বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)/মিস্মিদের কবচ/সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আমার মনে একটা বিশ্বাস ক্রমশ দৃঢ়তর হয়ে উঠচে। গাঙ্গুলিমশায়কে খুন করতে এবং খুনের পরে তাঁর ঘরের মধ্যে খুঁড়ে দেখতে খুনীর লেগেছিল সারারাত। যুক্তির দিক থেকে হয়তো এর অনেক দোষ বার করা যাবে—কিন্তু আমি অনেক সময় অনুমানের ওপর নির্ভর ক’রে অগ্রসর হয়ে সত্যের সন্ধান পেয়েছি।
কিন্তু ননী ঘোষকে আমি এখনও রেহাই দিই নি। শ্যামপুরে ফিরেই আমি আবার তার সঙ্গে দেখা করলাম। আমায় দেখে ননীর মুখ শুকিয়ে গেল—তাও আমার চোখ এড়ালো না।
বল্লাম—শোনো ননী, আবার এলাম তোমায় জ্বালাতে—কতকগুলো কথা জিগ্যেস করবো।
—আজ্ঞে, বলুন!
—গাঙ্গুলিমশায় যেদিন খুন হন, সে-রাত্রে তুমি কোথায় ছিলে?
ননীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। বল্লে, আজ্ঞে…
—বলো কোথায় ছিলে। বাড়ী ছিলে না—
—আজ্ঞে না। সামটায় শ্বশুরবাড়ী যেতে-যেতে সেদিন দেবনাথপুরের হাটতলায় রাত কাটাই।
—কেউ দেখেচে তোমায়?
—ননী বল্লে—আজ্ঞে, তা যদিও দেখে নি—
—কেন দেখে নি।
—রাত হয়ে গেল দেখে ওখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন কেউ সেখানে ছিল না।
—খেয়াঘাট পার হওনি দেবনাথপুরে?
—হ্যাঁ বাবু। অনেক লোক একসঙ্গে পার হয়েছিল। আমায় তো পাটনি চিনে রাখে নি!
—বাড়ী এসেছিলে কবে?
—শনিবার দুপুরবেলা।
—গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েচেন কার মুখে শুনলে?
—আজ্ঞে, গাঁয়ে ঢুকেই মাঠে কাপালিদের মুখে শুনি।
—কার মুখে শুনেছিলে তার নাম বলো।
—আজ্ঞে, ঠিক মনে হচ্ছে না, বোধ হয় হীরু কাপালি—
—তার কাছে গিয়ে প্রমাণ ক’রে দিতে পারবে?
ননী ইতস্তত ক’রে বল্লে—আজ্ঞে, ঠিক তো মনে নেই; যদি হীরু না হয়?
ননীর কথায় আমার সন্দেহ আরো বেশী হোলো। সে-রাত্রে ও ঘরে ছিল না, অথচ কোথায় ছিল তা পরিষ্কার প্রমাণও দিতে পারছে না। গোপনে সন্ধান নিয়ে আরও জানলাম, ননী সম্প্রতি কলকাতায় গিয়েছিল। আজ দু’দিন হলো এসেছে। ননীকে জিগ্যেস করে কোনো লাভ নেই, ও সত্যি কথা বলবে না। একটা কিছু কাণ্ড ও ঘটাচ্চে নাকি তলে-তলে? কিছু বোঝা যাচ্চে না!
দু’দিন পরে শ্রীগোপাল এসে আমায় খবর দিলে, গ্রামের মহীন্ সেকরাকে সে ডেকে এনেচে—আমার সঙ্গে দেখা করবে, বিশেষ কাজ আছে।
মহীন্ সেকরার বয়স প্রায় পঞ্চাশের ওপর। নিতান্ত ভালোমানুষ গ্রাম্য-সেকরা, ঘোরপেঁচ জানে না বলেই মনে হোলো।
শ্রীগোপালকে বললাম—একে কেন এনেচ?
—এ কি বলচে শুনুন।
—কি মহীন্?
—বাবু, ননী ঘোষ আমার কাছে এগারো ভরি সোনার তাবিজ আর হার তৈরি ক’রে নিয়েচে—আজ তিন-চারদিন আগে।
—দাম কত?
—সাতাশ টাকা ক’রে ভরি, হিসেব করুন।
—টাকা নগদ দিয়েছিল?
—হ্যাঁ বাবু।
—সে টাকা তোমার কাছে আছে? নোট, না নগদ?
—নগদ। টাকা নেই বাবু, তাই নিয়ে মহাজনের ঘর থেকে সোনা কিনে এনে গহনা গড়ি!
—দু’ একটা টাকাও নেই?
—না বাবু।
—তোমার মহাজনের কাছে আছে?
—বাবু, রাণাঘাটের শীতল পোদ্দারের দোকানে কত সোনা কেনা-বেচা হচ্চে দিনে। আমার সে টাকা কি তারা বসিয়ে রেখেচে?
—শীতল পোদ্দার নাম? আমার সঙ্গে তুমি চলো রাণাঘাটে আজই।
বেলা তিনটের ট্রেনে মহীন্ সেকরাকে নিয়ে রাণাঘাটে শীতল পোদ্দারের দোকানে হাজির হোলাম। সঙ্গে মহীন্কে দেখে বুড়ো পোদ্দারমশায় ভাবলে, বড় খরিদ্দার একজন এনেচে মহীন্। তাদের আদর-অভ্যর্থনাকে উপেক্ষা ক’রে আমি আসল কাজের কথা পাড়লাম, একটু কড়া—রুক্ষস্বরে।
বল্লাম—সেদিন এই মহীন্ আপনাদের ঘর থেকে সোনা কিনেছিল, এগারো ভরি?
পোদ্দারের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো ভয়ে—ভাবলে, এ নিশ্চয়ই পুলিসের হাঙ্গামা! সে ভয়ে-ভয়ে বল্লে—হ্যাঁ বাবু, কিনেছিল।
—টাকা নগদ দেয়?
—তা দিয়েছিল।
—সে টাকা আছে?
—না বাবু, টাকা কখনো থাকে? আমাদের বড় কারবার, কোথাকার টাকা কোথায় গিয়েচে!
আমিও ওকে ভয় দেখানোর জন্যে কড়া সুরে বল্লাম—ঠিক কথা বলো। টাকা যদি থাকে আনিয়ে দাও—তোমার ভয় নেই। চুরির ব্যাপারে নয়, মহীনের কোনো দোষ নেই। তোমাদের কোনো পুলিসের হাঙ্গামায় পড়তে হবে না—কেবল কোর্টে সাক্ষী দিতে হতে পারে। টাকা বার করো।
মহীন্ও বললে—পোদ্দারমশায়, আমাদের কোনো ভয় নেই, বাবু বলেচেন। টাকা যদি থাকে, দেখান বাবুকে।
পোদ্দার বল্লে—কিন্তু বাবু, একটা কথা। টাকা তো সব সমান, টাকার গায়ে কি নাম লেখা আছে?
—সে-কথায় তোমার দরকার নেই। নাম লেখা থাক্ না থাক্—টাকা তুমি বার করো।