তের

 ১৯২৯ সালের ২৫শে ডিসেম্বর লাহোরে ভারতীয় জাতীয় মহাসভার অধিবেশন হয়। সেবারকার কংগ্রেসে বামপন্থীদের উদ্যোগ-আয়োজন দেখিয়া গান্ধীজিও দক্ষিণপন্থী নেতারা কংগ্রেসের সভাপতি মনোনয়নে এমন কুটনৈতিক চাল চালিলেন যে তাহার ফলে বামপন্থীদল দুর্বল হইয়া পড়ে। সভাপতি পদের জন্য গান্ধীজির নাম প্রস্তাবিত হইয়াছিল, কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে সভাপতি মনোনীত করেন। এইভাবে বামপন্থীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠনেতাকে দক্ষিণপন্থীদল স্বপক্ষে আনিতে সক্ষম হয়। এই সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের উক্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য:—

 “বাম পক্ষের বিরোধিতাকে পর্য্যুদস্ত করিয়া কংগ্রেসে অপ্রতিহত প্রাধান্য পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে হাত করা মহাত্মাজির পক্ষে একান্ত প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছিল।······এই কাজে (সভাপতি মনোনয়নে) মহাত্মাজি বিশেষ চাতুর্য্যের পরিচয় দেন। কিন্তু বামপন্থীদলের পক্ষে এই নির্বাচন দুর্ভাগ্যের সূচনা করে। কারণ এই ঘটনা হইতেই মহাত্মাজি ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মধ্যে অধিকতর মতসামঞ্জস্য ও ঘনিষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয়; এবং কংগ্রেসে বামপক্ষ ও নেহরুর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। কংগ্রেস-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর হইতেই জনসেবার ক্ষেত্রেও পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর জীবনে সম্পূর্ণ এক নূতন অধ্যায় আরম্ভ হয়; তদবধি একান্ত নিষ্ঠার সহিত পণ্ডিত নেহরু মহাত্মাজিকে সমর্থন করিয়া আসিতেছেন।”

 এদিকে কলিকাতা কংগ্রেসে যে চরমপত্র দেওয়া হইয়াছিল তাহার মেয়াদ উত্তীর্ণপ্রায়। দেশবাসী পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্কল্প গ্রহণ করিতে আগ্রহান্বিত। অবশেষে ৩১শে অক্টোবর তদনীন্তন বড়লাট লর্ড আরউইন ঘোষণা করিলেন যে, ১৯১৭ সালের ঘোষণায় ভারতের ‘শাসন-তান্ত্রিক প্রগতি’ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে ই ব্যবহৃত হইয়াছে। বড়লাটের এই ঘোষণার পর গান্ধীজী, মতিলাল, মালব্য, ডাঃ আনসারী, মুঞ্জে, প্যাটেল, শ্রীযুক্তা নাইডু এমন কি জওহরলালেরও স্বাক্ষরযুক্ত এক ঘোষণা প্রকাশিত হয়—তাহাতে সরকারের আন্তরিকতার প্রশংসা করা হয় এবং ভারতের জন্য ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে এক শাসনবিধি প্রনয়ন করিতে সরকারকে অনুরোধ করা হয়। সুভাষচন্দ্র এই ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করিতে অস্বীকৃত হন এবং কংগ্রেসদলপতিদের ঘোষণার প্রতিবাদে একটি স্বতন্ত্র ঘোষণাপত্র প্রচার করেন। অমৃতসরের ডাঃ সফিউদ্দিন কিচ্‌লু ও পাটনার অধ্যাপক আবদুল বারি শেষোক্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই সময় গান্ধীজী ও মতিলাল বড়লাটের সহিত সাক্ষাৎ করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সাক্ষাৎকরের কোনই ফল হয় নাই। ফলে, লর্ড আরউইনের ঘোষণার দুইমাস পরে (২৯শে ডিসেম্বর, ১৯২৯) লাহোর অধিবেশনের কালে দলপতিদের ক্ষীণ আশার শেষ রশ্মিটুকুও নিবিয়া যায়—তাঁহারা শূন্যহস্তে অধিবেশনে যোগদান করিলেন। কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসাবে পূর্ণ স্বাধীনতা গৃহীত হইল কিন্তু বোমার আক্রমন হইতে জীবন রক্ষা হওয়ায় বড়লাট বাহাদুরকে যে অভিনন্দন জানান হইয়াছিল সেই অভিনন্দন প্রস্তাব বর্জ্জন করার দাবী জানান সত্ত্বেও সেই প্রস্তাব বর্জন করা হইল না। পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জ্জনের জন্য কংগ্রেসের কি কর্ম্মপন্থা অবলম্বন করা উচিত নিখিল ভারতীয় নেতারা সে বিষয় কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। আন্দোলনের পথ নির্দ্দেশ ও আন্দোলন পরিচালনার ভার গান্ধীজীর উপর ন্যস্ত করিয়াই ক্ষান্ত রহিলেন। একমাত্র সুভাষচন্দ্রই সেদিন কংগ্রেসের সম্মুখে একটি কর্মপন্থা উপস্থাপিত করিয়াছিলেন। এক সংশোধন প্রস্তাব তুলিয়া তিনি বলিলেন যে, দেশের প্রচলিত শাসনযন্ত্র বর্জ্জন করিয়া আয়র্লণ্ডের সিন ফিনের আদর্শে একটি প্রতিদ্বন্দ্বী (parallel) গভর্ণমেণ্ট স্থাপন করা হউক এবং দেশবাসীকে সেই প্রতিদ্বন্দ্বী গভর্ণমেণ্টের প্রতি অনুগত্য প্রকাশে আহ্বান করা হউক। উক্ত প্রস্তাবে তিনি দেশের শ্রমিক, কৃষক ও যুবসম্প্রদায়কে সংগঠিত করার দাবীও উপস্থিত করেন। কিন্তু নিখিল ভারতীয় নেতৃবৃন্দ কেহই সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন করিলেন না। বাঙ্‌লার ডেলিগেটদের একটি প্রধান দল (দেশপ্রিয় সেনগুপ্তের সমর্থকদল) সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব সমর্থন করিলেন না। মহাত্মাজীর সুপারিশক্রমে জওহরলাল সভাপতির আসনে সমাসীন—সুতরাং তিনিও সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবের বিরােধী। গান্ধীমণ্ডলের নেতারা তাে গান্ধীজী ব্যতীত অন্যকাহারও প্রােগ্রাম গ্রহণ করিতেই পারেন না। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাব অগ্রাহ্য় হইল। সপ্তরথী বেষ্টিত হইয়া অভিমন্যুর মত বীর বিক্রমে একাকী সংগ্রাম করিয়া তিনি পরাজয় বরণ করিলেন। সেদিন লাহাের কংগ্রেসেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, “আজ আমার প্রস্তাব অগ্রাহ্য হইল; কিন্তু, এমন দিন শীঘ্রই আসিবে যেদিন আপনারা অনুরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করিতে বাধ্য হইবেন” সেদিন সুভাষচন্দ্রের ব্যাকুল কণ্ঠের করুণ আবেদন শুনিয়া অনেকেই বক্রহাসি হাসিয়াছিলেন। আজ ১৯৪২ সালে আগষ্ট আন্দোলনের ইতিহাসে যখন দেখি সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবিত প্রতিদ্বন্দ্বী গভর্ণমেণ্ট স্থাপনের পরিকল্পনা তমলুক, কাঁথি, সাতারা প্রভৃতি স্থানে কার্য্যকরী করিবার প্রচেষ্টা হইয়াছিল, তখন সুভাষচন্দ্রের কর্মপন্থায় অভ্রান্ত দূর দৃষ্টির পরিচয়ই আমরা পাই।[]

 ১৯২৯ সালে সুভাষচন্দ্র নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি নির্ব্বাচিত হন এবং ১৯৩১ সাল পর্য্যন্ত উক্ত পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। কিন্তু ১৯২৭ সাল হইতে তিনি কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির সদস্য ও জেনারেল সেক্রেটারী থাকা সত্ত্বেও লাহাের অধিবেশনে তাঁহাকে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যপদ পরিত্যাগ করিতে হয়। এই বৎসর মাদ্রাজের জনপ্রিয় নেতা ও ভূতপূর্ব্ব কংগ্রেস সভাপতি নিবাস আয়েঙ্গারকেও কমিটি হইতে বর্জন করা হয়। লাহাের অধিবেশনে সুভাষচন্দ্র এই মর্মে আর একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণ অতঃপর নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির মধ্য হইতে নির্ব্বাচিত হইবেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতিসম্মত এই দাবীও অগ্রাহ্য হয়। গণতান্ত্রিক নীতির এই অবমাননায় সুভাষচন্দ্র প্রমুখ বামপন্থীদল সভাস্থল পরিত্যাগ করেন এবং গয়া কংগ্রেসের অনুরূপ লাহোর কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটি স্বতন্ত্র দল গঠন করেন। এই দলের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, “The new party will without prejudice to the party's objective of complete independence for India, endeavour to the best of its ability to co-operate as far as possible with the other parties in the country in such programmes, policies and activities as the party may accept for the purpose of attaining its objective.”

 ১৯৩০ সালের ৪ঠা জানুয়ারী সুভাষচন্দ্র ব্রাড্‌লে হলে লাহোরের নাগরিকদের এক সভায় বক্তৃতা করেন। লাহোর হইতে প্রত্যাবর্ত্তনের পরে ১৯৩০ সালের ২৩শে জানুয়ারী তারিখে নিখিল ভারত রাজনৈতিক লাঞ্ছিত কর্মী দিবসের শোভাযাত্রা সম্পর্কে রাজদ্রোহের অভিযোগে তিনি ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

 এই সময় গান্ধীজীর নেতৃত্বে লবণ আইন অমান্য অন্দোলন আরম্ভ হয়। এই আন্দোলনেও অন্যান্য বারের ন্যায় বাঙ্‌লার যুবসম্প্রদায় বিপুল সংখ্যায় দলে দলে আন্দোলনের পুরোভাগে আসিয়া দাঁড়ায়। সুভাষচন্দ্র তখন জেলে। কারারুদ্ধ অবস্থাতেই তিনি কলিকাতার নাগরিক জীবনের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সম্মান কর্পোরেশনের মেয়রপদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৩০ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর তিনি মুক্তিলাভ করেন। মুক্তিলাভের পরেই তিনি নিখিল ভারত ট্রেডইউনিয়ন কংগ্রেসের কলিকাতা অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ট্রেডইউনিয়ন কংগ্রেসকে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি আনুগত্য রক্ষা করিয়া চলিবার উপদেশ দেন। সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন, “জাতীয় স্বাধীনতা অর্জ্জনই সর্ব্বাগ্রে প্রয়োজন—স্বাধীনতালাভের পূর্ব্বে শ্রমিকদের কোনরূপ শ্রেণী সংগ্রামে প্রবৃত্ত হওয়া আমি সঙ্গত মনে করি না। শ্রমিক আন্দোলন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হউক কিন্তু তাহা যেন জাতীয়তাবিরোধী (anti-nationalist) না হয়।

 ১৯৩১ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে সুভাষচন্দ্র নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ও উত্তর বঙ্গ পরিভ্রমণে বহির্গত হন। মালদহ জেলার সীমান্তে ট্রেনের কামরায় ফৌজদারী কার্য্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুসারে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট তাঁহার উপর এক আদেশ জারী করেন। ঐ আদেশ দ্বারা তাঁহাকে মালদহ জেলায় প্রবেশ করিতে নিষেধ করা হয়। সুভাষচন্দ্র এই আদেশ মানিতে অস্বীকার করেন। ফলে ষ্টেশনে প্রথম শ্রেণীর আরোহীদের বিশ্রামাগারেই তাঁহার বিচার হয়। এই বিচার সম্পর্কে তাঁহার বক্তব্য জানিতে চাহিলে তিনি বলেন, “এই আদেশে ফৌজদারী দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারার সম্পূর্ণ অপপ্রয়োগ হইয়াছে। আত্মমর্য্যাদাসম্পন্ন ভারতবাসী হিসাবে আমি ইহা মানিতে পারি না। আমি যদি এই আদেশ মানিয়া লই তাহা হইলে নাগরিক হিসাবে আমি কর্ত্তব্যচ্যুত হইব।” বিচারে তাঁহার উপর ৭ দিন বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়। সুভাষচন্দ্র রাজসাহী সেণ্টাল জেলে প্রেরিত হন। শোভাযাত্রাদি যাহাতে না হইতে পারে তজ্জন্য রাজশাহীর জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ১৮ই জানুয়ারী স্বয়ং গভীর রাত্রিতে তাঁহাকে রাজসাহী হইতে ত্রিশমাইল দূরবর্ত্তী নাটোর রেলওয়ে ষ্টেশনে আনিয়া গাড়ীতে উঠাইয়া দেন। এই ভাবে তাঁহাকে আলিপুর সেণ্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত করা হয়।

 লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী ঘোষিত হওয়ার পর হইতে প্রতিবৎসর ২৬শে জানুয়ারী স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপিত হইয়া আসিতেছে। ১৯৩১ সালের স্বাধীনতা দিবসের সভা ও শোভাযাত্রা সরকার বে-আইনী ঘোষণা করেন। কিন্তু কর্পোরেশনের মেয়র সুভাষচন্দ্র সরকারের এই অন্যায় আদেশ অগ্রাহ্য করিয়া স্বয়ং মনুমেণ্টের অভিমুখে শোভাযাত্রা পরিচালনা করিয়া লইয়া যান। শোভাযাত্রা ময়দানের সমীপবর্ত্তী হইলে পুলিশ বেপরোয়া লাঠি চালনা করে। উহার ফলে সুভাষচন্দ্র আহত হন। আইন ভঙ্গের অপরাধে তিনি ছয়মাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

 কিন্তু দণ্ডকাল শেষ হইবার পূর্ব্বেই তিনি মুক্তি লাভ করেন; কেননা, সেই সময় গান্ধীজী আইন অমান্য আন্দোলন প্রত্যাহার করিয়াছেন এবং গান্ধী-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হইয়াছে। এই চুক্তিতে দারুণ অসন্তুষ্ট হইলেও সুভাষচন্দ্র তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় কংগ্রেসের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখিবার আবেদন জানাইয়া এক বিবৃতি প্রচার করেন। ইতিপূর্ব্বে প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস যোগদান না করায় বৈঠক চরম ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হয়। গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর কংগ্রেস দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের প্রস্তাবে স্বীকৃত হয়। কিন্তু দেশের যুবশক্তি এই চুক্তি ও আপোষ মানিয়া লয় নাই। সেই সময়ে ভগৎ সিং, রাজগুরু ও শুকদেও ব্যবস্থাপরিষদে বোমানিক্ষেপের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন। এই বীর যুবকত্রয়ের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞারদকল্পে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করিয়া যুবসম্প্রদায় এই দাবী উত্থাপন করে যে, এই বীরত্রয়ের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহার না হইলে গভর্ণমেণ্টের সহিত কোন প্রকার চুক্তিই হইতে পারে না। জনমতের চাপে গান্ধীজী বড়লাটকে বলিয়াও এ বিষয়ে কিছুই করিতে পারিলেন না। অথচ, এই যুবকদের ফাঁসিরদ না করাতে তিনি আপোষ-আলোচনা ভাঙ্গিয়াও দিলেন না। ২৩শে মার্চ্চ যে সময়ে কংগ্রেসের অধিবেশন আরম্ভ হয় ঠিক সেই সময়ে ভারতের নবজাগ্রত যুবশক্তি ও দেশাত্মবোধের মূর্ত্ত প্রতীক, আত্মত্যাগের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ভারতমাতার এই বীর সন্তানত্রয় সাম্রাজ্যবাদের যুপকাষ্ঠে আত্মাহুতি দিলেন। এই ঘটনায় দেশের যুবসম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হইয়া উঠে এবং সর্ব্বত্র কৃষ্ণপতাকাধারী ছাত্র শোভাযাত্রিদল কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে। এই মর্মন্তুদ ঘটনার বর্ণনা করিতে গিয়া জওহরলাল বলেন, গান্ধী-আরউইন আপোষ-নিষ্পত্তির পথের মাঝখানে ঝুলিয়া আছে ভগৎ সিংহের মৃতদেহ। সাহসিকতা ও তেজস্বিতার মূর্ত্ত বিগ্রহ, আত্মত্যাগ ও কষ্টসহিষ্ণুতার মহনীয় আদর্শ এই তিন বীর শহিদের প্রাণহরণে অত্যাচারী গভর্ণমেণ্টের সহিত আপোষের প্রস্তাব দেশবাসী কিছুতেই মানিতে পারে নাই! বিক্ষুব্ধ জনচিত্ত সেদিন জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে একমাত্র সুভাষচন্দ্রকেই তাহাদের অন্তরের কথা বলিতে শুনিয়াছিল। সুভাষচন্দ্র করাচীতে “হিন্দুস্থান নওজোয়ান সঙ্ঘের” সভাপতি রূপে দেশবাসীর অন্তরের এই তীব্র বিক্ষোভকে ভাষায় ব্যক্ত করিয়াছিলেন। সুভাষচন্দ্র গান্ধী-আরইউন চুক্তির তীব্র প্রতিবাদ করেন। করাচী কংগ্রেসে সভাপতি পদে সর্দার প্যাটেলের নির্ব্বাচনেরও তিনি প্রতিবাদ করেন। সর্দার প্যাটেল প্রতিনিধি মণ্ডলী কর্ত্তৃক নির্ব্বাচিত না হইয়া সরাসরি ওয়াকিং কমিটি কর্ত্তৃক মনোনীত হইয়াছিলেন। সভাপতি নির্ব্বাচনের এই প্রথা কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র বিরোধী হইলেও গান্ধী-আরইউন চুক্তি পাকাপাকি ভাবে সিদ্ধ করাইয়া লইবার জন্যই সর্দার প্যাটেলকে সভাপতিপদে বরণ করা হইয়াছিল।

 এই সময়ে বাঙ্‌লাদেশে সন্ত্রাসবাদের যুগ চলিতেছে। চট্টগ্রামের গোয়েন্দা কর্ম্মচারী আশানুল্লা এই সময় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হন। কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটি এই সম্পর্কে বাঙ্‌লাদেশের উল্লেখ করিয়া যে বিবৃতি দেন তাহা মোটেই শোভন হয় নাই। সুভাষচন্দ্র ঐ বিবৃতির প্রতিবাদে এক বিবৃতি দেন। ইতিমধ্যে হিজলী বন্দীনিবাসে রক্ষীদলের বেপরোয়া গুলীচালনার ফলে কয়েকজন রাজবন্দী আহত ও নিহত হন। এই মর্ম্মান্তিক ঘটনা সকলকেই বিচলিত করিয়া তোলে; এমন কি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেই উহার প্রতিবাদকল্পে আহূত এক জনসভায় সভাপতিত্ব করিতে কলিকাতায় ছুটিয়া আসেন এবং অগ্নিবর্ষী ভাষায় এই বর্বরোচিত বীভৎসতার তীব্র নিন্দা করেন। এই সময়ে সুভাষচন্দ্র বঙ্গীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সমিতির সভাপতি পদে ও কলিকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান পদে ইস্তফা দেন। বিলাতের দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কোনই ফল হইল না—কেবল দেশকে এক অপ্রয়োজনীয় পরাজয় ও অমর্য্যাদাকর আপোষের গ্লানি বহন করিতে হইল। গান্ধীজী রিক্তহস্তে দেশে ফিরিয়া আসিলেন। কর্ম্মপন্থা নির্দ্ধারণের জন্য বোম্বাইয়ে ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন আহূত হইল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, সুভাষচন্দ্র লাহোর কংগ্রেসে ওয়ার্কিং কমিটির সভ্যপদ ত্যাগ করেন। এবারকার বৈঠকে বিশেষ নিমন্ত্রণদ্বারা সুভাষচন্দ্রকে আলোচনায় যোগদান করিতে অনুরোধ করা হয়। সেখানে পুনরায় আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু এই আন্দোলনে যোগ দিবার পূর্ব্বেই কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তনের পথে ১৯৩২ সালের ২রা জানুয়ারী বোম্বাই হইতে ত্রিশ মাইল দূরবর্ত্তী “কল্যাণ” ষ্টেশনে ১৮১৮ সালের তিন আইনে সুভাষচন্দ্র গ্রেফ্‌তার হন। তাঁহাকে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত সিউনি জেলে লইয়া যাওয়া হইল। এইবারও জেলে তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িল। সিউনি জেল হইতে জব্বলপুর সেণ্ট্রাল জেলে, সেখান হইতে ভাওয়ালী স্বাস্থ্য-নিবাসে এবং সেখান হইতে চিকিৎসকগণ কর্ত্তৃক পরীক্ষার জন্য বলরামপুর হাসপাতালে সুভাষচন্দ্রকে ক্রমান্বয়ে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু এই ভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে ও স্বাস্থ্যাবাসে ঘুরিয়া ফিরিয়াও যখন তাঁহার স্বাস্থ্যের কোন উন্নতি হইল না তখন সরকার তাঁহাকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে গমন করিতে সম্মতি দান করেন।

 ১৯৩৩ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী তিনি ইউরোপ অভিমুখে যাত্রা করেন। যাত্রার প্রাক্‌কালে জাহাজ হইতে বাংলার উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী বাণী প্রেরণ করেন—“বাঙলা মরিলে কে বাঁচিয়া থাকিবে? বাঙলা বাঁচিলে কে মরিবে?”

  1. লাহাের কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্রের যে সংগ্রামশীল রূপ ও প্রখর ব্যক্তিত্ব ফুটিয়া উঠে তৎসম্পর্কে “ট্রিবিউন” পত্রিকায় নিম্নোদ্ধৃত মন্তব্য প্রকাশিত হয়—“Mr. Bose was an embodiment of C. R. Dass's fighting spirit—fighting against every thing that smacked of oppression and for everything that led to the national glory.”