বিলাত-প্রবাসী।
সন্ন্যাসীর চিঠি। 

(৯)

আমি অক্ষফোর্ডে যে গৃহস্থের বাড়িতে থাকি তারা সামান্য রকম লোক। কিন্তু ভদ্র। কর্ত্তা প্রায় এক শত টাকা মাসিক রোজগার করেন—অর্থাৎ আমাদের দেশের ২৫।৩০ টাকার কেরাণীর মত অবস্থাপন্ন। গৃহিণী সুশিক্ষিতা—বিবাহের পূর্ব্বে শিক্ষকের কার্য্য করিতেন। তিনটি কন্যা ও একটি পুত্র। বড় মেয়েটি এক-ফারমে কেরাণীর কাজ করে। আমাকে এরা সকলেই খুব খাতির যত্ন করে। আমি একটি বড় ঘরে থাকি। ঘরটি ফুলদার রঙীন কাগজে মোড়া। মেজে কারপেট বিছান। একটি সোফা (Sofa) ইজিচেয়ার (Easy chair) তিন খানি গদি-মোড়া কেদারা তিনটি ত্রিপাই (Tripoy) ও একটা বড় মেজ। দেওয়ালে খান বারো নানা রকমের ছবি সাজানো আছে। আর এক খানা গিল‍্টির কাজ-করা ফেরেম-দেওয়া বড় আর‍্সি আছে তাতে উঠতে বসতে আমার চাঁদমুখ দেখতে পাই। আহা যদি নিজেকে ভালবাসতাম তা হোলে কি আনন্দই না হোত। কিন্তু আমার কপাল এমনি মন্দ যে যাদের সঙ্গে আমার ভারি ঘনিষ্ঠতা তারা প্রায় সকলেই আমার চেয়ে সুশ্রী—নয় গুণবান্। তাই ছেলেবেলা থেকে নিজের উপর বড় ভাব-ভক্তি হয় না। তবে চেহারা যে একেবারে মন্দ তা নয় কিন্তু ভালবাসার যুগ্যি নয়। যাক্ নিজের কথা। ঘরটিতে দুটি জানালা। তাতে নেটের ফুলকরা পরদা টাঙ্গান। স্প্রিঙ্গের একখানি খাট বেশ গদিপাতা। দেশে কম্বলে মাদুরে শুয়ে বৈরাগ্য সাধন করিতাম। এখানে বৈরাগ্য টৈরাগ্য কোথায় ভেসে গেছে। প্রাতে উঠে মুখ হাত ধুয়েই খাওয়া। দু পেয়ালা চা-চারি টুকরা রুটী একতাল মাখন ও এক পেলেট পরিজ (Porridge) অর্থাৎ সিদ্ধকরা কোন শস্য—আমি রোজ বেলা ৮॥টার সময় উদরসাৎ করি। ইহাকে উপবাস-ভঞ্জন breakfast বলে। তার পর বেলা একটার সময় লাঞ্চ (lunch) অর্থাৎ মধ্যাহ্নের আহার। ভাত ডাল আলু ভাজা কপির তরকারী রুটী মাখন ও ফল ইত্যাদি খাই। আবার চারিটার সময় টোষ্ট অর্থাৎ রুটী মাখমে ভাজা-কেক্ আর দু পেয়ালা চা অবাধে গ্রহণ করি। রাত্রি। আটটার সময় ডিনার (Dinner) অর্থাৎ প্রধান আহার। আমি প্রায়ই আলু বরবটি ও কলাই শুঁটির তরকারী রুটী ও পুডিং (Pudding) খাই। এখনও শেষ হয় নি। শোবার আগে এক পেয়ালা গরম দুগ্ধ পান করি। দেশে যদি এত খাই তা হলে দু চার দিনেই শমন-ভবন গমন করিতে হয়। তবু আমি এখানে একজন মস্ত সাধু। মাছ মাংস ডিম কিছু খাই না—কি কোরে বাঁচি তাই সবাই অবাক্। এখানকার নিরামিষাশীরা (Vegetarian) ডিম খায় কেননা ডিমের কোন কষ্ট হয় না। কিন্তু এখানে যেমন খাওয়া তেমনি পরিশ্রম। করা চাই। ছ সাত মাইল অন্ততঃ রোজ না বেড়ালে অসুখ করে। আমার শরীর বেশ শুধরে গেছে। চেহারা লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু মাসে ৫০টি করে টাকা দিতে হয়। এর চেয়ে সস্তা হয় না। গৃহিণী মাঝে মাঝে মিষ্টান্ন করেও খাওয়ান। আর ডিম খাইনে বোলে প্রায়ই ডিম না দিয়ে কেক্ তৈয়ারী করেন। কাপড় চোপড় নিজেই কেচে দেন ধোপার খরচ লাগে না। বাড়িতে ইস্ত্রি করিবার বন্দোবস্ত আছে। ইজের মোজা ছিঁড়ে গেলে খুব ভাল রকম নিজে রিপু কোরে দেন। গৃহিণী বড় পরিশ্রমী। দাসী নাই। সমস্ত দিন রান্না ও ঘরকন্নার কাজ তাঁহাকে করিতে হয়। আমার উপর এঁর কিছু ভক্তি হয়েছে। এক এক দিন সময় হোলে আমার কাছে এসে ধর্ম্মোপদেশ নেন। সংসারের ভাবনার সঙ্গে ভগবদ্ভক্তি কি প্রকারে মিশাইতে হয় তাহা আমি একে বলি। তাই অনেকটা গুরুর মতন সেবা পাই। ছোট ছোট মেয়েগুলি সদাই ব্যস্ত পাছে আমার খাবার দাবারের কোন ত্রুটি হয়। বড় মেয়েটি একদিন, আমার খাবার দিতে এসে তার কাঁধের উপর দিয়ে একটু নুন ছড়িয়ে দিলে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—ব্যাপার কি। সে বল‍্লে যে আস‍্তে আস‍্তে নুন ফেলে দিয়েছিল। নুন ফেলা বড় অলক্ষণ। তাই ঐরকম কোরে অলক্ষণের কাটান করিতে হয়। আমাদের দেশেও অনেক স্থানে এই রকম প্রথা আছে—যেমন তেল পড়ে গেলে সেই জায়গায় একটু জলের ছিটে দিতে হয়। এখানে ঐপ্রকার অনেক সরল প্রথা আছে। সভ্যতার প্রকোপে আমাদের দেশে ভারতবর্ষে কত না ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আচার ব্যবহারকে কুসংস্কার বোলে উড়িয়ে দেওয়া হোয়েছে। সভ্যতার দেশেই কিন্তু কুসংস্কার বেশী। গৃহিণীর এক ভগ্নী তার মামাতো ভাইকে বিয়ে করিবে বোলে ক্ষেপেছে। মামা ভয়ানক চটেছেন। ছেলেকে বিষয় দেবে না বলে ভয় দেখিয়েছেন। কিন্তু প্রণয়িযুগল অটল। তাই গৃহিণী দুঃখ কোরে আমায় বাল‍্ছিলেন যে মামাতো পিস‍্তুতো ভাই বোনে বিয়ে বড় মন্দ। একটা ইংরেজিতে ছড়া বলিলেন —সেটা আমি ভুলে গেছি। তার অর্থ এই যে ঐ প্রকার বিয়েতে স্বাস্থ্য ও অর্থনাশ হয় আর বন্ধ্যাদোষ হয়। বল‍্লেন—যতগুলা আমি দেখেছি ততগুলা ঐরকম। তার সাক্ষী আমাদের পাড়াতেই এক ঘর বুড়ো বুড়ী স্বামী স্ত্রী আছে। তারা খুড়তুতো ভাই বোন। তাদের সব টাকাও ব্যবসায় নষ্ট হোয়েছে—ছেলে পিলে হয় নাই আর তারা রোগে জীর্ণ। এত দেখে-শুনেও তাঁর বোনের কেন এমন কুমতি হোলো তাই বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করিলেন।

 আমরা সকলেই জানি যে ইংরেজের প্রাণ অন্যান্য দেশ হইতে আমদানি খাদ্যদ্রব্যের উপর নির্ভর করে। কিন্তু নির্ভরটা কত দূর তা বোধ হয় অনেকেই জানে না। বিলেতে প্রতি বৎসর প্রায় ছয় কোটি মণ গম আমদানি হয়। মার্কিণ মুলুক হোতে তিন কোট্টি মণ আসে। কানেডা হোতে পঁয়েষট্টি লাখ মণ ও হিন্দুস্থান হোতে ষাট লাখ মণ গম আসে। বাকি অন্যান্য দেশ যোগায়। গম ছাড়া ময়দা ১ কোটি ৮০ লাখ মণ। যবও প্রায় অত। জুয়ারি (Maize) তিন কোটি মণ। ভেড়ার মাংস দেড় কোটি মণ ও ১০ লাখ মণ শূকরের মাংস বিদেশ থেকে আসে।: তাই ইংরেজের ব্যবসাগত প্রাণ।

 মিষ্টার চেম্বারলেন এখানে এক ভারি গোল বাধিয়েছেন। তিনি এক বক্তৃতায় বলেন যে, উপনিবেশের আমদানি মালের উপর মাশুল কম কোরে অন্য দেশের মালের উপর মাশুল বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। উপনিবেশ সকল আমাদের পরিবারভুক্ত তজ্জন্য তাদের মাল ত দেশের মাল এক মনে করা উচিত। আর তা হোলে ইংলণ্ডের সঙ্গে ও উপনিবেশ সকলের সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় হবে ও বৃটিস সামাজ্য বললাভ করিবে। এখন মুস্কিল এই যে শস্য মাংস ও অন্যান্য মাল উপনিবেশ হোতে খুব কম আসে। তাই বিদেশীয় মালের শুল্ক বাড়াইলেই আহারীয় দ্রব্যের দর চোড়ে যাবে। এই কথা নিয়ে কাল পার্লিয়ামেণ্ট মহাসভায় হুলস্থুল বেধে গিয়েছিল। রাজস্ব-সচিব মিষ্টার রিচি স্পষ্টাক্ষরে বলেছেন যে ঔপনিবেশিক সেক্রেটারি মিষ্টার চেম্বারলেনের প্রস্তাব অত্যন্ত অসঙ্গত। সচিবে সচিবে মতভেদ বড় দেখা যায় না। উদারপক্ষের (Liberal) মেম্বরেরা ভারি খুসি। গবর্ণমেণ্টকে খুব চেপে ধরেছে। আর গবর্ণমেণ্টের পক্ষের মেম্বরেরা অনেকেই চেম্বারলেনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। আর এক বিপদ। যে শিক্ষাবিধি (Education Act) পাস হয়েছে তাতে লোকেরা ভারি চটেছে। ইংলিশ চার্চ্চের (Church of England) বিরুদ্ধ সম্প্রদায়েরা (Nonconformist) মনে করে যে এই বিধি অনুযায়ী চলিলে সব ইস্কুল ইংলিশ চার্চের হাতে আসিবে। তাই তারা সহরে সহরে ধর্ম্মঘট কোরেছে যে শিক্ষার জন্য যে টেক‍্স তা কেউ দেবে না। বড় বড় লোক এই ধর্ম্মঘটে যোগ দিয়েছে। যারা টেক‍্স দিচ্ছে না। তাদের আসবাব পত্র সরকারে নীলাম করে টেক‍্স আদায় কর‍্ছে কিন্তু লোকে তবুও শুনছে না। বিদ্রোহ ক্রমশঃই বাড়ছে। ইংরেজ বিধির বড়ই বশ কিন্তু তারা ধর্ম্মহানির ভয়ে এবার বিধির বিরোধী হোয়েছে। গবর্ণমেণ্টের বড়ই বিপদ।

 ইংরেজ হিন্দু জাতিকে নিয়ে বড়ই মুস্কিলে পড়েছে। জাতি শ্বেতবর্ণ না হোলেই কাফ্রি বা জুলুদের মত অসভ্য—এইরূপ এদের ধারণা ছিল। কিন্তু হিন্দুস্থানে এসে তারা সে ধারণাটা হৃদয়ে পোযণ করিতে বড় সুবিধা পায় না। হিন্দুজাতি যে ইংরেজের অপেক্ষা সভ্য তার আর কোন সন্দেহ নাই। এ বিষয়ে পদে পদে এদের চোক ফুটছে কিন্তু পূর্ব্বসংস্কার ছাড়িতে চায় না। আমরা ইংরেজ বা ইয়ুরোপীয়—আমরাই সভ্য— আর সব অসভ্য—এই বুলি। ডাক্তার ফেয়ারবেয়ারণ (Dr Fairbairn) ও ডাক্তার ল্যাড (Dr Dadd) অমোদের দেশে দর্শন শিখাইতে গিয়েছিলেন। ভাল কথা। কিন্তু গিয়ে দেখিলেন যে হিন্দুর দর্শন তাঁদের দর্শনের অপেক্ষা অনেক অগ্রসর। তাই বড় একটা পসার হলো না। এই রাগ। দাও গালাগালি হিন্দুদিগকে। ডাক্তার ফেয়ারবেয়ারণ উক্ষপারে আছেন। বেদান্তের সম্বন্ধে জানিতে এখানে অনেক অধ্যাপক উৎসুক কিন্তু ইনি একেবারে বীতরাগ। হিন্দু দর্শনের উপর এঁর কিছু শ্রদ্ধা নাই। তবে সুখের বিষয় এই যে এখানে ইনি গাঁয়ে-মানে-না-আপনি-মোড়ল গোছর লোক। আমাদের দেশের লোক মনে করেছিল যে কোন একটা দিগ‍্গজ এসেছে। কিন্তু উক্ষপারে এঁর প্রতিপত্তি ভারি কম। ডাক্তার ল্যাড ত স্পষ্ট লিখেছেন যে হিন্দুরা মিথ্যাবাদী ও দুশ্চরিত্র। যে ইংরেজ ভারতে যায় সেই হিন্দুর বিষয় কিছু না কিছু লেখে। এখানে এত বই বেরিয়েছে যে আমরা তার খবরই জানি না। কিন্তু প্রায় সবগুলি হিন্দুর নিন্দায় ভরা। এঁর উপায় কি। উপায় রাঙ্গা পায়। আমাদের দেশীয় ধুরন্ধরেরাও হিন্দুর নিন্দা করিতে ছাড়েন না। রমেশ বাবুর হিন্দু সভ্যতা নামক পুস্তকখানিতে হিন্দুর নামকে যে কি মাটি কোরেছেন তা বলা যায় না। তাঁর গ্রন্থের মর্ম্ম যে আমরা কোনও পুরাকালে একটু আধটু সভ্য ছিলাম—তা আবার সে সভ্যতাটুকুও ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে লোপ পেয়েছে। যাক্ তাঁর আর নিন্দা করিব না। তিনি দেশ-হিতৈষী। ইংরেজের কাছে তিনি আমাদের দারিদ্রের ওকালতি করেন—তাঁর মঙ্গল হোক্।

 এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতে বেদান্তদর্শন শিক্ষা হয় সেই বিষয়ে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছি। যদি হয় ত বড় ভাল হয়। কতকগুলো বিলাতী ভুতুড়ে লোক আর বিলাতী মেয়ে মানুষের হাত থেকে হিন্দুয়ানির পাণ্ডাগিরি যত দিন না যায় তত দিন অমঙ্গল বই মঙ্গল নয়। যারা উচ্চশিক্ষিত তারা ঐ অর্ধশিক্ষিত প্রেতাত্মা-মহাত্মা-গ্রস্ত উদ্ভ‌ুট্টে বিলাতি হিন্দুদের ঘৃণা করে। এই পাণ্ডার দল—দর্শন কি বস্তু তাঁর বড় খোঁজ রাখে না কিন্তু কেবল নিজেদের দেশের নিন্দা ও কুৎসা করে আর না বুঝে সুঝে হিন্দুর বিষয় নিয়ে চীৎকার করে। যত স্বদেশদ্রোহী আর নব-নব-কৌতুহল-বিলাসিনী নারীগণের দ্বারা এই দল পরিপুষ্ট। হিন্দুত্বের যে এখানে কি দুর্দ্দশা―দেখিলে বড় কষ্ট হয়। অথচ আমাদের দেশে হৈ চৈ পোড়ে গেছে যে বিলেতে হিন্দুয়ানির আদর বাড়ছে।

উক্ষপার দার্শনিক সভা আমায় নির্গুণ ব্রহ্ম সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে নিমন্ত্রণ করিয়াছে। অনেক অধ্যাপক এই সভায় আসেন। এইরকম বলিতে বলিতে যদি কিছু ফল হয়। আগামী রবিবারে ঐ সভার অধিবেশন হবে।

উক্ষপার—১২ই জুন ১৯০৩।