হাস্যকৌতুক (১৯৪৬)/আশ্রমপীড়া

আশ্রমপীড়া

প্রথম দৃশ্য

নবকান্ত

 নবকান্ত। ওঃ, প্রেমের রহস্য কে ভেদ করতে পারে! না জানি সে কিসের বন্ধন যাতে এক হৃদয়ের সঙ্গে আর-এক হৃদয় বাঁধা পড়ে। কী জ্যোৎস্না-পাশ, কী পুষ্পসৌরভের ডাের, কী মুকুলিত মধুমাসের মধুর মলয়ানিলের বন্ধন।

নরােত্তমের প্রবেশ

 নরােত্তম। কী সর্বনাশ। নবকান্তের হাতে পড়লে তাে রক্ষা নেই। ধরলে বুঝি।

 নবকান্ত। (নরোত্তমকে ধরিয়া) ভাই, প্রেমের কী মহান শক্তি।

 নরােত্তম। খিদের শক্তি তার চেয়ে বেশি। আমি খেতে যাই, আমাকে ছাড়ো―

 নবকান্ত। হৃদয়ের ক্ষুধা―

 নরোত্তম। হৃদয়ের নয়, উদরের। আমি খেয়ে আসি―

 নবকান্ত। খাওয়ার কথা বলছি নে।

 নরােত্তম। তুমি কেন বলবে, আমি বলছি। একটু রােসো, আমি―ওই যে আদ্যানাথ বাবু আসছেন। ওঁকে ধরাে, প্রেমের শক্তি বােঝবার লােক এমন আর পাবে না।

প্রস্থান

আদ্যানাথের প্রবেশ

 নবকান্ত। (আদ্যানাথকে ধরিয়া) মশায়, প্রেমের কী মহান শক্তি।

 আদ্যানাথ। মহান শক্তি কী বাপু! মহতী শক্তি। কারণ, শক্তি শব্দ স্ত্রীলিঙ্গ, তৎপূর্বে―

 নবকান্ত। ভেবে দেখুন, প্রেমের সৈন্য নেই, সামন্ত নেই, অথচ প্রেম বিশ্ববিজয়ী। সে আপন জীবন্ত―

 আদ্যানাথ। জীবন্ত হতেই পারে না।

 নবকান্ত। আজ্ঞে হাঁ, সে আপনার জীবন্ত প্রভাবেই―

 আদ্যনাথ। জীবিত বলাে না কেন— তাহলে ব্যাকরণ―

 নবকান্ত। জীবন্ত প্রভাবে সর্বত্র আপনার পথ সৃজন—

 আদ্যানাথ। সৃজন নয়― সর্জন।

 নবকান্ত। পথ সৃজন করে নেয়। এই যে সূর্যতারাখচিত―

 আদ্যানাথ। সর্জন, কেন না সৃজ্ ধা―

 নবকান্ত। নীলাকাশ, এই যে বিচিত্রপুষ্পশােভিত―

 আদ্যনাথ। সৃজ্ ধাতুর উত্তর―

 নবকান্ত। পুষ্পকানন―

কথােপকথন করিতে করিতে প্রস্থান

গণেশের প্রবেশ

 গণেশ। লেখাটা তো শেষ করেছি এখন শােনাই কাকে। খাতা হাতে যেখানেই যাই কাউকে দেখতে পাই নে। আজ কাউকে শােনাতেই হবে― সন্ধান দেখি গে।

দ্বিতীয় দৃশ্য

হরিচরণ, নবীন, মাধব, নরােত্তম

 হরিচরণ। ওহে এতদিন ছিলাম ভালাে, কোনাে আপদ ছিল না। এখন কী করা যায়।

 নবীন। তাই তাে, কী করা যায়।

 নরােত্তম। তাই তাে হে, উপায় কী!

 হরিচরণ। এতদিন আমাদের বাসায় আপদের মধ্যে নবকান্ত ছিল, তাকে সয়ে গিয়েছিল, এখন কোথা থেকে একটা লেখক এসেছে।

 নরােত্তম। বাসায় লেখক থাকা কাজের কথা নয়।

 নবীন। কাল জাতিভেদের উপর এক কবিতা লিখে শােনাতে এসেছিল।

 হরিচরণ। কাল রাত্রি সাড়ে দশটা, সবে আমার একটু তন্দ্রা এসেছে এমন সময় লেখক এসে উপস্থিত। তন্দ্রা তাে ছুটলই আমিও তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটলুম।

 নরােত্তম। আরে ভাই, আমাকেও― ওই আসছে।

 হরিচরণ। ওই এল রে।

 নবীন। ওই খাতা!

 হরিচরণ। পালাই।

প্রস্থান

 নবীন। আমিও পালাই।

প্রস্থান

 নরােত্তম। আমি মােটা মানুষ ছুটতে পারব না। করি কী।

গণেশের প্রবেশ

 গণেশ। তিনটে প্রবন্ধ।

 নরােত্তম। কটা বাজল কে জানে।

 গণেশ। একটা হচ্ছে আধুনিক স্ত্রীজাতির―

 নরােত্তম। মশায় ঘড়ি আছে? দেখুন তো সময়―

 গণেশ। আজ্ঞে ঘড়ি নেই। আমার প্রবন্ধের একটা হচ্ছে―

 নরোত্তম। (উচ্চস্বরে) ওরে মোধো, আপিসের চাপকানটা কোথায় রাখলি?

 গণেশ। বুঝেছেন নরোত্তমবাবু, একটা প্রবন্ধ হিন্দুধর্মের―

 নরোত্তম। (নেপথ্যে চাহিয়া) ওই ওই ওই সর্বনাশ হল। ছেলেটা প’ল বুঝি।

প্রস্থান

 গণেশ। কাল থেকে চেষ্টা করছি কাউকে পাচ্ছি নে। কে যেন কাকের বাসায় ঢিল ছুঁড়েছে—বাসাসুদ্ধ প্রাণী চঞ্চল হয়ে বেড়াচ্ছে। পূর্বে যে বাসায় ছিলুম সেখানে একটি লোকও বাকি রইল না, কাজেই ছেড়ে আসতে হল। এখানেই বা এরা দু-দণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারে কেন। যাই নরোত্তমবাবুকে ধরি গে। লোকটি বেশ মোটাসোটা, ভালোমানুষ।

তৃতীয় দৃশ্য

নরোত্তম ও নবকান্ত

 নবকান্ত। দেখো নরোত্তম, হৃদয়ের রহস্য―

 নরোত্তম। এখন নয় ভাই, আপিস আছে।

 নবকান্ত। (সনিশ্বাসে) আহা, তোমার তো আপিস আছে, আমার কী আছে বলো তো? আমার যে occupation gone! Othello's occupation gone! শেকস্‌পিয়র যে লিখেছে― কোথায় যাও― আঃ শোনো না―

 নরোত্তম। না ভাই, আমাকে মাপ করো― সাহেব রাগ করবে, আমারও occupation যাবার জো হবে।

 নবকান্ত। আমি বলছিলুম, উভয় পক্ষের যদি— আহা শোনো না― উভয় পক্ষের―

 নরোত্তম। ও-সব কথা আমার জানা নেই, উভয় পক্ষের কথা শুনলে আমার ভারি গোল বেধে যায়, মাথা ঘুরতে থাকে।

 নবকান্ত। তুমি আমার কথা না শুনেই যে ভয় পাচ্ছ, আমি যা বলছি তা তর্কের কথা নয়― হৃদয়ের কথা, সহজ কথা।

 নরোত্তম। কিন্তু ওই সহজ কথাতেই সাড়ে চারটে বেজে যাবে― আমায় ছাড়ো।

 নবকান্ত। আচ্ছা দেখো, দশ মিনিটের বেশি লাগবে না― ঘড়ি ধরে থাকো, আমি বলে যাই।

 নরোত্তম। (সকাতরে) নবকান্ত, কেন তোমরা সকলে আমাকে নিয়েই পড়েছ? ও-ঘরে হরি আছে, নবীন আছে, তাদের কাছে তো ঘেঁষ না। সেদিন ঠিক এমনি সময়ে হৃদয়ের রহস্যের কথা পাড়লে সাড়ে দুপুর বেজে গেল— সাহেবের কাছে জরিমানা দিতে হল। আবার আজও সেই হৃদয়ের রহস্য। গরিবের চাকরিটি গেলে হৃদয়ের রহস্য আমার কোন্ কাজে লাগবে!

প্রস্থানোদ্যম

 নবকান্ত। (ধরিয়া) রাগ করলে ভাই?

 নয়োত্তম। না, রাগের কথা হচ্ছে না। আপিসের বেলা হল তাই তাড়াতাড়ি করছি।

প্রস্থানোদ্যম

 নবকান্ত। (ধরিয়া) না ভাই, তুমি রাগ করছ।

 নরােত্তম। এও তাে বিষম মুশকিলে ফেললে। কিন্তু শীতকালের দিনে কথায় কথায় বেলা হয়ে যায়।

প্রস্থানােদ্যম

 নবকান্ত। (ধরিয়া) না ভাই, তুমি রাগ করে চলে যাচ্ছ, আমার সমস্ত দিন মন খারাপ থাকবে।

 নয়ােত্তম। আচ্ছা ভাই, আপিস থেকে ফিরে এসে কথা হবে।

প্রস্থানােদ্যম

 নবকান্ত। না, তুমি বলাে, আমাকে মাপ করলে।

 নরােত্তম। মাপ করলুম।

প্রস্থানোদ্যম

 নবকান্ত। (ধরিয়া) না ভাই, তােমার মুখ যে প্রসন্ন দেখছি নে।

 নরােত্তম। প্রসন্ন হবে কী করে। বেলা যে বিস্তর হল।

 নবকান্ত। (আটক করিয়া) প্রসন্ন মুখে মাপ করে যাও, তবে ছাড়ব।

 নরােত্তম। তােমাকে মাপ করব কি, তুমি আমাকে মাপ করাে। আমি পায়ে ধরছি, নাকে খত দিচ্ছি, আর যা বল তাই করছি কিন্তু এই অবেলায় হৃদয়ের রহস্য শুনতে পারব না।

প্রস্থান

চতুর্থ দৃশ্য

নরােত্তমের পশ্চাতে গণেশ

 গণেশ। অত হাঁপাচ্ছেন কেন? একটু স্থির হন না। আমার প্রবন্ধে―

 নরােত্তম। কী ভয়ানক। মশায়ের খাওয়া হয়েছে?

 গণেশ। আজ্ঞে না। কিন্তু আমার লেখায়—

 নরােত্তম। মাছি পড়েছে।

 গণেশ। আজ্ঞে মাছি পড়বে কেন?

 নরােত্তম। আপনার লেখায় নয়— আমার দুধে মাছি পড়েছে।

প্রস্থানােদ্যম,

নবকান্তের প্রবেশ

 নবকান্ত। তুমি ভাই রাগ করে এলে― আমার মন স্থির হচ্ছে না।

 নরােত্তম। আমারও মন অত্যন্ত অস্থির।

তাড়াতাড়ি প্রস্থান।

 নবকান্ত। যাই, নরােত্তমের মুখ প্রফুল্ল না দেখে তাকে তাে কিছুতেই ছাড়তে পারি নে।

প্রস্থান

 গণেশ। নরােত্তমবাবু গেলেন কোথায় দেখে আসি।

পঞ্চম দৃশ্য

নবােত্তম আহারে প্রবৃত্ত

গণেশের প্রবেশ

 গণেশ। এত সকাল সকাল আহারে বসেছেন যে!

 নরােত্তম। সকাল আর কই? আপিসে বেরােতে হবে যে।

 গণেশ। এখনি যেতে হবে! তবে যতক্ষণ খাচ্ছেন ততক্ষণ যদি আমার―

 নরােত্তম। মশায়, আমার খাওয়া হয়েছে, আমি উঠলুম।

 গণেশ। কিছুই যে খেলেন না, সবই যে পড়ে রইল। পানতামাক তো খাবেন, ততক্ষণ যদি―

 নরোত্তম। (নেপথ্যে চাহিয়া) ওই রে নবকান্ত মুখ বিমর্ষ করে আসছে। আজ্ঞে না, পানতামাকে প্রয়োজন নেই, আমি চললুম।

প্রস্থান

নবকান্তের প্রবেশ

 নবকান্ত। নরোত্তম কোথায় মশায়?

 গণেশ। (খাতা বাহির করিয়া) তিনি চলে গেছেন। তা হোক না, আপনি বসুন না।

 নবকান্ত। (দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া) হায়, আমার কী অবস্থা হল।

 গণেশ। কিছুই হয় নি, আপনি ভাববেন না, বেশ আছেন। হিন্দুপ্রকাশে আমার লেখা―

 নবকান্ত। কিছুই নয়। বলেন কী। হৃদয়ের―

 গণেশ। হৃদয়ের কথা তো হচ্ছিল না। আর্যমনীষিগণের―

 নবকান্ত। আর্যমনীষী আবার কোত্থেকে এল? হৃদয়ের কথাই তো হচ্ছিল। আমি বলছিলুম হৃদয় যখন―

 গণেশ। আমি যা লিখেছি তার বিষয়টা হচ্ছে আর্যমনীষিগণ যে-সকল বিধান করে গেছেন আমাদের বর্তমান অবস্থায় তার কী করা উচিত।

 নবকান্ত। শ্রাদ্ধ করা উচিত। সে যাক গে― যার হৃদয়ে তুষানল ধিকি ধিকি জ্বলছে―

 গণেশ। সে যেন ভদ্রলোকের ঘরের চালের উপর গিয়ে না বসে, তাহলেই লঙ্কাকাণ্ড বাধবে। আমার প্রশ্ন এই, শাস্ত্রের মূলে কী আছে—

 নবকান্ত। কচু!

 গণেশ। এবং তার থেকে কী ফলছে?

 নবকান্ত। কলা।

 গণেশ। এবং সে-মূল উদ্ধার কে করবে?

 নবকান্ত। বরাহ অবতার।

 গণেশ। সে-ফল ভােগ করবে কে?

 নবকান্ত। হনুমান অবতার। এখন আমার প্রশ্ন এই, জগতে সকলের চেয়ে গভীর রহস্য কী?

 গণেশ। আর্যশাস্ত্র।

 নবকান্ত। প্রেম।

 গণেশ। মনু এবং―

 নবকান্ত। অভিমানের অশ্রুজল―

 গণেশ। এবং গৃহ্যসূত্র―

 নবকান্ত। এবং চোখে চোখে চাহনি―

 গণেশ। দায়ভাগ―

 নবকান্ত। এবং প্রাণে প্রাণে মিলন।

ষষ্ঠ দৃশ্য

গণেশ লিখিতে প্রবৃত্ত

 গণেশ। বিষয়টা গুরুতর। “নারদের ঢেঁকি এবং আধুনিক বেলুন”—আরম্ভটা দিব্যি হয়েছে, শেষটা মেলাতে পারছি নে। তা শেষটা না হলেও চলবে। কিন্তু শােনাই কাকে। নরােত্তমবাবু বাসা ছেড়ে গেছেন। হরিহরবাবুর কাছে ঘেঁষতে ভয় হয়।

নবকান্তের প্রবেশ

 নবকান্ত। হায় হায়, নরােত্তম বাসা ছেড়েছে, এখন যাই কার কাছে।

 গণেশ। এই যে নবকান্তবাবু, নারদের ঢেঁকি―

 নবকান্ত। নিথর জ্যোৎস্নাজালে নধর নবীন―

আদ্যানাথের প্রবেশ

 গণেশ। বাঁচা গেল। আদ্যনাথবাবু, আমার নারদের ঢেঁকি―

 নবকান্ত। নয়ননলিনীদল নিদ্রায় নিলীন―

 গণেশ। সনাতনশাস্ত্র মন্থন করে নারদের ঢেঁকি―

 আদ্যনাথ। ঢেঁকি শব্দটা কি গ্রাম্যতাদোষদুষ্ট নয়? সাহিত্যদর্পণে―

ভৃত্যের প্রবেশ

 ভৃত্য। বাবুরা পালাও গো, আগুন লেগেছেন।

 আদ্যনাথ। বেটার ব্যাকরণজ্ঞান দেখো।

 নবকান্ত। (সনিশ্বাসে) আগুন! হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে―

গণেশ। নল যে বিনা-আয়ােজনে আগুন জ্বালাতেন সে অক্সিজেন হাইড্রোজেন যােগে।

আদ্যনাথ। ওটা যাবনিক প্রয়ােগ হল। ও-স্থলে—

ঘরে অগ্নির আবির্ভাব

১২৯৩