বিষম বুদ্ধি/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
―――→○◇○←―――
রাজচন্দ্র দাস ইতিপূর্ব্বে আমাকে বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার এক চপেটাঘাতে রসিক ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে। সেই মৃতদেহ দেখিবার আমার প্রধান উদ্দেশ্য এই হইল যে, তাহার গণ্ডদেশে চপেটাঘাতের কোনরূপ চিহ্ন বর্ত্তমান কি না।
মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, সেই কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া রসিকের মৃতদেহটী উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলাম। উহার গণ্ডদেশে বিষম চপেটাঘাতের কোনরূপ চিহ্নই দেখিতে পাইলাম না। সেইস্থানে সেই সময় যে ডোম উপস্থিত ছিল, তখন তাহাকে সেই মৃতদেহ সম্পূর্ণরূপে বিবস্ত্র করিতে কহিলাম। আদেশমাত্র উহার অঙ্গে যে সকল বস্ত্র ছিল, তাহা খুলিয়া সে দূরে রাখিয়া দিল। দুইটী বাতীর সাহায্যে সেই মৃতদেহের সমস্ত অঙ্গ অতি উত্তমরূপে দেখিলাম, কোনস্থানেই বিশেষ কোনরূপ চিহ্ন প্রথমতঃ পরিলক্ষিত হইল না; কিন্তু অনেক অনুসন্ধানের পর, উহার বক্ষঃস্থলে পয়সা পরিমিত একটী কালো বর্ণের গোলাকার চিহ্ন দৃষ্টিগোচর হইল। উহা কিসের চিহ্ন, তাহা ভাল করিয়া দেখিলে বুঝিতে পারিলাম, উহা একটী লৌহ পেরেকের গোলাকায় শেষ অংশ। বোধ হইল, ঐ পেরেকটী জোরপূর্ব্বক উহার বক্ষঃস্থলে বসাইয়া দেওয়া হইয়াছে; কিন্তু ঐ স্থান দিয়া রক্তাদি বহির্গত হইবার এরূপ কোন চিহ্ন পরিলক্ষিত হইল না। অঙ্গুলির দ্বারা ঐ পেরেকটী আস্তে আস্তে উঠাইবার চেষ্টা করিলাম। দেখিলাম, উহা উত্তমরূপে সংবিদ্ধ রহিয়াছে। বিশেষরূপ জোর করিয়া না উঠাইলে উহা সহজে দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে না। সুতরাং উহা উঠাইবার আর চেষ্টা না করিয়া যেরূপ অবস্থায় উহা দেহের সহিত সংবিদ্ধ ছিল, সেইরূপ অবস্থাতেই রাখিয়া দিলাম। এখন বুঝিতে পারিলাম, রসিকের বক্ষস্থলে ঐ লৌহ পেরেক প্রবিষ্ট হইবার নিমিত্তই তাহার মৃত্যু ঘটিয়াছে। বিসূচিকা রোগে উহার মৃত্যু হয় নাই বা কেবলমাত্র এক চপেটাঘাতেই উহার ইহজীবন শেষ হয় নাই।
রাজচন্দ্র দাসঘাষ সেই সময় আমাদিগের সহিত সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন এবং আমাদিগের ন্যায় ঐ লৌহপেরেক তিনিও সেই মৃতদেহে স্বচক্ষে দর্শন করিলেন। তখন আমি তাঁহাকে কহিলাম, যদি আপনার একটামাত্র চপেটাঘাতেই ইহার মৃত্যু হইয়া থাকে, তাহা হইলে ইহার বক্ষঃস্থলে এই লৌহপেরেক কিরূপে বিদ্ধ হইল? আমার বোধ হয়, কেবলমাত্র চপেটাঘাতে ইহার মৃত্যু হয় নাই, ইহার বক্ষঃস্থলে এই লৌহপেরেক প্রবিষ্ট হইয়াই ইহাকে ইহজীবন পরিত্যাগ করাইয়াছে। এ সম্বন্ধে আপনি এখন কি বলিতে চাহেন? যদি এই লৌহপেরেক আপনার কর্ত্তৃকই ইহার বক্ষঃস্থলে প্রবিষ্ট হইয়া থাকে, তাহা আপনি এখন বলিতে পারেন। যখন নিজের দোষ স্বীকার করিতে আপনা হইতেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, তখন প্রকৃত যাহা ঘটিয়াছিল, তাহাই প্রকাশ করা এখন আপনার সম্পূর্ণরূপে কর্ত্তব্য। কতক সত্য, কতক মিথ্যা বলিয়া আমাদিগকে নিরর্থক কষ্ট দেওয়া আপনার কর্ত্তব্য নহে। কারণ, অনুসন্ধানে পরিশেষে সমস্তই বাহির হইয়া পড়িলে, কোন কথাই গোপন থাকিবে না।
আমার কথার উত্তরে রাজচন্দ্র দাস কহিলেন, আমি আপনার নিকট প্রকৃত কথাই বলিয়াছি, কোন কথা গোপন করি নাই। যদি কোন কথা গোপন করিবার ইচ্ছা থাকিত, তাহা হইলে আমি নিজ ইচ্ছায় থানায় গমন করিয়া আত্মসমর্পণ করিব কেন? এ সম্বন্ধে আপনারা কিছুই জানিতেন না, কে হত হইল বা কাহা-কর্ত্তৃক হত হইল, এ সংবাদ আপনাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হয় নাই। সুতরাং আমি যে আপনাদিগের কর্ত্তৃক ধৃত হইব, তাহারই বা সম্ভাবনা কি ছিল? এরূপ অবস্থায় আমি নিজে আপনার নিকট আসিয়া আত্মসমর্পণ করিব কেন? পূর্ব্ব হইতে উহার বক্ষস্থলে যদি কোনরূপ লৌহপেরেক আবদ্ধ হইয়া থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। কিন্তু আমি উহাকে কেবলমাত্র একটি ভিন্ন চপেটাঘাত করি নাই, সেই চপেটাঘাতের পরেই সে সেইস্থানে পড়িয়া যায় ও তাহার মৃত্যু হয়। সুতরাং আমার অনুমান হয় যে, আমার চপেটাখাতেই উহার মৃত্যু হইয়াছে।
রাজচন্দ্র দাসের কথা শুনিয়া আমি সেই সময় কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। রাজচন্দ্র যাহা বলিতেছিলেন, তৎসম্বন্ধে একটু ভাবিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, এ পর্য্যন্ত যতদূর আমরা অবগত হইতে পারিয়াছি, তাহা রাজচন্দ্র বলিয়া না দিলে কোনরূপ উপায়েই আমাদিগের জানিবার উপায় ছিল না যে, মৃতব্যক্তি কে? কোথা হইতে তাহাকে সেইস্থানে আনা হইয়াছে এবং কেই বা তাহাকে আনিয়াছে। মনে করুন, রাজচন্দ্র দাস আমাদিগের নিকট গমন করেন নাই বা আমাদিগকে কোন কথা বলেন নাই। এই মৃতদেহ দাহ করিবার ঘাট হইতে সংবাদ পাঠাইয়া দেওয়ার পর আমরা আসিয়া এখানে উপস্থিত হইয়াছি, এবং মৃতদেহ যাহারা এইস্থানে বহন করিয়া আনিয়াছিল, তাহাদিগের কাহাকেও প্রাপ্ত হই নাই, এইস্থানে আসিয়া কেবলমাত্র মৃতদেহই পাইয়াছি। তাহার অঙ্গে পেরেক বিদ্ধ আছে দেখিতে পাইয়াছি, এরূপ অবস্থায় এ মৃতদেহ কাহার, প্রথমতঃ অনুসন্ধান করিয়া তাহাই বাহির করা সহজ নহে, তাহার উপর কাহার কর্ত্তৃক এ ব্যক্তি হত হইয়াছে, তাহা বাহির করা যে কিরূপ দুঃসাধ্য, তাহা পাঠকগণ সহজেই অনুমান করিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় রাজচন্দ্র দাস নিজে আসিয়া থানায় উপস্থিত না হইলে তাহার উপর এই অপরাধ আমরা সহজে প্রমাণ করিতে পারিতাম বলিয়া অনুমান হয় না। প্রমাণ হওয়া দুরে থাকুক, রাজদন্দ্র দাসের দ্বারা যে এই কার্য্য ঘটিয়াছে, তাহাই বা জানিতে পারিতাম কিরূপে? এরূপ অবস্থায় রাজচন্দ্র দাস নিজে হাজির হইয়া যে সকল কথা বলিয়া তাঁহাকে বিষম বিপদে পতিত করিতেছে, তাহাই বা একেবারে অবিশ্বাস করি কি প্রকারে? হয় ত হইতে পারে, কোন ব্যক্তি কর্ত্তৃক তাহার বক্ষঃস্থলে পেরেক বিদ্ধ হইয়াছে, রাজচন্দ্র হয় ত তাহার কিছুই অবগত নহে। সেই পেরেক বিদ্ধকারীর উদ্দেশে গালি প্রদানকালে রাজচন্দ্র দাস তাহাকে প্রহার করিয়াছে এবং সেই প্রহারের পর রসিক সেইস্থানে পতিত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে।
মনে মনে এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা আসিয়া উপস্থিত হইল, কিন্তু সেই সকল চিন্তার দিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া ইহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। মৃতদেহ আপাততঃ সেই স্থানেই প্রহরীর জিম্মায় রহিল।
রাজচন্দ্র দাসকে সঙ্গে লইয়া প্রথমতঃ রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীতেই গিয়া উপস্থিত হইলাম। রাজচন্দ্র দাসকে জিজ্ঞাসা করায়, তিনি তাঁহার বাড়ীর সম্মুখবর্ত্তী রাস্তা দেখাইয়া দিয়া কহিলেন, এইস্থানে রসিক দাঁড়াইয়া আমাকে গালি দিয়াছিল। এইস্থানে আমি তাহাকে চপেটাঘাত করি, এবং এইস্থানে সে পতিত হইয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করে। এই বাড়ীতে রসিক বাস করিত।
রাজচন্দ্র দাসের কথা শুনিয়া ঐ স্থানের প্রত্যেককেই একে একে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু কেহই কোন কথা বলিতে পারিল না বা ইচ্ছা করিয়া বলিল না। রাজচন্দ্র দাস যাহা কহিলেন, তাহার সমর্থন করিবার বা তাহার বিপক্ষে কোন কথা কহিতে পারে, এরূপ কোন ব্যক্তিকে সেইস্থানে প্রাপ্ত হইলাম না।
যে বাড়ীতে রসিক বাস করিত, রাজচন্দ্র দাস তাহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিলেন, ঐ বাড়ী রাজচন্দ্র দাসের বাড়ীর সন্নিকটে। আমরা ঐ বাড়ীতে প্রবেশ করিলাম, দেখিলাম, উহা একটী মেস বা বাসাড়িয়া বাড়ী। কেহ পরিবার লইয়া ঐ বাড়ীতে বাস করেন না, কয়েকটী স্কুলের ছাত্র ও কয়েকজন অফিসের কর্ম্মচারী ঐ বাড়ীতে বাস করিয়া থাকেন। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে একজন অর্দ্ধবয়স্ক যুবক আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কে? এই বাসার সহিত আপনার কোনরূপ সংশ্রব আছে কি? আমার কথার উত্তরে তিনি কহিলেন, আমি এই বাসাতেই থাকি এবং এই বাসার বন্দোবস্তের ভার এখন আমার উপরই ন্যস্ত আছে।
আমি। তাহা হইলে আপনিই এখন এই বাসার ম্যানেজার?
ম্যানেজার। কতকটা বই কি? কেন, আপনার কি প্রয়োজন?
আমি। প্রয়োজন অনেক আছে, আপনাদিগের নিকট আমার অনেক কথা জিজ্ঞাস্য আছে। আপনি বোধ হয় অবগত নহেন যে, আমি কে? আমি জনৈক পুলিস-কর্ম্মচারী, একটা গুরুতর অপরাধের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছি।
ম্যানে। এত রাত্রে আসিয়াছেন কেন, দিবাভাগে আসিলেই পারিতেন। এখন বাসার প্রায় সকলেই নিদ্রাগত, আপনি দিনমানে আসিবেন, আমাদিগের দ্বারা যে কোনরূপ সাহায্য হইবার সম্ভাবনা, তাহা অনায়াসেই আমাদিগের নিকট হইতে প্রাপ্ত হইবেন।
আমি। বিশেষ প্রয়োজন না হইলে কি এই রাত্রিকালে আপনাদিগকে বিরক্ত করিতে আসিয়াছি। কল্য দিবাভাগে আসিলে যদি চলিত, তাহা হইলে এত রাত্রিতে এখানে আসিব কেন?
ম্যানে। বলুন, আমাদিগকে কি করিতে হইবে।
আমি। বিশেষ কিছুই করিতে হইবে না, কেবলমাত্র আমি আপনাদিগকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করি, তাহার যথাযথ উত্তর পাইলেই আমার কার্য শেষ হইয়া যাইবে।
ম্যানে। আপনি কি জানিতে চাহেন বলুন, আমার দ্বারা যতদূর সম্ভব, তাহার উত্তর আপনি এখনই প্রাপ্ত হইবেন।
আমি। আপনাদিগের এই বাসায় রসিক নামক কোন ব্যক্তি বাস করেন কি?
ম্যানে। হাঁ, রসিকবাবু এই বাসায় থাকেন।
আমি। তিনি এখন উপস্থিত আছেন কি?
ম্যানে। আমি ঠিক বলিতে পারি না, সম্ভবত তিনি তাঁহার ঘরে শুইয়া আছেন।
আমি। যদি আপনি একবার অনুগ্রহ করিয়া দেখিয়া আসেন, তাহা হইলে বড়ই অনুগৃহীত হই।
আমার কথা শুনিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ ভিতরে গমন করিলেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফিরিয়া আসিয়া কহিলেন, না মহাশয়! তিনি তাঁহার ঘরে নাই। তিনি কি কোনরূপে বিপদগ্রস্ত হইয়া আপনাদিগের হস্তে পতিত হইয়াছেন?
আমি। না, তিনি কোনরূপ বিপদগ্রস্ত হইয়া আমাদিগের হস্তে পতিত হন নাই, কিন্তু জগতের সমস্ত বিপদ হইতে তিনি অব্যাহতি প্রাপ্ত হইয়াছেন।
ম্যানে। আপনার এ কথার কোনরূপ অর্থ আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।
আমি। আমার কথার অর্থ অতি পরিষ্কার, তিনি ইহজগতে নাই। সুতরাং ইহজগতের সমস্ত বিপদ হইতে তিনি অব্যাহতি প্রাপ্ত হইয়াছেন।
ম্যানে। সে কি মহাশয়! কোথায় ও কিরূপে তাঁহার মৃত্যু ঘটিল।
আমি। তাহাই অসুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছি।
আমার কথা শুনিবামাত্র তিনি ঐ বাসার সমস্ত ব্যক্তিকেই ডাকিলেন। তাঁহার কথা শুনিয়া সকলেই নিদ্রা হইতে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক আমার নিকট আগমন করিয়া আমার চতুস্পার্শ্বে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইলেন, এবং প্রত্যেকেই একেবারে আমাকে নানা কথা জিজ্ঞাসা আরম্ভ করিলেন। কেহ বলিলেন, “রসিক বাবু কোথায়? কেহ বলিলেন, তিনি কি একেবারে মরিয়া গিয়াছেন? কেহ জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কোথায় মরিলেন, কোন স্ত্রীলোকের বাড়ীতে কি? কেহ বলিলেন, কে তাঁহাকে মারিয়া ফেলিল? কেহ জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি করিয়া জানিতে পারিলেন? কেহ কহিল, যে মারিয়াছে, সে ধরা পড়িয়াছে ত? এইরূপ যাহার মনে যাহা আসিতে লাগিল, তিনি তাহাই কহিতে লাগিলেন। উহার মধ্য হইতে কোন বালক বলিয়া উঠিল, টাকা খাইয়া এই মকর্দ্দমা না উড়াইয়া দিলে, আর পুলিস এখানে আসিবে কেন? কেহ কহিল, আসল আসামীকে ছাড়িয়া দিয়া আমাদিগের মধ্যে কাহাকে ধরিয়া আসামী করিতে পারে, তাহাই দেখিবার নিমিত্ত পুলিস এখানে আসিয়াছে। পুলিসের যত ক্ষমতা তাহা জানি, উহারা দোষীকে দেখিতে পায় না, কেবল নির্দ্দোষী লইয়াই টানাটানি করে। কোন কথা না শুনিয়াই বা কোন বিষয় অবগত না হইয়াই যাহার মনে যাহা আসিয়া উদয় হইতে লাগিল, তিনি তাহাই বলিতে আরম্ভ করিলেন। উহাদিগের অবস্থা দেখিয়া উহাদিগের কোন কথার উত্তর প্রদান না করিয়া আমি চুপ করিয়া যে যাহা বলিতে লাগিল, তাহাই শুনিতে লাগিলাম।
এই কলিকাতা শহরের মধ্যে যে সকল স্কুলের ছাত্র বা অফিসের কর্ম্মচারী বা কেরাণীমহল বাসা করিয়া বাস করিয়া থাকেন, তাহাদিগের গতিকই এইরূপ; তাহারা প্রথমতঃ কোন কথা উত্তমরূপে অনুধাবন করিয়া দেখেন না, যাহা ইচ্ছা তাহা বলিয়া সরকারী কর্ম্মচারীগণকে নিরর্থক গালিবর্ষণ করিয়া থাকেন। তাঁহাদিগের মনের এই ধারণা যে, সরকারী কর্ম্মচারী মাত্রই অবিশ্বাসী, উৎকোচগ্রাহী ও অনবরত নিরীহ লোকদিগের সর্ব্বনাশ করিতেই প্রস্তুত। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়াই যে কোন সরকারি কর্ম্মচারীর সহিত তাঁহাদিগের কোনরূপ সংস্রব ঘটে, অমনি তাহাদিগকে গালি প্রদান করেন, এবং তাহাদিগের সম্মুখেই তাহাদিগের বিপক্ষে নানারূপ মন্তব্য প্রকাশ করিয়া থাকেন। যে সকল উদ্ধতস্বভাবের কর্ম্মচারীগণ ঐ সকল কথা সহ্য করিতে না পারিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতিবাদ করিতে আরম্ভ করেন, তাহাদিগের সহিতই তৎক্ষণাৎ গোলযোগ বাধিয়া উঠে ও পরিশেষে উহার ফল বিষময় হইয়া দাঁড়ায়। আর যে সকল কর্ম্মচারী উহাদিগের স্বভাব উত্তমরূপে অবগত আছেন, তাঁহারা ঐ সকল কথা শুনিয়াও শোনেন না, বা উহার উপর কোনরূপ লক্ষ্যও করেন না। এইরূপে উহাদিগের যাহা যাহা বক্তব্য, তাহা শেষ হইয়া গেলে পরিশেষে তাহাদিগের দ্বারাই সকল কার্য্য অনায়াসেই উদ্ধার করিয়া লইতে পারেন। তাহার উপর যে সকল কর্ম্মচারী উহাদিগের পক্ষ অবলম্বন করিয়া, তাহাদিগের কথার পোষকতা করিয়া, সেই সময় যদি দুই চারিটী কথা বলিতে পারেন, অর্থাৎ সরকারি কর্ম্মচারীগণ সমস্তই অত্যাচারী, সমস্তই উৎকোচগ্রাহী, সমস্তই অবিশ্বাসী প্রভৃতি এইরূপ দুই চারিটী কথা বলিয়া তাহাদিগের মতে মত দিতে সমর্থ হন, তাহা হইলে যে কার্য্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত তিনি এইস্থানে গমন করিয়াছেন, সেই কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে তাঁহাকে কোনরূপ কষ্টই পাইতে হয় না। সেই স্থানে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলেও তাঁহার সমস্ত কার্য্য উহারা আপনা হইতেই বিশেষ আগ্রহ ও যত্নের সহিত নির্ব্বাহ করিয়া দিয়া থাকেন। এরূপ উদাহরণ আমি শত শত দেখাইতে পারি।
আমি, এই স্থানের বাসাড়িয়া বাড়ীর ছাত্রগণ ও অফিসের কর্ম্মচারীগণের অবস্থা উত্তমরূপে জানিতাম। সুতরাং উহাদিগের কথায় বিন্দুমাত্র লক্ষ্য না করিয়া, আমি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলাম ও উহাদিগের কথায় সমর্থন করিয়া পুলিস-কর্ম্মচারীগণ যে নিতান্ত অকর্ম্মণ্য ও অবিশ্বাসী, তাহার সত্য মিথ্যা দুই একটী উদাহরণও প্রদান করিলাম। দেখিলাম, আমার উপর সকলেই সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহারা আপনাপন মুখ বন্ধ করিলেন ও আমাকে সর্ব্বতোভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। তখন উহারা নিতান্ত অসঙ্গত কথা ছাড়িয়া দিয়া, সঙ্গত কথার আলোচনায় প্রস্তুত হইলেন। উহাদিগের মধ্যে একজন সকলকে চুপ করিতে বলিয়া আমার সহিত কথা কহিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
তিনি আমাকে প্রথমতঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, রসিকবাবু কি প্রকৃতই মরিয়া গিয়াছেন?
আমি। সত্য মরিয়া গিয়াছেন।
বাসাড়িয়া। তাহার যেরূপ স্বভাব ছিল, তাহাতে আমরা পূর্ব্বেই ভাবিয়াছিলাম যে, উহার দশা এইরূপই হইবে। সে কোথায় মরিয়া গেল, কোন স্ত্রীলোকের বাড়ীতে কি তাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে?
আমি। না।
বাসা। তাহার যেরূপ চরিত্রের কথা আমরা ইদানীন্তন জানিতে পারিয়াছিলাম, তাহাতে আমরা একরূপ স্থির করিয়াই রাখিয়াছিলাম যে, হয় বেশ্যাবাড়ীতে—না হয় মদ খাইয়া কোন রূপ বেটক্করে পড়িয়া সে তাহার জীবন হারাইবে।
আমি। আপনারা যেরূপ অনুমান করিয়া রাখিয়াছিলেন, ঘটিয়াছেও তাহাই। কিন্তু কিরূপে যে ঘটিল, তাহার এখন পর্য্যন্ত কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই বলিয়াই আপনাদিগের নিকট আগমন করিয়াছি। সে কি সদাসর্ব্বদাই নেশায় উন্মত্ত থাকিত?
বাসা। সদাসর্ব্বদা না হইলেও রাত্রিকালে প্রায়ই সুরাপান করিয়া সে বাসায় আসিত। অবশ্য আমরা সকল দিন জানিতে পারিতাম না যে, কখন সে ফিরিয়া আসিয়াছে। তাহার খাদ্য প্রায় নষ্ট হইত।
আমি। বেশ্যাবাড়ীর কথা বলিতেছেন, কোন বেশ্যাবাড়ীতে তাহার যাতায়াত ছিল?
বাসা। এ কথা আমরা বলিতে পারি না, ইহা আমাদিগের অনুমান মাত্র। তবে ইহা আমরা বেশ বুঝিতে পারিতাম যে, সে নিশ্চয়ই বেশ্যাসক্ত হইয়া পড়িয়াছে। তাহার উপর উহার আর একটী বিষম দোষ ঘটিয়াছিল। আপনি দেখিতে পাইতেছেন যে, আমরা গৃহস্থপল্লীর মধ্যে বাস করি। আমরা যে সময় বাসায় উপস্থিত না থাকিতাম, অথচ সে একাকী এই স্থানে থাকিত, সেই সময় নিকটবর্ত্তী গৃহস্থবর্গের কোন স্ত্রীলোককে জানালার সন্নিকটে আগমন করিবার বা ছাদের উপর উঠিবার যো ছিল না; স্ত্রীলোকগণকে দেখিতে পাইলেই প্রায়ই সে ঠাট্টা তামাসা ও অশ্লীলভাষা প্রয়োগ করিয়া তাহাদিগকে বিপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিত; ইহার জন্য কতদিন প্রতিবেশীবর্গের নিকট আমাদিগকে লাঞ্ছনা ভোগ করিতে হইয়াছে। আমরা একরূপ স্থির করিয়াই রাখিয়াছিলাম ও উহাকে বলিয়া দেওয়াও হইয়াছিল যে, এই মাসের এই কয়েকদিবস গত হইলেই তাহাকে এ বাসা পরিত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে। ইহার অনেক দিবস পূর্ব্বেই আমরা তাহাকে এই বাসা হইতে তাড়াইয়া দিবার সংকল্প করিয়াছিলাম, কিন্তু বাসার হিসাবে অনেকগুলি টাকা তাহার নিকট পাওনা থাকায় নিতান্ত দায়ে পড়িয়া কেবল তাহাকে এতদিবস রাখিতে হইয়াছে। কিন্তু এ মাসে আমরা সেই টাকার আশা পরিত্যাগ করিয়া তাহাকে বলিয়া দিয়াছিলাম যে, ১লা তারিখের মধ্যেই তিনি যেন এই বাসা পরিত্যাগ করিয়া অপর স্থানে চলিয়া যান। তিনিও আমাদিগের কথায় সম্মত হইয়া, শুনিয়াছি অপর বাসার অনুসন্ধান করিতেছিলেন। সে যাহা হউক, এখন তাহার মৃতদেহ পাইলেন কোথায়?
আমি। তাহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে কাশীমিত্রের শবদাহ করিবার ঘাটে।
বাসা। সেই স্থানে কে লইয়া গেল?
আমি। শুনিয়াছি, তাহার বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজন।
বাসা। বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে এক তো আমরাই সকলে আছি।
তাহার আত্মীয়স্বজন যে কেহ এখানে আছে, তাহা তো আমাদিগের বোধ হয় না। কারণ, এ কথা তো কখন আমরা শুনি নাই। যাহারা ঐ মৃতদেহ দাহ করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছিল, তাহাদিগকে পাইয়াছেন তো, তাহারা কি বলে?আমি। তাহাদিগকে পাওয়া যায় নাই, ঘাটে মৃতদেহ পরিত্যাগ করিয়া তাহারা পলায়ন করিয়াছে।
বাসা। উহার মৃত্যু হইয়াছে কিসে?
আমি। যাহারা মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিল, তাহারা বলিয়াছিল যে, বিসূচিকা রোগে উহার মৃত্যু হইয়াছে, কিন্তু মৃতদেহের বক্ষঃস্থলে একটী বড় লৌহ পেরেক বিদ্ধ আছে, সুতরাং উহাই উহার মৃত্যুর কারণ বলিয়া অনুমান হইল।
বাসা। উহার বক্ষঃস্থলে লৌহ পেরেক বিদ্ধ করিল কে?
আমি। তাহাই জানিবার জন্য অনুসন্ধান করিতে হইতেছে। আপনি বাসার সকলকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন যে, এখান হইতে ঐ মৃতদেহ কেহ তো সৎকার করিবার নিমিত্ত লইয়া যায় নাই?
বাসা। তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই জানিতে পারিতাম। .
উহার কথা শুনিয়া সকলেই বলিয়া উঠিলেন, “আমরা ইহার কিছুই জ্ঞাত নহি।”
আমি। রসিক যদি এই বাড়ীতে বা ইহার সন্নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে হত হইতেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বোধ হয়, আপনারা তাহা অনায়াসেই অবগত হইতে পারিতেন?
বাসা। অবগত হইতে পারিবার খুব সম্ভাবনা।
আমি। আর আপনাদিগের বাসাবাড়ী অথবা তার নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে যদি উহার মৃতদেহ পাওয়া যাইত, তাহা হইলে ঐ স্থান হইতে ঐ মৃতদেহ কাশীমিত্রের ঘাটে লইয়া যাইবার কালীনও বোধ হয়, আপনারা জানিতে পারিতেন।
বাসা। নিশ্চয়ই জানিতে পারিতাম, আর আমরা ভিন্ন এইস্থানে তাহার এরূপ আর কোন আত্মীয় আমরা দেখিতে পাইতেছি না যে, ঐ মৃতদেহ দাহ করিবার নিমিত্ত তাহারা লইয়া যাইতে সহজে সম্মত হয়। আমার বোধ হয়, যাহারা উহাকে হত্যা করিয়াছে, তাহারাই ঐ মৃতদেহ ভস্মে পরিণত করিবার মানসে ঐ স্থানে লইয়া গিয়াছিল।
আমি। যিনি উহাকে মারিয়াছেন, তিনি তো আপনাদিগের সম্মুখেই উপস্থিত আছেন। তিনি বলিতেছেন, ঐ মৃতদেহ তাহারা স্থানান্তরিত করে নাই, রসিকের আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবগণ ঐ মৃতদেহ লইয়া গিয়াছে।
বাসা। তাই হইলে রসিক বাবুকে যিনি হত্যা করিয়াছেন, তাকে আপনারা প্রাপ্ত হইয়াছেন, তিনি কোথায়?
আমি। আপনাদিগের, সম্মুখেই দণ্ডায়মান, আপনারা রাজচন্দ্র দাসকে চেনেন?
বাসা। এই বাবুটাকে?
আমি। হাঁ।
বাসা। খুব চিনি, ইনি আমাদিগের প্রতিবাসী; আমাদিগের বাসাবাড়ীর সংলগ্ন বাড়ীতে ইনি বাস করিয়া থাকেন।
আমি। ইনিই রসিক বাবুকে হত্যা করিয়াছেন।
বাসা। আমাদিগের সহিত মিথ্যা উপহাস করিতেছেন কেন? রাজচন্দ্র বাবু নিরীহ ভদ্রলোক, ইহাঁর দ্বারা এ কার্য্য কিছুতেই সম্পন্ন হইতে পারে না। এমন কি, যদি আমরা স্বচক্ষে ইহাঁকে ঐ কার্য্য সম্পন্ন করিতে দেখি, তাহা হইলেও আমাদিগের বিশ্বাস হয় না যে, ঐ কার্য্য ইহাঁর দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে।
আমি। আমি আপনাদিগের সহিত উপহাস করিতেছি না। রাজচন্দ্র দাসকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন, তিনি নিজে আপনাদিগকে কি বলেন?
বাসা। কি মহাশয়! এরূপ কথা হইতেছে কেন?
রাজ। রসিক আমার দ্বারাই হত হইয়াছে, ইহাই আমার বিশ্বাস।
বাসা। সে আপনার দ্বারা কিরূপে হত হইল?
রাজ। সন্ধ্যার সময় যখন আমি আমার অফিস হইতে প্রত্যাগমন করিতেছিলাম, সেই সময় রসিক আমার বাড়ীর সম্মুখে আমাকে দেখিতে পাইয়া, বিনাকারণে নিতান্ত অশ্লীল ভাষায় আমাকে গালি প্রদান করিতে আরম্ভ করে। আমি তাহাকে যত নিষেধ করি, সে ততই অশ্লীল ভাষায় গালি প্রদান করিতে থাকে। এরূপ অবস্থায় আমার নিতান্ত ক্রোধের উদয় হয় ও ঐ ক্রোধ আমি কোনরূপে সংবরণ করিতে না পারিয়া, সজোরে তাহার গণ্ডদেশে এক চপেটাঘাত করি। আমার ঐ চপেটাঘাত সে সহ্য করিতে না পারিয়া ঐ স্থানে পতিত হয় ও ইহজীবন পরিত্যাগ করে।
বাসা। এ কিরূপ কথা হইল! আপনার বাড়ীর সম্মুখে এই কার্য সম্পন্ন হইলে, প্রকারান্তরে আমাদিগের বাসার সম্মুখেই এই কার্য্য সম্পন্ন হইল, অথচ আমরা তাহার কিছুমাত্র জানিতে পারিলাম না। বিশেষ আপনি যে সময়ের কথা বলিতেছেন, সেই সময় আমাদিগের বাসার অনেকেই বাসায় উপস্থিত ছিলেন, এরূপ একটা ভয়ানক ঘটনা বাসার সম্মুখে ঘটিলে আমাদিগের মধ্যে কেহ না কেহ নিশ্চয়ই উহা জানিতে পারিতেন। আর এক চপেটাঘাতেই যদি উহার মৃত্যু হইয়া থাকে, তাহা হইলে উহার বক্ষঃস্থলে লৌহ পেরেক কিরূপে সংবিদ্ধ হইল?
রাজ। তাহা আমি বলিতে পারি না।
বাসা। উহাকে দাহ করিবার জন্য কে লইয়া গিয়াছিল?
রাজ। তাহা বলিতে পারি না। ও ঐ স্থানে পতিত হইবার পর আমি আমার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করি। হঠাৎ এই অবস্থা ঘটিয়া পড়ায়, আমার মনের কিছুমাত্র স্থিরতা থাকে না, সুতরাং আমি আর বাড়ী হইতে বহির্গত হই নাই। কিন্তু পরে শুনিয়াছিলাম, ঐ মৃতদেহ তাহার আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুবান্ধবেরা লইয়া গিয়াছে। সুতরাং আমি মনে করিয়াছিলাম যে, আপনারাই ঐ মৃতদেহ সৎকার মানসে স্থানান্তরিত করিয়াছেন।
বাসা। আমরা অনেক দিবস হইতে এই স্থানে বাসা করিয়া আছি। আপনার সহিত বিশেষরূপ আলাপ পরিচয় না থাকিলেও আপনাকে আমরা বিশেষরূপে অবগত আছি। অবগত আছি যে, আপনি নিতান্ত ভদ্রলোক, নিজের বাড়ীতে পরিবারসহ বাস করিয়া থাকেন, এ পর্যন্ত কখন আপনার সহিত কাহারও বিবাদ বিসম্বাদ হইতে দেখি নাই বা শুনি নাই; সুতরাং এরূপ অবস্থায় এরূপ কার্য্য যে কখন আপনার দ্বারা হইতে পারে, তাহা বিশ্বাস করা সহজ নহে; কিন্তু আপনি যেরূপ বলিতেছেন, তাহা আমরা সহজে বিশ্বাস করিতে সমর্থ নহি। রসিক আজ যদি নিতান্ত অশ্লীল ভাষায় রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া গালি প্রদান করিত, তাহা হইলে আমরা কেহ না কেহ নিশ্চয়ই তাহা জানিতে পারিতাম। তাহার উপর সে হত হইয়া রাস্তার উপর পতিত থাকিলে নিশ্চয়ই ঐ স্থানে লোকের জনতা হইত ও আমরা নিশ্চয়ই তাহা জানিতে পারিতাম। বৈকাল হইতে রাত্রি ৯টা ১০টা পর্য্যন্ত আমাদিগের এই বাসার কেহ না কেহ যে কতবার ঐ স্থান দিয়া গমনাগমন করিয়াছে, তাহার স্থিরতা নাই। এরূপ অবস্থায় আপনি মনে করেন কি, যে আমরা সকলেই অন্ধ হইয়া ঐ স্থান দিয়া যাতায়াত করিয়াছি। তাহার উপর বলুন দেখি, যদি আমরা ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া না লইয়া গিয়া থাকি, তাহা হইলে এই স্থান হইতে অপর কোন ব্যক্তি উহা লইয়া যাইবে, আর লইয়া গেলেও যে আমরা উহা একেবারে জানিতে পারিব না, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? আমার বোধ হয়, এই ঘটনা এই স্থানে আদৌ ঘটে নাই, বা আপনা কর্ত্তৃক সে শমন-সদনে গমন করে নাই। ইহা অপর স্থানের ঘটনা ও যাহার দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হইয়াছে, আপনি তাহাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত সমস্ত দোষ আপনার উপর গ্রহণ করিতেছেন।
আমি। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা নিতান্ত অযুক্তি সঙ্গত কথা নহে, তবে ইহার ভিতর একটী কথা বিবেচনা করা আবশ্যক যে, যাহারা ঐ মৃতদেহ সৎকার করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছিল, তাহারা যখন দেখিল, ঐ মৃতদেহের সৎকার হইল না, অথচ ঐ সংবাদ পুলিসে প্রদত্ত হইল, তখন তাহারা বিপদগ্রস্ত হইবে ভাবিয়া ঐ মৃতদেহ পরিত্যাগ করিয়া সেইস্থান হইতে পলায়ন করিল। এইরূপে যাহারা পলায়ন করিয়া আসিয়াছে, তাহারা কি আর এখন সহজে স্বীকার করিবে যে, তাহারা ঐ মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিল।
বাসা। আপনার কথা প্রকৃত মনে করুন, আমরাই ঐ মৃতদেহ লইয়া গিয়াছিলাম ও বিপদের আশঙ্কা করিয়া ঐ মৃতদেহ ঐ স্থানে পরিত্যাগ করিয়া আমরা পলাইয়া আসিয়াছি। সুতরাং এখন আমরা তাহা কোনরূপেই স্বীকার করিব না। কিন্তু যে স্থানে ঐ মৃতদেহ পড়িয়াছিল বলিয়া জানিতে পারিতেছেন, ও যে স্থান হইতে ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছিল, সেইস্থানে অনুসন্ধান করিলেই তো জানিতে পারিবেন যে, প্রকৃতপক্ষে সেইস্থানে কোন মৃতদেহ ছিল কি না, ও সেইস্থান হইতে কোন মৃতদেহ কেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছে কি না? অনুসন্ধানে যদি অবগত হইতে পারেন যে, এইস্থানে ঐ মৃতদেহ পড়িয়াছিল ও এইস্থান হইতে ঐ মৃতদেহ কেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহা হইলেই প্রমাণ হইবে যে, আমরাই ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম, ও ঘাট হইতে ভয়ে পলাইয়া আসিয়াছি ও এখন পর্য্যন্ত মিথ্যা কথা বলিতেছি।
আমি। আপনার কথায় আমি সম্পূর্ণরূপে অনুমোদন করি। যদি এই স্থান হইতে ঐ মৃতদেহ স্থানান্তরিত হইয়া থাকে ও মৃত অবস্থায় রসিক যদি কিয়ৎক্ষণ ঐ রাস্তার উপর পড়িয়া থাকে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পাড়ার লোকে তাহা দেখিয়াছে; ও একটু অনুসন্ধান করিলেই অনায়াসেই এখন জানা যাইতে পারিবে। এখন রসিক কোন্ ঘরে বাস করিত, একবার তাহা দেখিয়া লই।