হাস্যকৌতুক (১৯৪৬)/অন্ত্যেষ্টি-সৎকার

অন্ত্যেষ্টি-সৎকার

প্রথম দৃশ্য

রায় কৃষ্ণকিশোর বাহাদুর মৃত্যুশয্যায় শয়ান। চন্দ্রকিশোর

নন্দকিশোর ও ইন্দ্রকিশোর পুত্রত্রয় পরামর্শে রত

ডাক্তার উপস্থিত। মহিলাগণ ক্রন্দনোন্মুখী

 চন্দ্র। কাকে কাকে লিখি।

 ইন্দ্র। রেনল্‌ড্‌স সায়েবকে লেখো।

 কৃষ্ণ। (অতিকষ্টে) কী লিখবে বাবা।

 নন্দ। তোমার মৃত্যুসংবাদ।

 কৃষ্ণ। এখনো তো মরি নি বাবা।

 ইন্দ্র। এখনি নেই বা মলে কিন্তু একটা সময় স্থির করে লিখতে হবে তো।

 চন্দ্র। যত শীঘ্র পারি সাহেবদের কন্‌ডোলেন্‌স লেটার্‌গুলো আদায় করে কাগজে ছাপিয়ে ফেলা দরকার, এর পরে জুড়িয়ে গেলে ছাপিয়ে তেমন ফল হবে না।

 কৃষ্ণ। রোসো বাবা, আগে আমি জুড়িয়ে যাই।

 নন্দ। সবুর করলে চলবে না বাবা। সিমলে দার্জিলিঙে যাদের যাদের চিঠি পাঠাতে হবে তাদের একটা ফর্দ করা যাক। বলে যাও।

 চন্দ্র। লাট সায়েব, ইলবর্ট সায়েব, উইলসন সায়েব, বেরেসফোর্ড, মেকলে, পিকক―

 কৃষ্ণ। বাবা, কানের কাছে ও কী নামগুলো করছ, তার চেয়ে ভগবানের নাম করো। অন্তিমে তিনিই সহায়। হরি হে―

 ইন্দ্র। ভালো মনে করিয়ে দিয়েছ, হ্যারিসন সায়েবকে ধরা হয় নি।

 কৃষ্ণ। বাবা, বলো রাম রাম―

 নন্দ। তাই তো, রামজে সায়েবকে তো ভুলেছিলুম।

 কৃষ্ণ। নারায়ণ, নারায়ণ।

 চন্দ্র। নন্দ, লেখো তো, নোরান সায়েবের নামটা লেখো তো।

স্কন্দকিশোরের প্রবেশ

 স্কন্দ। বা, তোমরা বেশ তো। আসল কাজটাই তো বাকি।

 চন্দ্র। কী বলো তো।

 স্কন্দ। ঘাটে যাবার প্রোসেশ্যনে যারা যোগ দেবে তাদের তো আগে থাকতে খবর দেওয়া চাই।

 কৃষ্ণ। বাবা, কোনটা আসল হল। আগে তো মরতে হবে, তার পরে―

 চন্দ্র। সে জন্য ভাবনা নেই। ডাক্তার।

 ডাক্তার। আজ্ঞে।

 চন্দ্র। বাবার আর কত বাকি। সাধারণকে কখন আসতে বলব?

 ডাক্তার। বোধ হয়—

রমণীদের রোদন

 স্কন্দ। (বিরক্ত হইয়া) মা, তুমি তো ভারি উৎপাত আরম্ভ করলে। আগে কথাটা জিজ্ঞাসা করে নিই। কখন, ডাক্তার?

 ডাক্তার। বোধ হয় রাত্রি―

রমণীদের পুনশ্চ ক্রন্দন

 নন্দ। এ তো মুশকিল হল। কাজের সময় এমন করলে তো চলে না। তোমাদের কান্নায় ফল কী? আমরা বড়ো বড়ো সায়েবদের কাঁদুনি চিঠি কাগজে ছাপিয়ে দেব।

রমণীগণকে বহিস্করণ

 স্কন্দ। ডাক্তার, কী বোধ হচ্ছে?

 ডাক্তার। যে-রকম দেখছি আজ রাত্রি চারটের সময়েই বা হয়ে যায়।

 চন্দ্র। তবে তো আর সময়― নন্দ যাও ছুটে যাও, স্লিপগুলো দাঁড়িয়ে থেকে ছাপিয়ে আনো।

 ডাক্তার। কিন্তু ওযুধটা আগে―

 স্কন্দ। আরে, তোমার ডাক্তারখানা তো পালিয়ে যাচ্ছে না। প্রেস বন্ধ হলে যে মুশকিলে পড়তে হবে।

 ডাক্তার। আজ্ঞে, রুগি যে ততক্ষণে―

 চন্দ্র। সেই জন্যই তো তাড়াতাড়ি― পাছে স্লিপ ছাপার আগেই রুগি―

 নন্দ। এই আমি চললুম।

 স্কন্দ। লিখে দিয়ো কাল আটটার সময় প্রোসেশ্যন আরম্ভ হবে।

দ্বিতীয় দৃশ্য

 স্কন্দ। কই ডাক্তার, চারটে ছেড়ে সাতটা বাজল যে।

 ডাক্তার। (অপ্রতিভ ভাবে) তাই তো, নাড়ী এখনো বেশ সবল আছে।

 চন্দ্র। বা, তুমি তো বেশ ডাক্তার। আচ্ছা বিপদে ফেলেছ।

 নন্দ। ওষুধটা আনতে দেরি করেই বিপদ ঘটল। ডাক্তারের ওষুধ বন্ধ হয়েই বাবা বল পেয়েছেন।

 কৃষ্ণ। এতক্ষণ তোমরা প্রফুল্ল ছিলে হঠাৎ বিমর্ষ হলে কেন? আমি তো ভালোই বোধ করছি।

 স্কন্দ। আমরা যে ভালো বোধ করছি নে। ঘাটে যাবার এন্‌গেজমেণ্ট যে করে বসেছি।

 কৃষ্ণ। তাই তো। আমার মরা উচিত ছিল।

 ডাক্তার। (অসহ্য হইয়া) এক কাজ কর তো সব গোল চুকে যায়।

 ইন্দ্র। কী।

 স্কন্দ। কী।

 চন্দ্র। কী।

 নন্দ। কী।

 ডাক্তার। ওঁর বদলে তোমরা যদি কেউ সময়মতো মর।

তৃতীয় দৃশ্য

বহির্বাটীতে লোকসমাগম

 কানাই। ওহে সাড়ে আটটা বাজল। দেরি কিসের।

 চন্দ্র। বসুন, একটু তামাক খান।

 কানাই। তামাক তো সকাল থেকেই খাচ্ছি।

 বলাই। কই হে, তোমাদের জোগাড় তো কিছুই দেখি নে।

 চন্দ্র। জোগাড় সমস্তই আছে― আমাদের কোনো ত্রুটি নেই— এখন কেবল―

 রামতারণ। কি হে চন্দ্র, আর দেরি করা তো ভালো হয় না।

 চন্দ্র। সে কি আমি বুঝি নে― কিন্তু

 হরিহর। দেরি কিসের জন্যে হচ্ছে? আপিসের বেলা হয় যে, কাণ্ডখানা কী।

ইন্দ্রকিশোরের প্রবেশ

 ইন্দ্র। ব্যস্ত হবেন না, হল বলে। ততক্ষণ কনডোলেন্‌স-লেটারগুলাে পড়ুন। (হাতে হাতে বিলি) এটা ল্যামবার্টের, এটা হ্যারিসনের, এটা সার জেমস―

স্কন্দকিশােরে প্রবেশ

 স্কন্দ। এই নিন ততক্ষণে কাগজে বাবার মৃত্যুর বিবরণ পড়ুন। এই স্টেটসম্যান, এই ইংলিশম্যান?

 মধুসূদন। (যাদবের প্রতি) দেখছ ভাই, বাঙালি পাংচুয়ালিটি কাকে বলে জানে না।

 ইন্দ্র। ঠিক বলেছেন। মরবে তবু পাংচুয়াল হবে না।

খববের কাগজ ও কনডােলেন্‌স্‌ পত্র পড়িতে পড়িতে অভ্যাগতগণের অশ্রুপাত

 রাধামােহন। (সজল নেত্রে) হরি হে দীনবন্ধু।

 নয়ানচাঁদ। হায়, হায়, এমন লােকেরও এমন বিপদ ঘটে।

 নবদ্বীপচন্দ্র। (সনিশ্বাসে) প্রভু তােমারই ইচ্ছা।

 রসিক। “হৃদয়বৃন্তে ফুটে যে কমল”—তার পরে কী ভুলে যাচ্ছি―

“হৃদয়বৃন্তে ফুটে যে কমল
তাহারে কাল অকালে ছিঁড়িলে, হৃদয়
মৃণাল ডুবে শোকসাগরের জলে।”

এও ঠিক তাই। হৃদয়-মৃণাল শােকসাগরের জলে। আহা।

 আডি এস্কোয়ার। O tempora, O mores!

 তর্কবাগীশ। চলচ্চিত্তং চলদ্‌বিত্তং চলজ্জীবন—হায় হায় হায়!

 ন্যায়বাগীশ। যদুপতেঃ ক্ক গতা মথুরাপুরী, রঘুপতেঃ―(কণ্ঠরোধ)

 দুঃখীরাম। হা কৃষ্ণকিশাের বাহাদুর, তুমি কোথায় গেলে।

 নেপথ্য হইতে ক্ষীণকণ্ঠ। আমি এইখানেই আছি, বাবা। দোহাই, তােরা অত চেঁচাস নে।

১২৯৩