হাস্যকৌতুক (১৯৪৬)/সূক্ষ্ম বিচার: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
JoyBot (আলোচনা | অবদান)
rp
JoyBot (আলোচনা | অবদান)
→‎top: rplc
১ নং লাইন:
{{header
|title= [[হাস্যকৌতুক]]
|section = [[সূক্ষ্মবিচার]]
|previous =[[../]] [[একান্নবর্তী]]
|next =[[../]] [[আশ্রমপীড়া]]
১০ নং লাইন:
|portal =
|categories =রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর}}
<div style="padding-left:2em;font-size:1.3em">
চণ্ডীচরণ ও কেবলরাম
 
কেবলরাম । মশায় , ভালো আছেন ?
 
চণ্ডীচরণ । ‘ ভালো আছেন ' মানে কী ?
 
কেবলরাম । অর্থাৎ সুস্থ আছেন ?
 
চণ্ডীচরণ । স্বাস্থ্য কাকে বলে ?
 
কেবলরাম । আমি জিজ্ঞাসা করেছিলেম , মশায়ের শরীর-গতিক-
 
চণ্ডীচরণ । তবে তাই বলো । আমার শরীর কেমন আছে জানতে চাও । তবে কেন জিজ্ঞাসা করছিলে আমি কেমন আছি ? আমি কেমন আছি আর আমার শরীর কেমন আছে কি একই হল ? আমি কে , আগে সে'ই বলো ।
 
কেবলরাম । আজ্ঞে , আপনি তো চণ্ডীচরণবাবু ।
 
চণ্ডীচরণ । সে বিষয়ে গুরুতর তর্ক উঠতে পারে ।
 
কেবলরাম । তর্ক কেন উঠবে! আপনি বরঞ্চ আপনার পিতাঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করবেন ।
 
চণ্ডীচরণ । নাম জিনিসটা কী ? নাম কাকে বলে ?
 
কেবলরাম । ( বহু চিন্তার পর) নাম হচ্ছে মানুষের পরিচয়ের-
 
চণ্ডীচরণ । নাম কি কেবল মানুষেরই আছে , অন্য প্রাণীর নেই ?
 
কেবলরাম । ঠিক কথা । মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর-
 
চণ্ডীচরণ । কেবল মানুষ ও প্রাণী ছাড়া আর কিছুর নাম নেই ? তবে বস্তু চেনার কী উপায় ?
 
কেবলরাম । ঠিক বটে । মানুষ , প্রাণী এবং বস্তু -
 
চণ্ডীচরণ । শব্দ স্বাদ বর্ণ প্রভৃতি অবস্তুর কি নাম নেই ?
 
কেবলরাম । তাও বটে । মানুষ , প্রাণী , বস্তু এবং শব্দ , স্বাদ , বর্ণ প্রভৃতি অবস্তু-
 
চণ্ডীচরণ । এবং-
 
কেবলরাম । আবার এবং!
 
চণ্ডীচরণ । এবং আমাদের মনোবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির-
 
কেবলরাম । এবং আমাদের মনোবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির-
 
চণ্ডীচরণ । এবং অন্তর ও বাহিরের যাবতীয় পরিবর্তনের ও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার-
 
কেবলরাম । যাবতীয় পরিবর্তনের এবং ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার-
 
চণ্ডীচরণ । এবং-
 
কেবলরাম । ( কাতরভাবে) এবং না ব'লে এইখানে একটা ইত্যাদি লাগানো যাক-না ।
 
চণ্ডীচরণ । আচ্ছা বেশ । এখন সমস্তটা কী হল বলো তো । কথাটা পরিষ্কার হয়ে যাক ।
 
কেবলরাম । ( মাথা চুলকাইয়া) পরিষ্কার হবে কি না বলতে পারি নে , চেষ্টা করি । নাম হচ্ছে মানুষের এবং অবস্তুর , না না — বস্তু এবং অবস্তুর , এবং বাহিরের ও অন্তরের যাবতীয় হৃদয়বৃত্তির , না মনোবৃত্তির , না না-যাবতীয় ভিন্ন ভিন্ন কিম্বা পরিবর্তন ও অবস্থার ভিন্ন ভিন্ন যাবতীয় — এ তো মুশকিল হল! কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পারছি নে । এক কথায় নাম হচ্ছে মানুষের এবং প্রাণীর এবং — দূর হোক গে , মানুষের , প্রাণীর এবং ইত্যাদির পরিচয়ের উপায় ।
চণ্ডীচরণ । এ সম্বন্ধে তর্ক আছে । পরিচয় কাকে বলে!
 
কেবলরাম । ( জোড়হস্তে) আমি কাউকেই বলি নে । মশায়ই বলুন ।
 
চণ্ডীচরণ । ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের প্রভেদ অবগত হয়ে তাদের স্বতন্ত্র করে জানা । এই ঠিক তো!
 
কেবলরাম । এ ছাড়া আর তো কিছু হতেই পারে না ।
 
চণ্ডীচরণ । তা হলে তুমি অস্বীকার করছ না ?
 
কেবলরাম । আজ্ঞে না ।
 
চণ্ডীচরণ । যদিই অস্বীকার কর তা হলে এ সম্বন্ধে গুটিকতক তর্ক আছে ।
 
কেবলরাম । না না , আমি কিছুমাত্র অস্বীকার করছি নে ।
 
চণ্ডীচরণ । মনে কর , যদিই কর ।
 
কেবলরাম । ( ভীতভাবে ) আজ্ঞে না , মনেও করতে পারি নে ।
 
চণ্ডীচরণ । তুমি না কর , যদি আর কেউ করে ।
 
কেবলরাম । কারো সাধ্য নেই যে করে । এত বড়ো দুঃসাহসিক কে আছে!
 
চণ্ডীচরণ । আচ্ছা বেশ , এটা যেন স্বীকারই করলে , তার পরে — নামই যদি পরিচয়ের একমাত্র উপায় হবে
 
তবে কি আমার চেহারা পরিচয়ের উপায় নয় ? আর আমার অন্যান্য লক্ষণগুলো-
 
কেবলরাম । আজ সম্পূর্ণ বুঝেছি নাম কাকে বলে তার নামগন্ধও জানি নে , আপনিই বলে দিন ।
 
চণ্ডীচরণ । ভাষার দ্বারা স্বতন্ত্র পদার্থের স্বাতন্ত্র্য নির্দিষ্ট করবার একটি কৃত্রিম উপায়কে বলে নামকরণ-যদি অস্বীকার কর-
 
কেবলরাম । না , আমি অস্বীকার করি নে-
 
চণ্ডীচরণ । কেবল তর্কের অনুরোধেও যদি অস্বীকার কর-
 
কেবলরাম । তর্কের অনুরোধে কেন , বাবার অনুরোধেও অস্বীকার করতে পারি নে ।
 
চণ্ডীচরণ । এর কোনো একটা অংশও যদি অস্বীকার কর ।
 
কেবলরাম । একটি অক্ষরও অস্বীকার করতে পারি নে ।
 
চণ্ডীচরণ । এই মনে করো , ‘ কৃত্রিম ' কথাটা সম্বন্ধে নানা তর্ক উঠতে পারে ।
 
কেবলরাম । ঠিক তার উলটো , ঐ কথাতেই সকল তর্ক দূর হয়ে যায় ।
 
চণ্ডীচরণ । আচ্ছা , তাই যদি হল, মীমাংসা করা যাক আমার নাম কী ।
 
কেবলরাম । ( হতাশভাবে) মীমাংসা আপনিই করুন , আমার খিদে পেয়েছে ।
 
চণ্ডীচরণ । নাম আমার সহস্র আছে , কোন্‌টা তুমি শুনতে চাও ?
 
কেবলরাম । যেটা আপনি সবচেয়ে পছন্দ করেন ।
 
চণ্ডীচরণ । প্রথমে বিচার করতে হবে কিসের সঙ্গে আমার প্রভেদ জানতে চাও — যদি পশুর সঙ্গে আমার প্রভেদ নির্দেশ করতে চাও-
 
কেবলরাম । আজ্ঞে , তা চাই নে-
 
চণ্ডীচরণ । তা হলে আমার নাম মানুষ । যদি শ্বেত পীত পদার্থের সঙ্গে আমার প্রভেদ জানতে চাও তবে আমার নাম-
 
কেবলরাম । কালো ।
 
চণ্ডীচরণ । শামলা । যদি ছেলের সঙ্গে প্রভেদ জানতে চাও তবে আমার নাম-
 
কেবলরাম । বুড়ো ।
 
চণ্ডীচরণ । মধ্যবয়সী ।
 
কেবলরাম । তবে চণ্ডীচরণ কার নাম মশায় ?
 
চণ্ডীচরণ । একটি মনুষ্যের মধ্যে , একটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মনুষ্য বিশেষের মধ্যে , একটি পূর্ণপরিণত মনুষ্যের মধ্যে তার জন্মকাল হতে আজ পর্যন্ত যে-সকল পরিবর্তন অহরহ সংঘটিত হচ্ছে এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত হবার সম্ভাবনা আছে , সেই পরিবর্তন ও পরিবর্তনসম্ভাবনার কেন্দ্রস্থলে যে-একটি সজ্ঞান ঐক্য বিরাজ করছে , তাকেই একদল লোক অর্থাৎ সেই লোকদের সজ্ঞান ঐক্য চণ্ডীচরণ নামে নির্দেশ করে ।
 
কেবলরাম । সর্বনাশ! মশায় বেলা হল । অত্যন্ত ক্ষুধানুভব হয়েছে , আহারও প্রস্তুত , এবার তবে-
 
চণ্ডীচরণ । ( হাত চাপিয়া ধরিয়া) রোসো — আসল কথাটার কিছুই মীমাংসা হয় নি । সবে আমরা তার ভূমিকা করেছি মাত্র । তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে আমি ভালো আছি কি না ; এখন প্রশ্ন এই , তুমি কী জানতে চাও , আমার অন্তর্গত প্রাণী কেমন আছে জানতে চাও , না মনুষ্য কেমন আছে জানতে চাও-
 
কেবলরাম । গোড়ায় কী জানতে চেয়েছিলুম তা বলা ভারি শক্ত । কিন্তু আপনার সঙ্গে এতক্ষণ কথা কয়ে এখন অনুমান হচ্ছে আপনার সজ্ঞান ঐক্য কেমন আছেন এইটে জানাই অজ্ঞান আমার অভিপ্রায় ছিল ।
 
চণ্ডীচরণ । অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলে ।
 
কেবলরাম । তা হলে মাপ করবেন — অপরাধ করেছি , এখন অনুতাপে এবং পেটের জ্বালায় দগ্ধ হচ্ছি । আহারের পূর্বে এরকম প্রশ্ন আমি আর কখনো আপনাকে জিজ্ঞাসা করব না ।
 
চণ্ডীচরণ । ( কর্ণপাত না করিয়া) আমি ভালো আছি কি না জিজ্ঞাসা করলে প্রথম দেখা আবশ্যক ভালোমন্দ কাকে বলে । তার পরে স্থির করতে হবে আমার সম্বন্ধে ভালোই বা কী আর মন্দই বা কী । তার পরে দেখতে হবে বর্তমানে যা ভালো তা-
 
কেবলরাম । মশায়, আপনার পায়ে ধরছি এখনকার মতো ছুটি দিন । বরং ‘ আপনি কেমন আছেন ' এই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্নের উত্তর আপনি কবে দিতে পারবেন একটা দিন স্থির করে দিন — আমি যে নিতান্ত ব্যস্ত হয়েছি তা নয় — নাহয় উত্তর পেতে কিছুদিন দেরিই হবে , নাহয় উত্তর নেই পাওয়া গেল । কিন্তু আজ আমার অপরাধ ক্ষমা করুন , ভবিষ্যতে আমি সতর্ক হব।