হাস্যকৌতুক (১৯৪৬)/সূক্ষ্ম বিচার

সূক্ষ্ম বিচার

চণ্ডীচরণ ও কেবলরাম

 কেবলরাম। মশায়, ভালো আছেন?

 চণ্ডীচরণ। “ভালো আছেন” মানে কী?

 কেবলরাম। অর্থাৎ সুস্থ আছেন?

 চণ্ডীচরণ। স্বাস্থ্য কাকে বলে?

 কেবলরাম। আমি জিজ্ঞাসা করছিলেম মশায়ের শরীর-গতিক―

 চণ্ডীচরণ। তবে তাই বলো। আমার শরীর কেমন আছে জানতে চাও। তবে কেন জিজ্ঞাসা করছিলে আমি কেমন আছি। আমি কেমন আছি আর আমার শরীর কেমন আছে কি একই হল? আমি কে, আগে সে-ই বলো।

 কেবলরাম। আজ্ঞে আপনি তো চণ্ডীচরণবাবু।

 চণ্ডীচরণ। সে-বিষয়ে গুরুতর তর্ক উঠতে পারে।

 কেবলরাম। তর্ক কেন উঠবে। আপনি বরঞ্চ আপনার পিতাঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করবেন।

 চণ্ডীচরণ। নাম জিনিসটা কি? নাম কাকে বলে?

 কেবলরাম। (বহু চিন্তার পর) নাম হচ্ছে মানুষের পরিচয়ের―

 চণ্ডীচরণ। নাম কি কেবল মানুষেরই আছে, অন্য প্রাণীর নেই?

 কেবলরাম। ঠিক কথা। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর―

 চণ্ডীচরণ। কেবল মানুষ ও প্রাণী ছাড়া আর কিছুর নাম নেই? তবে বস্তু চেনার কী উপায়?

 কেবলরাম। ঠিক বটে। মানুষ, প্রাণী এবং বস্তু―

 চণ্ডীচরণ। শব্দ স্বাদ বর্ণ প্রভৃতি অবস্তুর কি নাম নেই?

 কেবলরাম। তাও বটে। মানুষ, প্রাণী, বস্তু এবং শব্দ, স্বাদ, বর্ণ প্রভৃতি অবস্তু―

 চণ্ডীচরণ। এবং―

 কেবলরাম। আবার এবং!

 চণ্ডীচরণ। এবং আমাদের মনোবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির―

 কেবলরাম। এবং আমাদের মনোবৃত্তি ও হৃদয়বৃত্তির―

 চণ্ডীচরণ। এবং অন্তর ও বাহিরের যাবতীয় পরিবর্তনের ও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার―

 কেবলরাম। যাবতীয় পরিবর্তনের এবং ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার―

 চণ্ডীচরণ। এবং―

 কেবলরাম। (কাতরভাবে) এবং না বলে এইখানে একটা ইত্যাদি লাগানো যাক না।

 চণ্ডীচরণ। আচ্ছা বেশ। এখন সমস্তটা কী হল বলো তো। কথাটা পরিষ্কার হয়ে যাক।

 কেবলরাম। (মাথা চুলকাইয়া) পরিষ্কার হবে কি না বলতে পারি নে, চেষ্টা করি। নাম হচ্ছে মানুষের এবং অবস্তুর, না না― বস্তু এবং অবস্তুর, এবং বাহিরের ও অন্তরের যাবতীয় হৃদয়বৃত্তির, না― মনোবৃত্তির, না না― যাবতীয় ভিন্ন ভিন্ন কিম্বা পরিবর্তন ও অবস্থার ভিন্ন ভিন্ন যাবতীয়― এ তো মুশকিল হল। কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পারছি নে। এক কথায় নাম হচ্ছে মানুষের এবং প্রাণীর এবং― দুর হোক গে মানুষের, প্রাণীর এবং ইত্যাদির পরিচয়ের উপায়।

 চণ্ডীচরণ। এ-সম্বন্ধে তর্ক আছে। পরিচয় কাকে বল!

 কেবলরাম। (জোড়হস্তে) আমি কাউকেই বলি নে। মশায়ই বলুন।

 চণ্ডীচরণ। ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের প্রভেদ অবগত হয়ে তাদের স্বতন্ত্র করে জানা। এই ঠিক তো!

 কেবলরাম। এ ছাড়া আর তো কিছু হতেই পারে না।

 চণ্ডীচরণ। তাহলে তুমি অস্বীকার করছ না।

 কেবলরাম। আজ্ঞে না।

 চণ্ডীচরণ। যদিই অস্বীকার কর তাহলে এ-সম্বন্ধে গুটিকতক তর্ক আছে।

 কেবলরাম। না না, আমি কিছুমাত্র অস্বীকার করছি নে।

 চণ্ডীচরণ। মনে করো, যদিই কর।

 কেবলরাম। (ভীতভাবে) আজ্ঞে না, মনেও করতে পারি নে।

 চণ্ডীচরণ। তুমি না কর, যদি আর কেউ করে।

 কেবলরাম। কারও সাধ্য নেই যে করে। এত বড়ো দুঃসাহসিক কে আছে!

 চণ্ডীচরণ। আচ্ছা বেশ, এটা যেন স্বীকারই করলে; তার পরে। নামই যদি পরিচয়ের একমাত্র উপায় হবে তবে কি আমার চেহারা পরিচয়ের উপায় নয়? আর আমার অন্যান্য লক্ষণগুলো―  কেবলরাম। আজ সম্পূর্ণ বুঝেছি নাম কাকে বলে তার নামগন্ধও জানি নে, আপনিই বলে দিন।

 চণ্ডীচরণ। ভাষার দ্বারা স্বতন্ত্র পদার্থের স্বাতন্ত্র্য নির্দিষ্ট করবার একটি কৃত্রিম উপায়কে বলে নামকরণ— যদি অস্বীকার কর―

 কেবলরাম। না, আমি অস্বীকার করি নে―

 চণ্ডীচরণ। কেবল তর্কের অনুরোধেও যদি অস্বীকার কর―

 কেবলরাম। তর্কের অনুরোধে কেন বাবার অনুরোধেও অস্বীকার করতে পারি নে।

 চণ্ডীচরণ। এর কোনো একটা অংশও যদি অস্বীকার কর।

 কেবলরাম। একটি অক্ষরও অস্বীকার করতে পারি নে।

 চণ্ডীচরণ। এই মনে করো, “কৃত্রিম” কথাটা সম্বন্ধে নানা তর্ক উঠতে পারে।

 কেবলরাম। ঠিক তার উলটো, ওই কথাতেই সকল তর্ক দূর হয়ে যায়।

 চণ্ডীচরণ। আচ্ছ। তাই যদি হল মীমাংসা করা যাক আমার নাম কী।

 কেবলরাম। (হতাশভাবে) মীমাংসা আপনিই করুন, আমার খিদে পেয়েছে।

 চণ্ডীচরণ। নাম আমার সহস্র আছে, কোন্‌টা তুমি শুনতে চাও!

 কেবলরাম। যেটা আপনি সবচেয়ে পছন্দ করেন।

 চণ্ডীচরণ। প্রথমে বিচার করতে হবে কিসের সঙ্গে আমার প্রভেদ জানতে চাও― যদি পশুর সঙ্গে আমার প্রভেদ নির্দেশ করতে চাও―

 কেবলরাম। আজ্ঞে তা চাই নে—

 চণ্ডীচরণ। তাহলে আমার নাম মানুষ। যদি শ্বেত পীত পদার্থের সঙ্গে আমার প্রভেদ জানতে চাও তবে আমার নাম―

 কেবলরাম। কালো।

 চণ্ডীচরণ। শামলা। যদি ছেলের সঙ্গে প্রভেদ জানতে চাও তকে আমার নাম―

 কেবলরাম। বুড়ো।

 চণ্ডীচরণ। মধ্যবয়সী।

 কেবলরাম। তবে চণ্ডীচরণ কার নাম মশায়?

 চণ্ডীচরণ। একটি মনুষের মধ্যে, একটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মনুষ্য বিশেষের মধ্যে, একটি পূর্ণপরিণত মনুষ্যের মধ্যে তার জন্মকাল হতে আজ পর্যন্ত যে-সকল পরিবর্তন অহরহ সংঘটিত হচ্ছে এবং মৃত্যুকাল পর্যন্ত হবার সম্ভাবনা আছে সেই পরিবর্তন ও পরিবর্তন-সম্ভাবনার কেন্দ্রস্থলে যে একটি সজ্ঞান ঐক্য বিরাজ করছে, তাকেই একদল লোক অর্থাৎ সেই লোকদের সজ্ঞান ঐক্য চণ্ডীচরণ নামে নির্দেশ করে।

 কেবলরাম। সর্বনাশ! মশায় বেলা হল। অত্যন্ত ক্ষুধানুভব হয়েছে, আহারও প্রস্তুত, এবার তবে না―

 চণ্ডীচরণ। (হাত চাপিয়া ধরিয়া) রোসো― আসল কথাটার কিছুই মীমাংসা হয় নি। সবে আমরা তার ভূমিকা করেছি মাত্র। তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে আমি ভালো আছি কি না; এখন প্রশ্ন এই, তুমি কী জানতে চাও, আমার অন্তর্গত প্রাণী কেমন আছে জানতে চাও না মনুষ্য কেমন আছে জানতে চাও না―

 কেবলরাম। গোড়ায় কী জানতে চেয়েছিলুম তা বলা ভারি শক্ত। কিন্তু, আপনার সঙ্গে এতক্ষণ কথা কয়ে এখন অনুমান হচ্ছে আপনার সজ্ঞান ঐক্য কেমন আছেন এইটে জানাই অজ্ঞান আমার অভিপ্রায়। ছিল।

 চণ্ডীচরণ। অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলে।

 কেবলরাম। তাহলে মাপ করবেন— অপরাধ করেছি, এখন অনুতাপে এবং পেটের জ্বালায় দগ্ধ হচ্ছি। আহারের পূর্বে এ-রকম প্রশ্ন আমি আর কখনো আপনাকে জিজ্ঞাসা করব না।

 চণ্ডীচরণ। (কর্ণপাত না করিয়া) আমি ভালো আছি কিনা জিজ্ঞাসা করলে প্রথম দেখা আবশ্যক ভালোমন্দ কাকে বলে। তার পরে স্থির করতে হবে আমার সম্বন্ধে ভালোই বা কী আর মন্দই বা কী। তার পরে দেখতে হবে বর্তমানে যা ভালো তা—

 কেবলরাম। মশায়, আপনার পায়ে ধরছি, এখনকার মতো ছুটি দিন। বরং “আপনি কেমন আছেন” এই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্নের উত্তর আপনি কবে দিতে পারবেন একটা দিন স্থির করে দিন― আমি যে নিতান্ত ব্যস্ত হয়েছি তা নয়— না হয় উত্তর পেতে কিছুদিন দেরিই হবে, না হয় উত্তর নেই পাওয়া গেল। কিন্তু আজ আমার অপরাধ ক্ষমা করুন, ভবিষ্যতে আমি সতর্ক হব!

১২৯৩