বিবিধ প্রসঙ্গ/অধিকার
অধিকার।
জনক রাজা কহিলেন এক্ষণে আমার মোহ নির্ম্মুক্ত হওয়াতে আমি নিশ্চয় বুঝিতে পারিয়াছি যে, কোন পদার্থেই আমার অধিকার নাই, অথবা আমি সমুদয় পদার্থেরই অধিকারী। আমার আত্মাও আমার নহে; অথবা সমুদয় পৃথিবীই আমার। ফলতঃ ইহলোকে সকল বস্তুতেই সকলের সমান অধিকার বিদ্যমান রহিয়াছে।”
মহাভারত। আশ্বমেধিক পর্ব্ব। অনুগীতা পর্ব্বাধ্যায়। দ্বাত্রিংশত্তম অধ্যায়। ৪৩ পৃঃ।
জনক রাজার উপরিউক্ত উক্তি লইয়া একটা তর্ক উপস্থিত হইল, নিম্নে তাহা প্রকাশ করিলাম।
আমি। যাহা কিছু আমি দেখিতে পাই, সকলি আমার।
তুমি। সে কি রকম কথা?
আমি। নহেত কি? যে গুণে তুমি একটা পদার্থকে আমার বল, সে গুণটি কি?
তুমি। অন্য সকলে যে পদার্থকে উপভোগ করিতে পায় না, অথবা আংশিক ভাবে পায়, আমিই কেবল যাহাকে সর্ব্বতোভাবে উপভোেগ করিতে পাই তাহাই আমার।
আমি। পৃথিবীতে এমন কি পদার্থ আছে, যাহাকে আমরা সর্ব্বতোভাবে উপভোগ করিতে পারি? কোনটার ঘ্রাণ, কোনটার শব্দ, কোনটার স্বাদ, কোনটার দৃশ্য কোনটার স্পর্শ আমরা ভোগ করি, অথবা একাধারে ইহাদের দুই তিনটাও ভোগ করিতে পারি। কিম্বা হয়ত ইহাদের সকলগুলিকেই এক পদার্থের মধ্যে পাইলাম, কিন্তু তবু তাহাকে সর্ব্বতোভাবে উপভোগ করিতে পারি কই? জগতে আমরা কিছুই সর্ব্বতোভাবে জানি না, একটি তৃণকেও না,—তবে সর্ব্বতোভাবে ভোগ করিব কি করিয়া? কে বলিতে পারে আমাদের যদি তার একটি ইন্দ্রিয় থাকিত তবে এই তৃণটির মধ্যে দৃষ্টি, স্বাদ, গন্ধ, স্পর্শ প্রভৃতি ব্যতীতও আরো অনেক উপভোগ্য গুণ দেখিতে না পাইতাম?
তুমি। তুমি অত সূক্ষ্মে গেলে চলিবে কেন? “সর্ব্বতভাবে উপভোগ করার’ অর্থ এই যে, মানুষের পক্ষে যতদূর সম্ভব, ততদূর উপভাগ করা।
আমি। এস্থলে তুমি উপভোগ শব্দ ব্যবহার করিয়া অতিশয় ভ্রমাত্মক কথা কহিতেছে। প্রচলিত ভাষায় স্বত্ব থাকা ও উপভোগ করা উভয়ের এক অর্থ নহে। মনে কর, এক জন হতভাগ্য নিজে ভাঙ্গা ঘরে কুশ্রী পদার্থের মধ্যে বাস করে ও গৌরাঙ্গ প্রভুদের জন্য একটি অট্টালিকা ভাল ভাল ছবি, রঙ্গীন কার্পেট ও ঝাড় লণ্ঠন দিয়া সুসজ্জিত করিয়া রাখিয়াছে, সে অট্টালিকা সে ছবি সে উপভোগ করে না বলিয়াই কি তাহা তাহার নহে?
তুমি। উপভোগ করে না বটে, কিন্তু ইচ্ছা করিলেই করিতে পারে।
আমি। সে কথা নিতান্তই ভুল, যদি সে কোন অবস্থায় ছবি উপভোগ করিতে পারিত তবে তাহা নিজের ঘরেই টাঙ্গাইত। মুর্খ একটি বই কিনিয়া কোন মতেই তাহা বুঝিতে না পারুক, তথাপি সে বইটিকে আপনার বলিতে সে ছাড়িবে না।
তুমি। আচ্ছা, উপভোগ করা চুলায় যাউক। যে বস্তুর উপর সর্ব্বসাধারণের অপেক্ষা তোমার অধিক সমতা খাটে। যে বইটিকে তুমি ইচ্ছা করিলে অবাধে পোড়াইতে পার, রাখিতে পার, দান করিতে পার, অন্যের হাত হইতে কাড়িয়া লইতে পার তাহাতেই তোমার অধিকার আছে।
আমি। তবুও কথাটা ঠিক হইল না। শারীরিক ক্ষমতাকেইত ক্ষমতা বলে না। মানসিক ক্ষমতা তদপেক্ষা উচ্চ শ্রেণীস্থ। তাহা যদি স্বীকার কর, তাহা হইলে তোমার ভ্রম সহহজেই দেখিতে পাইবে। তুমি অরসিক, তোমার বাগানের গাছ হইতে একটি গোলাব ফুল তুলিয়াছ, তোমার হাতে সেটি রহিয়াছে, আমি দূর হইতে দেখিতেছি। তুমি ইচছা করিলে সে গোলাপটি ছিঁড়িয়া কুটিকুটি করিতে পার, সে ক্ষমতা তোমার আছে, কিন্তু সে গোলাপটির সৌন্দর্য্য উপভোগ করিবার ক্ষমতা তোমার নাই, ইচ্ছা করিলে আর সব করিতে পার, কিন্তু মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে উপভোগ করিতে পার না; আর, আমি তাহাকে ছিঁড়িতে পারি না বটে, কিন্তু দূর হইতে দেখিয়া তাহার সৌন্দর্য্য উপভোগ করিতে পারি। তাহার গোলাব ছিড়িবার ক্ষমতা আছে, আমার গোলাপ উপভোগ করিবার ক্ষমতা আছে, কোন্ ক্ষমতাটি গুরুতর? তবে কেন সে তাহাকে “আমার গোলাপ” বলে, আর আমি পারি না? গোলাপ সম্বন্ধে সেটি সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ক্ষমতা, আমার তাহা আছে, তবু সে গোলাবের অধিকারী আমি নহি। এস্থলে দেখা যাইতেছে, যে বলদ চিনি বহন করিয়া থাকে, প্রচলিত ভাষায় তাহাকেই চিনির অধিকারী কহে। আর যে মানুষ ইচ্ছা করিলেই সে চিনি খাইতে পারে, সে মানুষের সে চিনিতে অধিকার নাই।
তুমি হয়ত বলিবে যাহার উপর আমাদের শারীরিক ক্ষমতা খাটে, চলিত ভাষায় তাহাকেই “আমার” কহে। তাহাও ঠিক নহে, যাহার সহিত আমার হৃদয়ে হৃদয়ে যোগ আছে। তাহাকেও ত আমি “আমার” কহি।
তুমি। আচ্ছা, আমি হার মানিলাম। কিন্তু তুমি কি সিদ্ধান্ত করিলে শুনি।
আমি। যে কোন পদার্থ আমরা দেখি, শুনি, ইন্দ্রিয় বা হৃদয় দিয়া উপলব্ধি করি, তাহাই আমাদের। তুমি যে ফুলকে “আমার” বল, তুমি তাহাকে দেখিতে পার, স্পর্শ করিতে পার, ঘ্রাণ করিতে পাও, আমি আর কিছু পাই না, কিন্তু যদি তাহাকে দেখিতে পাই, তবে সে মুহূর্ত্তেই তাহার সহিত আমার সম্বন্ধ বাধিয়া গেল, সে সম্বন্ধ হইতে কেহ আমাকে আর বঞ্চিত করিতে পারিবে না! তুমিও তাহার সব পাও নি, আমিও তাহার সব পাইনি, কারণ মানুষের পক্ষে তাহা অসম্ভব; তুমিও তাহার কিছু পাইলে, আমিও তাহার কিছু পাইলাম, অতএব তোমারও সে, আমারও সে। এই জন্যই জনক কহিয়াছিলেন, “কোন পদার্থেই আমার অধিকার নাই, অথবা সমুদয় পদার্থেই অধিকারী আমি। ফলত ইহলোকে সকল বস্তুতেই সকলের সমান অধিকার রহিয়াছে।” সন্ধ্যা বা উষাকে কেহ আমার সন্ধ্যা আমার উযা বলে না কেন? যদি বল, তাহার কারণ, তাহার সকল মানুষের পক্ষেই সমান, তাহা হইলে ভুল বলা হয়। আমি সন্ধ্যাকে তোমাদের সকলের চেয়ে অধিক উপভোগ করি, অতএব সেই উপভোগ ক্ষমতার বলে তোমাদের কাছ হইতে সন্ধ্যার দখলি-স্বত্ব কাড়িয়া লইয়া সন্ধ্যাকে বিশেষ করিয়া আমার সন্ধ্যা বলি না কেন? তাহার কারণ আমি সন্ধ্যাকে সর্বপ্রকারে অধিক উপভোগ করিতেছি বটে, কিন্তু তাই বলিয়া তোমাদের কাছ হইতে সে ত একেবারে ঢাকা পড়ে নাই। এইরূপে একটা পদার্থকে কেহ বা কিছু উপভোগ করে, কেহ বা অধিক উপভোগ করে, কিন্তু সে পদার্থটা তাহাদের উভয়েরই।