বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/অষ্টবিংশ প্রবাহ
অষ্টাবিংশ প্রবাহ
রাজার দক্ষিণ হস্ত—মন্ত্রী, বুদ্ধি—মন্ত্রী, বল—মন্ত্রী। মন্ত্রীপ্রবর গাজী রহ্মানের চক্ষেও আজ নিদ্রা নাই, একথা সপ্তবিংশতি প্রবাহের প্রারম্ভেই প্রকাশ করা হইয়াছে। গাজী রহ্মান এক্ষণে মহাব্যস্ত। নিশা প্রায় শেষ হইয়া আসিল, গুপ্তচরেরা এ পর্য্যন্ত ফিরিয়া আসে নাই। আজিকার সংবাদ, দামেস্ক নগরের সংবাদ—এজিদ-শিবিরের নূতন সংবাদ, এ পর্য্যন্ত কোনও সংবাদই তিনি প্রাপ্ত হইতে পারেন নাই: দ্বিতীয় দিনে শিবির আক্রমণের উদ্যোগে এজিদ জয়নাল আবেদীনের প্রাণবধ হইতে বিরত হইল,—ইহাতে কি কোন নিগূঢ় তত্ত্ব আছে? আজ হউক, কাল হউক, শিবির আক্রমণ হইবেই হইবে,—সে ভয়ে জয়নালের প্রাণধে ক্ষান্ত হইবে কেন?
দূরদর্শী মন্ত্রী উপরোক্ত আলোচনায় চিন্তার বেগ বিস্তার করিয়াছেন। নগর, প্রান্তর, শিবির, বন্দীগৃহ, যুদ্ধক্ষেত্র, সৈনিকদল, শূলদণ্ড, এজিদ, মারওয়ান, সকলের বিষয় এক একবার আলোচনা করিতেছেন। আবার মনে উঠিল: জয়নাল-বধে ক্ষান্ত থাকিরে কেন? মারওয়ানের কূটবুদ্ধির সীমা বহুদূরব্যাপী। নিশাও প্রায় শেষ হইয়া আসিল, এখনও কেহ শিবিরে ফিরিতেছে না, ইহাই বা কারণ কি? আর যে দুইটি ছদ্মবেশীর কথা শুনিলাম, তাহারা শিবিরের দিকে আসিতেছিল, প্রহরীদিগের সতর্কতায় কৃতকার্য্য হইতে পারে নাই।—দুই তিনবার চেষ্টা করিয়াও শিবিয়ের বহির্ভাগ রেখার নিকটে আশা দুরে থাকুক, সহস্র হস্ত ব্যবধান হইতে ফিরিয়া গিয়াছে। ইহারাই বা কে? বিশেষ গোপন ভাবে চরদিগকে, শেষে পঞ্চবিংশতি আম্বাজী সৈন্যকেও পাঠাইয়াছি। তাহারাই বা কি করিল? মন্ত্রিপ্রবর এই সকল বিষয় চিন্তা করিতে করিতে শিবির অভ্যন্তরস্থ তৃতীয় দ্বার পর্য্যন্ত আসিয়া সর্ব্বপ্রধান দ্বারী মালিককে জিজ্ঞাসা করিলেন: কোন সংবাদ জানিতে পারিয়াছ?
মালিক বলিল, “আমি এ পর্য্যন্ত কোন সংবাদ পাই নাই।”
মন্ত্রিবর মৃদুমন্দপদে চতুর্থ দ্বার পর্য্যন্ত যাইয়া সাদ্কে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন সংবাদ নাই?”
সাদ্ জোড়করে বলিল, “আমি যে সংবাদ পাইয়াছি, তাহা বিশেষ প্রয়োজনীয় নহে বলিয়া জানাই নাই।”
“কি সংবাদ?”
“শিবির-বহির্দ্বারের চন্দ্ররেখা পর্য্যন্ত শাহ্বাজের পাহারায় আছে। তাহার কিছু দূরেই সীমা-নির্দ্দিষ্ট খর্জ্জুর বৃক্ষ। সেই বৃক্ষের দুরে স্তূপাকার শিলাখণ্ডোপরি সেই দুইটি লোক অস্ফুটস্বরে কি আলাপ করিতেছিল। অনুমানে বোধ হয়, তাহারা কোনরূপ দুরভিসন্ধিতেই আসিয়াছিল।”
মন্ত্রির আরও চিন্তিত হইলেন। ক্রমে শিবির বহির্দ্বার পর্য্যন্ত যাইয়া দাঁড়াইতেই সুদক্ষ প্রহরী আবদুল কাদের করজোড়ে বলিল, “শিলাসমষ্টির নিকটে যে দুইজন ছদ্মবেশী বসিয়াছিল, তাহাদের সঙ্গে আর একজন আসিয়া মিশিয়াছে। এ সকল সংবাদে কোন বিশেষ সারত্ব নাই বলিয়া চরেরা পুনরায় সেইস্থানে গিয়াছে।”
উভয়ে এই কথা কহিতেছেন, ইতিমধ্যে দামেস্ক-নগরে প্রেরিত গুপ্তচর দ্বারে প্রবেশ করিয়াই মন্ত্রিবরকে দেখিয়া নতশিরে অভিবাদনপূর্ব্বক বলিল, “আজ বড় ভয়ানক সংবাদ শুনিতে হইয়াছে। জয়নাল আবেদীন বন্দী গৃহে নাই। এজিদের আজ্ঞায় মারওয়ান জয়নাল আবেদীনকে ধরিয়া আনিতে গিয়াছিল, না পাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে। দামেস্ক-নগরে ঘরে ঘরে এজিদের সন্ধানী লোক ফিরিতেছে; রাজপথ, গুপ্তপথ, দীন-দরিদ্রের কুটীর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। জয়নাল আবেদীন কোথায় গিয়াছেন, তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যাইতেছে না।”
এ সংবাদ শুনিয়া গাজী রহ্মান একেবারে নিস্তব্ধ হইলেন। বহু চিন্তায় পর সাব্যস্ত হইল: জয়নাল আবেদীন নগর হইতে বাহির হইয়াছেন, সন্দেহ নাই। শত্রুহস্তেও তিনি পতিত হন নাই। কিন্তু আশঙ্কা অনেক। এই অভাবনীয় সংবাদে মন্ত্রীপ্রবরের মস্তক ঘুরিয়া গেল; মস্তিষ্কের মজ্জা চিন্তাশক্তির অপরিসীম বেগে অধিকতর আলোড়িত হইয়া বিন্দু বিন্দু ঘর্ম্মবিন্দুতে ললাট পরিশোভিত হইল।
একজন গুপ্তচর আসিয়া সেই সময় বলিতে লাগিলেন, “সেই নিশাচর শিলাখণ্ডে বসিয়া আলাপ করিতেছিল, কোন স্পষ্ট কথাই বুঝা যাইতে ছিল না। কেবল ‘মদিনা’ ‘চতুর’ ‘ফিরিয়া যাই’ এই তিনটি কথা বুঝা গিয়াছিল! ইতিমধ্যে আর একজন লোক হঠাৎ সেইখানে উপস্থিত হইলেই উহারা যেন ভয়ে ভীত হইয়া গাত্রোত্থান করিল। আগন্তুক জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কে?” তাহাতে তাহারা উত্তর করিল—“আমরা পথিক।” পুনরায় প্রশ্ন—“পথিক এ পথে কেন?” উত্তর—“পথ ভুলিয়া।” আবার প্রশ্ন—“কোথায় যাইবে? উত্তর—“দামেস্ক নগরে।” “কি আশা?” —“চাকুরী।” “বসতি কোথায়?—“মদিনা।” অমনি চতুর্দ্দিক হইতে শব্দ হইল, “আর কোথায় যাইবি?” “মদিনার লোক চাকুরীর জন্য দামেস্কে?” দেখিতে দেখিতে আম্বাজী গুপ্ত সৈন্যগণ বর্শাহস্তে তিন জনকেই ঘিরিয়া ফেলিল, পঞ্চবিংশতি বর্শা-ফলক তাহাদের বক্ষ এবং পৃষ্ঠে উত্থিত হইয়া তিন জনকেই বন্দী করিল। সৈন্যগণ বলিল, প্রভাতে পরিচয়—পরীক্ষার পর মুক্তি।”
মন্ত্রিবর এই সকল কথা মনোযোগের সহিত শুনিয়া আদেশ করিলেন এখনই আরও শত বর্শাধারী সৈন্য লইয়া ভিন্ন ভিন্ন পথে ঐ বন্দী তিনজনকে বিশেষ সতর্কতার সহিত আনিয়া তিন স্থানে আবদ্ধ কর। সাবধান! কাহার সহিত যে কেহ আর কোন কথা না কহিতে পারে,—দেখা না করিতে পারে। সাবধান! বন্দীগণের প্রতি কোন প্রকার অবজ্ঞা বা অপমানসূচক কোন কথা কেহ যেন প্রয়োগ না করে। আর তোমাদের মধ্যে কেহ দামেস্ক-নগয়ে যাও, কেহ এজিদ-শিবিরের নিকটও সন্ধান কর। নিকটবর্ত্তী পর্ব্বত, বন, উপবন, যেখানে মানুষের গতিবিধি —যাওয়া-আসা সম্ভব মনে কর, সেইখানেই সন্ধান করিবে। আর সতর্ক হইয়া সর্ব্বদা এই কথা মনে মনে রাখিয়া দেখিও যে, কেহ কাহাকেও ধরিয়া কোথাও লইয়া যায় কিনা। যদি ধরিয়া লয়, তাহার অনুসরণে যাইবে—দুই এক জন আসিয়া শিবিরেও সংবাদ দিবে। নিশা অবসানের সহিত এই সংবাদ তোমাদের কাছে চাই। চরগণ, আজই তোমাদের পরিশ্রমের শেষ দিন। আজিকার পরিশ্রমই যথার্থ পরিশ্রম। প্রভুর উপকার ও সাহায্যের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিবে—প্রত্যুষে পুরস্কার। আমি তোমাদের আগমন-প্রতীক্ষায় জাগরিত রহিলাম!”
গুপ্তচরগণ মন্ত্রিবরের পদচুম্বন করিয়া স্ব স্ব গন্তব্যপথে যথেচ্ছা চলিয়া গেল। মন্ত্রিবর চক্ষের পলক ফিরাইতে অবসর পাইলেন না, কে কোথায় কোন্ পথে চলিয়া গেল, তাহা স্থির করিতে পারিলেন না। একটু চিন্তা করিয়া তিনি আর একটি আজ্ঞা প্রচার করিলেন,—নিশাবসানের পূর্ব্বে এজিদশিবিরের নিকট ভেৱী বাজাইতে রাজাইতে ঘোষণা করিবে: “তিনটি লোক আমাদের হাতে বন্দী; যদি তোমাদের শিবিরস্থ কেহ হয়, তবে সূর্য্যোদয়ের পর চাহিয়া পাঠাইলেই ছাড়িয়া দিব।” মন্ত্রিবর এই আজ্ঞা প্রচার করিয়া বহির্দ্বার হইতে চলিয়া গেলেন।