বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)/মিস্মিদের কবচ/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পরদিন থানায় গিয়ে দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা ক’রে আমার পরিচয় দিলাম।
তিনি আমায় সমাদর ক’রে বসালেন—আমায় বল্লেন, তাঁর দ্বারা যতদূর সাহায্য হওয়া সম্ভব, তা তিনি করবেন।
আমি বল্লাম—আপনি এ-সম্বন্ধে কিছু তদন্ত করেচেন?
—তদন্ত করা শেষ করেচি। তবে, আসামী বার-করা ডিটেকটিভ ভিন্ন সম্ভব নয় এক্ষেত্রে!
—ননী ঘোষকে আমার সন্দেহ হয়।
—আমারও হয়, কিন্তু ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ হবে না।
—ওকে চালান দিন না, ভয় খেয়ে যাক্! খুনের রাত্রে ও অনুপস্থিত ছিল। কোথায় ছিল তার সন্তোষজনক প্রমাণ দিতে পারে নি।
—আপনি ওকে চালান দিতে পরামর্শ দেন?
—দিলে ভালো হয়। এর মধ্যে আর-একটা উদ্দেশ্য আছে—বুঝেচেন নিশ্চয়ই।
দারোগাবাবু হেসে বল্লেন—এতদিন পুলিসের চাকরি ক’রে তা আর বুঝিনি মশায়? ওকে চালান দিলে সত্যিকার হত্যাকারী কিছু অসতর্ক হয়ে পড়বে এবং যদি গা-ঢাকা দিয়ে থাকে, তবে বেরিয়ে আসবে—এই তো?
—ঠিক তাই—যদিও ননী ঘোষকে আমি বেশ সন্দেহ করি। লোকটা ধূর্ত-প্রকৃতির।
—কাল আমি লোকজন নিয়ে গ্রামে গিয়ে ডেকে বলবো—ননীকে কালই চালান দেবো।
—চালান দেওয়ার সময় গ্রামের সব লোকের সেখানে উপস্থিত থাকা দরকার।
দারোগাবাবু বল্লেন—দাঁড়ান, একটা কথা আছে। হিসেবের খাতার একখানা পাতা সেদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম গাঙ্গুলিমশায়ের ঘরে। পাতাখানা একবার দেখুন।
একখানা হাতচিঠে-কাগজের পাতা নিয়ে এসে দারোগাবাবু আমার হাতে দিলেন।
আমি হাতে নিয়ে বললাম—এ তো ননীর হাতের লেখা নয়!
—না, এ গণেশের হাতের লেখাও নয়।
—সরফরাজ তরফদারও নয়। কারণ, সে মারা যাওয়ার পরে লেখা। তারিখ দেখুন।
—তবে, খুনের অনেকদিন আগে এ লেখা হয়েচে—চার মাসেরও বেশী আগে।
—ব্যাপারটা ক্রমশঃ জটিল হয়ে পড়চে মশায়। আমি একটা জিনিস আপনাকে তবে দেখাই।
দারোগাবাবুর হাতে কাঠের পাতটা দিয়ে বল্লাম—এ জিনিসটা দেখুন।
দারোগাবাবু সেটা হাতে নিয়ে বল্লেন—কি এটা?
—কি জিনিসটা তা ঠিক বলতে পারবো না। তবে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ীর পেছনের জঙ্গলে এটা কুড়িয়ে পেয়েচি। আর-একটা জিনিস দেখুন।
ব’লে সেওড়াডালের গোড়াটা তাঁর হাতে দিতেই তিনি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে বল্লেন—এ তো একটা শুকনো গাছের ডাল—এতে কি হবে?
—ওতেই একটা মস্ত সন্ধান দিয়েচে। জানেন? যে খুন করেচে, সে ভোর রাত পর্য্যন্ত গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ী ছাড়ে নি। ভোরের দিকে রাত পোহাতে দেরি নেই দেখে সরে পড়েচে। যাবার সময় অভ্যাসের বশে সেওড়াডালের দাঁতন করেচে।
দারোগামশায় হো-হো ক’রে হেসে উঠে বল্লেন—আপনারা যে দেখচি মশায়, স্বপ্নরাজ্যে বাস করেন! এত কল্পনা ক’রে পুলিসের কাজ চলে? কোথায় একটা দাঁতনকাঠির ভাঙা গোড়া!
—আমি জানি আমার গুরু মিঃ সোম একবার একটা ভাঙা দেশলাইয়ের কাঠিকে সূত্র ধ’রে আসামী পাক্ড়েছিলেন।
দারোগাবাবু হাসতে-হাসতে বল্লেন—বেশ, আপনিও ধরুন না দাঁতনকাঠি থেকে, আমার আপত্তি কি?
—যদি আমি এটাকে এত প্রয়োজনীয় মনে না করতাম, তবে এটা এতদিন সঙ্গে নিয়ে বেড়াই? যে দুটো জিনিস পেয়েচি, তাদের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ আছে—এও আমার বিশ্বাস।
—কি রকম?
—যে দাঁতনকাঠি ভেঙেচে—তার বা তাদের দলের লোকের এই কাঠের পাতখানাও!
—পাতখানা কি?
—সে-কথা পরে বলবো। আর-একটা সন্ধান দিয়েছে এই দাঁতনকাঠিটা।
—কি?
—সেটা এই: দোষীর বা দোষীর দলের কারো দাঁতন করবার অভ্যেস আছে। দাঁতন করবার যার প্রতিদিনের অভ্যেস নেই—সে এরকম দাঁতন নিপুণভাবে মোচড় দিয়ে ভাঙতে জানবে না। এবং সম্ভবত সে বাঙালী এবং পল্লীগ্রামবাসী। হিন্দুস্থানীরা দাঁতন করে, কিন্তু দেখবেন, তারা সেওড়াডালের দাঁতন করতে জানে না—তারা নিম, বা বাব্লাগাছের দাঁতনকাঠি ব্যবহার করে সাধারণত। এ লোকটা বাঙালী এ-বিষয়ে ভুল নেই।
সেইদিনই আমি কলকাতায় মিঃ সোমের সঙ্গে দেখা করলাম। সেওড়াডালের গোড়াটা আমি তাঁকে দেখাই নি—কাঠের পাতটা তাঁর হাতে দিয়ে বল্লাম—এটা কি ব’লে আপনি মনে করেন?
তিনি জিনিসটা দেখে বল্লেন—এ তুমি কোথায় পেলে?
—সে-কথা আপনাকে এখন বলবো না, ক্ষমা করবেন।
—এটা আসামে মিস্মি-জাতির মধ্যে প্রচলিত রক্ষাকবচ। দেখবে? আমার কাছে আছে।
মিঃ সোমের বাড়ীতে নানা দেশের অদ্ভুত জিনিসের একটা প্রাইভেট মিউজিয়াম-মত আছে। তিনি তাঁর সংগৃহীত দ্রব্যগুলির মধ্যে থেকে সেই রকম একটা কাঠের পাত এনে আমার হাতে দিলেন।
আমি বললাম—আপনারটা একটু বড়। কিন্তু চিহ্ন একই—ফুল আর শেয়াল।
—এটা ফুল নয়, নক্ষত্র—দেবতার প্রতীক, আর নীচে উপাসনাকারী মানুষের প্রতীক—পশু!
—কোন্ দেশের জিনিস বল্লেন?
—নাগা পর্ব্বতের নানা স্থানে এ-কবচ প্রচলিত—বিশেষ ক’রে ডিব্রু-সদিয়া অঞ্চলে।
আমি তাঁর হাত থেকে আমার পাতটা নিয়ে তারপর বল্লাম—এই সেওড়াডালটা ক’দিনের ভাঙা বলে মনে হয়?
তিনি বল্লেন—ভালো ক’রে দেখে দেবো? আচ্ছা, বোসো।
সেটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে একটু পরে ফিরে এসে বল্লেন—আট ন’দিন আগে ভাঙা।
আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম নিজের বাসায়।