বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)/মিস্‌মিদের কবচ/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ


 সেদিনই আমার সঙ্গে গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে শ্রীগোপালের দেখা হোলো। সে তার পিতার দাহকার্য্য শেষ ক’রে ফিরে আসছে কাছাগলায়।

 আমি তাকে আড়ালে ডেকে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিলাম। শ্রীগোপালের চোখ দিয়ে দর্‌দর্ করে জল পড়তে লাগলো। সে আমাকে সব-রকমের সাহায্য করবে প্রতিশ্রুতি দিলে।

 আমি বল্লাম—কারো ওপর আপনার সন্দেহ হয়?

 —কার কথা বলব বলুন। বাবার একটা দোষ ছিল, টাকার কথা জাহির ক’রে বেড়াতেন সবার কাছে। কত জায়গায় এ-সব কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে কে এ-কাজ করলে কি ক’রে বলি?

 —আচ্ছা, কথা একটা জিগ্যেস করবো—কিছু মনে করবেন না। আপনার বাবার কত টাকা ছিল জানেন?

 —বাবা কখনো আমাদের বলতেন না। তবে, আন্দাজ, দু’হাজারের বেশি নগদ টাকা ছিল না।

 —সে টাকা কোথায় থাকতো?

 —সেটা জানতাম। ঘরের মেজেতে বাবা পুঁতে রাখতেন—কতবার বলেছি, টাকা ব্যাঙ্কে রাখুন। সেকেলে লোক, ব্যাঙ্ক বুঝতেন না।

 —গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর পর বাড়ী এসে আপনি মেজে খুঁড়ে কিছু পেয়েছিলেন?

 —মেজে তো খুঁড়ে রেখেছিল যারা খুন করেচে তারাই। আমি এক পয়সাও পাই নি—তবে একটা কথা বলি—দু’হাজার টাকার সব টাকাই তো মেঝেতে পোঁতা ছিল না—বাবা টাকা ধার দিতেন কিনা! কিছু টাকা লোকজনকে ধার দেওয়া ছিল।

 —কত টাকা আন্দাজ?

 —সেদিক থেকেও মজা শুনুন, বাবার খাতাপত্র সব ওই সঙ্গে চুরি হয়ে গিয়েচে। খাতা না দেখলে বলা যাবে না কত টাকা ধার দেওয়া ছিল।

 —খাতাপত্র নিজেই লিখতেন?

 —তার মধ্যেও গোলমাল আছে। আগে নিজেই লিখতেন, ইদানীং চোখে দেখতে পেতেন না বলে একে-ওকে ধ’রে লিখিয়ে নিতেন।

 —কাকে-কাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতেন জানেন?

 —বেশির ভাগ লেখাতেন সদ্‌গোপ-বাড়ীর ননী ঘোষকে দিয়ে। সে জমিদারী-সেরেস্তায় কাজ করে—তার হাতের লেখাও ভালো। বাবার কথা সে খুব শুনতো।

 —ননী ঘোষের বয়েস কত?

 —ত্রিশ-বত্রিশ হবে।

 —ননী ঘোষ লোক কেমন? তার ওপর সন্দেহ হয়।

 —মুশ্‌কিল হয়েচে, বাবা তো একজনকে দিয়ে লেখাতেন না! যখন যাকে পেতেন, তখন তাকেই ধ’রে লিখিয়ে নিতেন যে! স্কুলের ছেলে গণেশ ব’লে আছে, ওই মুখুজ্যে বাড়ি থেকে পড়ে—তাকেও দেখি একদিন ডেকে এনেচেন। শুধু ননী ঘোষের ওপর সন্দেহ ক’রে কি করবো?

 —আর কাকে দেখেচেন?

 —আর মনে হচ্চে না।

 —আপনি হিসাবের খাতা দেখে ব’লে দিতে পারেন, কোন্ হাতের লেখা কার?

 —ননীর হাতের লেখা আমি চিনি। তার হাতের লেখা বলতে পারি—কিন্তু সে খাতাই-বা কোথায়? খুনেরা সে খাতা তো নিয়ে গিয়েচে!

 —কাকে বেশী টাকা ধার দেওয়া ছিল, জানেন?

 —কাউকে বেশী টাকা দিতেন না বাবা। দশ, পাঁচ, কুড়ি—বড়জোর ত্রিশের বেশি টাকা একজনকেও তিনি দিতেন না।


 শ্যামপুরের জমিদার-বাড়ি সেবেলা খাওয়া-দাওয়া করলাম।

 একটা বড় চত্বর, তার চারিধারে নারিকেল গাছের সারি, জামরুল গাছ, বোম্বাই-আমের গাছ, আতা-গাছ। বেশ ছায়াভরা উপবন যেন। ডিটেক্‌টিভগিরি ক’রে হয়তো ভবিষ্যতে খাবো—তা ব’লে প্রকৃতির শোভা যখন মন হরণ করে—এমন মেঘমেদুর বর্ষা-দিনে গাছপালার শ্যামশোভা উপভোগ করতে ছাড়ি কেন?

 বসলুম এসে চত্বরের একপাশে নির্জন গাছের তলায়।

 ব’সে-ব’সে ভাবতে লাগলুম:

 …কি করা যায় এখন? মামা বড় কঠিন পরীক্ষা আমার সামনে এনে ফেলেচেন?

 মিঃ সোমের উপযুক্ত ছাত্র কি-না আমি, এবার তা প্রমাণ করার দিন এসেচে।

 কিন্তু ব’সে-ব’সে মিঃ সোমের কাছে যতগুলি প্রণালী শিখেচি খুনের কিনারা করবার—সবগুলি পাশ্চাত্ত্য-বৈজ্ঞানিক-প্রণালী—স্কটল্যাণ্ড-ইয়ার্ডের ডিটেক্‌টিভের প্রণালী। এখানে তার কোনটিই খাটবে না। আঙুলের ছাপ নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি করা হয় নি—সাত-আটদিন পরে এখন জিনিসপত্রের গায়ে খুনীর আঙুলের ছাপ অস্পষ্ট হয়ে গিয়েচে।

 পায়ের দাগ সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা।

 খুন হবার পর এত লোক গাঙ্গুলিমশায়ের ঘরে ঢুকেচে—তাদের সকলের পায়ের দাগের সঙ্গে খুনীর পায়ের দাগ একাকার হয়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েচে। গ্রামের কৌতূহলী লোকেরা আমায় কি বিপদেই ফেলেচে! তারা জানে না, একজন শিক্ষানবিশ-ডিটেক্‌টিভের কি সর্ব্বনাশ তারা করেচে!

 আর-একটা ব্যাপার, খুনটা টাটকা নয়, সাতদিন আগে খুন হয়ে লাশ পর্য্যন্ত দাহ শেষ—সব ফিনিশ্—গোলমাল চুকে গিয়েচে।

 চোখে দেখি নি পর্য্যন্ত সেটা—অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন-টিহ্নগুলো দেখলেও তো যা হয় একটা ধারণা করা যেত। এ একেবারে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া! ভীষণ সমস্যা!

 মিঃ সোমকে কি একখানা চিঠি লিখে তাঁর পরামর্শ চেয়ে পাঠাবো? এমন অবস্থায় পড়লে তিনি নিজে কি করতেন জানাতে বলবো?

 কিন্তু তাও তো উচিত নয়!

 মামা যখন বলেচেন, এটা যদি আমার পরীক্ষা হয়, তবে পরীক্ষার হলে যেমন ছেলেরা কাউকে কিছু জিগ্যেস ক’রে নেয় না—আমায় তাই করতে হবে।

 যদি এর কিনারা করতে পারি, তবে মামা বলেচেন, আমাকে এ-লাইনে রাখবেন—নয়তো মিঃ সোমের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেবেন, নিয়ে হয়তো কোনো আর্টিস্টের কাছে রেখে ছবি আঁকতে শেখাবেন, বা, বড় দরজির কাছে রেখে শার্ট তৈরী, পাঞ্জাবী তৈরী শেখাবেন।

 তবে শিক্ষানবিশের প্রথম পরীক্ষা-হিসেবে পরীক্ষা যে বেশ কঠিন, এতে কোন ভুল নেই।…

 —ব’সে-ব’সে আরও অনেক কথা ভাবলুম:

 …হিসেবের খাতা যে লিখতো, সে নিশ্চয়ই জানতো ঘরে কত টাকা মজুত, বাইরে কত টাকা ছড়ানো। তার পক্ষে জিনিসটা জানা যত সহজ, অপরের পক্ষে তত সহজ নয়।

 এ-বিষয়েও একটা গোলমাল আছে। গাঙ্গুলিমশায় টাকার গর্ব্ব মুখে ক’রে বেড়াতেন যেখানে-সেখানে। কত লোক শুনেচে—কত লোক হয়তো জানতো।

 একটা কথা আমার হঠাৎ মনে এল।

 কিন্তু, কাকে কথাটা জিগ্যেস করি?

 ননী ঘোষের বাড়ি গিয়ে ননী ঘোষের সঙ্গে দেখা করা একবার বিশেষ দরকার। তাকেই এ-কথা জিগ্যেস করতে হবে। সে নাও বলতে পারে অবিশ্যি—তবুও একবার জিগ্যেস করতে দোষ নেই।…

 ননী ঘোষ বাড়িতেই ছিল। আমায় সে চেনে না, একটু তাচ্ছিল্য ও ব্যস্ততার সঙ্গে বললে—কি দরকার বাবু? বাড়ী কোথায় আপনার?

 আমি বললাম—তোমার সঙ্গে দরকারী কথা আছে। ঠিক উত্তর দাও। মিথ্যে বল্লে বিপদে পড়ে যাবে।

 ননীর মুখ শুকিয়ে গেল। দেখলাম সে ভয় পেয়েচে। বুঝেচে যে, আমি গাঙ্গুলিমশায়ের খুন-সম্পর্কে তদন্ত করতে এসেছি—নিশ্চয়ই পুলিসের সাদা পোশাক-পরা ডিটেক্‌টিভ।

 সে এবার বিনয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললে—বাবু, যা জিগ্যেস করেন, করুন।

 —গাঙ্গুলিমশায়ের খাতা তুমি লিখতে?

 ননী ইতস্তত করে বললে—তা ইয়ে—আমিও লিখিচি দু’ একদিন—আর ওই গণেশ ব’লে একটা স্কুলের ছেলে আছে, তাকে দিয়েও—

 আমি ধমক দিয়ে বললাম—স্কুলের ছেলের কথা হচ্ছে না—তুমি লিখতে কিনা?

 ননী ভয়ে-ভয়ে বললে—আজ্ঞে, তা লেখতাম।

 —কতদিন লিখচো? মিথ্যে কথা বললেই ধরা পড়ে যাবে। ঠিক বলবে।

 —প্রায়ই লেখতাম। দু’বছর ধরে লিখচি।

 —আর কে লিখতো?

 —ওই যে স্কুলের ছেলে গণেশ—

 —তার কথা ছেড়ে দাও, তার বয়েস কত?

 —পনের-ষোলো হবে।

 —আর কে লিখতো?

 —আর, সরফরাজ তরফদার লিখতো, সে এখন—

 —সরফরাজ তরফদারের বয়েস কত? কি করে?

 —সে এখন মারা গিয়েছে।

 —বাদ দাও সে-কথা। কতদিন মারা গিয়েচে?

 —দু’বছর হবে।

 —এইবার একটা কথা জিগ্যেস করি—গাঙ্গুলিমশায়ের কত টাকা বাইরে ছিল জানো?

 —প্রায় দু’হাজার টাকা।

 —মিথ্যে বোলো না। খাতা পুলিসের হাতে পড়েচে—মিথ্যে বললে মারা যাবে।

 —না বাবু, মিথ্যে বলিনি। দু’হাজার হবে।

 —ঘরে মজুত কত ছিল?

 —তা জানিনে!

 —আবার বাজে কথা? ঠিক বলো।

 —বাবু, আমায় মেরেই ফেলুন আর যাই করুন—মজুত টাকা কত তা আমি কি ক’রে বলবো? গাঙ্গুলিমশায় আমায় সে টাকা দেখায় নি তো? খাতায় মজুত-তবিল লেখা থাকতো না।

 —একটা আন্দাজ তো আছে? আন্দাজ কি ছিল ব’লে তোমার মনে হয়?

 —আন্দাজ আর সাত-আট-শো টাকা।

 —কি ক’রে আন্দাজ করলে?

 —ওঁর মুখের কথা থেকে তাই আন্দাজ হোতো।

 —গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর কতদিন আগে তুমি শেষ খাতা লিখেছিলে?

 —প্রায় দু’মাস আগে। দু’মাসের মধ্যে আমি খাতা লিখিনি—আপনার পায়ে হাত দিয়ে বলচি। তাছাড়া খাতা বেরুলে হাতের লেখা দেখেই তা আপনি বুঝবেন।

 —কোনো মোটা টাকা কি তাঁর মরণের আগে কোনো খাতকে শোধ করেছিল ব’লে তুমি মনে কর?

 —না বাবু! ঊর্দ্ধ্বসংখ্যা ত্রিশ টাকার বেশি তিনি কাউকে ধার দিতেন না, সেটা খুব ভালো করেই জানি। মোটা টাকা মানে, দু’শো একশো টাকা কাউকে তিনি কখনো দেননি।

 —এমন তো হতে পারে, পাঁচজন খাতকে ত্রিশ টাকা ক’রে শোধ দিয়ে গেল একদিনে? দেড়শো টাকা হোলো?

 —তা হতে পারে বাবু, কিন্তু তা সম্ভব নয়। একদিনে পাঁচজন খাতকে টাকা শোধ দেবে না। আর-একটা কথা বাবু। চাষী-খাতক সব—ভাদ্রমাসে ধান হবার সময় নয়—এখন যে চাষী-প্রজারা টাকা শোধ দিয়ে যাবে, তা মনে হয় না। ওরা শোধ দেয় পৌষ মাসে—আবার ধার নেয় ধান-পাট বুনবার সময়ে চৈত্র-বৈশাখ মাসে। এ-সময় লেন-দেন বন্ধ থাকে।