বিবিধ প্রসঙ্গ/খাঁটি বিনয়
খাঁটি বিনয়।
ভলি জহরী নহিলে খাঁটি বিনয় চিনিতে পারে না। একদল অহঙ্কারী আছে তাহারা অহঙ্গার করা আবশ্যক বিবেচনা করে না। তাহাদের বিস্তৃত জমিদারী, বিস্তর লোকের নিকট হইতে যশের খাজনা আদায় হয়, এই নিমিত্ত তাহাদের বিনয় করিবার উপযুক্ত সম্বল আছে। তাহারা সখ্ করিয়া বিনয় করিয়া থাকে। বাহিরে না কি জমিজমা যথেষ্ট আছে এই জন্য বাড়ির সমুখে একখানা বিনয়ের বাগান করিয়া রাখে। যে বেচারীর জমিদারী নাই, আধ পয়সা খাজনা মিলে না, সে ব্যক্তি পেটের দায়ে নিজের বাড়ির উঠানে, “অহং”-এর বাস্তু ভিটার উপরে অহঙ্কারের চাষ করিয়া থাকে, তাহার আর সখ্ করিবার জায়গা নাই। নিজমুখে অহঙ্কার করিলে যে দারিদ্র্য প্রকাশ পায়, সে দারিদ্র্য ঢাকিতে পরে এত বড় অহঙ্কার ইহাদের নাই। যাহা হউক, ইহাদের মধ্যে এক দল সখ করিয়া বিনয়ী, আর এক দল দায়ে পড়িয়া অহঙ্কারী; উভয়ের মধ্যে প্রভেদ সামান্য।
নিজের গুণহীনতার বিষয়ে অনভিজ্ঞ এমন নির্গুণ শতকরা নিরেনব্বই জন, কিন্তু নিজের গুণ একেবারে জানে না, এমন গুণী কোথায়? তবে, চব্বিশ ঘণ্টা নিজের গুণগুলি চোখের সাম্নে খাড়া করিয়া রাখে না এমন বিনয়ী সংসারে মেলে। অতএব কে বিনয়ী? না, যে আপনাকে ভুলিয়া থাকে, যে আপনাকে জানে না তাহার কথা হইতেছে না।
বড় মানুষ গৃহকর্ত্তা নিমন্ত্রিতদিগকে বলেন, “মহাশয়, দরিদ্রের কুটীরে পদার্পণ করিয়াছেন; আপনাদিগকে আজ বড় কষ্ট দেওয়া হইল” ইত্যাদি। সকলে বলে, “আহা মাটির মানুষ।” কিন্তু ইহারা কি সামান্য অহঙ্কারী! অপ্রস্তুত হইলে লোকে যে কারণে কাঁদে না, হাসে; ইহারও সেই কারণে বিনয় বাক্য বলিয়া থাকে। ইহারা কোন মতেই ভুলিতে পারে না, যে, ইহাদের বাসস্থান প্রাসাদ; কুটীর নহে। এ অহঙ্কার সর্ব্বদাই ইহাদের মনে জাগরুক থাকে। এই নিমিত্ত ইহাদিগকে সারাক্ষণ শশব্যস্ত হইয়া থাকিতে হয়, পাছে বিনয়ের অভাব প্রকাশ পায়। অভ্যাগত হাসিলেই তাড়াতাড়ি ডাকিয়া বলিতে হয়, মহাশয়, এ কুটীর, প্রাসাদ নহে। তেমন বৃষ যদি কেহ থাকে তবে এই অহঙ্কারী মশাদের বলে, বাপুহে, তুমি যে এতক্ষণ আমার শিঙ্গে বসিয়াছিলে, তাহা আমি মুলে জানিতেই পারি নাই, ভোঁ ভোঁ করিতে আসিয়াছ বলিয়া এতক্ষণে টের পাইলাম। তোমার এ বাড়িটা প্রাসাদ কি কুটীর, সে বিষয়ে আমি মুহুর্ত্তের জন্য ভাবিও নাই, আমার নজরেই পড়ে নাই, অতএব ও কথা তুলিবর আবশ্যক কি? আমাদের দেশে উক্ত প্রকার অহঙ্কারী বিনয়ের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব। সুকণ্ঠ বলেন “আমার গলা নাই,” সুলেখক বলেন “আমি ছাই ভষ্ম লিখি,” সুরূপসী বলেন “এ পোড়ামুখ লোকের কাছে দেখাইতে লজ্জা করে!” এ ভাবটা দূর হইলেই ভাল হয়। ইহাতে না অহঙ্কার ঢাকা পড়ে, না সরলতা প্রকাশ হয়। আর এই সামান্য উপায়েই যদি বিনয় করা যাইতে পারে, তবে ত বিনয় খুব শস্তা!
আসল কথা এই যে, “বিনয় বচন” বলিয়া একটা পদার্থ মুলেই নাই। বিনয়ের মুখে কথা নাই, বিনয়ের অর্থ চুপ করিয়া থাকা। বিনয় একটা অভাবাত্মক গুণ। আমার যে অহঙ্কারের বিষয় আছে এইটে না মনে থাকাই বিনয়, আমাকে যে বিনয় প্রকাশ করিতে হইবে, এইটে মনে থাকার নাম বিনয় নহে। যে বলে আমি দরিদ্র, সে বিনয়ী নহে; যে স্বভাবতই প্রকাশ করে না যে, আমি ধনী, সেই বিনয়ী। যাহার বিনয়-বাক্য বলিবার আবশ্যক পড়ে না সেই বিনয়ী। তবে কি না, বিদেশী ভাষা শিখতে হইলে, ব্যাকরণ পড়িতে হয়, অভিধান মুখস্থ করিতে হয়; বিনয় যাহাদের পক্ষে বিদেশী তাহাদিগকে বিনয়ের অভিধান মুখস্থ করিতে হয়। কিন্তু এই প্রকার মুখস্থ বিনয় সংসারের এক্জামিন পাশ করিতেই কাজে দেখে, পরীক্ষাশালার বাহিরে কোন কাজে লাগে না।