বিবিধ প্রসঙ্গ/দয়ালু মাংসাশী
দয়ালু মাংসাশী।
বাঙ্গালীদের মাংস খাওয়ার পক্ষে অনেক গুলি যুক্তি আছে, তাহা আলোচিত হওয়া আবশ্যক। আমার বিশ্বজনীন প্রেম, সকলের প্রতি দয়া, এত প্রবল যে, আমি মাংস খাওয়া কর্ত্তব্য কাজ মনে করি। আমাদের দেশের প্রাচীন দার্শনিক বলিয়া গিয়াছেন, আমদের এই অসম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব পূর্ণ-আত্মার মধ্যে লীন করিয়া দেওয়াই সাধনার চরম ফল! পূর্ণতর জীবের মধ্যে অপূর্ণতর জীবের নির্ব্বাণ-মুক্তি প্রার্থণীয় নহে ত কি? একটা পশুর পক্ষে ইহা অপেক্ষা সৌভাগ্য আর কি হইতে পারে যে, সে মানুষ হইয়া গেল; মানুষের জীবনী-শক্তিতে অভাব পড়িলে একটা পশু তাহা পূরণ করিতে পারিল; মানুষের দেহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মিলাইয়া গিয়া মানুষের রক্ত, মাংস, অস্থি, মজ্জা, সুখ, স্বাস্থ্য, উদ্যম, তেজনির্ম্মণ করিতে পারিল, ইহা কি তাহার সাধারণ সৌভাগ্যের বিষয়! প্রথমতঃ সে নিজে স্বপ্নের অগোচর সম্পূর্ণতা লাভ করিল, দ্বিতীয়তঃ মানুষের মত একটা, উন্নত জীবকে সম্পূর্ণতর করিল। ছাগলদের মধ্যে এমন দার্শনিক কি আজ পর্যন্ত কেহ জন্মায় নাই, যে তাহার লম্বা দাড়ি নাড়িয়া সমবেত শিষ্য-শিশুবর্গকে এই নির্ব্বাণ-মুক্তির সম্বন্ধে ভ্যাকরণ-শুদ্ধ উপদেশ দেয়! আহা, যদি কেহ এমন ছাগ-হিতৈষী জন্মিয়া থাকে, তবে তাহার নিকট আমার ঠিকানাটা পাঠাইয়া দিই, এবং সেই সঙ্গে লিখিয়া দিই যে, জ্ঞানালোকিত ইয়ং-ছাগদের মধ্যে যাঁহার মুক্তিকামনা আছে, তিনি উক্ত ঠিকানায় আগমন করিলে সদয়-হৃদয় উপস্থিত লেখক মহাশয় তাঁহাকে মুক্তি দান পূর্ব্বক বাধিত করিতে প্রস্তুত আছেন। যাহা হউক, পশুদের উপকার করিবার জন্য ব্যয়সাধ্য হইলেও দয়ার্দ্রচিত্ত লোকদের মাংস খাওয়া কর্ত্তব্য। আমাদের দেশে এমন অনেক পণ্ডিত আছেন, যাঁহাদের মত এই যে, ভারতবর্ষীয়েরা ইংরাজত্ব অর্থাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়া যদি ইংরাজদের মধ্যে একেবারে লীন হইয়া যাইতে পারে, তবে সুখের বিষয় হয়।
বিখ্যাত ইংরাজ কবি বলিয়াছেন, যে, আমরা বোকা জানোয়ারের মাংস খাই, যেমন ছাগল, ভেড়া, গরু। অধিক উদাহরণের অবশ্যক নাই-মুসলমানেরা আমাদের খাইয়াছেন, ইংরাজের আমাদের খাইতেছেন। যদি প্রমাণ হইল যে, আমরা বোকা জানোয়ারের মাংস খাইয়া থাকি, তবে দেখা যাক্, বোকা জানোয়ারের। কি খায়। তাহারা উদ্ভিজ্জ খায়। অতএব উদ্ভিজ্জ যাহারা খায় তাহারা বোকা। এমন দ্রব্য খাইবার আবশ্যক? নির্ব্বোধদের আমরা, গাধা, গরু, মেড়া, হস্তিমূর্খ কহিয়া থাকি। কখনো বিড়াল, ভল্লুক, সিংহ, বা ব্যাঘ্র মূর্খ বলি না। উদ্ভিজ্জ-ভোজীদের এমন নাম খারাপ হইয়া গিয়াছে, যে, বুদ্ধির যথেষ্ট লক্ষণ প্রকাশ করিলেও তাহাদের দুর্ণাম ঘুচে না। নহিলে “বাঁদর” বলিয়া সম্ভাষণ করিলে লোকে কেন মনে করে, তাহাকে নির্ব্বোধ বলা হইল? পশুদের মধ্যে বানরের বুদ্ধির প্রভাব বিশেষ লক্ষিত হয় নাই, তাহার একমাত্র অপরাধ সে বেচারী উদ্ভিদভোজী। অতএব অনর্থক এমন একটা দুর্ণাম-ভাজন হইয়া থাকিবার ভাবশ্যক কি? আর একটা কথা;—উদ্ভিদ-ভোজী ভারতবর্ষকে ইংরাজ-শ্বাপদের দিব্য হজম করিতে পারিয়াছেন; কিন্তু পাকযন্ত্রের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থাকাতে মাংসাশী কান্দাহার গ্রাস করিলেন, ভাল হজম হইল না; পেটের মধ্যে বিষম গোলযোগ বাধাইয়া দিল। মাংসাশী জুলুভূমি ও ট্রান্সবাল পেটে মূলেই সহিল না, আহার করিতে চেষ্টা করিতে গিয়া মাঝের হইতে বলহানী হইল, রোগ হইবার উপক্রম হইল। অতএব মাংসাশী প্রাণীর লোভ এড়াইতে যদি ইচ্ছা থাকে, তবে মাংসাশী হওয়া আবশ্যক। নহিলে আত্মত্ব বিসর্জ্জন করিয়া পরের দেহের রক্ত নির্ম্মাণ করাই আমাদের চরম সিদ্ধি হইবে। মাংস খাইবার এক আপত্তি আছে যে, শাস্ত্রে মাংসকে অপবিত্র বলে। কিন্তু সে কোন কাজের কথাই নহে। শাস্ত্রেই আছে, মেদিনী মাংসেই নির্ম্মিত। আমরা মাংসের উপরেই বাস করি। এ মাংসের পৃথিবীতে মাংসেই জয়।