হাস্যকৌতুক (১৯৪৬)/একান্নবর্তী

একান্নবর্তী

দৌলতচন্দ্র ও কানাই

 দৌলত। হৃদয় যখন ভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে তখন কোম্পানির দমকল এলেও থামাতে পারে না। একান্নবর্তী পরিবার প্রথা সম্বন্ধে সভায় দাড়িয়ে অনর্গল বলতে লাগলুম, সভাপতি ঘুমিয়ে পড়াতে নিষেধ করবার কেউ রইল না। শেষকালে দুজন ছোকরা এসে দুই হাত ধরে আমাকে টেনে বসিয়ে দিলে। সেদিন এত উৎসাহ হয়েছিল।

 কানাই। বটে, তা হবার কথাই তো। তা আপনি কী বলেছিলেন?

 দৌলত। আমি বলেছিলেম স্বার্থত্যাগের একমাত্র উপায় একান্নবর্তী পরিবার। যেখানে পরের অর্থেই জীবননির্বাহ হয় সেখানে স্বার্থের কোনো প্রয়োজনই হয় না। খবরের কাগজে আমার বক্তৃতা খুব রটে গেছে— তারা সকলেই বলছে, দুঃখের বিষয় দৌলতবাবুর পরিবার কেউ নেই, তিনি একলা। (দীর্ঘনিশ্বাস)

জয়নারায়ণের প্রবেশ

 জয়নারায়ণ। জয় হোক বাবা। আমি তোমার পিসে।

 দৌলত। সে কী মশায়, আমার তো পিসি নেই।

 জয়নারায়ণ। না, তাঁর কাল হয়েছে বটে।

 দৌলত। পিসি কোনোকালেই যে ছিলেন না।

 জয়নারায়ণ। (ঈষৎ হাসিয়া) সে কী করে হয় বাবা। আমি তাহলে তোমার পিসে হলুম কী করে।

কানাইয়ের প্রতি

 কী বলেন মশাই।

 কানাই। তা তো বটেই।

 দৌলত। যে আজ্ঞে, তা আপনার কী অভিপ্রায়ে আগমন?

 জয়নারায়ণ। অভিপ্রায় তেমন বিশেষ কিছু নয়। শুনলুম, আমরা পৃথক হয়ে আছি বলে খবরের কাগজে নিন্দে করছে তাই একত্র বাস করতে এসেছি।

 দৌলত। আপনার সম্পত্তি কিছু আছে?

 জয়নারায়ণ। কিছু নেই, কোনো বালাই নেই, কোনো উৎপাত নেই। কেবল এক খুড়তত ভাই আছে। তা সে-ও এল বলে।

 দৌলত। তা বটে। তাঁর কিছু আছে?

 জয়নারায়ণ। কিছু না, কোনো ঝঞ্চাট না। কেবল দুই স্ত্রী ও চারটি শিশুসন্তান। তারাও এল বলে। এতক্ষণ এসে পড়ত; যাত্রা করবার বেলা দুই স্ত্রীতে চুলোচুলি বেধে গেছে তাই যা দেরি।

 দৌলত। কানাই, কী করা যায়।

 জয়নারায়ণ। তোমাকে কিছুই করতে হবে না তারা আপনারাই আসবে, ভাবনা কী দৌলত। এত অল্পে কাতর হয়ো না। তারা আজ সন্ধ্যের মধ্যেই এসে পৌছবে।

রামচরণের প্রবেশ ও ভূমিষ্ঠ হইয়া দৌলতকে প্রণাম

 রামচরণ। মামা, তোমার বক্তৃতায় বড়ো লজ্জা দিয়েছ।

 দৌলত। কে হে বাপু, কে তুমি?

 রামচরণ। আজ্ঞে, আপনারই ভাগনে রামচরণ। ইস্টিশনে লোক পাঠিয়ে দিন― সেখেনে একটি পুঁটুলি আর বুড়ী মাকে রেখে এসেছি।

 দৌলত। এখানে কী করতে আসা?

 রামচরণ। বাস করতে।

 দৌলত। আর কোথাও বাসস্থান নেই?

 রামচরণ। একরকম আছে বটে কিন্তু সেখানে স্বার্থত্যাগ শিক্ষা হয় না।

 দৌলত। (ভীতভাবে) কানাই!

 কানাই। আপনার উপদেশ উনি যে-রকম দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করেছেন ওঁকে বোধ হয় নড়ানো শক্ত হবে।

নিতাইয়ের প্রবেশ

 নিতাই। দাদা, চাকরি ছেড়ে এলুম, নইলে তোমার যে নিন্দে হয়। কে আছিস রে। ঝট করে দুটো ডাব পেড়ে নিয়ে আয় তো। বড়ো পিপাসা লেগেছে।

নদেরচাঁদের প্রবেশ

 নদেরচাঁদ। এই লও খুড়ো, আমার সমস্ত স্বার্থ বিসর্জন দিতে এসেছি। এই আমার ভাঙা বোকনা, থেলো হুঁকো আর এই বেড়ালছানাটি। মধ্যে ও-দুটো পৈতৃক সম্পত্তি, বেড়ালছানা আমার স্বোপার্জিত। আর আমায় দোষ দিতে পারবে না, তোমার এখানেই আমি লেগে রইলুম।

দরজির প্রবেশ

 দৌলত। তুমি আমার কে হও বাপু?

 দরজি। আজ্ঞে আমি দরজি, আপনার গায়ের মাপ নিতে এসেছি।

 দৌলত। এখন যাও টানাটানির সময়, এখন আমি কাপড় করাতে পারব না।

 নদেরচাঁদ। খলিফাজি, যাও কোথায়। আমার গায়ের মাপটা নেও। খুড়োর গায়ে যে-রকম ফুলকাটা ছিটের জামা দেখছি অমনি ছ-জোড়া হলেই আমার চলে যাবে। যদি বেশ ভালো রকম করে তৈরি করে দিতে পার তো খুড়ো তোমাকে খুশি করে দেবেন, বুঝেছ খলিফাজি।

 দরজি। যে আজ্ঞে।

গায়ের মাপ লওন

বালকসমেত পরেশনাথের প্রবেশ

 পরেশ। (দৌলতকে প্রণাম করিয়া বালকের প্রতি) তোর জেঠামশায়কে প্রণাম কর্। দাদা, এই লও তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র।

 দৌলত। আমার ভ্রাতুষ্পুত্র!

 পরেশ। যাকে চলিত বাংলায় বলে ভাইপো। দাদা যে একেবারে অবাক। ভ্রাতৃ শব্দের ষষ্ঠীতে হয় ভ্রাতুঃ; তার উপর পুত্র শব্দ যোগ করলেই হল ভ্রাতুষ্পুত্র। স্বয়ং পাণিনি বোপদেব রয়েছেন, অন্য প্রমাণের প্রয়োজন কী? অতএব ইনি হলেন ভাইপো।

 কানাই। আপনার ছেলেটি কী করেন?

 পরেশ। ওকে নিজেই পড়াচ্ছিলুম। হ্রস্ব ই পর্যন্ত সেরে দীর্ঘ ইতে এমনি আটকা পড়ল যে ভাবলুম দৌলদ্দা যখন আছেন তখন ছেলের লেখাপড়ার দরকার কী? যে বেটার হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান নেই তার পক্ষে বাবা জেঠা দুই সমান। কেমন কি না।

 কানাই। সমান বই কি।

 পরেশ। দাদা বলেছেন নিজের ক্ষুধা হেয় জ্ঞান করে পরের ক্ষুধানিবৃত্তির সুখ একমাত্র একান্নবর্তী পরিবারেই সম্ভব। শুনেই ঠাওরালুম, এ সুখ দাদা নিশ্চয়ই অনেক দিন পান নি। যদি বা পেয়ে থাকেন বিস্মৃত হয়েছেন; তাই নিতান্ত মমতাপরবশ হয়ে ছেলেটিকে এখানে নিয়ে এলুম। রাবণের চুলো যদি কোথাও জ্বলে সে এর পেটের মধ্যে।

নটবরের প্রবেশ

 নটবর। (দৌলতের কান মলিয়া) কি রে শালা। শুনলুম না কি শালার শােকে সভায় দাঁড়িয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিস?

 দৌলত। কে হে তুমি বেল্লিক। ভদ্রলােকের কানে হাত দাও।

 নটবর। ভগ্নীপতির কান মলব না তো কি কান ভাড়া করে এনে মলব! কি বলেন মশায়।

 কানাই। কথাটা তাে ঠিক বটে।

 দৌলত। কী বল হে কানাই! আমার স্ত্রীই নেই তাে আবার শালা কিসের?

 নটবর। তােমারই যেন স্ত্রী নেই, তাই বলে আর কারও স্ত্রী নেই? একটু ভেবে দেখাে না।

 দৌলত। স্ত্রী তাে অনেকেরই আছে তা আর ভাবতে হবে কী?

 নটবর। (হাসিয়া) তবে?

 দৌলত। (সরােষে) তবে কী। তুমি আমার শালা কোন্ সম্পর্কে?

 নটবর। কেন, দাদার সম্পর্কে। দাদা আছেন তাে! শালাই যেন ভাঁড়ালে কিন্তু দাদা বেকবুল গেলে তাে চলবে না।

 দৌলত। আমি তাে জানতেম, নেই, কিন্তু আজ যে-রকম দেখছি তাতে―

 নটবর। থাক, তাহলেই তাে চুকে গেল। বেশি বকাবকিতে কাজ কী। ভদ্রলােক বসে আছেন, এর সামনে কে শালা আর কে শালা নয় তা নিয়ে তকরার করা ভালাে দেখায় না।

দৌলতের পশ্চাৎ হইতে তাকিয়া টানিয়া লইয়া

 একটু জিরােনাে যাক। এক ছিলিম তামাক ডাকো।

ফলমূলমিষ্টান্ন লইয়া ভৃত্যের প্রবেশ

 ভৃত্য। (দৌলতকে) আপনার জলখাবার।

 দৌলত। (সরোষে) বেটা, তোকে এখানে কে খাবার আনতে বলেছে। বাড়ির ভিতর নিয়ে যা।

 পরেশ। বিলক্ষণ, তাতে দোষ হয়েছে কী!

ভৃত্যের প্রতি

 ওরে তুই দিয়ে যা, এদিকে দিয়ে যা।

থালা লইয়া আহার আরম্ভ

চুলের মুঠি ধরিয়া বিধুভূষণকে লইয়া দুই স্ত্রীলোকের প্রবেশ

 প্রথমা। পোড়ারমুখো, তোমার মরণ হয় না?

 দৌলত। (শশব্যস্তে) এঁরা কে।

 জয়নারায়ণ। বাবা ব্যস্ত হয়ো না, আমার সেই খুড়তুতো ভাই এসে পৌঁচেছেন।

 প্রথমা। ও আবাগের বেটা ভূত।

 দ্বিতীয়া। মার্ ঝাঁটা, মার্ ঝাঁটা

 দৌলত। ভাই কানাই।

 কানাই। সহিষ্ণুতা শিক্ষার এমন উপায় আর কী আছে।

 প্রথমা। মিনসে বুড়োবয়সে আক্কেল খুইয়ে বসেছে।

 দ্বিতীয়া। ওগো এত লোকের এত স্বামী মরছে যমরাজ কী তোমাকেই ভুলেছে।

 দৌলত। বাছারা একটু ঠাণ্ডা হও।

 উভয়ে। ঠাণ্ডা হব কিরে মিনসে। তুই ঠাণ্ডা হ, তোর সাত পুরুষ ঠাণ্ডা হয়ে মরুক।

 দৌলত। কানাই।

 কানাই। গৃহ পূর্ণ হয়েছে—

 দৌলত। গ্রহ পূর্ণ হয়েছে বলো―

 কানাই। যাই হােক আজ আর আমাকে প্রয়ােজন নেই। আমি এই বেলা সরি।

প্রস্থান

 দৌলত। (উচ্চস্বরে) কানাই, আমাকে একলা রেখে পালাও কোথায়।

 সকলে মিলিয়া। (দৌলতকে চাপিয়া ধরিয়া) একলা কিসের। আমরা সবাই আছি, আমরা কেউ নড়ব না।

 দৌলত। বল কী।

 সকলে। হাঁ তােমার গা ছুঁয়ে বলছি।

১২৯৪