার্হস্থ্য ধর্ম্মানুষ্ঠানেই ক্ষেপণ করিতেন। অতঃপর আরও দুই ঘণ্টা একাকিনী বসিয়া চরকায় সুতা কাটিতেন। সুতরাং দিবাযামিনীর মধ্যে তিন ঘণ্টা মাত্র নিদ্রার সুকোমল ক্রোড়ে বিশ্রামসুখ লাভ করিতেন।

 সময়ের সদ্ব্যবহারার্থে অন্যবিধ ধর্ম্মকর্ম্ম মানবজীবনে অনুষ্ঠিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। যখন আমরা সংসারের কোলাহল হইতে দূরে অবস্থান করি, বৈষয়িক কর্ম্মক্ষেত্র হইতে ক্ষণকালের জন্য অবসরগ্রহণ করি, যখন একাকী নির্জ্জন স্থানে উপবেশন করি, তখন সেই পরম দেবতা, বিশ্ববিধাতা, অনাদি পুরুষের উপাসনায় নিযুক্ত হওয়া আমাদিগের অবশ্যকর্ত্তব্য। স্রষ্টার আরাধনায় ক্ষণকাল ব্যাপৃত থাকা প্রত্যেক মানুষেরই একটি গুরুতর কর্ত্তব্য কর্ম্ম। তাঁহার অর্চ্চনা ব্যতীত সংসারের তাড়নায় ছিন্ন ভিন্ন ও দলিত হৃদয়কে প্রকৃতিস্থ করিতে অভিলাষ করা বিড়ম্বনা মাত্র। যিনি মঙ্গলময় বিশ্বপিতার চরণপ্রান্তে উপনীত হইয়া, তৎসকাশে হৃদয়ের প্রার্থনা জ্ঞাপন করিতে পারেন, তিনি মনে মনে অনির্ব্বচনীয় আনন্দ উপভোগ করিয়া থাকেন। যখন তিনি ঈশ্বরোপাসনায় নিযুক্ত হন, তখন তাঁহার আত্মা ভগবদ্ভক্তিতে পরিপূর্ণ হয়, হৃদয়ে আশার সঞ্চার হয় এবং যে মহতী শক্তি তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে, তাহার বিদ্যমাতার সম্যক উপলদ্ধি হয়। তিনি সকল ভয়, ভাবনা, শোক, দুঃখকেই রক্ষাকর্ত্তার চরণে সমর্পণ করিয়া স্বয়ং নির্ব্বিঘ্নে ও সুখশান্তিতে কালাতিপাত করিতে থাকেন। এই দুস্তর জীবনসমুদ্রের প্রভঞ্জনোত্থিত ফেনিল তরঙ্গের ঘাত প্রতিঘাত কেবল গভীরতাবিহীন অসার সংসারেই দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু যাঁহারা মৌক্তিকপ্রসূ শুক্তির ন্যায় তাহার তলদেশে বসিয়া স্বীয় হৃদয়োপরি পরম রমণীয় দুর্লভ মুক্তার নির্ম্মাণে সচেষ্ট, তাঁহাদিগকে সেই উর্ম্মিমালার ভীম প্রকম্পন স্পর্শও করিতে পারে না। গভীরতা, হৃদয়ের পূর্ণতা সমাজের ঘূর্ণাবর্ত্তে সম্পাদিত হওয়া অসম্ভব; তজ্জন্য নিস্তব্ধ শান্তি-আবাসে ধীর চিন্তাপ্রবাহের প্রয়োজন।

 ভগবতী দেবী দিবাভাগের কিয়দংশ এবং সন্ধ্যার সময় নিষ্ঠাবান্, হিন্দুর গৃহস্থোচিত পূজা, সন্ধ্যা বন্দনাদিতে অতিবাহিত করিতেন। যখন তিনি সেবাধর্ম্মানুষ্ঠানে নিরত থাকিতেন, তখন তাঁহাকে দেখিলে মনে হইত, তিনি যেন আর ইহজগতের জীব নহেন। এই সময়ে তিনি একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হইয়া যাইতেন। এবং যেন ভগবৎসেবা করিতেছেন এই ভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া তিনি জীবসেবা করিতেন। এই সকল বিষয় পর্য্যালোচনা করিলে আমাদের মনে হয়, দিবাযামিনীর অধিকাংশ সময় তিনি নির্জ্জনবাসজনিত শান্তি উপভোগ করিতে পারিতেন। তিনি এইরূপে সময়ের সদ্ব্যবহার করিয়াছিলেন বলিয়াই, অদ্যাপি বীরসিংহ ও তন্নিকটবন্তী গ্রামসমূহের অধিবাসিদের নিকট তাঁহার নামোচ্চারণ করিবামাত্র, তাঁহারা অশ্রুবিসর্জ্জন করিতে করিতে আবেগময়ী ভাষায় তাঁহার অশেষ গুণনকীর্ত্তন করিয়া থাকেন। তিনি মরিয়াও অমরত্ব লাভ করিয়াছেন।