বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/অষ্টম প্রবাহ
অষ্টম প্রবাহ
কি চমৎকার দৃশ্য! মহাবীর মোহাম্মদ হানিফা অশ্ব-বল্গা সজোরে টানিয়া অশ্ব-গতি রোধ করিয়াছেন। তাঁহার গ্রীবা বক্র, দৃষ্টি পশ্চাতে—কারণ, সৈন্যগণ কতদূরে তাহাই তাহার লক্ষ্য। অশ্ব সম্মুখস্থ পদদ্বয় কিঞ্চিৎ বক্রভাবে উত্তোলিত করিয়া দণ্ডায়মান। এক পার্শ্বে মদিনার কাসেদ। হানিফার চক্ষু জলে পরিপূর্ণ। দেখিতে দেখিতে অর্দ্ধ চন্দ্র এবং পূর্ণ তারকাসংযুক্ত নিশান হেলিয়া দুলিয়া ক্রমেই নিকটবর্ত্তী হইল। গাজী রহ্মান উপস্থিত; তিনি দেখিলেন: প্রভুর চক্ষু সজল, মুখভাব মলিন,— নিকটে অপরিচিত কাসেদ, বিষাদের স্পষ্ট লক্ষণ! নিশ্চয়ই বিপদ! মহাবিপদ! বুঝি হোসেন আর ইহজগতে নাই!!
গাজী রহ্মান! আপনার সিদ্ধান্তই নিশ্চিত। মোহাম্মদ হানিফা ভ্রাতৃহারা, জ্ঞাতিহারা হইয়া এক্ষণে জ্ঞানহারা হইবার উপক্রম হইয়াছেন। তাঁহাকে রক্ষার উপায় দেখুন। ভ্রাতৃশোক মহাশোক!
মোহাম্মদ হানিফা গদ গদ স্বরে বলিলেন, “গাজী রহ্মান,! আর কারবালায় যাইতে হইল না, বিধির নিবন্ধে ভ্রাতৃবর হোসেন শত্রুহস্তে প্রাণ হারাইয়াছেন। ইমাম বংশ সমূলে বিনাশ হইয়াছে। পরিজন মধ্যে যাঁহারা বাঁচিয়া আছেন তাঁহারাও দামেস্ক নগরে এজিদের কারাগারে বন্দী—এইক্ষণে কি করি? আমার বিবেচনায় অগ্রে মদিনায় যাইয়া প্রভু মোহাম্মদের রওজা পরিদর্শন করি। পরে অন্য বিবেচনা।”
গাজী রহ্মান বলিলেন, “এ অবস্থায় মদিনাবাসীদিগের মত গ্রহণ করাও নিতান্ত আবশ্যক। রাজা বিহনে সেখানেও নানাপ্রকার বিভ্রাট উপস্থিত হইতে পারে। ইমাম বংশে কেহই নাই—একথা যথার্থ হইলে পূণ্যভূমি মদিনা যে এতদিন এজিদের পদভরে দলিত হয় নাই—ইহাতেই বা বিশ্বাস কি? তবে অনিশ্চিত হইয়া অন্য চিন্তা নিরর্থক, মদিনাভিমুখে যাওয়াই এখন কর্ত্তব্য।”
পুনরায় মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “যাহা ঘটিবার ঘটিয়াছে, ভবিষ্যতের লেখা খণ্ডন করিতে কাহারও সাধ্য নাই। মদিনাভিমুখে গমনই যখন স্থির হইল, তখন বিশ্রামের কথা যেন কাহারও অন্তরে আর উদয় না হয়। সৈন্যগণসহ আমার পশ্চাদগামী হও।”
দিবারাত্রি গমন। বিশ্রামের কথা কাহারও মুখে নাই। এই প্রকারে কয়েক দিন অবিশ্রান্তভাবে গমন করিলে দ্বিতীয় কাসেদের সহিত মোহাম্মদ হানিফার দেখা হইল। দ্বিতীয় নিশান দেখিয়াই তিনি গমনে ক্ষান্ত দিলেন।
কাসেদ যথাবিধি অভিবাদন করিয়া জোড়করে বলিল,—“বাদশাহ্-নামদার! দাসের অপরাধ মার্জ্জনা হউক। আমি মদিনার কাসেদ।”
মোহাম্মদ হানিফা বিশেষ আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সংবাদ কি?”
“পূর্ব্বসংবাদ বাদশাহ্-নামদারের অবিদিত নাই। তৎপরে সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, আর আমি যাহা স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি, তৎসমুদয়ই বলিতেছি।”
“বাদশাহ্-নামদার! আপনার ভ্রাতৃবংশে পুরুষ পক্ষে কেবলমাত্র এক জয়নাল আবেদীন জীবিত আছেন। তিনি, তাঁহার মাতা, ভগ্নী পিতৃব্য-পত্নী এখন দামেস্ক নগরে বন্দী। দিনান্তে এক টুকরা শুষ্করুটি, এক পাত্র জল ভিন্ন আর কোন প্রকার খাদ্যের মুখ দেখাও তাঁহাদের ভাগ্যে নাই। এজিদ এক্ষণে অগ্নিমুর্ত্তি ধারণ করিয়া বসিয়াছেন—সে কেবল আপনার সংবাদে। আপনার প্রাণ বিনাশ করাই এক্ষণে তাঁহার প্রথম কার্য্য। তিনি ওত্বে অলীদকে লক্ষাধিক সৈন্যসহ সাজাইয়া মদিনার সীমায় পাঠাইয়া দিয়াছেন। ওত্বে অলীদ মদিনা আক্রমণ না করিয়া আপনার প্রতীক্ষায় মদিনার প্রবেশপথ রোধ করিয়া সর্ব্বদা সতর্ক ও প্রস্তুত রহিয়াছে। অলীদ আপনার শিরশ্ছেদ করিয়া পরে মদিনার সিংহাসনে এজিদ-পক্ষ হইতে বসিবে,—ইহাই ঘোষণা করিয়াছে। এক্ষণে যাহা ভাল হর করুন।”
মোহাম্মদ হানিফা এবার এক নূতন চিন্তায় নিপতিত হইলেন। সহজে মদিনায় যাইবার আর সাধ্য নাই—প্রথমে যুদ্ধ, পরে প্রবেশ, তার পর মদিনাবাসীদিগের সহিত সাক্ষাৎ!
গাজী রহ্মান বলিলেন, “তবে যুদ্ধ অনিবার্য্য। যেখানে বাধা সেই খানেই সমর, এ ত বিষম ব্যাপার! অলীদ চতুরতা করিয়া এমন কোন স্থানে যদি শিবির নির্ম্মাণ করিয়া থাকে যে, সম্মুখে সুপ্রশস্ত সমতল ক্ষেত্র নাই, শিবির নির্ম্মাণের উপযুক্ত স্থান নাই, জলের সুযোগ নাই, সৈনিক দিগের দৈনিক ক্রীড়া করিবার উপযুক্ত প্রাঙ্গন নাই, তবে ত মহাবিপদ! তাই অগ্রেই গুপ্তচর, চিত্রকর এবং কুঠারধারিগণকে ছদ্মবেশে প্রেরণ করিতে হইতেছে।”
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “আমার মতি স্থির নাই, যাহা ভাল বিবেচনা হয় কর। তবে এইমাত্র কথা যে, বিপদে, সম্পদে, শোকে, দুঃখে সর্ব্বদা সকল সময়ে যিনি ভগবান—তাঁহারই নাম করিয়া চলিতে থাক। যাহা অদৃষ্টে আছে ঘটিবে। আর এখান হইতে আমার আর আর বৈমাত্রেয় ভ্রাতৃগণ যাঁহারা যেখানে আছেন, তাঁহাদিগকে ইমামের অবস্থা, ইমাম পরিবারের অবস্থা বিস্তারিতরূপে লিখিয়া কাসেদ পাঠাও। একথাও লিখিয়া দাও যে, পদাতিক; অশ্বারোহী প্রভৃতি যত প্রকার যোদ্ধা যাঁহার অধীনে যত আছে, তাহাদের আহার সংগ্রহ করিয়া মদিনা-প্রান্তরে আসিয়া আমার সঙ্গে তাঁহারা খোগদান করুন। ইরাক নগরে মস্হাব-কাক্কা, আঞ্জাম নগরে ইব্রাহিম ওয়াদি, তোগান রাজ্যে আলিওয়দের নিকটে সমুদয় বিবরণ লিখিয়া কাসেদ প্রেরণ কর। আর আর মুসলমান রাজা যিনি যে প্রদেশে, যে নগরে রাজ্য বিস্তার করিয়া আছেন, তাঁহাদের নিকটেও এই সমাচার লিখিয়া কাসেদ প্রেরণ কর। শেষে এই কয়েকটি কথা লিখিও: “ভ্রাতৃগণ! যদি জাতীয় ধর্ম্ম-রক্ষার বাসনা থাকে, জগতে মোহাম্মদীয় ধর্ম্মের স্থায়িত্ব রাখিতে ইচ্ছা থাকে, কাফেরের রক্তে ইসলাম-অস্ত্র রঞ্জিত করিতে ইচ্ছা থাকে, আর প্রভু মোহাম্মদের প্রতি যদি অটল ভক্তি থাকে, তবে এই পত্র প্রাপ্তিমাত্র আপন আপন সৈন্যসহ মদিনাপ্রান্তরে আসিয়া উপস্থিত হউন। প্রভু-পরিবারের প্রতি যে দৌরাত্ম্য হইতেছে, সে বিষয় আলোচনা করিয়া এখন কেহ দুঃখিত হইবেন না। এখন ধর্ম্মরক্ষা, মদিনার সিংহাসন রক্ষা, এজিদের বধ, হোসেন-পরিজনের উদ্ধার,—এই সকল কথাই যেন জপমালার মন্ত্র হয়। এইক্ষণে কেহ চক্ষের জল ফেলিবেন না। কাঁদিবার দিনে সকলে একত্র হইয়া কাঁদিব। শুধু আমরা কয়েকজনেই যে কাঁদিব, তাহা নহে; জগৎ কাঁদিবে। এ জগৎ চিরদিন কাঁদিবে। স্বর্গীয় দূত এস রাফিল জীবের জীবন-লীলা শেষ করিতে যে দিন ঘোর নাদে শিঙ্গা বাজাইয়া জগৎ সংহার করিবেন, সে দিন পর্য্যন্ত জগৎ কাঁদিবে। দুঃখ করিবার দিন ধরা রহিল; এখন অস্ত্র ধরুন, শত্রু বিনাশ করুন—মোহাম্মদীয় দিন, ঐ শিঙ্গাবাদন দিন পর্য্যন্ত অক্ষয়রূপে স্থায়িত্বের উপায় বিধান করুন। আবদুর রহ্মান। এ সকল কথা লিখিতে কখনও ভুলিও না।”
গাজী রহ্মান প্রভুর আদেশ মত “শাহীনামা” পত্র, যাহা যাহার নিকট উপযুক্ত, তখনই লিখাইতে আরম্ভ করিলেন। সৈন্যগণ ক্রমে ক্রমে আসিয়া জুটিল। মন্ত্রীপ্রবর রাজাদেশে সকল শ্রেণীর প্রধান প্রধান অধ্যক্ষগণকে সমস্ত বিবরণ জ্ঞাপন করিলেন। নির্দ্দিষ্ট স্থানে কাসেদসকল প্রেরিত হইল। সকলে আবার গমনে অগ্রসর হইলেন। এক দিন প্রেরিত গুপ্তচর ও সন্ধানী লোকদিগের সহিত তাঁহাদের দেখা হইল। বিস্তৃত বিবরণ অবগত হইয়া পুনরায় তাঁহারা যাইতে লাগিলেন। নির্দ্দিষ্ট স্থান অতি নিকট; উৎসাহে গমনবেগ বৃদ্ধি করা হইল।