বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/ষষ্ঠ প্রবাহ
ষষ্ঠ প্রবাহ
যে নগরের সুখসাগরে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ খেলা করিতেছিল, মহানন্দের স্রোত বহিতেছিল, রাজপ্রাসাদ, রাজপথ, প্রধান প্রধান সৌধ আলোক মালায় পরিশোভিত হইয়াছিল, ঘরে ঘরে নৃত্য গীত, বাজনার ধুম পড়িয়াছিল, রঞ্জিত পতাকাসকল হেলিয়া দুলিয়া জয়সূচক চিহ্ন দেখাইতেছিল;—হঠাৎ তৎসমুদয় বন্ধ হইয়া গেল! মুহূর্ত্তমধ্যে মহানন্দ-বায়ু থামিয়া বিষাদ-ঝটিকাবেগ রহিয়া রহিয়া বহিতে লাগিল, মাঙ্গলিক পতাকারাজি নতশিরে হেলিতে দুলিতে পড়িয়া গেল। রাজপ্রাসাদের বাদ্যধ্বনি, নূপুরের ঝন্ঝন্, সুমধুর কণ্ঠস্বর আর কাহারও কর্ণে প্রবেশ করিল না। সুহাস্য আস্যসকল বিষাদ-কালিমা রেখায় মলিন হইয়া গেল। কেহ কাহারও সঙ্গে কথা কহিতেছে না, জিজ্ঞাসা করিলেও উত্তর পাইতেছে না। রাজভবনের অবস্থার হঠাৎ পরিবর্ত্তন দেখিয়া কত জনে কত কথার আলোচনায় বসিয়া গেল। শেষে সাব্যস্ত হইল, গুরুতর মনঃপীড়ায় হঠাৎ এই পরিবর্তন, নিশ্চয়ই হঠাৎ কোন দুঃখের সংবাদ শ্রবণ! তাহা কি? কারবালার সংবাদ—বিবি সালেমার প্রেরিত কাসেদের আগমন।
এ প্রদেশের নাম আম্বাজ, রাজধানী—হানুফা নগর। এই সমৃদ্ধিশালী মহানগরীর দণ্ডধর—মোহাম্মদ হানিফা। সম্রাট স্বীয় কন্যার বিবাহ উপলক্ষে আমোদ আহলাদে মাতিয়াছিলেন, শুভ-সময়ে শুভ-কার্য্য সুসম্পন্ন করিবেন আশা ছিল, এমন সময় কাসেদ আসিয়া হরিষে সম্পূর্ণ বিষাদ ঘটাইয়া মোহাম্মদ হানিফাকে নিতান্তই দুঃখিত করিয়া তুলিল!
হাসানের সাংঘাতিক মৃত্যু, জেয়াদের সখ্যতা, মারওয়ানের আচরণ; কুফার পথ ভুলিয়া হোসেনের কারবালায় গমন ও ফোরাত নদীর তীর শত্রুপক্ষের দ্বারা বেষ্টন,—এই সকল কথা শুনিয়া ক্রোধে, বিষাদে নরপল মহা অস্থির! কাসেদ তাঁহার সম্মুখে অবনতশিরে দণ্ডায়মান।
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “হায়! জীবিত থাকিতেই ভ্রাতা হাসানেয় মৃত্যু-সংবাদ শুনিতে হইল। তা হোসেনও কারবালা-প্রান্তরে সপরিবারে কষ্টে পড়িয়াছেন! হায়! এত দিন না জানি কি ঘটনাই ঘটিয়া থাকিবে! জগদীশ! আমার এই প্রার্থনা, দাসের এই প্রার্থনা,—কারবালা প্রান্তরে যাইয়া যেন ভ্রাতার পবিত্র চরণ দেখিতে পাই, পিতৃহীন কাসেমের মুখখানি যেন দেখিতে পাই। দয়াময়! আমার পরিজনকে রক্ষা করিও, দুরন্তু কারবালা প্রান্তরে তুমি ভিন্ন তাহাদের সহায় আর কেহ নাই। দয়াময়! দয়াময়!! আমার মনে শান্তি দান কর। আমি স্থির মনে অটলভাবে যেন কারবালায় গমন করিতে পারি—পূজ্যপাদ ভ্রাতার সাহায্য করিয়া কৃতার্থ হইতে পারি। দয়াময়! আমার শেষ ভিক্ষা এই যে, তোমার এ চিরকিঙ্করের চক্ষু কারবালা প্রান্তসীমা না দেখা পর্যন্ত হোসেন-শিবির শত্রুর আক্রমণ ইতে রক্ষা করিও।”
এই প্রকারে উপাসনা করিয়া মোহাম্মদ হানিফা তাহার সৈন্যগণকে প্রস্তুত হইতে আদেশ করিলেন। তিনি আরও বলিলেন, “আমার সঙ্গে কারবালায় যাইতে হইবে। আমি এ নগরে আর ক্ষণকালের জন্যও থাকিব না। রাজকার্য্য প্রধান মন্ত্রীর হস্তে ন্যস্ত থাকিল।”
মোহাম্মদ হানিফা ঈশ্বরের নাম করিয়া বীরসাজে সজ্জিত হইলেন। যুদ্ধবিদ্যাবিশারদ গাজী রহ্মাকে প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষ-পদে বরণ করিয়া তিনি কারবালাভিমুখে যাত্রা করিলেন। কাসেদ সঙ্গে সঙ্গে চলিল।