এগার

 সুভাষচন্দ্রের মুক্তিতে সমগ্র দেশ আনন্দ-চঞ্চল হইয়া উঠে। মুক্তিলাভের পর রোগশয্যা হইতে সুভাষচন্দ্র দেশবাসীর নিকট বাণী প্রদান প্রসঙ্গে বলেন, “এখন আমি প্রত্যাবর্ত্তন করিয়াছি। যাহাতে আমি শীঘ্র কার্য্য আরম্ভ করিতে পারি তজ্জন্য এখন আমার প্রধান ও প্রথম কর্ত্তব্য হইবে পূর্ব্বস্বাস্থ্য লাভের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা... ..আমি আশা করি, আমি দ্রুত নিরাময় হইয়া উঠি আমার দেশবাসী ইহাই কামনা করিবেন। কারণ তাহা হইলে আমি সকল অভীষ্টকার্য্যে পুনরায় মন-প্রাণ নিয়োগ করিতে পারিব।” তাঁহার মুক্তিতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান হইতে যে সমস্ত আনন্দ-সূচক পত্র আসিতে থাকে তদুত্তরে সংবাদ পত্রের মারফৎ তিনি বলেন, “সম্মুখে কিছুকাল বিশ্রাম ও অবসরের যে সময় রহিয়াছে সে সময় আমি অহর্নিশি ভগবানের চরণে এই প্রার্থনাই করিব যে, দেশবাসী আমার প্রতি যে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালবাসা অর্পণ করিয়াছেন, আমি যেন কিয়দংশেও তাহার যোগ্য হইতে পারি। এখন আমার প্রধান কাজ হইবে, আমাদের সম্মুখে যে সমস্যা রহিয়াছে, তাহার সমাধান কল্পে আমি যেন নিভৃতে প্রস্তুত হইতে পারি।”

 “চতুর্দ্দিকেই নবজাগরণের চিহ্ন দেখা যাইতেছে। পূজনীয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের আকস্মিক মহাপ্রয়াণের পর যে ঘনান্ধকার আমাদিগকে আবৃত করিয়াছিল, তাহা ক্রমশঃ অপসারিত হইতেছে—যাহা এখনও আছে, তাহার মধ্যেও নবপ্রভাতের নবীন সূর্য্যের তরুণ আভা দেখা যাইতেছে।”

 “সময় নিকট হইলে, কর্ম্মের আহ্বান আসিলে যেন আমরা সকলেই একাগ্রচিত্তে পুনরায় কার্য্য আরম্ভ করিতে পারি—আজ ইহাই আমার একান্ত প্রার্থনা।” কিন্তু বিশ্রাম গ্রহণ তাঁহার স্বাস্থ্যের দিক হইতে অবশ্য কর্ত্তব্য হইলেও বিশ্রাম গ্রহণ আর হইয়া উঠিল না। অন্তরে যাঁহার কর্ম্মোন্মাদনা, দেশের ডাক যাঁহার কানে পৌঁছিয়াছে, সে কি ঘরে বসিয়া বিশ্রাম করিতে পারে? পাটনায় এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দেশের বর্ত্তমান অবস্থায় আমাদের অসুস্থ থাকা সাজে না।” তিনি পুনরায় কর্ম্মসাগরে ঝাঁপ দিলেন।

 দেশবন্ধুর পরলোকগমনে বাঙ্‌লার রাজনীতির তরণী কর্ণধারবিহীন হইয়া পড়ে। দেশবন্ধুর শূন্য আসন পূর্ণ করিবার মত নেতা একমাত্র সুভাষচন্দ্রই। সুতরাং বাঙ্‌লাদেশবাসী তাঁহাকেই প্রাদেশিক কংগ্রসের সভাপতিপদে বরণ করিলেন। সেই হইতে সুভাষচন্দ্রের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাজনৈতিক জীবন আরম্ভ হয়। মুক্তির ছয়মাসের মধ্যেই মাদ্রাজে ডাঃ আনসারীর সভাপতিত্বে নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রসের অধিবেশন হয়। সেখানে বাঙ্‌লার প্রতিনিধি দল দেশবন্ধুর যোগ্য উত্তরাধিকারীর নেতৃত্বে উপস্থিত হন। মাদ্রাজ অধিবেশনে পণ্ডিত জওহরলালের সহিত সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারী পদে নির্ব্বাচিত হন।

 ১৯২৮ সাল কংগ্রেস আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরনীয় হইয়া আছে। এই বৎসর কংগ্রেসের অভ্যন্তরে তরুণ ও প্রবীনদলের মধ্যে বিশেষ বিরোধ উপস্থিত হয়। পণ্ডিত মতিলাল নেহরুকে সভাপতি করিয়া “নেহরু কমিটি” গঠিত হইল। এই কমিটি এক বৎসরের মধ্যে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসন দাবী করিলেন। তরুণ দল পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষপাতী। তাঁহারা ‘নেহরু কমিটির’ সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হইতে পারিলেন না। পণ্ডিত জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র এই তরুণ দলের অবিসম্বাদী নেতা। এই পর্য্যন্ত কংগ্রেসের মধ্যে এই দুইজন নেতা—বিশেষ করিয়া সুভাষচন্দ্রই—অগ্রগামী চিন্তা ও কর্মপন্থা প্রবর্ত্তনের জন্য সংগ্রাম করিয়া আসিতেছেন।

 এই বৎসরই স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে বিলাতের “সাইমন কমিশন” ভারত পরিদর্শনে আসেন। এই “সাইমন কমিশন” বিলাতের কয়েকজন ইংরেজ সদস্য লইয়া গঠিত হয়। একজন ভারতীয়কেও এই কমিশনে গ্রহণ করা হয় নাই। ইহাতে ভারতের সর্ব্বত্র তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হইল। ১৯২৭ সালের মাদ্রাজ কংগ্রেসেই “সাইমন কমিশন” নিয়োগে গভর্ণমেণ্টের কার্য্যের তীব্র নিন্দা করিয়া গৃহীত এক প্রস্তাবে ঘোষণা করা হয়— “This congress resolve that the only self-respecting course for India to adopt is to boycott the Commission at every stage and in every form.” ৩রা ফেব্রুয়ারী “সাইমন কমিশন” বোম্বায়ে পদার্পণ করেন। ঐ দিন সমগ্র ভারতে “সাইমন ফিরিয়া যাও” বলিয়া তীব্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় ও সর্ব্বত্র হরতাল প্রতিপালিত হয়। মাদ্রাজ, কলিকাতা, লাহোর, লক্ষ্মৌ প্রভৃতি স্থানে বিক্ষোভকারীদের উপর লাঠি চার্জ্জ ও গুলীচালনা হয়। অবশেষে ৩১শে মার্চ্চ “সাইমন কমিশন” বোম্বাই পরিত্যাগ করেন। বাঙ্‌লাদেশে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে বয়কট আন্দোলন সাফল্যের সহিত পরিচালিত হয়।

 এই উপলক্ষে দেশের সর্ব্বত্র বিরাট উদ্দীপনা ও সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হয়। এই বৎসর মে মাসে পূণাতে মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে সভাপতিত্ব করিতে গিয়া সুভাষচন্দ্র দেশের যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে অভূতপূর্ব্ব উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কর্ম্মচাঞ্চল্য প্রত্যক্ষ করেন। এই সম্মেলনে তিনি যুবসম্প্রদায় ও কংগ্রেসকর্ম্মীদিগকে কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করিবার নির্দ্দেশ দেন; ব্যাপক ছাত্রআন্দোলনের জন্য তিনি ছাত্রসমাজকে, স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিবার পরামর্শ দেন। কৃষক-শ্রমিক-যুবক-তরুণ দলকে নিয়া ব্যাপক গণআন্দোলনের এই নবতর কর্মপন্থা প্রচারেই তিনি এই সময়ে বিশেষ ভাবে নিযুক্ত থাকেন। বিখ্যাত মার্কিণ সংবাদিক ডরথি টমসন তাঁহার হিটলার সম্বন্ধীয় এক প্রবন্ধের একস্থানে লিখিয়াছেন, ‘হিটলারকে কারাগারে বন্দী করিয়া রাখাই এক মারাত্মক ভুল হইযাছে, কারণ এই কারাগৃহেই তিনি জার্মেনীর জন্য লেবেনসরম (Lebensaraum) বা পর্য্যাপ্তবাসভূমি দাবী করার বিষয় চিন্তা করেন এবং উত্তরকালে জার্মানদের উপযুক্ত বাসস্থানের জন্যই হিট্‌লার সমগ্র বিশ্বকে জার্মেনীর করতলগত করিতে চাহিয়াছিলেন।’ নাৎসীনায়ক হিটলারের সহিত সুভাষচন্দ্রের তুলনা না করিয়াও বলা চলে যে সুভাষচন্দ্রকে মান্দালয়ে বন্দী করিয়া কর্ত্তৃপক্ষ মহাভুলই করিয়াছিলেন। কেননা এই মান্দালয় কারাগৃহে বসিয়াই তিনি দেশের যুবক, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের কথা ভাবিতে আরম্ভ করেন এবং কংগ্রেসের অভ্যন্তরে যুবক শ্রমিক ও কৃষকদের সংঘবদ্ধ করিয়া একটি সংগ্রামশীল ‘বামপক্ষ’ গঠনের সঙ্কল্প করেন। মান্দালয় জেলে উদ্ভাবিত এই কর্মপন্থাই তিনি মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক রাষ্টীয় সম্মেলনে দেশবাসীর নিকট ঘোষণা করেন।

 এদিকে সর্দ্দার প্যাটেলের নেতৃত্বে বার্দ্দোলির কিষাণেরা খাজানা দিতে অস্বীকার করিয়া এক আন্দোলন শুরু করে। সুভাষচন্দ্রের ইচ্ছা ছিল এই সুযোগে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের সৃষ্টি করা। কিন্তু কংগ্রেসের প্রবীন নেতারা তখনও প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে পা বাড়াইতে নারাজ। কলিকাতায় নিখিল ভারত যুব-সঙ্ঘের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হিসাবে তিনি সর্ব্বপ্রথম গান্ধী-নীতির সমালোচনা করেন ও দেশবাসীর নিকট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আদর্শ প্রচার করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলিয়াছিলেন “There is absolutely no doubt that if the Congress Working Committee had taken courage in both hands, they could have anticipated the movement of 1930 by two years and the appointment of the Simon Commission could have made the starting point of such movement.”

 এই সময়েই সুভাষচন্দ্র বাঙ্‌লায় “স্বেচ্ছাসেবক আন্দোলন আরম্ভ করেন। ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের অধিবেশন কলিকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশন উপলক্ষে সেচ্ছাসেবক-বাহিনী গঠনে তিনি অনন্য সাধারণ কর্ম্ম-কুশলতার পরিচয় প্রদান করেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়ক রূপে তিনি সভাপতি পণ্ডিত মতিলাল নেহরুকে বিরাট সমারোহের সহিত সম্বর্দ্ধনা করেন। সভাপতির সম্বর্দ্ধনা কালে যে বিরাট শোভাযাত্রার আয়োজন হইয়াছিল ভারতের জাতীয় ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই। জাতীয় পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানও মহাড়ম্বরে নিষ্পন্ন হয়। কলিকাতা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র “নেহরু কমিটি”র প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, “এই প্রস্তাবের অর্থ এই যে, বৃটিশ গভর্ণমেণ্ট যদি নেহেরু কমিটি রচিত শাসনতন্ত্র ১৯২৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর বা তৎপূর্ব্বে মানিয়া লয় তাহা হইলে কংগ্রেস উহা গ্রহণ করিবে এবং তদ্দ্বারা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসনই স্বীকার করিয়া লইবে। কিন্তু আমরা কখনও সেই অবস্থা মানিয়া লইতে পারি না। ‘স্বাধীনতা’ আমরা চাই—এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের সুদূর ভবিষ্যতের আদর্শ নহে—স্বাধীনতা বর্ত্তমানেই আমাদের দাবী।”[] পণ্ডিত মতিলালের সমর্থকেরা কিন্তু নেহেরু কমিটির সুপারিশ হইতে অধিকদূর অগ্রসর হইতে চাহিলেন না। অধিবেশন মণ্ডপে জওহরলালের সহিত মতিলালের বাগবিতণ্ডা হইয়া যায়। শেষ পর্য্যন্ত গান্ধীজী উভয়দলকে সন্তুষ্ট করিয়া এই মর্ম্মে এক প্রস্তাব আনয়ন করেন যে, বৃটিশ পার্লামেণ্ট যদি ১৯২৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে নেহেরু কমিটির সুপারিশ না মানিয়া লয় তবে কংগ্রেস অহিংস অসহযোগ সংগ্রাম শুরু করিবে। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের মতে “The maximum concession which they could make fell short of the minimum demand of the left wingers.” সুভাষচন্দ্র পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী করিয়া এক সংশোধন প্রস্তাব আনয়ন করেন। তাঁর প্রস্তাবটি এই:—“কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতা ভারতীয় জনগণের আদর্শ বলিয়া সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে। কংগ্রেস সেই পূর্ব্ব সিদ্ধান্তে অটল থাকিয়া এই অভিমত প্রকাশ করিতেছে যে, ব্রিটেনের সহিত সম্পূর্ণ ভাবে সম্পর্কচ্ছেদ না হওয়া পর্য্যন্ত প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ অসম্ভব।” এই প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া তিনি বলেন, “হয়ত আপনারা বলিবেন যে স্বাধীনতার এই প্রস্তাব করিয়া আমাদের কি লাভ হইবে? হহার উত্তরে আমি বলিব, ইহা দ্বারা আমাদের এক নূতন মনোবৃত্তি গড়িয়া উঠিবে। রাজনীতিক্ষেত্রে আমাদের অধঃপতনের মূল কারণ কি? আমাদের বর্ত্তমান মনোবৃত্তিই উহার কারণ। এই হীন মনোবৃত্তির কোনরূপ পরিবর্ত্তন যদি আপনাদের কাম্য হয়, তাহা হইলে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের আদর্শ দেশবাসীর মনে সঞ্চার করিতে হইবে। যদি ইহাও ধরিয়া লওয়া হয় যে, আমরা কার্য্যতঃ পূর্ণ স্বাধীনতার আদর্শ অনুসরণ করিব না সত্য, কিন্তু দেশবাসীর নিকট অকপট ভাবে এই আদর্শ প্রচার করিব তাহা হইলেও আমরা এক নূতন ভাবধারায় অনুপ্রাণিত তরুণ সম্প্রদায় গড়িয়া তুলিব। আমি আপনাদিগকে জানাইতেছি যে, আমরা হাত পা গুটাইয়া বসিয়া থাকিব না। দেশের তরুণেরা তাহাদের দায়িত্ব বুঝিয়াছে, কাজের জন্যও প্রস্তুত হইয়াছে। আমাদের কর্ম্মপন্থা আমরা নিজেরা স্থির করিব এবং যাহাতে আমাদের প্রস্তাব উপেক্ষাভরে আবর্জ্জনাপাত্রে নিক্ষিপ্ত না হয়, এজন্য আমরা যথাশক্তি, ঐ কর্ম্মপন্থা অনুসরণ করিয়া কাজ করিব। আপনারা ইহা নিশ্চয়ই জানেন যে বাঙ্‌লাদেশে জাতীয় আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত হইতেই আমরা স্বাধীনতা অর্থে পূর্ণ স্বাধীনতা বুঝিয়াছি। উহার অর্থ আমরা কখনও ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন বুঝি নাই। আমাদের দেশের শত শত শহিদের আত্মবিসর্জ্জনে, কবির বাণীতে আমরা পূর্ণ স্বাধীনতারই স্বপ্ন দেখিয়াছি। ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথায় আমাদের দেশবাসীর অন্তঃকরণে বিশেষ করিয়া তরুণদের চিত্তে এতটুকুও উৎসাহের সৃষ্টি হইবে না। আজ তরুণদের কথাই বিশেষ করিয়া ভাবিতে হইবে—ইহারাই দেশের ভবিষ্যৎ।”[] এই সংশােধন প্রস্তাবের সমর্থনে পণ্ডিত জওহরলাল এক ওজস্বিনী বক্তৃতা করেন। কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত সুভাষচন্দ্রের সংশােধন প্রস্তাবটি ১৩৫০-৯৭৩ ভােটে অগ্রাহ্য হইয়া যায়। জাতীয় মহাসভার অধিবেশন শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে কলিকাতায় “হিন্দুস্থান সেবাদল” সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অপরিহার্য্য প্রয়ােজনীয়তার উপর বিশেষ জোর দেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর সবদেশের ইতিহাসেই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী জাতীয় সংগ্রামে মুক্তিফৌজের কাজ করে—ভারতবর্ষে তাহার ব্যতিক্রম হইতে পারে না। ইহার পরেই সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল ও শ্রীযুক্ত শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার প্রমুখ পূর্ণ-স্বাধীনতাবাদী নেতৃবর্গ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে পূর্ণ স্বাধীনতার আদর্শ প্রচারের জন্য “স্বাধীনতা সঙ্ঘ” গঠন করেন।

 ১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে বাঙ্‌লার গভর্ণর হঠাৎ বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা ভাঙ্গিয়া দিলেন। তাঁহার এইরূপ আচরণের দ্বারা তিনি স্বরাজ্যদলকে শক্তি পরীক্ষায় আহ্বান করিতেছেন বুঝা গেল। সুভাষচন্দ্রও অসীম সাহস ও ঐকান্তিক দৃঢ়তার সহিত এই আহ্বান গ্রহণ করিলেন।১৯২৯ সালের জুনমাসে যে নির্ব্বাচন হইল তাহাতে কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থীরাই বিপুল ভোটাধিক্যে নির্ব্বাচিত হইলেন। এই বৎসর আগষ্ট মাসে “নিখিল ভারত লাঞ্ছিত রাজনৈতিক কর্মী দিবস” পালন উপলক্ষে দক্ষিণ কলকাতায় এক শোভাযাত্রা পরিচালন করিতে গিয়া সুভাষচন্দ্র রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। যখন গ্রেফ্‌তারী পরওয়ানা জারী হয় সুভাষচন্দ্র তখন পাঞ্জাবে ছিলেন। পাঞ্জাব হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া তিনি আলিপুরের ম্যাজিষ্ট্রেটের এজলাসে উপস্থিত হইলেন। মামলার বিচারসাপেক্ষ তাঁহাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। তখন হইতে কংগ্রেসের সাহোর অধিবেশন পর্য্যন্ত তিনি জামিনে মুক্ত ছিলেন।

 ১৩ই সেপ্টেম্বর লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার আসামী যতীন দাস লাহোর সেণ্টাল জেলে ৬৩ দিন অনশনের পর প্রাণত্যাগ করেন। তাঁহার মৃতদেহ কলিকাতায় আনীত হইলে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে যে শোভাযাত্রা বাহির হয়, দেশবন্ধুর শবযাত্রা ছাড়া সেরূপ বিরাট শব শোভাযাত্রা আর হয় নাই। ২৯শে সেপ্টেম্বর সুভাষচন্দ্র হাওড়া রাষ্ট্রীয় সম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯শে অক্টোবর তিনি লাহোরে পাঞ্জাব ছাত্র সম্মেলনে পৌরোহিত্য করেন। তিনি অভিভাষণে বলেন, “আজিকার ছাত্র আন্দোলন দায়িত্বহীন যুবক যুবতীর একটা লক্ষ্যহীন অভিযান নহে। দায়িত্বশীল কর্ম্মক্ষম যে সকল যুবক-যুবতী চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠন করিয়া দেশের কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে চান, ইহা তাহাদেরই অন্দোলন।” “স্বাধীনতার কোনও সহজ নিরাপদ পথ নাই। স্বাধীনতার পথে যেমন আঘাত-বিপদ আছে, তেমনি গৌরব ও অমরত্বও আছে। প্রাচীনের যাহা কিছু শৃঙ্খলের মত আমাদের চলাকে প্রতিপদে প্রতিহত করিয়া আসিতেছে, আজ তাহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তীর্থযাত্রীর মত দলে দলে স্বাধীনতার লক্ষ্যপথে যাত্রা করিতে হইবে। স্বাধীনতাই জীবন; স্বাধীনতার সন্ধানে জীবনদানে অবিনশ্বর গৌরব। আসুন আজ আমরা সম্মিলিত হইয়া স্বাধীনতা লাভ করিতে প্রাণপণ চেষ্টা করি—সেই উদ্যমে জীবনপাত করিয়া আমরা মৃত্যুঞ্জয়ী যতীন্দ্রনাথের স্বদেশবাসী হইবার যোগ্যতা লাভ করি।” তিনি আরও বলেন, “জীবনের একটি মাত্র উদ্দেশ্য আছে। তাহা হইল সকল প্রকার বন্ধন হইতে মুক্তি। স্বাধীনতার জন্য উদগ্র আকাঙ্ক্ষাই হইতেছে জীবনের মূল সুর। সদ্যোজাত শিশুর প্রথম ক্রন্দনধ্বনিই তো বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা। আপনাদের নিজেদের প্রাণের এবং দেশবাসীর প্রাণে স্বাধীনতার এই তীব্র আকাঙ্ক্ষাটা জাগাইয়া তুলুন। তাহা হইলে ভারতবর্ষ অল্পদিনের মধ্যেই স্বাধীনতা লাভ করিবে।”

 “ভারতবর্ষ স্বাধীন হইবেই, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। রাত্রির পর যেমন দিন আসিবেই তেমনি ইহাও আসিবে। ভারতবর্ষকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে, এমন কোনও শক্তি এ পৃথিবীতে আজ নাই। কিন্তু আসুন এমন মহীয়সী ভারতের ধ্যানচিত্র আজ আমরা গড়িয়া তুলি, যাহার জন্য জীবনসর্ব্বস্বধন বলি দিয়া আমরা ধন্য হইতে পারি।” “স্বাধীনতা বলিতে আমি বুঝি সমাজ ও ব্যক্তি, নর ও নারী, ধনী ও দরিদ্র সকলের জন্য স্বাধীনতা। শুধু ইহা রাষ্ট্রীয় বন্ধন মুক্তি নহে, ইহাতে অর্থের সমান বিভাগ, জাতিভেদ ও সামাজিক অবিচারের নিরাকরণ ও সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামী বর্জ্জনও বুঝায়।”

 ১লা ডিসেম্বর অমরাবতীতে সুভাষচন্দ্র মধ্যপ্রদেশ ও বেরার ছাত্রসম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি তাঁহার অভিভাষণে বলেন, “আমরা যে নূতন সমাজ গড়িয়া তুলিতে চাই সেই সমাজের গোড়ার কথা হইবে—সকলের জন্য সমান অধিকার, সমান সুযোগ, ঐশ্বর্য্যের উপর সকলের সমান অধিকার, বৈষম্যমূলক সামাজিক বিধানের উচ্ছেদ, জাতিভেদ প্রথার বিলোপ এবং বৈদেশিক শাসন হইতে মুক্তি।”

 “আমি যে স্বপ্ন ভালবাসি সে হইতেছে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন; আপনার প্রভায় গৌরবান্বিত সমুজ্জ্বল ভারতের স্বপ্ন। আমি চাই—এই ভারত তাহার নিজ সংসারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হউক, তাহার ভাগ্যনিয়ন্ত্রনের ভার তাহারই হস্তগত হউক। আমি চাই এদেশে একটা স্বাধীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হউক। তাহার সৈন্য, তাহার নৌবল, তাহার বিমান পোত, তাহার সমস্তই স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র হউক। আমি চাই পৃথিবীর স্বাধীনদেশ সমূহে স্বাধীন ভারতের দূত প্রেরণ করা হউক। আমি দেখিতে চাই—প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যাহা কিছু মহত্তর তাহারই গৌরবে গৌরবান্বিত হইয়া এই ভারত-মাতা, সমগ্র জগতের সমক্ষে ষড়ৈশ্বর্য্যশালিনীরূপে দণ্ডায়মান হউক। আমি চাই—এই ভারত দেশে দেশে পরিপূর্ণ সত্যের বাণী, সর্ব্বাঙ্গীন স্বাধীনতার বাণী প্রেরণ করুক।”

  1. সুভাষচন্দ্র ও পণ্ডিত জওহরলাল উভয়েই নেহরু কমিটিতে ছিলেন—এমন কি নেহরু রিপোর্টে তাঁহারা স্বাক্ষরও করিয়াছিলেন। পরে কংগ্রেসের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্রকে নেহরু রিপোর্টের বিরোধিতা করিয়া এক সংশোধন প্রস্তাব উত্থাপন করিতে দেখিয়া তাঁহার এইরূপ বিসদৃশ আচরণে অনেকেই বিস্মিত হইয়াছিলেন। সুভাষচন্দ্র ইহার যে কৈফিয়ত দেন তাহা এই:—“I have been asked by my friends why I, being a signatory to the Nehru Report, have stood up to speak for independence. I would only refer to the statement made in the body of the report where it is said that the principles of the constitution which we have submitted in the report can be applied in all the entirety to a constitution of independence. I do not think that in moving this amendment my action can be construed as in any way inconsistent.”
  2. প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র যে হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করেন তাহার প্রারম্ভেই তিনি বলেন, “I am sorry that I have to rise to an amendment to a resolution moved by Mahatma Gandhi and which has the support of some, if not many, of our elder leaders. The fact that I rise to-day to move the amendment is a clear indication of a cleavage, the fundamental cleavage between the elder school and the new school of thought in the Congress (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)।