বিবিধ প্রসঙ্গ/ছোট ভাব
ছোট ভাব।
বর্ত্তমান সভ্যতার প্রাণপণ চেষ্টা এই যে, কিছুই ফেলা না যায়, সকলই কাজে লাগে। মনোবিজ্ঞান একটা ক্ষুদ্র বালকের একটা বদ্ধ পাগলের প্রত্যেক ক্ষুদ্রতম চিন্তা, খেয়াল, মনোভাব সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া দেয়, কাজে লাগিবে। সমাজ বিজ্ঞান, শিশু সমাজের, অসভ্য সমাজের প্রত্যেক ক্ষুদ্র অনুষ্ঠান, অর্থহীন প্রথা, পুঁথিতে জমা করিয়া রাখিতেছে, কাজে লাগিবে। এখনকার কবিরাও এমন সকল ক্ষুদ্র যৎসামান্য বিষয়গুলিকে কবিতায় পরিণত করেন, যাহা প্রাচীন লােকেরা গদ্যেরও অনুপযুক্ত মনে করিতেন। এখনকার শিল্পেও যাহা সাধারণ লােকে অনাবশ্যক, পুরাণ, গলিত বলিয়া ফেলিয়া দেয়, তাহাও একটা না একটা কাজে খাটিয়া যাইতেছে।
আমরা যখন, বেড়াইতেছি, শুইয়া আছি, আহার করিতেছি, সংসারের ছােটখাট খুঁটিনাটি কাজ সমাধা করিতেছি, তখন আমাদের মনের মধ্যে কত শত খুচরা বাজে ভাব আনাগোনা করিতে থাকে, সে গুলিকে আমরা নিতান্ত অনাবশ্যক বলিয়া আবর্জ্জনা মনে করিয়া ফেলিয়া দিই। খুব একটা দীর্ঘপ্রস্থ ভাব নহিলে আমরা তাহার উপরে হস্তক্ষেপ করি না। আমরা আমাদের মনের মধ্যে যে জাল পাতিয়া রাখি, তাহা. বড় মাছ ধরিবার জাল; ছোট ছোট মাছেরা তাহার ছিদ্রের মধ্য দিয়া গলিয়া পালাইয়া যায়। কিন্তু এমনতর অমনোযোগিতা এ কালের রীতিবহির্ভূত। ঐ ছোট ভাব ধরিয়া জিয়াইয়া রাখিলে কত বড় হইত কে বলিতে পারে। একবার হাতছাড়া হইলে বড় হইয়া আবার যে তোমাকে ধরা দিবে তাহার সম্ভাবনা নিতান্ত অল্প। তাহা ছাড়া, আয়তন লইয়া আবশ্যক স্থির করে বালকেরা। সমাজের যতই বয়স বাড়িতেছে, ততই এ বিষয়ে তাহার উন্নতি দেখা যাইতেছে। আমার একটি বন্ধু আছেন, তিনি অতি সাবধানে তাঁহার মনের দ্বার আগলাইয়া বসিয়া আছেন, যখনি ভাব আসে, তখনি পাক্ড়া করেন, তাহাকে নাড়াচাড়া করিয়া দেখেন; ভাবিতে থাকেন, ইহাকে কোন প্রকারে মাজিয়া ঘষিয়া ছঁটিয়া বাড়াইয়া কমাইয়া অক্ষরে লিখিবার উপযোগী করিতে পারি কি না। এই উপায়ে ইহাঁর এমনি হাত পাকিয়া গিয়াছে, যে, তুমি যে ভাব ব্যবহার করিয়া বা ব্যবহারের অযোগ্য বিবেচনা করিয়া রাস্তায় ফেলিয়া দেও, তাহাই লইয়া দুই দণ্ডের মধ্যে ইনি ব্যবহারের জিনিষ বা ঘর সাজাইবার খেলেনা গড়িয়া দিতে পারেন। লোকের অব্যবহার্য ভাঙ্গাকাঁচের টুকরা কুড়াইয়া কারীগরেরা ফানুষ গড়ে; ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া লইয়া কাগজ গড়ে। আমার বন্ধুর প্রবন্ধগুলি সেইরূপ। তাহাদের মূল উপকরণ অনুসন্ধান করিতে যাও, দেখিবে ভাবের আবর্জ্জনা, ছিন্ন টুকুরা, অব্যবহার্য্য চিন্তাখণ্ড লইয়া সমস্ত গড়িয়াছেন।
সকলের প্রতি আমার পরামর্শ এই যে, কোন ভাব বিবেচনা না করিয়া যেন ফেলা না যায়। অনবরত এইটে যেন মনে করেন, এ ভাবটাকে কোন প্রকারে লিখিয়া ফেলিতে পারি কি না। যাহা কিছু মনে আসে, সমস্ত ভাব লিখিয়া রাখা তাহার কর্ত্তব্য কর্ম্ম। অতএব অবিরত যেন, হাতুড়ি, বাটালি, পালিষ করিবার যন্ত্রাদি হাতের কাছে মজুত থাকে। ইহা নিঃসন্দেহ যে, আমাদের মনে যত প্রকার ভাব উঠে, সকল গুলিই লিখিবার উপযুক্ত। কিন্তু অতবড় লেখক হইবার উপযুক্ত প্রতিভা আমাদের নাই। বড় বড় কবিদিগের লেখা দেখিয়া আমরা অধিকাংশ সময়ে এই বলিয়া আশ্চর্য্য হই যে, “এ ভাবটা আমার মনে কত শতবার উদয় হইয়াছিল, কিন্তু আমিত স্বপ্নেও মনে করি নাই, এ ভাবটাও আবার এমন চমৎকার করিয়া লেখা যায়!” অনেকের মনে ভাব আছে, অথচ ভাব ধরা দেয় না, ভাব পোষ মানে না; ভাবের ভাব বুঝিতে পারা যায় না। আইস, আমরা অনবরত বুঝিতে চেষ্টা করি। মনোরাজ্যে এমন একটা বন্দোবস্ত করিয়া লই যে, বাজে খরচ না হয়। কাহারো কি আশ্চর্য্য মনে হয় না যে কেবল মাত্র বেবন্দোবস্তের দরুণ প্রত্যহ কত হাজার হাজার ভাব নিস্ফল খরচ হইয়া যাইতেছে। তাহার হিসাব পর্যন্ত রাখ। হইতেছে না! এক জন লেখক ও এক জন অলেখকের মধ্যে শুদ্ধ কেবল এই বন্দোবস্তের প্রভেদ লইয়া প্রভেদ। একজন তাঁহার ভাব খাটাইয়া কারবার করেন, আর এক ব্যক্তির এই ভাবের টাকাকড়ির বিষয়ে এমনি গোলমেলে মাথা, যে, কোন্ দিক্ দিয়া যে সমস্ত খরচ হইয়া যায়, উড়িয়া যায়, তাহার ঠিকানা করিতে পারেন না।