বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র/পরিশিষ্ট (ঘ)
পরিশিষ্ট—(ঘ)
মাতৃভূমি পরিত্যাগ করিলাম কেন?
শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু
[১৯৪৩ সালের ৯ই জুলাই সিঙ্গাপুরে এক জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতা]
আপনারা জানেন, ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করিবার পর হইতে আমি স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে কাজ করিতেছি। গত দুই দশকে যে কয়েকবার আইন অমান্য আন্দোলন হইয়াছে, আমি সেই সকল আন্দোলনে ছিলাম। এছাড়া অহিংস হউক বা সহিংস হউক গােপনীয় বিপ্লবী আন্দোলনের সহিত আমার সম্পর্ক আছে এই সন্দেহে আমাকে বার বার বিনা বিচারে আটক রাখা হইয়াছিল। আমি অতিশয়ােক্তি না করিয়া বলিতে পারি যে, ভারতের কোন জাতীয় নেতা আমার মত এত বহুমুখী অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিতে পারেন নাই।
এই অভিজ্ঞতা হইতেই আমি বুঝিতেছি যে ভারতে আমরা যে চেষ্টাই করি না কেন ব্রিটিশকে আমাদের দেশ হইতে তাড়ানো শক্তই হইবে। যদি দেশের সংগ্রমের দ্বারা আমাদের জাতির স্বাধীনতা সম্ভব হইবে বলিয়া মনে করিতাম, তবে এই সঙ্কটময় দুর্গমপথে কখনই আমি পাড়ি দিতাম না। বাহির হইতে স্বদেশের সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী করাই আমার স্বদেশ ত্যাগের উদ্দেশ্য। বাহিরের এই সাহায্য ছাড়া ভারতকে স্বাধীন করা অসম্ভব। স্বদেশে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সাহায্য করা প্রয়োজন অত্যন্ত জরুরী এবং সামান্য সাহায্য হইলেই চলিবে। এক্সিস শক্তি কর্ত্তৃক ব্রিটিশের পরাজয়ে ব্রিটিশ শক্তি ও মর্য্যাদা তীব্র আঘাত পাইয়াছে বলিয়া আমাদের কাজ কিছুটা সহজ হইয়া গিয়াছে।
দেশে আমাদের স্বদেশবাসী নৈতিক ও যুদ্ধোপকরণের দ্বারাই সাহায্য চাহেন। প্রথমত তাহাদের জয় সুনিশ্চিত—এই নৈতিক বিশ্বাস সৃষ্টি করিতে হইবে। নৈতিক বিশ্বাস সৃষ্টি করিতে হইলে যুদ্ধের পরিস্থিতি বুঝিতে হইবে এবং তাহা হইতেই যুদ্ধের ফলাফল জানা যাইবে। দ্বিতীয় কাজ করিতে হইলে ভারতের বাহিরের ভারতীয়রা তাহাদের স্বদেশবাসীদিগকে কিভাবে সাহায্য করিতে পারে এবং প্রয়োজন হইলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শত্রুদের কাছ হইতেও কি সাহায্য লাভ সম্ভব, তাহা জানিতে হইবে। সমগ্র বিশ্বে আমার স্বদেশবাসীরা যে যেখানে রহিয়াছেন, তাহা তাহাদের স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণের জন্য আকুল হইয়াছেন ইহা দেখিয়া আমি অত্যন্ত প্রীত হইয়াছি। এক্সিস শক্তিরাও ভারত স্বাধীনতা লাভ করুক ইহা চাহে এবং যদি ভারতীয় জনগণ আবশ্যক বোধ করে, তবে তাহারা তাহাদের শক্তি অনুযায়ী সাহায্য করিতেও প্রস্তুত আছে, ইহা বুঝিয়াও আমি আনন্দিত হইয়াছি।
বিদেশে ভারতীয় এমন কোন নরনারী নাই যিনি ভারতের স্বাধীনতা চাহেন না এবং জাতির সংগ্রামে সাহায্য করিতে প্রস্তুত নহেন—তাঁহাদের এই মনোভাব আমি বুঝিয়াছি।
আমাকে বিশ্বাস করিতে বলি। আমার দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে আমি কিছু করিতে পারি—একথা আমার শত্রুরাও বলিবে না। যদি ব্রিটিশ সরকার আমার নৈতিক শক্তি নষ্ট করিতে না পারিয়া থাকে অথবা আমাকে প্রতারিত বা প্রলুব্ধ না করিতে সমর্থ হয়, তবে পৃথিবীর কোন শক্তি আমাকে প্রতারিত করিতে পারিবে না। সুতরাং আমাকে বিশ্বাস করুন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপনাদের সংগ্রামে যদি বাহিরের সাহায্য আপনারা চাহেন, তবে এক্সিস শক্তির সাহায্য আপনারা পাইবেন! আপনারা সাহায্য চাহেন কিম্বা চাহেন না—আপনারাই তাহা স্থির করিবেন। বলা বাহুল্য যে, যদি বাহিরের সাহায্য ব্যতীতই আপনাদের চলে তবে তাহা ভারতের পক্ষে সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা। আমি একথাও বলিতেছি, প্রবল প্রতাপাম্বিত ব্রিটিশ সরকার যদি পৃথিবীর সর্ব্বত্র এমন কি দাসত্বশৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত দরিদ্র নিপীড়িত ভারতের জনগণের নিকটও ভিক্ষার ঝুলি লইয়া বাহির হইতে পারে, তবে বাহিরের নিকট হইতে সাহায্য লইতে যদি আমরা বাধ্য হই, তবে তাহা অন্যায় হইবে না!
কিভাবে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা লাভ করিতে চাই বর্ত্তমানে তাহা আমাদের শত্রুসহ সমগ্র পৃথিবীর কাছে প্রকাশ্যে বলিবার সময় হইয়াছে। ভারতের বাহিরে ভারতীয়গণ—বিশেষভাবে পূর্ব্ব এশিয়ার ভারতীয়েরা ভারতে ব্রিটিশসৈন্য বাহিনীকে আক্রমণ করিবার জন্য এক শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করিতেছে। যখন আমরা তাহাদিগকে আক্রমণ করিব, তখন আমাদের দেশে জনগণের মধ্যেই শুধু বিপ্লব হইবে না তখন ব্রিটিশ পতাকাতলে সমবেত ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর মধ্যেও বিপ্লবের বহ্নি জ্বলিয়া উঠিবে। যখন ব্রিটীশ সরকার এইভাবে দুইদিক অর্থাৎ ভিতর ও বাহির হইতে আক্রান্ত হইবে,তখন উহা ভাঙ্গিয়া পড়িবে এবং ভারতের জনগণ পুনরায় তাহাদের স্বাধীনতা ফিরিয়া পাইবে। ভারত সম্পর্কে এক্সিস শক্তির মনােভাব লইয়া মাথা ঘামাইবার কোন প্রয়ােজন নাই। যদি বিদেশে ভারতীয়গণ এবং দেশে জনগণ তাহাদের কর্ত্তব্য পালন করে, তবে ব্রিটিশকে ভারত হইতে তাড়াইয়া দেওয়া ভারতীয় জনগণের পক্ষে সম্ভব হইবে এবং তাহাদের ৩৮ কোটী ৮০ লক্ষ স্বদেশবাসীকে মুক্ত করা সম্ভব হইবে।
এক জাতীয় জীব আছে, যাহারা বলিবে ৩৮ কোটী ৮০ লক্ষ লােক যদি ব্রিটীশ শক্তিকে ভারত হইতে তাড়াইতে না পারে তবে বিদেশস্থ ত্রিশ লক্ষ ভারতীয় কি ভাবে তাহাদিগকে তাড়াইতে পারিবে? বন্ধুগণ, আয়ার্ল্যাণ্ডের ইতিহাস দেখুন। যদি ত্রিশলক্ষ আইরিস ব্রিটীশের শৃঙ্খলে সামরিক আইনের আওতায় পাঁচ সহস্র সিনফিন স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্যে ১৯২১ সালে ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টকে নতজানু হইতে বাধ্য করিতে পারে, তবে স্বদেশে শক্তিশালী আন্দোলনে সচেতন জাতির সদিচ্ছায় পুষ্ট ত্রিশ লক্ষ ভারতীয় কেন ভারত হইতে বৃটিশকে তাড়াইতে পারিবে না?
বিদেশস্থ ভারতীয়েরা বিশেষভাবে পূর্ব্ব এশিয়ার ভারত সন্তানরা প্রাণপণ চেষ্টা করিবেন। আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কার্য্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী গবর্নমেণ্ট গঠন করা আমার অভিপ্রায়। এই গভর্ণমেণ্ট ভারতীয় জনগণের শক্তির সমাবেশ করিবেন এবং ভারতের ব্রিটীশ সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করিবেন। যখন যুদ্ধে আমরা জয়ী হইব ও ভারত স্বাধীন হইবে—এই অস্থায়ী গবর্ণমেণ্ট তখন স্বাধীন ভারতের স্থায়ী গবর্ণমেণ্টের অনুকূলে সরিয়া দাঁড়াইবে। স্থায়ী গবর্ণমেণ্ট ভারতের জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ীই গঠিত হইবে।
বন্ধুগণ! পূর্ব্ব এশিয়ায় ত্রিশ লক্ষ ভারতীয়ের অর্থ ও জনশক্তি দিয়া তাহাদের সমুদয় শক্তির সমাবেশ করিবার সময় আসিয়াছে। ভাসা ভাসা ব্যবস্থার দ্বারা কিছুই হইবেনা; আমি সমুদয় শক্তিরই সমাবেশ চাই। ইহার কমে চলিবে না, কারণ আমাদের শত্রুরাও বলিতেছে যে, ইহা সামগ্রিক যুদ্ধ।
আপনারা আপনাদের সম্মুখে ভারতীয় মুক্তিসেনা—আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর একটা অংশকে দেখিতেছেন।
সেদিন টাউনহলে এই সৈনিকেরা অনুষ্ঠানিকভাবে কুচকাওয়াজ করিয়াছে। তারপর তাহারা এই সঙ্কল্প করে যে পুরাতন দিল্লীর লাল কেল্লার সামনে বিজয়োৎসবের কুচকাওয়াজ না করা পর্য্যন্ত তাহারা বিশ্রাম গ্রহণ করিবে না। ‘দিল্লী চলো’ ‘দিল্লী চলো’—এই ধ্বনি তাহারা গ্রহণ করিয়াছে। বন্ধুগণ! পূর্ব্ব এশিয়ার ত্রিশ লক্ষ ভারতীয়ের ধ্বনি হইবে—সামগ্রিক যুদ্ধের জন্য সামগ্রিক সমাবেশ।
এই সামগ্রিক সমাবেশে আমি তিনলক্ষ সৈন্য ও তিন কোটী ডলার চাই। আমি মরণজয়ী বাহিনী গঠনের জন্য সাহসী ভারতীয় নারীদের একটা দল গঠন করিতে চাই। ১৮৫৭ সালে প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর ঝান্সীর রাণী যে প্রকার সংগ্রাম করিয়াছেন এই নারী বাহিনীও সৈই প্রকার সংগ্রাম করিবেন।
বন্ধুগণ! আমরা বহুদিন ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গনের কথা শুনিয়া আসিতেছি। কিন্তু দেশে আমাদের স্বদেশবাসীরা অত্যন্ত বিপদাপন্ন এবং তাহারা দ্বিতীয় রণাঙ্গণের দাবী করিতেছে। পূর্ব্বে ভারতে সামগ্রিক সমাবেশের ব্যবস্থা করুন, আমি দ্বিতীয় রণাঙ্গনের প্রতিশ্রুতি দিতেছি— ইহাই ভারতীয় সংগ্রামের প্রকৃত দ্বিতীয় রণাঙ্গন।