বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/সপ্তবিংশ প্রবাহ
সপ্তবিংশ প্রবাহ
রজনী দ্বিপ্রহর। তিথির পরিভাগে বিধুর অমুদয়, কিন্তু আকাশ নক্ষত্র মালায় পরিশোভিত। মহাকোলাহলপূর্ণ রণ-প্রাঙ্গণ এইক্ষণে সম্পূর্ণভাবে নিস্তব্ধ। দামেস্ক-প্রান্তরে প্রাণীর অভাব নাই। কিন্তু প্রায় সকলেই নিদ্রার কোলে অচেতন। জাগ্রত কে?—প্রহরী দল, সন্ধানীদল, আর উভয় পক্ষের মন্ত্রীদল! মন্ত্রীদলমধ্যেও কেহ কেহ আলস্যের প্রভাবে চক্ষু মুদিয়া চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া আছেন, কেহ দিবাভাগের সেই অভাবনীয় ঘটনার কোন কোন অংশ ভাবিয়া উপবেশন-স্থানেই গড়াইয়া পড়িয়াছেন, কেহ শয়ন-শয্যার এক পার্শ্বে পড়িয়া আধ-জাগরণে, আধ-স্বপ্নে জেয়াদের শিরশূন্য দেহ দেখিয়া চমকাইয়া উঠিতেছেন। যথার্থ জাগরিত কে?—এক পক্ষে মারওয়ান, অন্য পক্ষে গাজী রহ্মান।
মারওয়ান আপন নির্দ্দিষ্ট বস্ত্রাবাসের বহির্দ্বারে সামান্য কাষ্ঠাসনোপরি উপবেশন করিয়া বলিতেছে, “ভাবিলাম কি? ঘটিল কি? এখন উপায়ই বা কি? রাজ্যরক্ষা, রাজার জীবন রক্ষা, নিজের প্রাণ রক্ষার উপায় কি? কি ভ্রম! কি ভয়ানক ভ্রম!! আশা ছিল শত্রুকে শূলে দিয়া জগতে নাম জাঁকাইব—যুদ্ধে জয়লাভ করিব;—সে আশা-বারিধি গাজী রহ্মানের মস্তিষ্ক তেজে, ছদ্মবেশী বাহ্রামের বাহুবলে এবং ওমর আলীর কৌশলে একেবারে পরিশুষ্ক হইয়া গিয়াছে। এখন জীবনের আশঙ্কা, রাজ-জীবনে সন্দেহ। জয়নাল আবেদীনের বন্দী-গৃহ হইতে পলায়নে আরও সর্ব্বনাশ ঘটিল। দ্বারে দ্বারে প্রহরী, নগর-প্রবেশের দ্বারে প্রহরী, বহির্দ্বারে প্রহরী। সকল প্রহরীর চক্ষে ধূলি দিয়া আপন মুক্তি সে আপনিই করিল। কি আশ্চর্য্য কাণ্ড! এখন আর কাহার জন্য যুদ্ধ? আর কি কারণে হানিফার সহিত শত্রুতা? কেন প্রাণীক্ষয়? জয়নালকে হানিফা-হস্তে দিতে না পারিলে আর চক্ষা নাই! সন্ধির প্রস্তার মুখে আনিতেও আমার আর ক্ষমতা নাই—আর তাহাতে হানিফাও ভুলিবে না। সন্ধির নিশানে আর কিছুই হইবে না। শত সহস্র দূতের প্রস্তাবেও আর হানিফা কর্ণপাত করিবে না। পরাজয় স্বীকারে মৃত্তিকায় তরবারি রাখিয়া দিলেও আর সে ছাড়িবে না। যদি জয়নালের মুক্তির কথা গোপনই থাকে, তাহা হইলে যুদ্ধে আমাদের লাভ কি? জয়নালই যদি আমাদের হাতছাড়া হইল, তবে হানিফার পরাজয়ে ফল কি? ফল আছে। মহারাজের প্রাণ, স্বদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রাণরক্ষা করা ভিন্ন আর কি আশা? কিন্তু তাহাতেও আমার বিশেষ সন্দেহ আছে। হোসেনপুত্র জয়নাল!—সিংহশাবক সিংহ। আজই হউক, কালই হউক, দুদিন পরেই হউক, তাহার বল-বিক্রম সে প্রকাশ করিবে,—নিশ্চয়ই করিবে। সে নব-কেশরীর নর-গর্জ্জনে দামেস্কনগর কাঁপিবেই কাঁপিবে। তাহার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ সে কালে লইবেই লইবে।”
মারওয়ানের চিন্তার ইতি নাই। দামেস্কের এ দুর্দ্দশা কেন ঘটিল, ইহাও এক প্রশ্ন। এজিদের দোষ, কি তাহার দোষ—সে কথারও মীমাংসা হইতেছে। সর্ব্বোপরি প্রাণের ভয়—মহাভয়! যদি আবদুল্লাহ্ জেয়াদের উপর ওমর আলীর বধসাধন-ভার অর্পণ করিয়া রাজসমীপে সে না যাইত, তাহা হইলে এই নিশীথ সময়ে প্রান্তরে বসিয়া আর চিন্তার ভার তাকে বহন করিতে হইত না—এই কথাই বিশেষ করিয়া মারওয়ান আলোচনা করিতেছে।
মারওয়ান যে স্থানে বসিয়াছিল, সে স্থান হইতে হানিফার শিবিরে প্রজ্জলিত দীপমালা সমুজ্জ্বল নক্ষত্রমালার ন্যায় তাহার চক্ষে দৃষ্ট হইতেছিল। প্রদীপ্ত দীপরাশির উজ্জলাভা মনঃসংযোগে দেখিতে দেখিতে তাহার মনে মুক্ত একটি কথার সঞ্চার হইল। কথাটা কিছু গুরুতর, অথচ নীচ। কিন্তু মারওয়ানের হৃদয়ে সে কথার সঞ্চার আজ নূতন নহে। বিশেষতঃ, আসন্নকালে বিপরীত বুদ্ধিবশে মারওয়ান মনের কথা মুখে আনিল। গুপ্তভাবে হানিফার শিবিরে যাইলে জয়নালের কোন সন্ধান জানিতে পারা যায় কি না? যদি জয়নাল হানিফার হস্তগত হইয়া থাকে, তবে সকলই বৃথা। কোন উপায়ে, কি কোন কৌশলে, কোন সুযোগে জয়নালের কোন সন্ধান জানিতে পারিলে এখনও রক্ষার অনেক উপায় করা যায়। মদিনায় মায়মুনায় আবাসে কত নিশীথ সময়ে ছদ্মবেশে যাইয়া কত গুপ্ততথ্য অনুসন্ধান করিয়াছি, কত অসাধ্য সাধন সহজে সাধন করিয়াছি, আর এ দামেস্ক নগর—আপন দেশ, নিজের অধিকার, এখানে কিছুই করিতে পারি না। তবে একটা কথা,—পাত্রভেদে কিছু লঘু-গুরু আছে। আবার একেবারে নিঃসন্দেহের কথাও নহে। মোহাম্মদ হানিফা বুদ্ধিমান। প্রধান মন্ত্রী গাজী রহ্মান অদ্বিতীয় রাজনীতিজ্ঞ, চিন্তাশীল ও চতুর, তাহাদের নিকট মারওয়ান পরাস্ত। কি জানি, কি কৌশল করিয়া শিবিররক্ষার কি উপায় তাহারা করিয়াছে! হঠাৎ বিপদগ্রস্ত হইলেও হইতে পারি! অদ্বিতীয় ভালবাসার প্রাণ—পাখীটাই যে, দেহপিঞ্জর হইতে একেবারে দূরে না যাইতে পারে, তাহাই বা কে বলিল? এও সন্দেহ; নতুবা দামেস্ক-প্রান্তরে এই নিশীথ সময়ে একা একা ভ্রমণ করিতে মারওয়ান সন্দিহান নহে, দামেস্কের রাজমন্ত্রী ভীত নহে।”
এই বলিয়া মারওয়ান আসন হইতে উঠিল। উঠিয়া একটু চিন্তা করিয়া বলিল, “একা যাইব না, অলীদকে সঙ্গে করিয়া ছদ্মবেশে—পথিক-সাজে—সামান্য পথিক-সাজে বাহির হইব।”
মারওয়ান বেশ-পরিবর্ত্তনের জন্য বস্ত্রাবাসমধ্যে প্রবেশ করিল।
অলীদের চক্ষেও আজ নিদ্রা নাই। মহাবীর-হৃদয় আজ মহাচিন্তায় অস্থির। এ যুদ্ধের পরিণাম-ফল কি? সমরের যে প্রকায় গতি দেখিতেছি, শেষ ঘটনায় নিয়তিদেবী যে কোন্ দৃশ্য দেখাইয়া এ অভিনয়ের যবনিকা পতন করিবেন, তা তিনিই জানেন।
বীরবর শিবিরের বাহিরে পদচারণা করিয়া বেড়াইতেছে, আর ভাবিতেছে— মাঝে মাঝে বিমানে পরিশোভিত তারাদলের মিটি মিটি ভাব দেখিয়া মনে মনে আর একটি মহাভাবের ভাবনা ভাবিতেছে। কিন্তু সে ভাব—ক্ষণকালের জন্য সে জ্বলন্ত দৃঢ়ভাব তাহার হৃদয়ে স্থান পাইতেছে না। মায়াময় সংসারে স্বার্থপূর্ণ ভাবই প্রবলবেগে তাহার হৃদয় অধিকার করিতেছে। নিশার শেষের সহিত কি আবার রণভেরী বাজিয়া উঠিবে? কার ভাগ্যে কি আছে, কে বলিবে? আবার তারাদলে তাহার নয়ন পড়িল,—সেই মধুমাখা মিটি মিটি হাসিহাসি ভাব,—এ তারা, ও তারা, কত তারা দেখিল, কিন্তু অরুন্ধতী নক্ষত্র তাহার নয়নে পড়িল না। তারাদল হইতে নয়ন ফিরাইয়া আনিতেই হানিফার শিবিরে প্রদীপ্ত দীপালোকের প্রতি তাহার চক্ষু পড়িল। অলীদ সে দিকে মনঃসংযোগ না করিয়া অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াই তীর-ধনু হস্তে লইল। ছদ্মবেশী মারওয়ান কথা না কহিলে, অলীদ-বাণে তখনই তাহার জীবন শেষ হইত।
অলীদ বলিল, “নিশীথ-সময়ে এ বেশে কোথায়? ভাগ্যে কথা বলিয়াছিলেন!”
“তাহাতেও দুঃখ ছিল না। যে গতিক দেখিতেছি, তাহাতে দুই এক দিনের অগ্রপশ্চাৎ মাত্র। ভাল, তোমার চক্ষেও যে আজ নিদ্র নাই?”
“আপনার চক্ষেই বা আছে কি?”
“অনেক চেষ্টা করিলাম, কিছুতেই নিদ্রা হইল না। মনে শান্তি নাই, আত্মার পরিতোষ কিসে হইবে? নানা প্রকার চিন্তায় মন মহা আকুল হইয়া পড়িয়াছে। দেখ দেখি, কি ভ্রম! কি করিতে গিয়া কি ঘটিল! জেয়াদের মৃত্যু জেয়াদ নিজ বুদ্ধিতেই টানিয়া আনিয়াছিল। এমন আশ্চর্য্য ঘটনা, অভাবনীয় বুদ্ধিকৌশল, হাতে হাতে চাতুরী কখনই দেখি নাই, আজ পর্য্যন্ত কাহারও মুখে শুনি নাই। ধন্য মোহাম্মদ হানিফা। ধন্য গাজী রহ্মান।”
“গত বিষয়ের চিন্তা বৃথা,—আলোচনাতে কেবল আক্ষেপ ও মনের কষ্ট। ও কথা মনে করিবার আর প্রয়োজন নাই। এখন রাত্রি প্রভাতের পর উপায় কি? যুদ্ধ আর ক্ষান্ত থাকে না,—সে যুদ্ধই বা কাহার জন্য, মূলধন ত সরিয়া পড়িয়াছে।”
“সেও কম আশ্চর্য্য নহে।”
“সময় মন্দ হইলে এই প্রকারই হইয়া থাকে।
“যাহা হইবার হইয়াছে, এখন চল, একবার হানিফার শিবিরের দিকে যাইয়া দেখিয়া আসি, কোন সুযোগে জয়নালের কোন সন্ধান লইতে পারি কি না; এখন মুল কথা—জয়নাল আবেদীন। যুদ্ধ করিতে হইলেও জয়নাল! পরাভব স্বীকার করিয়া প্রাণরক্ষা—রাজ্যরক্ষা করিতে হইলেও জয়নাল। সন্ধির প্রস্তাব করিতে হইলেও সেই জয়নাল! জয়নালের সন্ধান না করিয়া আর কোন কথা উঠিতে পারে না। জীবনে, মরণে সকল অবস্থাতেই জয়নালের প্রয়োজন।”
“তাহা ত শুনিলাম। কিন্তু একটি কথা—এই নিশীথ সময়ে জয়নালের সন্ধান করিতে, কি বিপক্ষ-শিবিরে সন্ধান জানিতে যাইব?—তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে পারিব কি না, সে বিষয়ে একটু চিন্তা করিতে চাই। ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া পথিক, পরিব্রাজক, দীন-দুঃখীর পরিচয় দিলেই যে কার্য্যসিদ্ধি হয়, তাহা নহে। এ মদিনার মায়মুনা নহে, দগ্ধ-হৃদয় জাএদা নহে। এ বড় কঠিন হৃদয়, বৃহৎ মস্তক। এ মস্তকে মজ্জার ভাগও অতি অধিক, শক্তিও বেশী পরিমাণ, ক্ষমতাও অপরিসীম। প্রত্যক্ষ প্রমাণ ত অনেক দেখিতেছি, আবার এই নিশীথ সময়ে ছদ্মবেশে গোপনভাবে দেখিয়া অধিক আর কি লাভ হইবে? তাহাদের গুপ্তসন্ধান জানিয়া সাবধান ও সতর্ক হওয়া, কি কোন কার্য্যের প্রতিযোগিতা করা, কি নূতন কার্য্যের অনুষ্ঠান করা, বহু দূরের কথা। শত্রু-শিবিরের বহিঃস্থ সীমার নিকট যাইতে পার কি না সন্দেহ। তোমার ইচ্ছা হইয়াছে—চল, দেখিয়া আসি, গাজী রহমানের সতর্কতাও জানিয়া আসি; কিন্তু লাভ কিছু হইবে না, বরং বিপদের আশঙ্কাই অধিক।”
“লাভের আশা যাহা পূর্ব্বেই বলিয়াছি; সে যে ঘটিবে না, তাহাও বুঝিয়াছি। তথাপি যদি কিছু পারি।”
পারিবে ত অনেক। মানে মানে ফিরিয়া আসিতে পারিলে রক্ষা।”
“আচ্ছা, দেখাই যাউক, আমাদের ত রাজ্য!”
“আচ্ছা, আমি সম্মত আছি।”
“তবে আর বিলম্ব কি? পোষাক লও।”
“পোষাক ত লইবই, আরও কিছু লইব।”
“সাবধান। কেহ যেন হঠাৎ দেখিতে না পায়।
ওত্বে অলীদ ছদ্মবেশে মারওয়ানের সঙ্গে চুপে চুপে বাহির হইল। প্রভাত হইতে না হইতেই তাহারা ফিরিয়া আসিবে,—এই কথা পথে স্থির হইল। কিঞ্চিৎ দূরে আসিয়া মারওয়ান বলিল, “একেবারে সোজা পথে যাইব না। শিবিরের পশ্চাৎ ভাগ সম্মুখে রাখিয়া যাইতে হইবে। এখন আমরা বাম পার্শ্ব হইয়া ক্রমে শত্রু-শিবির বেষ্টন করিয়া যাইতে থাকিব।”
এই যুক্তিই স্থির করিয়া তাহারা ক্রমে বাম দিকেই যাইতে লাগিল। ক্রমে হানিফার শিবিরের পশ্চাৎ দিক তাহাদের চক্ষে পড়িতে লাগিল। সম্মুখে যেরূপ আলোর পারিপাট্য, সেইরূপ পশ্চাৎ, পার্শ্ব—সকল দিকেই সমান। সম্মুখে, পার্শ্বে, পশ্চাতে কিছুই ভেদ নাই। কখনও দ্রুতপদে, কখনও মন্দ মন্দ ভাবে, চতুর্দ্দিক লক্ষ্য করিয়া যথাসাধ্য সতর্কে তাহারা যাইতে লাগিল। কিছুদূর গিয়া তাহারা নিশ্চয় বুঝিতে পারিল যে, তাহাদের সঙ্গে আরও লোক আসিতেছে। আরও কিছুদূর অগ্রসর হইল, হাসি-রহস্য-বিদ্রূপসূচক কোন কোন কথার আভাস তাহাদের কানে আসিতে লাগিল। কোন্ দিক এবং কত দূর হইতে এই কথার আভাষ আসিতেছে, তাহারা তাহা স্থির করিতে পারিল না। কারণ, কখনও দক্ষিণে, কখনও বামে, কখনও সম্মুখে, আবার কখনও পশ্চাতে— অতি মৃদু মৃদু কথায় আভাষ তাহাদের কানে আসিতে লাগিল। উভয়ে গমনে ক্ষান্ত দিয়া মনঃসংযোগে বিশেষ লক্ষ্যে চারিদিকে দেখিতে লাগিল।—দেখিল, কোন দিকে কিছুই নাই, চারিদিক অন্ধকার, উপরে তারকারাজি।
উভয়ে আবার যাইতে লাগিল। প্রায় দশ-পদ ভূমি অতিক্রম করিয়া যাইতেই, মানব-মুখোচ্চারিত অসংযুক্ত কথার ঈষৎ ভাব স্পষ্ট শুনিতে পাইল। সে কথার প্রতি গ্রাহ্য না করিয়া তাহারা যাইতে লাগিল, কিন্তু আর বেশী দূর যাইতে হইল না। আনুমানিক পঞ্চ হস্ত পরিমাণ ভূমি পশ্চাতে রাখিয়া অগ্রসর হইতেই তাহাদের বামপার্শ্ব হইতেই শব্দ হইল—“আর নয়, অনেক দূর আসিয়াছ।”
মারওয়ান চম্কাইয়া উঠিল। আবার শব্দ হইল,—“কি অভিসন্ধি?”
মারওয়ান ও অলীদ উভয়েই চম্কাইয়া উঠিল, তাহাদের অঙ্গ শিহরিয়া উঠিল—স্থির ভাবে তাহারা দাঁড়াইয়া রহিল।
আবার শব্দ হইল—“নিশীথ সময়ে রাজ-শিবিরের দিকে কেন? সাধান! আর অগ্রসর হইও না। যদি আর যাইতে আশা থাকে, তবে সূর্য্য উদয়ের পর—”
মারওয়ান ও অলীদ উভয়ে ফিরিল, আর সে পথের দিকে ফিরিয়াও চাহিল না। কিছু দূরে আসিয়া অন্য পথে অন্য দিকে শিবিরের দিকে লক্ষ্য করিয়া চলিতে লাগিল। মারওয়ান বলিল, “অলীদ আমারই ভুল হইয়াছে, এদিকে না আসিয়া অন্য দিকে যাওয়াই ভাল ছিল।”
“অন্য কোন্ দিকে যাওয়া ভাল ছিল বলুন, সেই দিকেই যাই। ভুল সংশোধন করিতে কতক্ষণ লাগে? যে দিক আপনি নিরাপদ বোধ করেন, সেই দিকেই চলুন।”
মারওয়ান শিবিরের দক্ষিণ পার্শ্বে যাইতে লাগিল, সেই দিকে যাইতে তাহার মনে কোন সন্দেহ হইল না। পশ্চাতে, সম্মুখে, কি বামে, কোন দিকেই আর শঙ্কাবোধ হইল না। নিঃশঙ্কচিত্তে তাহারা যাইতে লাগিল।
অলীদ বলিল, “দেখিলে গাজী রহ্মানের বন্দোবস্ত দেখিলে?”
এ দিকে কি?”
“বোধ হয়, অন্য দিকের মত এদিকের তত গুরুত্ব মনে করে নাই।”
“সে কি আর ভ্রম নয়?”
“মারওয়ান! এখন ও-কথা মুখে আনিও না। গাজী রহ্মানের ভ্রম একথা মুখে আনিও না। কার্য্যসিদ্ধি করিয়া নির্ব্বিঘ্নে নিজ শিবিরে যাইয়া যাহা বলিবার বলিও। অন্য দিকে কি কৌশল করিয়াছে, তাহা তাহারাই জানে।”
“তা জানুক, এ দিকে কোন বাধা নাই, নিঃসন্দেহে যাইতেছি; মনে কোনরূপ শঙ্কা হইতেছে না।”
“আমি ভাই, আমার কথা বলি।—আমার মনে অনেক কথা উঠিয়াছে—ভয়েরও সঞ্চার হইয়াছে। আমি তোমার পশ্চাতে থাকিব না। দুই জনে একত্রে সমানভাবে যাই, কেহই কাহারও অগ্রপশ্চাৎ হইব না।”
মারওয়ান হাসিয়া বলিল, “অলীদ, তুমি আজ মহাবীরের নাম ডুবাইলে। অল্পমতি বালকগণের মনের সহিত পরিপক্ক মনের সমান ভাব দেখাইলে। বীর-হৃদয়ে ভয়! দুইজনে সমানভাবে একত্র যাইতে পারিলেই নির্ভয়,— এ কি কথা?”
“মারওয়ান! আমরা যে কার্য্যে বাহির হইয়াছি, সে কার্য্যের কথা মনে আছে। কার্য্যগতিকে সাহস, রুচিগতিকে বল। এখানে তোমার মন্ত্রী নাই, আমারও বীরত্ব নাই। যেমন কার্য্য, তেমনই স্বভাব।
উভয়ে হাস্যে রহস্যে একত্রে যাইতেছে। প্রজ্জ্বলিত দীপের প্রদীপ্ত আভায় শিবির-দ্বারে মানুষের গতিবিধি স্পষ্টভাবে দেখা যাইতেছে। গমনের বেগ তাহারা কিছু বর্দ্ধিত করিল, সঙ্গে সঙ্গে হাসি-রহস্য ও চলিতেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে তাহাদের হাসি বেশীক্ষণ রহিল না। দৈবাৎ নিকটে একটি শব্দ তাহাদের কর্ণে প্রবেশ করিল। তাহারা দক্ষিণে, বামে দৃষ্টিপাত করিল—অন্ধকার! সম্মুখে-দীপালোক! তাহারা গমনে ক্ষান্ত হইল। আবার সেই হৃদ্কম্পনকারী শব্দ—ক্ষিপ্রহস্তে নিক্ষিপ্ত তীরের শন্ শন্ শব্দ। মারওয়ান অন্তরে জানিয়াছে—তীরের গতি, মুখে বলিতেছে—“ও কিসের শব্দ? অলীদ! ও কিসের শব্দ?” কি বিপদ, এই কথা কহিতে না কহিতেই তিনটি লৌহশর তাহাদের সম্মুখে আসিয়া পড়িল। এখন কি করিবে—অগ্রে পা ফেলিবে, কি পিছনে সরিবে, কি স্থিরভাবে একস্থানে দণ্ডায়মান থাকিবে— কিছুই তাহারা স্থির করিতে পারিল না। দক্ষিণ পার্শ্ব হইতে গভীর নাদে শব্দ: শত্রু হও, মিত্র হও—ফিরিয়া যাও,—রাত্রে এ শিবিরে প্রবেশ নিষেধ— রাত্রে আঘাত মহারাজের নিষিদ্ধ, তাহাতেই প্রাণ বাঁচাইতে পারিলে; নতুবা ঐ স্থানেই ইহকালের মত পড়িয়া থাকিতে হইত।”
আর কোন কথা নাই। চতুর্দ্দিক নিঃশব্দ। কিছুক্ষণ পরে অলীদ বলিল, “মারওয়ান! এখন আর কথা কি? অঙ্গুলি পরিমাণ ভূমি আগে যাইতে আর কি সাহস হয়?”
মারওয়ান মৃদুস্বরে বলিল, “ওহে চুপ কর। প্রহরীরা আমাদের নিকটেই আছে।”
“নিকটে থাকিলে ত ধরিয়া ফেলিত।”
“ধরিবার ত কোন কথা নাই—তবে উহারা বিশেষ সতর্কতার সহিত শিবিরে যা করিতেছে। যে উদ্দেশে আসিয়াছিলাম, তাহা ত ঘটিল না। এখন নিরাপদে শিবিরে ফিরিতে পারিলেই রক্ষা।”
“সে কথা ত আমি আগেই বলিয়াছি। এখন লাভের মধ্যে প্রাণ লইয়া টানাটানি।”
মারওয়ান বলিল, “আর কথা বলিও না; এস, চুপে চুপে নিঃশব্দে চলিয়া যাই।”
উভয়ে কিছু দুর আসিয়া “রক্ষা পাইলাম” বলিয়া দাঁড়াইল। চুপি চুপি কথা কহিতে, আর তাহাদের সাহস হইল না—পারিলও না। কণ্ঠতালু শুষ্ক, জিহ্বা একেবারে নীরস,—তবুও বহুদূর তাহারা আসিয়া পড়িয়াছে। ক্ষণকাল পরে মারওয়ান একটু স্থির হইয়া বলিল, “অলীদ। বাঁচিলাম। চল, এখন একটু স্থির হইয়া আমাদের শিবিরে যাই।”
মুখের কথা শেষ হইতেই পশ্চাৎ দিক হইতে বজ্রনাদে শব্দ হইল— “সাবধান! আর কথা বলিও না, চলিয়া যাও। ঐ বৃক্ষ—ঐ তোমাদের সম্মুখের ঐ উচ্চ খর্জ্জুরবৃক্ষ পর্য্যন্ত আমাদের সীমা। নির্দ্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকিতে পারিবে না। যদি প্রাণ বাঁচাইতে চাও, সীমার বাহিরে যাও।”
কি করে, উভয়ে দ্রুতপদে সীমা-বৃক্ষ পার হইয়া রক্ষা পাইল। আর কোন কথা শুনিল না। জীবনে এমন অপমান কখনও হয় নাই। কি লজ্জা!
মারওয়ান বলিল, “কি বিপদ! হানিফার প্রহরীরা কি প্রান্তরের চতুষ্পার্শ্ব ঘিরিয়া রহিয়াছে? এখনও আমার মন কিছুতেই সুস্থির হয় নাই, এখনও হৃদয়ের চঞ্চলতা দূর হয় নাই। এখানে আর দাঁড়াইব না। এখনও সন্দেহ হইতেছে। আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্য, সীমা-বৃক্ষ উহাদের—কি আশ্চর্য্য। সীমা-বৃক্ষ না ছাড়াইয়া আসিলে জীবন যায়—কি ভয়ানক ব্যাপার। চল শিবিরে যাই।”
উভয়ে নীরবে আপন শিবিরাভিমুখে চলিল। যাইতে যাইতে সম্মুখে একখণ্ড বৃহৎ শিলাখণ্ড দেখিয়া মারওয়ান বলিল, “অলীদ। এই শিলাখণ্ডের উপরে একটু বিশ্রাম করি। নানা কারণে মন অস্থির হইয়াছে। আর কোন গোলযোগ নাই। ক্ষণকাল এই স্থানে বসিয়া মনের অস্থিরতা দূর করি। যেমন কার্য্যে আসিয়াছিলাম, তাহার প্রতিফলও পাইলাম।”
অলীদ মারওয়ানের কথায় কোন আপত্তি না করিয়া শিলাখণ্ডের চতুষ্পার্শ্ব একবার বেষ্টন করিয়া আসিল এবং নিঃশঙ্কচিত্তে উভয়ে বসিয়া অস্ফুটস্বরে কথা কহিতে লাগিল।
এক কথার ইতি হইতে না হইতেই অন্য কথা তুলিলে কথার বাঁধুনী থাকে না; সমাজ-বিশেষে অসভ্যতাও প্রকাশ পায়। জয়নাল আবেদীন বন্দীগৃহ হইতে চলিয়া যাওয়ার পর এমন সুযোগ পাই নাই যে, তাহার বিবরণ পাঠকগণের গোচর করি। মারওয়ান এবং ওত্বে অলীদ শিলাখণ্ডের উপরে বসিয়া নির্ব্বিঘ্নে মনের কথা ভাঙ্গচুর করুক, এই অবসরে আমরা জয়নালের কথাটা বলিয়া রাখি।
জয়নাল আবেদীন ওমর আলীর শূলদণ্ডের ঘোষণা শুনিয়া বন্দীগৃহের সম্মুখস্থ প্রাঙ্গণ হইতে প্রহরীদের অসাবধানতায় নাগরিক দলে মিশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়াছিলেন। তিনি স্বীয় নামেই সকলের কাছে পরিচিত; কিন্তু অনেকেই তাঁহাকে চক্ষে দেখে নাই। মোহাম্মদ হানিফাকে তিনি কখনও দেখেন নাই, ওমর আলীকেও দেখেন নাই—অথচ ওমর আলীর প্রাণরক্ষার জন্য চেষ্টা করিবেন, এই দুরাশার কুহকে মাতিয়াই তিনি দামেস্ক-প্রান্তরে আসিয়াছিলেন। এজিদের শিবির, হানিফার শিবির, ওমর আলীর নিষ্কৃতি,সমুদয়ই তিনি দেখিয়াছেন, তাঁহার নিজের প্রাণবধের ঘোষণাও স্বকর্ণে শুনিয়াছেন। ঐ ঘোষণার পর তিলার্দ্ধকালও দামেস্ক-প্রান্তরে তিনি অবস্থিতি করেন নাই; নিকট এক পর্ব্বত-গুহায় আত্মগোপন করিয়া, দিবা অতিবাহিত করিয়াছেন। নিশীথ সময়ে পর্ব্বত-গুহা হইতে বহির্গত হইয়া তাঁহার প্রথম চিন্তা—কি উপায়ে মোহাম্মদ হানিফার সহিত একত্রিত হইবেন।—সে শিবিরে তাঁহার পরিচিত লোক কেহই নাই —নিজ মুখে নিজ পরিচয় দিয়া দাঁড়াইতেও নিতান্ত অনিচ্ছা! ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, তিনি দুই এক পদ করিয়া হানিফার শিবিভিমুখেই যাইতেছেন।
অলীদ বলিল, “মারওয়ান! কিছু শুনিতে পাইতেছ?”
“স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছি না, কিন্তু মানুষের গতিবিধিৱ ভাব বেশ বুঝা যাইতেছে। এক জন দুই জন নহে, বহুলোকের সাবধানে পদবিক্ষেপের শব্দ অনুভূত হইতেছে। আর এখানে থাকা উচিত নহে। বোধ হয়, বিপক্ষে আমাদের পরিচয় পাইয়াছে, এখনও আমাদিগকে ছাড়ে নাই। ঐ দেখ, সম্মুখে চাহিয়া দেখ। আমরা ছদ্মবেশে আসিয়াছি, কেবল তোমার নিকট একখানি তরবারি, আর আমার নিকট সামান্য একখানি ছুরি ভিন্ন অন্য কোন অস্ত্র আমাদের সঙ্গে নাই। আর থাকিলেই বা কি হইবে? তাহাদের তীরের মুখ হইতে দিনে রক্ষা পাওয়াই দায়, তায় আবার ঘোর নিশা। মনঃসংযোগে কান পাতিয়া শোন, যেন চতুর্দ্দিকেই লোকের গতিবিধি, চলাফেরা ও সাড়া পাওয়া যাইতেছে। চল, এখানে থাকা বিধেয় নহে।” এই বলিয়া শিলাখণ্ড হইতে উভয়ে গাত্রোথান করিয়া সমতল-ক্ষেত্রে দণ্ডায়মান হইল।
জয়নাল আবেদীনও নিকটবর্ত্তী হইয়া গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কে?”
মারওয়ান থতমত খাইয়া শঙ্কিত-চিত্তে উত্তর করিল, “আমরা পথিক, পথহারা হইয়া আসিয়াছি।”
“নিশীথ সময়ে পথিক পৃথহারা হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে। এ কি কথা?”
জয়নাল পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওহে পথিক। তোমরা কি বিদেশী?”
“হ্যাঁ, আমরা বিদেশী।
“কি আশ্চর্য্য। তোমরা বিদেশী হইয়া এই মহা সংগ্রামস্থলে কি উদ্দেশ্যে আসিয়াছ? সত্য বল, কোন চিন্তা নাই।”
মারওয়ান বলিল, “যথার্থ বলিতেছি, আমরা বিদেশী, অজানা দেশ, পথ-ঘাটের ভাল পরিচয় নাই—চিনি না। দামেস্ক-নগরে চাকরীর আশায় যাইতেছি। দিবসে সৈন্য-সামন্তের ভয়; রাত্রেই নগরে প্রবেশ করিব—ইহাই আশা এবং অন্তরের নিগূঢ় তত্ত্ব।”
“তোমরা কোথা হইতে আসিতেছ? তোমাদের বসতি কোথায়?”
“আমরা মদিনা হইতে আসিয়াছি। মদিনাই আমাদের বাসস্থান।”
ভীমনা শিলারাশির পার্শ্ব হইতে আম্বাজী গুপ্ত সৈন্যদের শব্দ হইল: ওরে ছদ্মবেশী নিশাচর। মদিনাবাসীরা দামেস্কে চাকরীর আশায় আসিয়াছে? আর কোথায় যাইবি? এই স্থানে নিশা যাপন কর। প্রভাতে পরীক্ষার পর মুক্তি। এক পদও আর অগ্রসর হইতে পারিবি না। যদি চক্ষের জ্যোতিঃ থাকে, দৃষ্টির ক্ষমতা থাকে, তবে যে দিকে ইচ্ছা চাহিয়া দেখ, পঞ্চবিংশতি বর্ষার ফলক তোমাদের বক্ষ, পৃষ্ঠ, বাহু ও পা লক্ষ্য করিয়া স্থিরভাবে রহিয়াছে। সাবধান! কোন কথা উত্থাপন করিও না,—নীরবে তিন মূর্ত্তি প্রভাত পর্য্যন্ত এই স্থানে দণ্ডায়মান থাক। আর যাইবার সাধ্য নাই। মোহাম্মদ হানিফার গুপ্ত সৈন্য দ্বারা তোমরা তিন জন সূর্য্যোদয় পর্য্যন্ত বন্দী।”