বার

 সুভাষচন্দ্রের সমগ্র জীবন আলোচনা করিলে বুঝিতে পারা যায়, তিনি যৌবন-শক্তির মূর্ত্ত প্রতীক—অজানার সন্ধানে ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ করিয়া বাহির হইয়া পড়া, পুরাতনকে ধ্বংস করিয়া নূতনের প্রতিষ্ঠা করা ও উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য সমস্ত বাধা-বিঘ্ন চুর্ণ করিবার দুর্জ্জয় সংকল্প লইয়া জীবনপথে অগ্রসর হওয়া—ইহাই যদি যৌবনের ধর্ম হয়, তবে সুভাষচন্দ্রের জীবনে যৌবনের এই রূপ পূর্ণভাবে মূর্ত্ত হইয়াছে নিঃসন্দেহে স্বীকার করিতে হইবে। কর্মক্ষেত্রে ও দেখিতে পাই, তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের সহিত আজীবন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া যুব সম্প্রদায়কে মহৎ আশা ও আকাঙ্ক্ষায় তিনি যেভাবে উদ্বুদ্ধ করিয়াছেন, সমসাময়িক অন্য কোন জননায়কের জীবনে সেইরূপ দৃষ্ট হয় না। ভারতব্যাপী যুবআন্দোলনের সর্ব্বভারতীয় নেতা হিসাবে যদি কাহারও নাম করিতে হয়, তবে সুভাষচন্দ্রের নামই সর্ব্বাগ্রে মনে পড়ে। তরুণ সমাজের এই আদর্শ নেতা সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারা ও পথনির্দেশ ভারতের যুব আন্দোলনের প্রসার ও অগ্রগতির পথে বিশেষ সহায়ক হইবে ও প্রবর্ত্তনা যোগাইবে। তাই ছাত্র ও যুব আন্দোলন সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের বাণী, নির্দেশ ও মতামত আলোচনা করিয়া তরুণের চলারপথ যথোপযুক্তভাবে নির্দ্দিষ্ট করা আজিকার দিনে বিশেষ প্রয়োজন।

 ১৯২৯-৩০ সালে সুভাষচন্দ্র ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহু ছাত্র ও যুব সম্মেলনে সভাপতি হইয়া ভারতবর্ষের ছাত্র ও যুব আন্দোলনের সহিত ঘনিষ্টভাবে পরিচিত হন। সে সময় তিনি নিখিল ভারত জাতীয় মহাসমিতির সাধারণ সম্পাদক ও নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। দেশের যুব-শক্তি সুভাষচন্দ্রের সঞ্জীবনী বাণীর দুর্বার উদ্দীপনায় প্রাণ-চঞ্চল হইয়া উঠিল—এই বিপ্লবী নেতার চিন্তা ও কর্মে দেশের যুবক সম্প্রদায় সত্যিকারের পথনির্দ্দেশ পাইল। যুব-অন্দোলন কেবল স্বাধীনতা-সংগ্রামেই সীমাবদ্ধ থাকিবে না। রাষ্ট্রীয় অধিকার পাইলেই যুব আন্দোলনের প্রয়োজন নিঃশেষ হইবে না। যুব আন্দোলনের কাজ জাতি গঠনের কাজ—বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যষ্টির জীবনকে আদর্শানুগ ও সমাজনিষ্ঠ করিয়া গঠন করা— কর্ত্তব্যনিষ্ঠা, চরিত্রবত্তা ও আত্মত্যাগের মহণীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত সুস্থ ও বলিষ্ঠ সমাজজীবন গড়িয়া তোলা। যুব আন্দোলন কেবল রাষ্ট্রীয় পরাধীনতার বন্ধন হইতেই মুক্তি দিবে না—ব্যক্তি ও সমাজকে সর্বপ্রকার বাঁধা-বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া আত্মবিকাশ ও সার্থকতার পথে উত্তীর্ণ করিয়া দিবে। জাতীয় জীবনে যুব আন্দোলনের প্রয়োজন অপরিসীম। ইহা তথাকথিত রাজনৈতিক আন্দোলন হইতে স্বতন্ত্র—ইহার বিশেষ আদর্শ আছে, স্বতন্ত্র কর্মপ্রণালী আছে। ইহার সমগ্রতার মধ্যে জীবনের সকল ভিন্ন ভিন্ন দিকগুলিই রহিয়াছে। যে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেখানে সকলেই মুক্ত—ব্যক্তি মুক্ত, সমাজ মুক্ত, সেখানে মানুষ রাষ্ট্রীয় বন্ধন হইতে মুক্ত, সামাজিক বন্ধন হইতে মুক্ত, অর্থনৈতিক বন্ধন হইতে মুক্ত। কাব্য, সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন, বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যায়াম-ক্রীড়া, সমাজ ও রাষ্ট্র—এই সবের মধ্যে দিয়া জাতীয় জীবনের বিকাশ হইয়া থাকে। এই সবের ভিতর দিয়াই তরুণ-প্রাণের আত্ম-প্রকাশ ঘটে। প্রাণ যখন জাগে তখন সহস্রধারায় নিজেকে প্রকাশ করে। শরীরে স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিলে প্রত্যেক অঙ্গে যেরূপ অপূর্ব্বশ্রী ফুটিয়া ওঠে তেমনি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যখন জাতির অন্তরে জাগিয়া উঠে তখন তাহা সব দিক দিয়াই ফুটিয়া বাহির হয়। কংগ্রেস মূলতঃ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ইহার উদ্দেশ্য সংকীর্ণ না হইলেও সীমাবদ্ধ। তাই যাহারা জীবনকে সমগ্ররূপে দেখিতে চায় তাহারা কংগ্রেসের ন্যায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে পারিবে না। যুব-আন্দোলন এই অভাব পূর্ণ করিবে। যুব-আন্দোলনের বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই।

 যুব-আন্দোলনের পরিধি জীবনের মতই ব্যাপক। শরীরকে সঞ্জীবিত করিতে হইলে আমাদিগকে ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যায়াম করিতে হইবে— হৃদয়কে মুক্ত ও নবশিক্ষাদ্বারা উদ্বুদ্ধ করিতে হইলে নূতনতর সাহিত্য, উচ্চতর ও উৎকৃষ্টতর শিক্ষাপ্রণালী ও সুদৃঢ় নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে—সমাজকে নবজীবন দান করিতে হইলে চিরাচরিত আচার ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করিয়া নূতন সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও বলিষ্ঠ ভাবধারার প্রবর্তন করিতে হইবে। যুগোচিত আদর্শের আলোকে বর্ত্তমান সামাজিক ও নৈতিক ব্যবস্থা ও বিধানসমূহ যাচাই করিয়া লইতে হইবে—এইরূপ নৈতিক ও সামাজিক আদর্শের প্রবর্ত্তন করিতে হইবে যাহা ভবিষ্যতের পথকে সুনির্দ্দিষ্ট ও সুনিয়ন্ত্রিত করিবে।

 যুব-অন্দোলন বর্ত্তমানের প্রতি অসন্তোষের প্রতীক। যুগ-সঞ্চিত সংস্কারের মোহবন্ধন, পথনিরোধকারী আচার ও বিধানের নাগপাশ, স্বেচ্ছাচারিতা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইহা একটি বিশিষ্টরূপ। সকল শৃঙ্খল মোচন করিয়া মানবের অফুরন্ত সৃজনীশক্তির স্বাভাবিক বিকাশ লাভের সহজ পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়া মানব জাতির জন্য নূতনতর জগতের প্রতিষ্ঠাই ইহার লক্ষ্য। অতীতের ও বর্ত্তমানের দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধা অতিক্রম করিয়া ভবিষ্যতের পানে, সম্মুখের দিকে ছুটিয়া চলা, সুদূরের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা—ইহাই যৌবন-ধর্ম। যুব-আন্দোলনের প্রকৃতিগত এই বৈশিষ্ট্যটি না থাকিলে কেবলমাত্র যুবক-যুবতীর সংঘ হইলেই কোন প্রতিষ্ঠান যুবক-সমিতি আখ্যা পাইতে পারে না। যুবসমিতিকে সেবা-সমিতির নামান্তর বলিয়া মনে করিলেও ভুল হইবে—কংগ্রেস কমিটির নাম ও label পরিবর্ত্তন করিয়া যুব-সমিতি গঠন করিলে চলিবে না। যুব-আন্দোলন দায়িত্বজ্ঞানহীন যুবক-যুবতীর লক্ষ্যহীন অভিযান নহে। দায়িত্বশীল কর্মক্ষম যে সকল তরুণ-তরুণী চরিত্র সুগঠিত করিয়া দেশের কাজে নিজেকে বিলাইয়া দিতে চায়, ইহা তাহাদেরই আন্দোলন। নূতন সমাজ, নূতন রাষ্ট্র, নূতন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা, মানুষের মধ্যে নূতন ও উচ্চতর আদর্শনিষ্ঠা জাগাইয়া তোলা যুব অন্দোলনের উদ্দেশ্য। এই অশান্ত, অসন্তুষ্ট, বিদ্রোহী মন যার আছে, যে ব্যক্তি বর্ত্তমান ও বাস্তবের অবগুণ্ঠন সরাইয়া মহত্তর ও সমৃদ্ধতর জীবনের দৃষ্টি ও আস্বাদ পাইয়াছে, সেই ব্যক্তিই যুব-অন্দোলনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে এবং যুবক সমিতি গঠনের অধিকারী হইয়াছে। যে প্রতিষ্ঠান বা অন্দোলনের মূলে স্বাধীন চিন্তা বা নূতন প্রেরণা নাই তাহা তরুণের প্রতিষ্ঠান বা আন্দোলন বলিয়া অভিহিত হইতে পারে না।

 রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শরীরগত ও শিক্ষাদীক্ষাগত— যুব-আন্দোলনের এই পাঁচটি দিক। এই আন্দোলনের লক্ষ্য দ্বিধা-বিভক্ত। একটি ধ্বংস ও বিদ্রোহের দিক—অপরটি সৃষ্টি ও গঠনের দিক। চিন্তাজগতে একটা ভাব-বিপ্লব আনিতে হইবে। ভাল ও মন্দ সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা বদ্ধমূল হইয়া আছে তাহার পরিবর্ত্তন করিতে হইবে। সকল মিথ্যা মাপকাঠি চুর্ণ বিধবস্ত করিয়া ফেলিয়া নূতনভাবে জীবনের মূল্য নিরূপণ করিতে হইবে। এইভাবে ধ্বংস ও সৃষ্টির কাজ একসঙ্গে চলিবে। ধ্বংস ভাল নয়, গঠনই ভাল এবং ধ্বংস না করিয়া গঠন করা সম্ভব একথা মনে করিলে অত্যন্ত ভুল করা হইবে। আবার ধ্বংসই ধ্বংসের লক্ষ্য একথা মনে করাও ভুল। জীবনের কোন একটি ক্ষেত্রে নব সৃষ্টির পত্তন করিতে গেলেই অনেক জিনিস ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হয়। অসত্য, কপটতা ও ভয়-বন্ধনকে কোনমতেই মানিয়া চলা যায় না। যখন আমাদের কর্ত্তব্য শুধু সম্মুখে অগ্রসর হওয়া, তখন পশ্চাতের মুখ চাহিয়া পিছনে পড়িয়া থাকিলে চলিবে না। সৃষ্টির দেবতা ভাঙ্গনের মহারথে বিজয় কেতন উড়াইয়া প্রবল ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়াই অগ্রসর হয়।

 (ক) ব্যায়াম সমিতি, ব্যায়ামাগার, পাঠচক্র, আলোচনা-বৈঠক, সাময়িকপত্র পরিচালনাসংঘ, জাতীয় সংগীত সমাজ, সমাজকল্যান সংঘ, পক্ষীমঙ্গল সমিতি ইত্যাদি স্থাপন করিতে হইবে।

 (খ) নব্যপ্রণালীতে স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী গঠন করিতে হইবে। Volunteer organization এর ফলে তরুণ সমাজ নির্ভীক ও শ্রমসহিষ্ণু হইবে—শৃঙ্খলাও আজ্ঞানুবর্ত্তিতা শিক্ষা করিবে, ছাত্র ও যুবক সমাজে প্রীতি ও সহযোগিতার মধ্য দিয়া সংহত শক্তির উদ্ভব হইবে এবং class patriotism এর সৃষ্টি হইবে।

 (গ) যুব সংঘগুলি এক একটি করিয়া যৌথ স্বদেশী ভাণ্ডার খুলিবে। ইহাতে তাহারা অল্পমূল্যে স্বদেশী জিনিস ব্যবহার করিতে পারিবে ও গৃহশিল্পের উন্নতি ও প্রসারে উৎসাহ বর্দ্ধন করিবে। যৌথ কারবার চালাইবার অভিজ্ঞতা হইতে সামাজিক বৃত্তি ও সঙ্ঘ-সংগঠন-প্রতিভার উন্মেষ হইবে।

 (ঘ) ভাবের দৈন্য় ঘুচাইবার জন্য নূতন চিন্তাধারার প্রবর্ত্তন করিতে হইবে। যাহারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃষ্টির কার্য্যে ব্যাপৃত আছে তাহাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান যাহাতে হয় তাহার জন্য League Of Young Intellectuals গঠন করা আবশ্যক। সাহিত্যিক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিধর্মীসকলেই এই লীগের সভ্য হইবে। সময়োপযোগী সংগীত রচনা, সাহিত্যরচনা, পতাকাসৃষ্টি, মুখপত্রপরিচালনা, অভিনয় কলার অনুশীলন প্রভৃতি এই লীগের কার্য্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হইবে।

 (ঙ) দেশের মধ্যে যতগুলি যুবকসমিতি ও যুবকদের আন্দোলন আছে সে সকলের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন করিতে হইবে। ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত যুবক ও তরুণদের প্রাণ এক সুরে বাঁধিতে হইবে। এই সংহত যুবশক্তির সম্মুখে কোনও বাধা-বিঘ্ন দাঁড়াইতে পারিবে না। জাগ্রত যৌবনশক্তি সকল বন্ধন হইতে স্বদেশ ও স্বজাতিকে মুক্ত করিয়া স্বাধীন ভারত সৃষ্টি করিবে—বিশ্বের দরবারে ভারতবাসীর গৌরবময় আসন প্রতিষ্ঠা করিবে। যুবকদের কর্ম-প্রচেষ্টা যাহাতে ভিন্নমুখী ও পরস্পরবিরোধী না হয়, এবং যাহাতে সকল চেষ্টা সংযত ও কেন্দ্রীভূত হইয়া একই আদর্শের দিকে পরিচালিত হয় তদুদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সমিতি গঠন করা আবশ্যক।

 দুঃখের বিষয়, আজিকার ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান ও আন্দোলন সমুহ স্বদেশের সম্পদশালী ঐতিহ্যকে, স্বকীয়তাকে, দেশের বিশেষ সমস্যা ও ঐতিহাসিক প্রয়োজনকে উপেক্ষা করিয়া বিদেশ হইতে আমদানিকরা মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত হইতে চলিয়াছে। ফলে, এই সকল আন্দোলনগুলি দেশ ও কালের উপযোগী কর্মপন্থা হারাইয়াছে—বিভিন্ন ও বিরুদ্ধ মতবাদের সংঘর্ষে ঐক্য নষ্ট হওয়ায় যুব আন্দোলনের মধ্যে দলাদলি প্রবেশ করিয়াছে। অন্য দেশের আদর্শ অন্ধভাবে অনুকরণ করা আত্মপ্রবঞ্চনার সামিল। প্রত্যেক দেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি হয় সেই দেশের ইতিহাসের ধারা, ভাব, আদর্শ এবং নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের প্রয়োজন হইতে। কোন প্রতিষ্ঠান গড়িতে হইলে ইতিহাসের ধারা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও বর্ত্তমানের সমস্যাকে অগ্রাহ্য় করা চলে না। পরদেশের চিন্তা, ভাব, প্রতিষ্ঠান বা আদর্শের হুবহু অনুসরণ বা অনুকরণ করার প্রচেষ্টা বাতুলতা মাত্র। পরাধীন দেশের যদি কোনও “ism” কে সর্ব্বান্তঃকরণে গ্রহণ করিতে হয়, তবে তাহা “nationalism”

 নিজের দেশের ইতিহাসের ধারা ও বিশিষ্ট সমস্যাগুলিকে অস্বীকার করিলে চলিবে না—কিন্তু তাই বলিয়া যেন মনে করা না হয় যে ছাত্র বা যুবসমাজের দৃষ্টি কেবল নিজদেশেই সীমাবদ্ধ থাকিবে। দেশের যুব-আন্দোলনকে সে দেশের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া বিশ্ব যুব-আন্দোলনের সহিত যুক্ত হইতে হইবে। যুব-আন্দোলনের দুইটি দিক আছে আন্তর্জাতিকতার দিক ও জাতীয়তার দিক। আন্তর্জাতিকতার দিক হইতে এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য বিশ্বের যুব সমাজকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করা। সকল দেশে সকল যুগে তরুণ ও যুবজনের আদর্শ, প্রেরণা, সাধনা ও অনুভূতি মূলতঃ একই। বিশ্বের তরুণ ও যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই আত্মীয়তা ও অভেদাত্মকভাব প্রবলতর হইলে মানবকল্যান ও মানবমুক্তির পথ প্রশস্ত হইবে।

 আজ আমরা যে শুধু পরাধীন তাহাই নয়— বিদেশী সভ্যতার কুহকাচ্ছন্ন হইয়া আমরা আমাদের প্রাণধর্ম হারাইয়াছি। আমাদের দেশ, ব্যক্তি ও জাতির জীবনে নূতন কিছু করিবার উৎসাহ ও প্রেরণা (initiative) লোপ পাইয়াছে। আমরা বাধ্য না হইলে বা কশাঘাত না খাইলে সহজে কিছুই করিতে চাহি না। বর্ত্তমানকে উপেক্ষা করিয়া ভবিষ্যতের পানে তাকাইয়া যে অনেক সময় অনেক কাজ করা দরকার এবং বাস্তবের দৈন্য ও গ্লানি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া আদর্শের প্রেরণায় জীবনটাকে অনেক সময় যে হাসিতে হাসিতে বিলাইয়া দেওয়া প্রয়োজন—একথা আমরা কার্য্যতঃ মানিয়া চলি না। এইজন্য প্রেরণা বা initiative এর অভাবে ব্যক্তি বা জাতির ইচ্ছাশক্তি ক্রমশঃ ক্ষীণ ও নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছে। ব্যক্তির ও জাতির জীবনে ইচ্ছাশক্তি পুনরায় জাগাইতে না পারিলে মহৎ কিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হইবে না। শুধু আদর্শের প্রেরণায়ই ইচ্ছাশক্তি জাগরিত হয়। আমরা আদর্শ ভুলিয়াছি বলিয়াই আমাদের ইচ্ছাশক্তি আজ এত ক্ষীণ। বর্ত্তমানের ভাব-দৈন্য বিদূরিত করিয়া নিজ নিজ জীবনে আদর্শের প্রতিষ্ঠা না করিতে পারিলে আমাদের প্রেরণা ও উদ্দীপনাশক্তি জাগিবে না—এবং প্রেরণাশক্তি না জাগিলে চিন্তাশক্তি ও কর্মপ্রচেষ্ঠা পুনরুজ্জীবিত হইবে না। তাই আদর্শবাদই যুব-আন্দোলনের প্রাণ। আদর্শের চরণে আত্মসমর্পণ করিতে হইবে—ঐ আদর্শের অনুসরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দিতে হইবে। আদর্শের চরণে আত্মবলিদান করিতে পারিলে মানুষের চিন্তা, কথাও কার্য্য এক সুরে বাঁধা হইবে—ভিতর বাহির এক হইয়া যাইবে। আদর্শের পশ্চাতে সারাটি জীবন অনুধাবনের ক্ষমতা, এই tenacity of purpose আমাদের নাই। আমরা অন্তরের সংগে দেশকে ভালবাসি না। তাই আমরা করি গৃহবিবাদ—তাই আমাদের মধ্যে জন্মায় মিরজাফর, উমিচাঁদ। আমরা যদি দেশকে একান্তরূপে ভালবাসিতে শিখি তাহা হইলে আত্মবলিদানের ক্ষমতা লাভ করিব, আমাদের চরিত্রে অবিরাম অশ্রান্ত পরিশ্রমের ক্ষমতা tenacity of purpose ফিরিয়া আসিবে। এই দুইটি বল tenacity of purpose বা moral stamina কোথায় পাইব? পাইব নিষ্কাম কর্মের মধ্যে জীবন ঢালিয়া দিলে—অবিরাম সংগ্রামে লিপ্ত হইলে।

 আমরা যদি হৃদয়ের গভীর অন্তঃস্থল হইতে দেশকে ভালবাসি, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা করিতে চাই—তাহা হইলে আমাদিগকে দাসত্বের বেদনা ও বন্ধনের দুঃখটিকে মর্মে মর্মে অনুভব করিতে হইবে। এই অনুভূতি যখন তীব্র হইবে তখন আমরা একথা উপলব্ধি করিব যে স্বাধীনতাহীন হইয়া বাঁচিয়া থাকার কোন মূল্য নাই এবং এই অভিজ্ঞতা বাড়িয়া চলার সংগে সংগে এমন দিন আসিবে, যেদিন আমাদের সকল প্রাণ স্বাধীনতা-তৃষ্ণায় ভরিয়া উঠিবে।

 স্বাধীনতার কোনও সহজ নির্বিঘ্ন পথ নাই। স্বাধীনতার পক্ষে যেমন আঘাত বিপদ আছে, তেমনি গৌরব ও অমরত্ব আছে। প্রাচীনের যাহা কিছু শৃঙ্খলের মত আমাদের চলাকে প্রতিপদে প্রতিহত করিতেছে আজ তাহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া তীর্থযাত্রীর মত দলে দলে স্বাধীনতার লক্ষ্যপথে যাত্রা করিতে হইবে। স্বাধীনতাই জীবন। স্বাধীনতার সন্ধানে জীবনদানে অবিনশ্বর গৌরব।

 দেশে দেশে যুগে যুগে নির্ভীক তরুণ ও যুবকদলই মুক্তির আলোকবর্ত্তিকাটিকে উচ্চে তুলিয়া ধরিয়াছে। আজ ভারতবর্ষের ভাগ্য ভারতের যৌবনের হস্তে ন্যস্ত। আমরা পরাধীন হইয়া জন্মিয়াছি একথা সত্য কিন্তু স্বাধীন দেশে মরিব। দেশকে মুক্ত করিয়া মরিব—আসুন আমরা এই প্রতিজ্ঞা করি। আর যদি বা জীবনে মুক্ত ভারতবর্ষের রূপ দেখিতে নাও পারি তবে যেন ভারতবর্ষকে মুক্ত করিতে জীবন বিসর্জ্জন করিতে পারি। মানুষ হইয়া জন্মিয়াছি—মানুষের মত বাঁচিতে চাই। পরাধীনতাই মনুষ্যত্ব বিকাশের প্রধান অন্তরায়। মনুষ্যত্ব লাভের একমাত্র উপায় মনুষ্যত্ব বিকাশের সকল অন্তরায় চুর্ণ করা। যেখানে যখন অত্যাচার অবিচার ও অনাচার দেখিব সেইখানে নির্ভীক হৃদয়ে শির উন্নত করিয়া প্রতিবাদ করিব এবং নিবারণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিব। অত্যাচার দেখিয়াও যে ব্যক্তি তাহা নিবারণ করিবার চেষ্টা করে না সে নিজের মনুষ্যত্বের অবমাননা করে। যে ব্যক্তি অনাচার নিবারণের প্রচেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিপন্ন হয়, কারারুদ্ধ হয় অথবা লাঞ্ছিত হয় সে সেই ত্যাগ ও লাঞ্ছনার ভিতর দিয়াই মনুষ্যত্বের গৌরবময় আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়।

 ভারতের তরুণও যুবসমাজকে সুভাষচন্দ্র যে ভাব ও চিন্তাধারায়, যে আদর্শে অনুপ্রাণিত করিতে চাহিয়াছেন, তরুণ সম্প্রদায়কে যে স্বপ্নের নেশায় মাতাইয়া তুলিতে চাহিয়াছেন, যে নূতনের সন্ধানে যুবচিত্তকে আহ্বান করিয়াছেন সুভাষচন্দ্রের নানা ভাষণ ও বাণী হইতে তাহারই কিঞ্চিৎ আভসে উপরে দেওয়া হইল।