অনধিকার।

 পূর্ব্বকালে মহারাজ জনকের রাজ্যে এক ব্রাহ্মণ কোন গুরুতর অপরাধ করাতে জনকরাজ তাঁহাকে শাসন করিবার নিমিত্ত কহিয়াছিলেন, “হে ব্রাহ্মণ, আপনি আমার অধিকার মধ্যে বাস করিতে পারিবেন না।” মহাত্মা জনক এইরূপ অজ্ঞা করিলে, ব্রাহ্মণ তাঁহাকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ, কোন্ কোন্ স্থানে আপনার অধিকার আছে, আপনি তাহা নির্দ্দেশ করুন; আমি অবিলম্বেই আপনার বাক্যানুসারে সেই সমুদয় স্থান পরিত্যাগ করিয়া অন্য রাজার রাজ্যে গমন করিব।” ব্রাহ্মণ এই কথা কহিলে, মহারাজ জনক তাহা শ্রবণ করিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক মৌনভাবে চিন্তা করিতে করিতে অকস্মাৎ রাহুগ্রস্ত দিবাকরের ন্যায় মহামোহে সমাক্রান্ত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁহার মোহ অপনীত হইলে, ব্রাহ্মণকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! যদিও এই পুরুষ-পরম্পরা গত রাজ্য আমার বশীভূত রহিয়াছে, তথাপি আমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, পৃথিধীস্থ কোন পদার্থেই তমার সম্পূর্ণ অধিকার নাই। আমি প্রথমে সমুদয় পৃথিবীতে তৎপরে একমাত্র মিথিলা নগরীতে, ও পরিশেষে স্বীয় প্রজামণ্ডলী মধ্যে আপনার অধিকার অন্বেষণ করিলাম, কিন্তু কোন পদার্থেই আমার সম্পূর্ণ স্বত্ব প্রতীত হইল না।

কালীসিংহের অনুবাদিত মহাভারত। আশ্বমেধিক পর্ব্ব। অনুগীতা পর্ব্বাধ্যায়। দ্বাত্রিংশতম অধ্যায়। ৪২ পৃঃ

 জনক রাজার উক্তির তাৎপর্য্য এই যে, যাহা কিছুকে আমরা আমার বলি তাহার কিছুই আমার নয়। আমার সহিত তাহাদের ন্যূনাধিক সম্বন্ধ আছে এই পর্যন্ত, কিন্তু তাহাদের প্রতি আমার কিছু মাত্র অধিকার নাই। আমরা ষষ্ঠীকে যে, সম্বন্ধ কারক বলি, তাহা অতি যথার্থ, কিন্তু ইংরাজেরা যে তাহাকে Possesive case বলে তাহা অতি ভূল। মানুষের ব্যাকরণে সম্বন্ধ কারক আছে কিন্তু Possesive case নাই। একটি পরমাণুও আমরা সম্পূর্ণ ভোগ করিতে পারি না, সম্পূর্ণ জানিতে পারি না, ধ্বংশ করিতে পারি না, নিয়মিত কালের অধিক রাখিতে পারি না। এমন কি, আমাদের শরীর ও মনের সহিত আমাদের সম্বন্ধ আছে বটে, কিন্তু তাহাদের উপর কামদের অধিকার নাই। আমরা নিতান্ত দরিদ্র, একটি ধনীর প্রাসাদে বাস করিতেছি। তিনি আমাদিগকে তাঁহার কতকগুলি গৃহসজ্জা ব্যবহার করিতে দিয়াছেন মাত্র। একটি মন দিয়াছেন, একটি শরীর দিয়াছেন আরো কতকগুলি ব্যবহার্য্য পদার্থ দিয়াছেন। তাহার একটিকেও আমরা ভাঙ্গিতে পারি না, স্থানান্তর করিতে পারি না। যদি তাহা করিতে চেষ্টা করি, তৎক্ষণাৎ তাহার শাস্তি ভোগ করিতে হয়। যদি কখনো ভ্রমক্রমে আমরা মনে করি —আমার শরীর আমার, ও সেই মনে করিয়া, তাহার প্রতি যথেচ্ছাচার করি, তৎক্ষণাৎ রোগ আসিয়া তাহার শাস্তি দেয়। এই জন্যই আমার শরীরকে পরের শরীরের মত অতি সন্তর্পনে রাখিতে হয়, যেন কে তাহা আমার জিম্মায় রাখিয়াছে; সর্ব্বদা সশঙ্কিত, পাছে তাহাতে আঘাত লাগে, পাছে তাহাতে আঁচড় পড়ে, পাছে তাহা মলিন হয়। মনকে যদি তুমি মনে কর আমার ও তাহার প্রতি যথেচ্ছা ব্যবহার কর, তবে চিরজীবন মনের যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়, এই জন্য আমরা মনকে অতি সাবধানে রাখি, একটি কঠোর হস্ত তাহাকে ছুঁইবামাত্র আমরা সশঙ্কিত হইয়া উঠি। মন যদি আমার নয়, শরীর যদি আমার নয়, ত কে আমার?