বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/সপ্তম প্রবাহ

সপ্তম প্রবাহ

 তোমার এ দুর্দ্দশা কেন? কোন্ কুক্রিয়ার ফলে তোমার এ দশা ঘটিয়াছে? যখন পাপ করিয়াছিলে, তখন কি তোমার মনে কোন কথা উদয় হয় নাই। এখন লোকালয়ে মুখ দেখাইতে এত লজ্জা কেন? খোল, খোল, মুখের আবরণ খোল; দেখি,—কি হইয়াছে। চিরপাপ পাপ-পথে দণ্ডায়মান হইলে হিতাহিত জ্ঞান অণুমাত্রও তাহার অন্তরে উদয় হয় না। যেন তেন প্রকারেণ পাপকুলে ডুবিতে পারিলেই সে এক প্রকার রক্ষা পায়, কিন্তু পরক্ষণে অবশ্যই তাহার আত্মগ্লানি উপস্থিত হয়।

 পাঠক! লেখনীর গতি বড় চমৎকার! ষষ্ঠ প্রবাহে আপনাদিগকে কোথায় লইয়া গিয়াছি, আবার সপ্তম প্রবাহে কোথায় আনিয়াছি! সম্মুখে পবিত্র রওজা—পুণ্যভূমি মদিনার সেই রওজা। পবিত্র রওজার মধ্যে অন্য লোকের গমন নিষেধ, একথা আপনারা পূর্ব্ব হইতেই অবগত আছেন। আর যাহার জন্য উপরে কয়েকটি কথা বলা হইল, সে আগন্তুককে কি করিতে দেখিতেছেন? সে পাপী পাপ-মোচনের জন্য এখন কি কি করিতেছে,—দেখিতেছেন? সে রওজার বহির্ভাগস্থ মৃত্তিকার ধূলি অবনতমুখে মন্তকে মর্দন করিতেছে, আর বলিতেছে, “প্রভু রক্ষা কর। হে হাবিবে খোদা, আমায় রক্ষা কর। হে নুরনবী হজরত মোহাম্মদ! আমায় রক্ষা কর। তুমি ঈশ্বরের প্রিয় বন্ধু। তোমার নামের গুণে নরকাগ্নি নরদেহের নিকটে আসিতে পারে না। তোমার রওজার পবিত্র ধূলিতে শত শত জরাগ্রস্ত, মহাব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নীরোগ হইয়া সুকান্তি লাভ করিতেছে, তাহাদের সাংঘাতিক বিষের বিষাক্ত গুণ হ্রাস পাইতেছে। সেই বিশ্বাসে এই নরাধম পাপী বহু কষ্টে পবিত্র ভূমি মদিনায় আসিয়াছে। যদিও আমি প্রভু হোসেনের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার করিয়াছি,—দয়াময়! হে দয়াময় জগদীশ! তোমার করুণা-বারি পাত্রভেদে নিপতিত হয় না! দয়াময়! তোমার নিকট সকলই সমান। জগদীশ! এই পবিত্র রওজার ধূলির মাহাত্মে তুমি আমাকে রক্ষা কর।”

 ক্রমে এক দুই জন করিয়া জনতা বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। আগন্তুকের আত্মগ্লানি ও মুক্তিকামনার প্রার্থনা শুনিয়া সকলেই সমুৎসুখ হইয়া,—কোথায় নিবাস, কোথা হইতে আগমন,—এই সকল প্রশ্ন তাহাকে করিতে লাগিল। অগম্ভক বলিল, “আমার দুর্দ্দশার কথা বলি। ভাই রে! আমি এমাম হোসেনের দাস। প্রভু যখন সপরিবারে কুফায় গমনের জন্য মদিনা হইতে যাত্রা করেন, তখন আমিও তাহার সঙ্গে ছিলাম। দৈব-নির্ব্বন্ধে কুফার পথ ভুলিয়া আমরা কারবালায় যাই।”  সকলে মহাব্যস্তে বলিল-“তার পর? তার পর??”

 “তার পর কারবালায় যাইয়া দেখি যে, এজিদ-সৈন্য পূর্ব্বেই আসিয়া ফোরাত নদীকূল ঘিরিয়া রাখিয়াছে। এক বিন্দু জল লাভের আর আশা নাই। আমার দেহ মধ্যে কে যেন আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে। সমুদয় বৃত্তান্ত আমি একটু সুস্থ না হইলে বলিতে পারিব না। আমি জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিলাম।”

 মদিনাবাসীরা আরও ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তারপর কি হইল, বল; জল না পাইয়া কি হইল?”

 “আর কি বলিব রক্তারক্তি, ‘মার মার’, ‘কাট কাট’ আরম্ভ হই; প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেবলি তরবারি চলিল; কারবালার মাঠে রক্তের স্রোত বহিতে বাগিল, মদিনার কেহই বাঁচিল না।”

 “ইমাম হোসেন, ইমাম হোসেন?”

 “ইমাম হোসেন সীমার হস্তে শহীদ হইলেন।”

 সমস্বরে আর্ত্তনাদ ও সজোরে বক্ষে করাঘাত হইতে লাগিল। মুখে “হায় হোসেন! হায় হোসেন!” শব্দ নির্গত হইল।

 কেহ কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিল, “আমরা তখনই হজরতকে বারণ করিয়াছিলাম, বলিয়াছিলাম মদিনা পরিত্যাগ করিবেন না। নূরনবী হজরত মোহাম্মদের পবিত্র রওজা পরিত্যাগ করিয়া কোনও স্থানে যাইবেন না।”

 কেহ আর কোন কথা না শুনিয়া ইমাম-শোকে কাঁদিতে কাঁদিতে পথ বাহিয়া যাইতে আরম্ভ করিলেন। কেহ কেহ ঐ স্থানে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন। কেহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “তারপর, যুদ্ধ অবসানের পর কি হইল?”

 “যুদ্ধের অবসানের পর কে কোথায় গেল, কে খুঁজিয়া দেখে?” স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে যাঁহারা বাঁচিয়াছিলেন, তাহাদিগকে ধরিয়া ধরিয়া উটে চড়াইয়া দামেস্কে লইয়া যাওয়া হইল। জয়নাল আবেদীন যুদ্ধে যান নাই, মারাও পড়েন নাই। আমি জঙ্গলে পলাইয়াছিলাম। যুদ্ধ শেষে ইমামের সন্ধান করিতে রণক্ষেত্রে, শেষে ফোরাত নদীর তীরে গিয়া দেখি যে, এক বৃক্ষ-মূলে হোসেনের দেহ পড়িয়া আছে। কিন্তু মন্তক নাই। রক্তমাখা খঞ্জরখানিও ইমামের দেহের নিকট পড়িয়া আছে। আমি পূর্ব হইতেই জানিতাম যে, ইমামের পায়জামার বন্ধ মধ্যে বহুমূল্য একটি মুক্তা থাকিত। সেই মুক্তা-লোভে দেহের নিকট গিয়া যেমন বন্ধ খুলিতেছি অমনি ইমামের বামহস্ত আসিয়া সজোরে আমার দক্ষিণ হস্ত চাপিয়া ধরিল। আমি মহা ভীত হইলাম, সে হাত কিছুতেই ছাড়িল না। মুক্তা হরণ করা দূরে থাকুক, আমার প্রাণ লইয়াই টানাটানি! সাত পাঁচ ভাবিয়া নিকটস্থ খঞ্জর বাম হস্তে উঠাইয়া সেই পবিত্র হস্তে আঘাত করিতেই হাত ছাড়িয়া গেল। কিন্তু কর্ণে শুনিলাম,—“তুই অনুগত দাস হইয়া আপন প্রভুর সহিত এই ব্যবহার করিলি? সামান্য মুক্তা-লোভে ইমামের হস্তে আঘাত করিলি? তোর শাস্তি—তোর মুখ কৃষ্ণবর্ণ কুকুরের মুখে পরিণত হউক, জগতেই নরকাগ্নির তাপে তোর অন্তর, মর্ম্ম, দেহ সর্ব্বদা জ্বলিতে থাকুক।”

 “এই আমার দুর্দ্দশা, এই আমার মুখের আকৃতি দেখুন। আমি আর বাঁচিব না, সমুদয় অঙ্গে যেন আগুন জ্বলিতেছে। আমি পূর্ব্ব হইতেই জানি যে, হজরতের রওজার ধূলি গায়ে মাখিলে মহারোগও আরোগ্য হয়, জ্বালা-যন্ত্রণা সকলই কমিয়া জল হইয়া যায়। সেই ভরসাতেই মহাকষ্টে কারবালা হইতে এই পবিত্র রওজায় আসিয়াছি।”

 মদিনাবাসিগণ এই পর্য্যন্তু শুনিয়াই আর কেহ তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিলেন না। সকলেই ইমাম-শোকে কাতর হইলেন। নগরের প্রধান প্রধান এবং রাজসিংহাসন সংস্রবী মহোদয়গণ সেই সময়ে নগর মধ্যে ঘোষণা করিয়া, কি কর্ত্তব্য স্থির করিবার জন্য রওজার নিকটস্থ উপাসনামন্দির সম্মুখে মহাসভা আহ্বান করিয়া একত্রিত হইলেন।

 কেহ বলিলেন, “এজিদকে বঁধিয়া আনি।”

 কেহ বলিলেন, “দামেস্ক-নগর ছারখার করিয়া দিই।”

 বহু তর্ক-বিতর্কের পর শেষে সুস্থির হইল, “নায়ক-বিহনে সবাই প্রধান; এ অবস্থায় ইহার কোন প্রতিকারই হইবে না। সেই কারণে মদিনার সিংহাসনে একজন উপযুক্ত লোককে বসাইয়া তাঁহার অধীনতা স্বীকার করাই যুক্তিসঙ্গত। প্রবল তরঙ্গমধ্যে শিক্ষিত কর্ণধার বিহনে যেমন তরী রক্ষা করা কঠিন, রাষ্ট্র-বিপ্লবের মত মহা বিপদে একজন ক্ষমতাশালী অধিনায়ক না হইলে রাজ্য রক্ষা করাও সেইরূপ মহা কঠিন। স্ব স্ব প্রাধান্যে কোন কার্য্যেরই প্রতুল নাই।”

 সমাগত দলমধ্যে এক জন বলিয়া উঠিলেন, “কাহার অধীনতা স্বীকার করিব? পথের লোক ধরিয়া কি মদিনার সিংহাসনে বসাইতে ইচ্ছা করেন? মদিনাবাসীরা কোন্ অপরিচিত নীচবংশীয় লোকের নিকট নতশিরে দণ্ডায়মান হইবে? প্রভু মোহাম্মদের বংশে ত এমন কেহই নাই যে, তাঁহাকে সিংহাসনে বসাইয়া জন্মভূমির গৌরব রক্ষা করিব।”

 প্রথম বক্তা বলিলেন: “কোন চিন্তা নাই, মোহাম্মদ হানিফা এখনও বর্ত্তমান আছেন। হোসেনের পর তিনিই আমাদের পূজ্য, তিনিই রাজা। ইহার পর হোসেনের বৈমাত্র ভ্রাতাও অনেক আছেন। কারবালার এই লোমহর্ষণ ঘটনা শুনিয়া তাঁহারা কি স্ব স্ব সিংহাসনে বসিয়া থাকিবেন? ইহার পর নূরনবী মোহাম্মদের ভক্ত রাজাও অনেক আছেন; এই সকল ঘটনা তাঁহাদের কর্ণগোচর হইলে তাহারাই কি নিশ্চিন্ত থাকিবেন? এজিদ ভাবিয়াছে কি? সে মনে করিয়াছে যে, হোসেন-বংশ নির্ব্বংশ করিয়াছে, সুতরাং এখন নিশ্চিন্তে থাকিবে! তাহা কখনই ঘটিবে না, চতুর্দ্দিক হইতে সমরানল জ্বলিয়া উঠিবে। আমরা এখনই উপযুক্ত একজন কাসেদকে হানুফা নগরে প্রেরণ করিব। আপাততঃ মোহাম্মদ হানিফাকে সিংহাসনে বসাইয়া, যদি জয়নাল আবেদীন প্রাণে বাঁচিয়া থাকেন, তবে তাঁহার উদ্ধারের উপায় করিব। সঙ্গে সঙ্গে এজিদের দর্প চূর্ণ করিতেও সকলে আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।”

 সকলেই এই প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তখনই হানুফা নগরে কাসেদ প্রেরিত হইল।

 প্রথম বক্তা পুনরায় বলিলেন, “মোহাম্মদ হানিফা মদিনায় না আসা পর্য্যন্ত আমরা কিছুই করিব না। শোক-বস্ত্র যাহা এক্ষণে ধারণ করিয়াছি, তাহাই রহিল। জয়নাল আবেদীনের উদ্ধার এবং এজিদের সমুচিত শাস্তি বিধান না করিয়া আর এ শোক-সিন্ধুর প্রবল তরঙ্গের প্রতি কখনই দৃষ্টিপাত করিব না। আঘাত লাগুক, প্রতিঘাতে অন্তর ফাটিয়া যাউক, মুখে কিছুই বলিব না। কিন্তু সকলেই ঘরে ঘরে যুদ্ধ-সাজের আয়োজনে প্রবৃত্ত হও।”

 এই প্রস্তাবে সকলে সম্মত হইয়া সভাভঙ্গ করিলেন। হোসেন শোকে সকলেই অন্তরে কাতর; কিন্তু নিতান্ত উৎসাহে যুদ্ধসজ্জার আয়োজনে ব্যাপৃত রহিলেন। নগরবাসিগণের অঙ্গে, দ্বিতল—ত্রিতল গৃহদ্বারে এবং গবাক্ষে শোক-চিহ্ন! নগরের প্রান্তসীমায় শোকসূচক ঘোর নীল বর্ণ নিশান উড্ডীয়মান হইয়া জগৎকে কাঁদাইতে লাগিল।

 এদিকে দামেস্কনগরে আবার রণভেরী বাজিয়া উঠিল। এজিদের লক্ষাধিক সৈন্য সমর-সাজে সজ্জিত হইয়া মদিনাভিমুখে যাত্রা করিল। হানিফার মদিনা-আক্রমণের পূর্ব্বেই সৈন্যগণ মদিনার প্রবেশ-পথে অবস্থিত হইয়া তাঁহার গমনে বাধা দিবে, ইহাই মারওয়ানের মন্ত্রণা। মোহাম্মদ হানিফা প্রথমে কারবালায় গমন করিবেন, তৎপরে মদিনায় না যাইয়া, মদিনাবাসীদের অভিমত না লইয়া, হজরতের রওজা পরিদর্শন না করিয়া কখনই দামেস্ক আক্রমণ করিবেন না—ইহাই মারওয়ানের অনুমান। সুতরাং মদিনার প্রবেশপথে সৈন্য সমবেত করিয়া রাখাই আবশ্যক এবং সে প্রবেশ পথে হানিফার দর্প চূর্ণ করিয়া তাঁহার জীবন শেষ করাই যুক্তি-যুক্ত—এই সিদ্ধান্তই নির্ভুল মনে করিয়া এজিদ মারওয়ানের অভিমতে মত দিলেন;—তাই আবার রণভেরী বাজিয়া উঠিল। ওত্‌বে অলীদ দামেস্ক হইতে আবার মদিনাভিমুখে সসৈন্যে চলিল। হানিফার প্রাণ-বিনাশ, কিম্বা তাঁহাকে বন্দী করিয়া দামেস্কে প্রেরণ না করা পর্য্যন্ত সে মদিনা আক্রমণ করিবে না—কারণ, মোহাম্মদ হানিফাকে পরাস্ত না করিয়া, মদিনার সিংহাসন লাভ করিলে, কোন লাভই নাই, বরং নানা বিঘ্ন, নানা আশঙ্কা। এই যুত্তির উপর নির্ভর করিয়াই ওত্‌বে অলীদ নির্ব্বিঘ্নে যাইতে থাক্, আমরা একবার হানিফার গম্যপথ দেখিয়া আসি।