বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী/সরলতা ও পবিত্রতা

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ॥ সরলতা ও পবিত্রতা

যেখানে সরলতা সেইখানেই পবিত্রতা বিরাজ করে। কুটিলতা ও স্বার্থপরতা সরল ব্যক্তির হৃদয়কে কখন কলঙ্কিত করিতে পারে না। আলোকে ও অন্ধকারে ষেরূপ প্রভেদ, সরলতা এবং কপটতায় সেইরূপ প্রভেদ। চন্দ্রের বিমল আলোকের ন্যায় সরলতা মানবচরিত্রকে উজ্জ্বল করিয়া রাখে। সরলতার সহিত সত্যের অতি নিকট সম্বন্ধ। বাস্তবিক সরলতা সত্যের ভিত্তিরূপ। মুসলমান ধর্ম্মের প্রবর্ত্তক মহম্মদ যখন বিশ্বাস করিলেন, ঈশ্বর এক এবং নিরাকার, তখন কার্যেও সেই মত প্রচার করিতে লাগিলেন, ইহাতে চতুর্দ্দিক হইতে শত্রুগণ তাঁহার প্রাণনাশ করিতে উদ্যত হইলে, মহম্মদের পিতৃব্য আবুতালাক এই চক্রান্তের বিষয় অবগত হইয়া, একদিন মহম্মদকে বলিলেন, “মহম্মদ, আমি তোমাকে সন্তানতুল্য স্নেহ করিয়া থাকি। কেহ যে তোমার মস্তকের এক গাছি কেশ উৎপাটন করে, ইহা আমার অভিপ্রেত নহে। অতএব বৎস! ক্ষান্ত হও, এখন হইতে তোমার হৃদয়ের বিশ্বাস গোপন করিয়া লোকের মনের মত কার্য্য কর।”

 আবুতালাকের এই কথা শ্রবণ করিয়া, মহম্মদ অতি বিনীতভাবে বলিলেন, “আপনি স্নেহের বশীভূত হইয়া যাহা আদেশ করিতেছেন, তাহা সম্পূর্ণ কপটতা। বিশ্বাসকে বলিদান দিয়া, আমি কখনই কপটতাচরণ করিতে পারিব না। যদি কেহ আমার এক হস্তে সূর্য্য ও অপর হতে চন্দ্র প্রদান করিতে পারে, তথাপি আমার বিশ্বাস বিনষ্ট করিতে পারিব না। অন্তরের বিশ্বাসমত কার্য্য করিব, ইহাতে জীবন যায়, তজ্জন্য কিছুমাত্র দুঃখিত হইব না।”

 এক সময়ে খৃষ্টধর্ম্মসংস্কারক লুথারকে তাঁহার বন্ধুরা বলিয়াছিলেন, ‘লুথার! সাবধান হও, দেশমধ্যে অধিকাংশ লোকেই তোমার শত্রু; অতএব, যদি বাঁচিতে সাধ থাকে, তবে ধর্মসংস্কার ত্যাগ করিয়া, স্বীয় জীবন রক্ষা কর।” এই কথা শ্রবণ করিয়া লুথার গভীরভাবে উত্তর করিলেন, “যাহা আমার হৃদয়ের দৃঢ় বিশ্বাস, আমি সরল মনে তাহাই প্রচার করিতেছি। আমি আমার কর্ত্তব্যপথে বিচরণ করিতেছি, ইহাতে যদি এই মহানগরের যাবতীয় ইষ্টকরাশি আমার মস্তকে বর্ষিত হয়, তাহাতেও আমি কর্ত্তব্যকর্ম্ম হইতে বিমুখ হইব না। আমার অদৃষ্টে যাহাই ঘটুক না কেন, আমি সরলতা-ক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া কণ্টকাকীর্ণ কপটতাপথে পদার্পণ করিব না।”

 ফলতঃ সরলতা ও পবিত্রতা সাধু হৃদয়ের অলঙ্কার। যাঁহার চরিত্র পবিত্র ও নিষ্কলঙ্ক, তাঁহার অতর বিমল চন্দ্রকিরণের ন্যায় সস্নিগ্ধ ও আনন্দপূর্ণ। সুর্য্য যেমন পথিবীর অন্ধকার দূরীভূত করিয়া চতুর্দ্দিক দিব্যালোকে আলোকিত করে, সরল ও পবিত্রহৃদয় সাধ, মহাপুরুষগণও সেইরপ পথিবীর পাপাচার বিনাশ করিয়া ধর্মের বিমল ও পবিত্র জ্যোতিতে বসুন্ধরাকে উদ্ভাসিত করেন। সরল হৃদয় মহাজন জগতের বিশ্বাস, ভক্তি ও সম্মানের পাত্র।

 ভগবতী দেবী সরলতা ও পবিত্রতাগণে ঐ প্রদেশের সকলেরই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান লাভ করিয়াছিলেন। তিনি মনের বিশ্বাস মত কার্য করিতেন। অন্তঃকরণের ভাব গোপন করিয়া কোনরুপ অন্যায় আচরণ করা তাঁহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। ফলতঃ তিনি প্রান্তেও অন্তরে এক প্রকার এবং কার্যে অন্যপ্রকার ব্যবহার করিয়া লোকের নিকট ঘৃণিত হইতেন না। অথবা অন্যের মনতুষ্টির জন্য ভীত হইয়া, বিশ্বাসের বিপরীত কার্য্য করিয়া কপটতাচরণ করিতেন না। যাহা সত্য বলিয়া হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেন, প্রাণাতেও কার্যকালে তাহার অন্যথাচরণ করিতেন না। তিনি প্রায়ই বলিতেন, ‘সংসারের পথ অতি সরল, লোকে বুদ্ধির দোষে ইহাকে কুটিল করিয়া ফেলে। তুমি যাহা ফলভোগ কর, তাহার জন্য তুমিই দায়ী। তুমি দিবারাত্রি নিজে তোমার যত অনিষ্ট সাধন কর, আর কাহারও নিকট কখনও তত অনিষ্টের আশঙ্কা করিও না।” আমরা এস্থলে ভগবতী দেবীর সরলতা, পবিত্রতা ও সাধুতা গুণের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ করিয়া এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি করিব।

 বীরসিংহ গ্রামে বামুণী পুষ্করিণী নামে এক জলাশয় আছে। একদিন ভগবতী দেবী তথায় স্নান করিতেছেন, এমন সকয়ে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ স্নানার্থ সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ব্রাহ্মণের হস্তে একটি পুটিকা ছিল। ব্রাহ্মণ সেই পুটিকা হইতে একখানি শুষ্ক বস্ত্র বাহির করিয়া পুটিকাটি পুষ্করিণীর ধারে একটি ঝোপের মধ্যে রাখিয়া স্নানার্থে পুষ্করিণীতে অবতরণ করিলেন। স্নানার্থে ব্রাহ্মণ শুষ্ক বস্ত্র পরিধান ও গামছা দ্বারা মস্তক আবৃত করিয়া সধ্যাহ্নিক করিতে করিতে দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন। তিনি পূটিকার কথা একেবারে বিস্মৃত হইয়া গিয়াছিলেন। ভগবতী দেবী স্নানান্তে উপরে উঠিলে, ঘটনাক্রমে পুটিকার দিকে তাঁহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। ভগবতী দেবী মনে করিলেন, ঐ ব্রাহ্মণ নিশ্চয়ই ভ্রমক্রমে ইহা রাখিয়া গিয়াছেন। তিনি পুটিকা খুলিয়া দেখিলেন, কয়েকখানি নতন বস্ত্র, কর্ণের দুইখানি স্বর্ণালঙ্কার ও চল্লিশটি মুদ্রা রহিয়াছে। ভগবতী দেবী মহাবিপদে পড়িলেন। তিনি সমস্ত দিন সেই পুটিকাটি রক্ষা করিয়া সেইখানে বসিয়া রহিলেন। সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পুবে ব্রাহ্মণ ক্রন্দন করিতে করিতে শশব্যস্তে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ভগবতী দেবীকে দেখিয়া বলিলেন, “মা আমার সর্বনাশ হইয়াছে! আমি কন্যাদায়গ্রস্ত। রাত্রি প্রভাতে কন্যার বিবাহ। আমি মধ্যাহ্নে এই পরিণীতে স্নান করিতে আসিয়াছিলাম। আমার নিকট একটি পুটিকা ছিল। ভিক্ষা করিয়া যাহা কিছু সংগ্রহ করিয়াছিলাম, তাহা ঐ পুটিকাভ্যন্তরেই ছিল। মা, এখন আমার উপায় কি?” ভগবতী দেবী ব্রাহ্মণকে প্রবোধ দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “পুটিকাতে আপনার কি কি দ্রব্য ছিল?” ব্রাহ্মণ সত্য কথা বলিলেন।

 ভগবতী দেবী বলিলেন, ‘আপনি যে কন্যাদায়গ্রস্ত তাহা আমি পুবেই জানিতে পারিয়াছি। কারণ, তাহা না হইলে আপনার এতদূর চিত্তভ্রম ঘটিবে কেন?” তৎপরে পুটিকাটি ব্রাহ্মণের হস্তে দিয়া বলিলেন, “দেখুন আপনার সমস্ত দ্রব্য আছে কি না? আমি তদবধি এই পুটিকা রক্ষা করিয়া এইখানেই বসিয়া আছি। যাহা হউক আপনি আমাকে নিশ্চিত করিলেন। ব্রাহ্মণ আনন্দাশ্র; ত্যাগ করিতে করিতে বলিলেন, “মা, তুমি আমার জাত কুল রক্ষা করিলে। মা, আমি এখনও জল গ্রহণ করি নাই। আমি অভীষ্ট দেবতার নিকট প্রার্থনা করিতেছি, তুমি যেন ধনে বংশে শ্রীবৃদ্ধি লাভ কর।’ ব্রাহ্মণ তখনও পর্যন্ত জলগ্রহণ করেন নাই শুনিয়া ভগবতী দেবী পরম সমাদরে তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া গৃহে আনিলেন। পরে ব্রাহ্মণের পরিচর্যা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার যে অর্থ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহাতে আপনি কন্যাদায় হইতে কি মুক্তিলাভ করিতে পারিবেন?” ব্রাহ্মণ উত্তর করিলেন, “না মা, আরও ১০|২০ টাকা প্রয়োজন।” তখন ভগবতী দেবী বিংশতি মুদ্রা ব্রাহ্মণের হস্তে দিয়া বলিলেন, “গরীব ব্রাহ্মণের মেয়ের এই কয়টি মুদ্রা দয়া করিয়া গ্রহণ করিবেন।” ব্রাহ্মণ বিস্মিত হইয়া অশ্রুপূর্ণলোচনে গদগদ ঘরে বলিতে লাগিলেন, “মা, তুমি দেবী, না মানবী! আমার ভ্রমই যে আমার পক্ষে পরম মঙ্গলজনক হইল। কারণ, আজ সাক্ষাৎ দেবীমুর্ত্তির দর্শন লাভ আমার ভাগ্যে ঘটিল।” এই কথা বলিয়া ব্রাহ্মণ তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।