বিষম বুদ্ধি/প্রথম পরিচ্ছেদ
বিষম বুদ্ধি
প্রথম পরিচ্ছেদ।
প্রায় দশ বৎসর অতীত হইল, রাত্রি আন্দাজ ১১টার সময় আমি আমার থানার দৈনিক কার্য্য সমাপন করিয়া অফিস হইতে উঠিয়া কেবলমাত্র আমার থাকিবার স্থানে প্রবেশ করিয়াছি, এরূপ সময়ে একজন প্রহরী আমাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে আরম্ভ করিল। সে যেরূপ ব্যগ্রতার সহিত উচ্চৈঃস্বরে আমাকে ডাকিতেছিল, তাহা শুনিবমাত্রই আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, বিশেষ কোনরূপ গোলযোগ আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। এই ভাবিয়া আমিও দ্রুতগতি বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।
বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, যে প্রহরী আমাকে ডাকিতেছিল, তাহার সমভিব্যাহারে অপর আর একটী লোক সেইস্থানে দাঁড়াইয়া আছে। আমাকে দেখিবামাত্র ঐ প্রহরী সেই লোকটীর দিকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, “এই ব্যক্তি কি বলিতেছে শুনুন।”
প্রহরীর কথা শুনিয়া আমি তাহার দিকে লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, ইনি একজন বাঙ্গালী যুবক, বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অধিক হইবে বলিয়া অনুমান হয় না। মুখশ্রী ও পোষাকপরিচ্ছদ দেখিয়া ইহাকে কোন ভদ্রবংশসম্ভূত বলিয়া অনুমান হয়। কিন্তু ইহাকে কোনরূপ উত্তেজিত বা ক্রোধপূর্ণ বলিয়া অনুমান হয় না, ইহার মুখ দেখিয়া অনুমান হয় যে, ইহার অন্তরে কোনরূপ গভীর চিন্তা প্রবেশ করিয়াছে।
আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার নাম কি?
উত্তরে তিনি কহিলেন, আমার নাম রাজচন্দ্র দাস ঘােষ, আমি জাতিতে কায়স্থ, আপনাদিগের দাস।
আমি। এত রাত্রিতে থানায় আসিবার আপনার কি প্রয়ােজন হইয়াছে?
রাজ। বিশেষ প্রয়ােজন হইয়াছে বলিয়াই আমি আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। আমি আত্মসমর্পণ করিবার নিমিত্ত এইস্থানে উপস্থিত হইয়াছি।
আমি। আত্মসমর্পণ করিতে আসিয়াছেন, এ কথার অর্থ কি? আপনি কি কোনরূপ অপরাধে অভিযুক্ত আছেন?
রাজ। অভিযুক্ত এখন পর্য্যন্ত হই নাই, কিন্তু হইবার নিমিত্তই আসিয়াছি। আমার দ্বারা একটী বিষম অপরাধ হইয়া গিয়াছে, তাই আমি আপনা হইতেই আত্মসমর্পণ করিতে আগমন করিয়াছি।
আমি। বিষম অপরাধ!—কি বিষম অপরাধ করিয়াছেন?
রাজ। হত্যা।
আমি। কি! আপনি মনুষ্যহত্যা করিয়া আত্মসমর্পণ করিবার নিমিত্ত এখানে আসিয়াছেন?
রাজ। হাঁ মহাশয়।
আমি। কাহাকে হত্যা করিয়াছেন?
রাজ। আমি যাহাকে হত্যা করিয়াছি, তাহার নাম রসিক বাবু বলিয়াই আমি জানি।
আমি। তিনি কোথায় থাকিতেন?
রাজ। আমার বাড়ীর নিকটেই তিনি বাস করিয়া থাকেন। কি করেন, তাহা বলিতে পারি না; বোধ হয় কোন অফিসে তিনি চাকরি করিয়া থাকেন।
আমি। তাহার আর কে আপন লোক আছে?
রাজ। আর কাহাকেও তো ঐ বাড়ীতে দেখিতে পাই না। বোধ হয় তিনি একাকীই ঐ বাড়ীতে বাস করিতেন।
আমি। আপনি প্রকৃতই কি তাহাকে হত্যা করিয়াছেন?
রাজ। হত্যা না করিয়া কি আর আমি আপনার নিকট মিথ্যা কথা বলিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি।
আমি। আপনি তাহাকে হত্যা করিলেন কেন?
রাজ। আমি ইচ্ছা করিয়া তাহাকে হত্যা করি নাই। আজ রাত্রি আন্দাজ নয়টার সময় যখন আমি আমার কার্য্য হইতে প্রত্যাগমন করিয়া আমার বাটীর ভিতর গমন করিতেছিলাম, সেই সময় উহাকে আমি আমার বাড়ীর সম্মুখে দেখিতে পাইলাম। আমাকে দেখিবামাত্র সে আমাকে নিতান্ত কটুভাযায় গালি প্রদান করিল। আমার সহিত তাহার ভালরূপ পরিচয়ও ছিল না বা আমাদিগের মধ্যে কোনরূপ শত্রুতাও ছিল না। তথাপি বিনাকারণে সে আমাকে গালি প্রদান করিতে লাগিল দেখিয়া আমি ভাবিলাম, সে অপরকে গালি প্রদান করিবার ইচ্ছা করিয়া, আমাকে চিনিতে না পারিয়া, আমায় সেই ব্যক্তি বিবেচনা করিয়া, গালি প্রদান করিতেছে। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, তুমি যাহার উদ্দেশে গালি প্রদান করিতেছ, আমি সেই ব্যক্তি নহি, তুমি আমাকে চিনিতে না পারিয়া আমাকেই সেই ব্যক্তি অনুমান করিয়া বিষম ভ্রমে পতিত হইয়া, আমাকে অকারণে গালি প্রদান করিতেছ। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তিনি কহিলেন, আমি যাহাকে গালি প্রদান করিতেছি, তাহাকে আমি খুব চিনিতে পারিয়াছি, চিনিতে পারিয়াই গালি দিতেছি। এই কথা বলিয়া সে আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া আরও অকথ্যভাষায় আমাকে গালি প্রদান করিতে লাগিল। তাহার কথা শুনিলে নির্জীব পদার্থেরও ক্রোধের উদয় হয়; সুতরাং রক্তমাংসে গঠিত, আমি কিরূপে সেই ক্রোধ সংবরণ করিতে পারি! আমি নিতান্ত ক্রোধের বশবর্তী হইয়া তাহাকে সজোরে এক চপেটাঘাত করিলাম। সে আমার বিষম চপেটাঘাতের বেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিল, এরং ঘূরিতে ঘূরিতে সেইস্থানে পতিত হইয়া চির নিদ্রার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে; সুতরাং এখন আমি হত্যাকারী। আমার হস্তে রসিক হত হইয়াছে বলিয়াই আমি এখানে আসিয়া আত্মসমর্পণ করিতেছি। এখন আপনি আমাকে চরমদণ্ডে দণ্ডিত করিতে পারেন।
আমি। আপনি যেরূপ বর্ণনা করিলেন, তাহাতে বুঝিলাম, আপনি জ্ঞানকৃত মনুষ্যবধের অপরাধ করেন নাই, সুতরাং আপনি কোনক্রমেই চরমদণ্ডে দণ্ডিত হইতে পারেন না। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে আপনাকে ২৪ মাসের জন্য কারাবাস ভোগ করিতে হইবে মাত্র। আপনি যাহা কহিলেন, তাহা সাক্ষীর দ্বারা প্রমাণ হইবে ত?
রাজ। সাক্ষী আপনি পাইবেন না। কারণ, যে স্থানে এই ঘটনা ঘটিয়াছিল, সেইস্থানে সেই সময় আমি ও রসিক ভিন্ন আর কেহই ছিল না; সুতরাং এ ঘটনা আর কেহই দেখে নাই। আমি যাহা আপনাকে বলিতেছি, তাহা কখনই অস্বীকার করিব না। যে কোন স্থানে বা যে কোন বিচারকের নিকট আপনি আমাকে লইয়া যাইবেন, মুক্তকণ্ঠে আমি আপনার দোষ স্বীকার করিব। ইহাতে আমার ফাঁসীই হউক বা কারাবাসই হউক, কিছুতেই আমি মিথ্যাকথা কহিব না।
আমি। আচ্ছা, সে বিষয় পরে দেখা যাইবে, এখন রসিকের মৃতদেহ কোথায়?
রাজ। তাহা আমি বলিতে পারি না। মৃতদেহ কিছুক্ষণ পর্য্যন্ত রাজবর্ত্মের উপরই পতিত ছিল, কিন্তু তাহার কয়েকজন আত্মীয়ই হইবে, কি বন্ধুই হইবে আসিয়া সেই মৃতদেহের সৎকার করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছে।
আমি। তাহা হইলে এতক্ষণ পর্য্যন্ত বোধ হয়, সেই মৃতদেহের সৎকার কার্য্য শেষ হইয়া গিয়াছে।
রাজ। তাহা আমি বলিতে পারি না।
আমি। তাহা হইলে তুমি আমার সহিত চল, কলিকাতা ও সহরতলীর মধ্যে শবদাহ করিবার যে কয়েকটী ঘাট আছে, অগ্রে সেই কয়েকটী স্থানে গমন করিয়া দেখি, রসিকের শব যদি পাওয়া যায়। তুমি বলিতে পার না যে, কোন্ ঘটে সেই মৃতদেহ লইয়া গিয়াছে?
রাজ। না মহাশয়, আমি তাহা জানি না।
রাজচন্দ্র দাসের নিকট এই কথাগুলি শ্রবণ করিয়া আমি আর কালবিলম্ব করিতে সাহস করিলাম না। শবদাহের ঘাটে গমন করিবার নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ একখানি গাড়ী আনিতে পাঠাইলাম। রাজচন্দ্রকেও সেই প্রহরীর নিকট অল্প সময়ের নিমিত্ত রাখিয়া আমি বাহিরে গমন করিবার উপযোগী কাপড় পরিধান করিয়া, পুনরায় সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। একজন প্রহরী আমার নিমিত্ত একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ীও সেই স্থানে অনিয়া উপস্থিত করিল। আমি রাজচন্দ্র দাসকে সঙ্গে লইয়া সেই গাড়ীতে আরোহণ করিলাম। কলিকাতায় শবদাহ করিবার সর্ব্বপ্রধান ঘাট নিমতলা, সুতরাং সেইস্থানেই আমরা গমন করিলাম। সেই স্থানের সব-রেজিষ্ট্রারের নিকট হইতে অবগত হইলাম, সন্ধ্যার পর হইতে ঐ প্রকারের কোনরূপ মৃতদেহ দাহ করিবার মানসে সেইস্থানে আনীত হয় নাই, বা রসিক নামক কোন ব্যক্তির মৃতদেহ সেই রাত্রিতে দাহ করাও হয় নাই।
নিমতলাঘাটে এই সংবাদ অবগত হইয়া পরিশেষে মনে করিলাম, এখন কাশীমিত্রের ঘাটে গিয়া অনুসন্ধান করা আবশ্যক। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া ঐ গাড়ীতেই কাশীমিত্রের ঘাট অভিমুখে গমন করিলাম। যাইবার সময় নিমতলার ঘাটে সেই কর্ম্মচারীকে বলিয়া গেলাম যে, ইহার পরও যদি ঐরূপের কোন মৃতদেহ সেইস্থানে কেহ আনয়ন করে, তবে হঠাৎ যেন ভস্মীভূত করা না হয় এবং ঐ মৃতদেহ ঐ স্থানে রাখিয়া তৎক্ষণাৎই যেন পুলিসে সংবাদ পাঠান হয়। সব-রেজিষ্ট্রারবাবু আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, আমরাও কাশীমিত্রের ঘাট-অভিমুখে যাত্রা করিলাম।
আমরা যখন কাশীমিত্রের ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন রাত্রি একটা বাজিয়া গিয়াছে। সেইস্থানে গিয়া জানিতে পারিলাম, কয়েকটী লোক একটী মৃতদেহ ঐ স্থানে রাত্রি আন্দাজ এগারটার সময় লইয়া যায়, এবং বিসূচিকারোগে উহার মৃত্যু হইয়াছে, এইরূপ প্রকাশ করিয়া যাহাতে শীঘ্র ঐ মৃতদেহের দাহকার্য্য সম্পন্ন হয়, তাহার নিমিত্ত উহারা ঐ ঘাটের কর্ম্মচারীকে বিশেষরূপ অনুরোধ করে। ঐ মৃতদেহ দর্শন করিয়া ঐ কর্ম্মচারীর কেমন একরূপ সন্দেহের উদয় হয়। বিসূচিকারোগে মৃত্যু হইলে মৃতদেহে যে সকল নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়, এই মৃতদেহে সেই রূপ কোন চিহ্নই দেখিতে পাওয়া যায় নাই। সুতরাং তাহার মনে কেমন একরূপ সন্দেহ হয় এবং সেই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়াই তিনি ঐ মৃতদেহ দাহ করিতে অসম্মত হন, ও এই সংবাদ সেইস্থানের স্থানীয় পুলিসকে প্রদান করেন। স্থানীয় পুলিস সংবাদ পাইবামাত্র ঐ মৃতদেহের উপর একটা প্রহরীর পাহারা রাখিয়া দিয়া, ঐ সংবাদ আমার থানায় পাঠাইয়া দেন। আমি থানা হইতে এই অনুসন্ধানে বহির্গত হইয়া আসিবার পর ঐ সংবাদ আমার থানায় গিয়া উপস্থিত হয়।
যাহারা ঐ মৃতদেহ দাহ করিবার নিমিত্ত লইয়া গিয়াছিল, তাহারা যখন জানিতে পারিল যে, ঐ মৃতদেহ তাহারা সহজে দাহ করিতে সমর্থ হইবে না, তখন তাহারা সেই রাত্রির অন্ধকারের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া সেইস্থানে পুলিশ প্রহরী আসিবার পূর্বেই সকলে তথা হইতে একে একে প্রস্থান করিল। আমরা যখন সেই ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন দেখিলাম, সেই মৃতদেহ সেইস্থানে পড়িয়া আছে, এবং তাহার নিকট জনৈক প্রহরী পাহারা দিতেছে। কিন্তু যাহারা ঐ মৃতদেহ সেইস্থানে আনয়ন করিয়াছিল, তাহারা কেহই সেইস্থানে নাই। রাত্রিকালে যতদূর সম্ভব, ঐ মৃতদেহটী আমি একবার দেখিলাম, উহা দেখিয়া উহার মৃত্যুর কারণ আমি কিছুই অনুমান করিতে সমর্থ হইলাম না।
সেই ঘাটের কর্ম্মচারীকে তখন ডাকিলাম, ইনি একজন বহু পুরাতন কর্ম্মচারী। বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে, এবং এই কার্য্যে তিনি প্রায় ত্রিশ বৎসর অতিবাহিত করিয়াছেন। এই দীর্ঘকালের মধ্যে তিনি যে কত মৃতদেহ দর্শন করিয়া ঐ সকল মৃতদেহের দাহকার্য সম্পন্ন করিতে অনুমতি প্রদান করিয়াছেন, তাহা নির্ণয় করা সহজ নহে। এই বহুদর্শিতার ফলেই এই মৃতদেহ দাহ করিতে তিনি অনুমতি প্রদান করেন নাই। তিনি আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কি কারণে আপনি সন্দেহ করিলেন যে, এই ব্যক্তি স্বাভাবিক মৃত্যুতে মরে নাই?
কর্ম্মচারী। কারণ কিছুই বলিতে পারি না। যাহারা ঐ মৃতদেহ এখানে আনয়ন করিয়াছিল, তাহারা আমাকে বলিয়াছিল যে, বিসূচিকারোগে উহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি সহস্র সহস্র বিসূচি্রোকাগে মৃত ব্যক্তিকে দেখিয়াছি, কিন্তু এই মৃতদেহে বিসূচিকারোগের কোন চিহ্নই নাই। সুতরাং ইহার মৃত্যুসম্বন্ধে আমার সন্দেহ হয়, এবং সেই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়াই আমি পুলিসে সংবাদ প্রদান করিয়াছি।
আমি। ইহার কিসে মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া আপনার অনুমান হয়?
কর্ম্ম। আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। কোন রোগে ইহার মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া আমার অনুমান হয় না।
আমি। বিসূচিকারোগে যদি উহার মৃত্যু হইত, তাহা হইলে মৃতদেহ দেখিয়াই আপনি তাহা অনুমান করিতে পারিতেন?
কর্ম্ম। নিশ্চয়ই পারিতাম। বিসূচিকায়োগে মৃত্যু হইলে মৃতদেহে ঐ রোগের লক্ষণ বিদ্যমান থাকিত, ইহাতে তাহার কিছুই নাই।
আমি। যদি অপর কোন রোগে উহার মৃত্যু হইয়া থাকে?
কর্ম্ম। কোন রোগে ইহার মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া আমার অনুমান হয় না। কারণ, মৃতদেহে কোন প্রকার রোগের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় নাই, আমার বোধ হয়, কোন কারণে ইহার হঠাৎ মৃত্যু হইয়াছে।
আমি। আপনার অনুমান প্রকৃত বলিয়াই অনুমিত হইতেছে, কিন্তু যে সকল ব্যক্তি এই মৃতদেহ দাহ করিবার মানসে এখানে আনয়ন করিয়াছিল, তাহারা পলায়ন করিল কিরূপে?
কর্ম্ম। আমি যেমন এই সংবাদ থানায় প্রেরণ করিলাম, অমনই তাহারা বুঝিতে পারিল যে, তাহারা হয় ত বিশেষ বিপদে পতিত হইবে; সুতরাং সুযোগমতে তাহারা এইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমি তাহাদিগকে এইস্থানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া দিয়াছিলাম, এবং আমার অধীনে যে কয়েকটী ডোম আছে, তাহাদিগকেও বলিয়া দিয়াছিলাম, যে পর্য্যন্ত পুলিস আসিয়া উপস্থিত না হয়, সেই পর্য্যন্ত উহারা যেন পলায়ন না করে। কিন্তু ডোমগণ আমার আদেশ প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয় নাই, অন্ধকারের আশ্রয় অবলম্বন করিয়া তাহারা অনায়াসেই ডোমের হস্ত হইতে পলায়ন করিতে সমর্থ হয়।
কর্ম্মচারীর এই কথা শুনিয়া যে ডোমের নিকট হইতে উহারা পলায়ন করিতে সমর্থ হয়, তাহাকে ডাকিলাম। সে সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, যে কয়েক ব্যক্তি ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া আনিয়াছিল, তাহারা কিরূপে পলায়ন করিতে সমর্থ হইল? আমার কথার উত্তরে ডোম যেরূপ কহিল, তাহাতে আমি বুঝিতে পারিলাম, যে ছয়জন ব্যক্তি ঐ মৃতদেহ বহন করিয়া সেইস্থানে আনিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে চারিজন মৃতদেহ আনিবার পরই সেইস্থান হইতে প্রস্থান করে। শবদাহ করিবার নিমিত্ত কেবলমাত্র দুইজন ঐ মৃতদেহের নিকট থাকে ও ইহার পর তাহারা জানিতে পারে যে, যে পর্য্যন্ত পুলিস আসিয়া ঐ মৃতদেহ দাহ করিবার আদেশ প্রদান না করিবে, সেই পর্য্যন্ত উহাদিগকে সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে হইবে। যাহাতে তাহারা তথা হইতে প্রস্থান করিতে না পারে, তাহা দেখিবার ভার ঐ ডোমের উপর ন্যস্ত হয়। ঐ ডোম তাহাদিগকে লইয়া যখন একস্থানে বসাইয়া রাখিবার চেষ্টা করে, সেই সময় তারা দুইজন ভিন্ন ভিন্ন দুইদিক অবলম্বন করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিবার চেষ্টা করে। ডোম একজনকে ধরিতে সমর্থ হয়, কিন্তু অপর একজন সেই স্থান হইতে অনায়াসেই পলায়ন করিতে সমর্থ হয়। ডোম যাহাকে ধরিতে সমর্থ হয়, তাহাকে সেইস্থানে বসাইয়া রাখে, কিয়ৎক্ষণ সেইস্থানে বসিয়া থাকিবার পর ঐ ব্যক্তি দূরে একটী মনুষ্য দেখিতে পাইয়া, সেই ডোমকে কহে যে, যে ব্যক্তি পলাইয়া গিয়াছে, ঐ দেখ, সেই ব্যক্তি গমন করিতেছে। এই কথা শুনিবামাত্র অগ্রপশ্চাৎ মাত্র না ভাবিয়াই সেই মূর্খ ডোম সেইদিকে দ্রুতপদে গমন করে এবং সেই মনুষ্যের নিকট গমন করিয়া দেখে যে, সে একটী স্ত্রীলোক। ইহা দেখিয়াই সে সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করে ও দেখিতে পায়, যাহাকে সে সেইস্থানে রাখিয়া গিয়াছিল, সেও সেইস্থানে নাই; অন্ধকারের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া সে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছে। কিয়ৎক্ষণ তাহার অনুসন্ধান করিয়া দেখে, কিন্তু আর তাহাকে প্রাপ্ত হয় না। ইহার কিয়ৎক্ষণ পরেই পুলিস-প্রহরী আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হয়।
ডোমের নিকট এই অবস্থা অবগত হইয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, তাহারই বুদ্ধির দোষে ঐ ব্যক্তি প্রস্থান করিতে সমর্থ হইয়াছে। ঐরূপ শব-বাহকগণ প্রস্থান করায় (বর্ত্তমান ক্ষেত্রে না হউক) যে কতদূর অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা, পাঠকগণ তাহা অনায়াসেই অনুমান করিতে পারেন। এরূপ অবস্থায় শববহনকারী লোকগণকে প্রাপ্ত না হইলে ঐ মৃতদেহ কোথা হইতে যে অনীত হইয়াছে, তাহা স্থির করা নিতান্ত সহজ হয় না। তাহার উপর উহা যদি হত্যা মকর্দ্দমায় পরিণত হয়, তাহা হইলে ঐ মকর্দ্দমার অনুসন্ধান হওয়া একরূপ অসাধ্যই হইয়া উঠে। সে যাহা হউক, বর্ত্তমানক্ষেত্রে উহারা পলায়ন করিলেও সেইরূপ ভয়ের বিশেষরূপ কোন কারণ ছিল না। কারণ ইহা যদি হত্যা মকর্দ্দমায় পরিণত হয়, তাহা হইলে হত্যাকারীর অনুসন্ধান করিতে হইবে না। সে পূর্ব্ব হইতেই আপনি থানায় আসিয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছে এবং যে ব্যক্তি হত হইয়াছে, তাহার নাম ও বাসস্থান সে আমাদিগকে বলিয়া দিয়াছে। এরূপ অবস্থায় শববহনকারীগণ পলায়ন করায় আমাদিগের কার্য্যের বিশেষ কোনরূপ অসুবিধা ঘটে নাই।
সেই মৃতদেহটী পূর্ব্বে সেই ঘাটের কর্ম্মচারী নিজচক্ষে দেখিয়াছিলেন, এবং উহাতে বিসূচিকারোগের কোনরূপ লক্ষণ দেখিতে না পাইয়াই তাহার মনে সন্দেহ হয়, এবং সেই সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া তিনি থানায় সংবাদ প্রেরণ করেন। তিনি স্বচক্ষে উহা দর্শন করিলেও আমি তাঁহার কথার উপর সম্পূর্ণরূপ নির্ভর না করিয়া, নিজ চক্ষে সেই মৃতদেহটা পুনরায় দেখিবার ইচ্ছা করিলাম।