বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/চতুর্থ প্রবাহ

চতুর্থ প্রবাহ

 কথা চাপিয়া রাখা বড়ই কঠিন। কবি কল্পনার সীমা পর্যন্ত যাইতে হঠাৎ কোন কারণে বাধা পাইলে তাহার মনে ভয়ানক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সমাজের এমনই কঠিন বন্ধন, এমনই দৃঢ় শাসন যে, কল্পনা-কসুমে আজ মনোমত হার গাঁথিয়া পাঠক-পাঠিকাগণের পবিত্র গলায় দোলাইতে পারিলাম না। শাস্ত্রের খাতিরে নানা দিকে লক্ষ্য রাখিতে হইতেছে। হে ঈশ্বর, সর্ব্বশক্তিমান্ ভগবান্। সমাজের মূর্খতা দূর কর। কুসংস্কার-তিমির সজ্ঞান-জ্যোতিঃপ্রভায় বিনাশ কর। আর সহ্য হয় না। যে পথে যাই, সেই পথেই বাধা। সে পথের সীমা পর্যন্ত যাইতে মনের গতিরোধ হয়। তাহাতে জাতীয় কবিগণের বিভীষিকাময় বর্ণনায় বাধা জন্মায়, চক্ষে ধাঁধা লাগাইয়া দেয়; কিন্তু তাহারাও যে কবি, তাঁহাদের যে কল্পনাশক্তির বিশেষ শক্তি ছিল, তাহা সমাজ মনে করেন না। এই সামান্য আভাষই যথেষ্ট, আর বেশী দূর যাইব না। বিষাদ-সিন্ধুর প্রথম ভাগেই স্বজাতীয় মূর্খ‌দল হাড়ে হাড়ে চটিয়া রহিয়াছেন। অপরাধ আর কিছুই নহে, পয়গম্বর এবং এমামদিগের নামের পূর্ব্বে, বাঙ্গালা ভাষায় ব্যবহার্য্য শব্দে সম্বোধন করা হইয়াছে। মহাপাপের কার্য্যই করিয়াছি! আজ আমার অদৃষ্টে কি আছে, ঈশ্বরই জানেন। কারণ, মর্ত্ত্যলোকে থাকিয়া স্বর্গের সংবাদ প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণকে দিতে হইতেছে! স্বর্গীয় প্রধান দূত জেব্রাইল অতি ব্যস্ততা সহকারে ঘোষণা করিতেছেন, দ্বার খুলিয়া দাও। প্রহরিগণ। আজ স্বর্গের দ্বার, সপ্ততল আকাশের দ্বার খুলিয়া দাও। পুণ্যাত্ম তপস্বী, সিদ্ধপুরুষ, ঈশ্বরভক্ত, ঈশ্বরপ্রণয়ী প্রাণিগণের অমরত্মার বন্দিগৃহের দ্বার খুলিয়া দাও। স্বর্গীয় দূতগণ! অমর পুরবাসী নরনারিগণ! প্রস্তুত হও। হোসেনের এবং অন্য অন্য মহারথিগণের দৈহিক সৎক্রিয়া সম্পাদনের জন্য মর্ত্ত্যলোকে যাইবার আদেশ হইয়াছে। দ্বার খুলিয়া দাও, প্রস্তুত হও!”

 মহা হুলুস্থূল পড়িয়া গেল। “অল্পক্ষণের জন্য আবার মর্ত্ত্যলোকে” অমরাত্মাগণ এই বলিয়া স্ব স্ব রূপ ধারণ করিলেন। এদিকে হজরত জেব্রাইল আপন দলবলসহ সকলের পূর্ব্বেই কারবালা প্রান্তরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ক্রমে সকলের আবির্ভাব হইতে আরম্ভ হইল। দেখিতে দেখিতে জনমানবশূন্য প্রান্তর, পুণ্যাত্মাদিগের আগমনে পরিপূর্ণ হইয়া গেল; বালুকাময় প্রান্তরে সুস্নিগ্ধ বায়ু বহিয়া বহিয়া স্বর্গীয় সৌরভে চতুর্দ্দিক মোহিত ও আমোদিত করিয়া তুলিল।

 স্বর্গীয় দূতগণ, স্বর্গসংস্রবী দেবগণ, সকলেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। হজরত আদম,—যিনি আদি পুরুষ, যাঁহাকে অবজ্ঞা করিয়া প্রধান ফেরেশতা আজাজীল শয়তানে পরিণত হইয়াছিল, সেই স্বর্গীয় দূতগণ-পূজিত হজরত আদম—হোসেন-শোকে কাতর! স্নেহপরবশে প্রথমেই তাহার সমাগম হইল। পরে মহাপুরুষ মুসা—স্বয়ং ঈশ্বর তুর পর্ব্বতে যাহার সহিত কথা কহিয়াছিলেন; এবং তিনি সেই সচ্চিদানন্দের তেজোময় কান্তি দেখিবার জন্য নিতান্ত উৎসুক হইলে, সেই কান্তির কিঞ্চিৎ আভামাত্র তাহার নয়নগোচর হইয়াছিল, তাহাতেই তিনি স্বীয় শিষ্যগণসহ সে তেজ ধারণে অক্ষম হইয়া তখনই অজ্ঞান অবস্থায় ধরাশায়ী হইয়াছিলেন, তাঁহার শিষ্যগণ পঞ্চত্ব পাইয়াছিল,—আবার করুণাময় জগদীশ্বর, তাহার প্রর্থনায় ঐ শিষ্যগণকে পুনর্জ্জীবিত করিয়া তাহার অন্তরে অটল ভক্তির নব ভাবের আবির্ভাব করিয়াছিলেন—সেই মহামতি সত্য তার্কিক মুসাও আজ হোসেন-শোকে কাতর, কারবালায় সমাসীন। প্রভু সোলেমান—যাঁহার হিতোপদেশ আজও পর্য্যন্ত সর্ব্বধর্ম্মাবলম্বীর নিকট সমভাবে আদৃত,—সেই নর-কিন্নর-দানবদল-ভূপতি মহামতিও আজ কারবালা প্রান্তরে উপস্থিত! যে দায়ূদের গীতে জগৎ মোহিত, পশুপক্ষী উন্নত, স্রোতঃস্বতীর স্রোত স্থিরভাবাপন্ন, সেই দায়ুদও আজ কারবালায়।

 ঈশ্বর-প্রণয়ী ইব্রাহিম,—যাহাকে ঈশ্বরদ্রোহী রাজা নমরুদ প্রচণ্ড অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করিয়া সত্য প্রেমিকের প্রাণসংহার করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, ফলে যে অগ্নিশিখা গগনস্পর্শী হইয়া জগজ্জনের চক্ষে ধাঁধা লাগাইয়া দিয়াছিল,—দয়াময়ের কৃপায় সেই প্রজ্জ্বলিত গগনস্পশী অগ্নি, ইব্রাহিম-চক্ষে বিকশিত কমলদলে সজ্জিত উপবনের ন্যায় দেখাইয়াছিল এবং সেই অগ্নিশিখা সুগন্ধযুক্ত স্নিগ্ধকর গোলাপমালা বলিয়া বোধ হইয়াছিল,সেই সত্য বিশ্বাসী মহাঋষিও আজ কারবালা-ক্ষেত্রে সমাগত। ইসমাইল-যিনি নিজ প্রাণ ঈশ্বরের উদ্দেশে উৎসর্গ করিয়া “দোম্বার” পরিবর্ত্তে নিজে বলি হইয়াছিলেন, সেই ঈশ্বরভক্ত ইসমাইলও আজ কারবালা-প্রান্তরে! ঈশা-যিনি প্রকৃত সন্ন্যাসী, জগন্বেষী মহাঋষি তাপস, ঈশ্বরের মহিমা দেখাইতে যে মহাত্মা চিরকুমারী মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনিও আজ মর্ত্ত্যধামে কারবালার মহাক্ষেত্রে। ইউনুস-যিনি মৎস্যগর্ভে থাকিয়া ভগবানের অপরিসীম ক্ষমতা দেখাইয়াছিলেন—তিনিও কারবালায়! মহামতি হজরত ইউসুফ যিনি বৈমাত্র ভ্রাতার চক্রে অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হইয়াও ঈশ্বর-কৃপায় জীবিত ছিলেন এবং দাস-পরিচয়ে বিক্রীত হইয়া শেষে মিসর-রাজসিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন, সেই মহাসুশ্রীর অগ্রগণ। পূর্ণজ্যোতির আকর হজরত ইউসুফও আজ কারবালার মহা-প্রান্তরে। হজরত জাজিস্‌কে বিধর্ম্মিগণ শতবার শত প্রকারে বধ করিয়াছে, কিন্তু তিনিও পুনঃ পুনঃ জীবন প্রাপ্ত হইয়া দয়াময়ের মহিমার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখাইয়াছেন। সেই ভুক্তভোগী হজরত জাজিস্‌ও আজ কারবালা-ক্ষেত্রে। এই প্রকার হজরত ইয়াকুব, আস্‌হাব, ইস্‌হাক, ইদ্রীস, আয়ুব, ইলিয়াস্‌, হরকেল, শামাউন, লুত, এহিয়া, জেক্‌রিয়া প্রভৃতি মহা মহা মহাত্মাগণের আত্মা অদৃশ্য শরীরে কারবালায় হোসেনের দৈহিক শেষ-ক্রিয়ার জন্য উপস্থিত হইলেন।

 সকলেই যেন কাহার আগমন-প্রতীক্ষা করিতেছেন। ক্ষণকাল পরে সকলেই একেবারে দণ্ডায়মান হইয়া উর্দ্ধনেত্রে আকাশের দিকে বারবার লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। আর সকলেই আরব্য ভাষায় “এয়া নবী সালাম আলায়কা, এয়া হবীব সালাম আলায়কা, রসুল সালাম আলায়কা সালওয়াতোল্লাহু আলায়কা” সমস্বরে গাহিয়া উঠিলেন। সহস্র সহস্র, শব্দ কোটী কোটী মুখে মহাঋষি প্রভু হজরত মোহাম্মদের গুণানুবাদ হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে মৃদুমন্দভাবে শূন্য হইতে “হায় হোসেন। হায় হোসেন” রব করিতে করিতে হজরত মোহাম্মদ উপস্থিত হইলেন। তাঁহার পবিত্র পদ ভূপৃষ্ঠ স্পর্শ করিল। এত দিন প্রকৃতি শরীরী জীবের মুখে “হায় হোসেন!” রব শুনিয়াছিল; আজ দেবগণ, স্বর্গের হুর-গেলেমাগণ, মহাঋষি, যোগী, তপস্বী ও অমরাত্মাগণের মুখে শুনিতে লাগিল, “হায় হোসেন! হায় হোসেন!! হায় হোসেন!!!”

 এই গোলযোগ না যাইতে যাইতেই সকলেই যেন মহাদুঃখে নির্ব্বাক-ভাবে দণ্ডায়মান হইলেন। হায় হায়! পুত্রের কি স্নেহ! রক্ত, মাংস, ধমনী অস্থি, শরীরবিহীন আত্মাও অপত্য-স্নেহে ফাটিয়া যাইতেছে, যেন মেঘগর্জ্জনের সহিত শব্দ হইতেছে-“হোসেন! হায় হোসেন!!” মোরতজা আলী “শেরে খোদা” (ঈশ্বরের শার্দ্দূল) স্বীয় পত্নী বিবি ফাতেমা সহ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দৈহিক জীবের জন্য অমরাত্মাগণের শোক অমূলক, খেদ বৃথা। দৈহিক জীবের সহিত তাহাদের কোন সংস্রব নাই, তথাপি পুত্রের এমনই মায়া যে, সকল মূলতত্ত্ব জ্ঞাত থাকিয়াও মহাত্মা আলী মহা খেদ করিতে লাগিলেন। জাগতিক বায়ু প্রকৃত আত্মায় বহমান হইয়া ভ্রমময় মহাশোকের উদ্রেক করিয়া দিল। কুহকিনী দুনিয়ার কুহক জালের ছায়া দেখিয়া হজরত আলী অনেক ভ্রমাত্মক কথা বলিতে লাগিলেন: “আন অশ্ব, আন তরবারি, এজিদের মস্তক এখনই সহস্র খণ্ডে খণ্ডিত করিব।” হায়! সন্তানের স্নেহের নিকট তত্ত্বজ্ঞান, আত্ম-জ্ঞান, সকলই পরাস্ত।

 সকল আত্মাই হজরত আলীকে প্রবোধ দিলেন। হজরত জেব্রাইল আসিয়া বলিলেন: “ঈশ্বরের আদেশ প্রতিপালিত হউক। শহীদগণের দৈহিক সৎকারে প্রবৃত্ত হওয়া যাউক। অগ্রে শহীদগণের মৃতদেহ অন্বেষণ করিয়া সংগ্রহ করিতে হইবে; বিধর্ম্মী, ধর্ম্মী, স্বর্গীয়, নারকীয়, একত্র মিশ্রিত হইয়া সমরাঙ্গণে অঙ্গে অঙ্গ মিশিয়া রহিয়াছে, সেইগুলি বাছিয়া লইতে হইবে। সকলেই শহীদগণের দেহ অন্বেষণে ছুটিলেন।

 ঐ যে শিরশূন্য মহারথী-দেহ ধূলায় পড়িয়া আছে, খরতর তীরাঘাতে অঙ্গে সহস্র সহস্র ছিদ্র দৃষ্ট হইতেছে, পৃষ্ঠে একটি মাত্রও আঘাত নাই, সমুদয় আঘাতই বক্ষ পাতিয়া সহ্য করিয়াছেন, এ কোন বীর? কবচ, কটিবন্ধ, বর্ম্ম, চর্ম্ম, অসি—বীর-সাজের সমুদয় সাজ-সাজওয়া অঙ্গেই শোভা পাইতেছে—বয়সে কেবল নবীন যুবা! কি চমৎকার গঠন্‌! হায়! হায়!! তুমি কি আবদুল ওহাব? হে বীরবর! তোমার মস্তক কি হইল? তুমি কি সেই আবদুল ওহাব—যিনি চির প্রণয়িনী প্রিয়তমা ভার্য্যার মুখখানি একবার দেখিতে বৃদ্ধা মায়ের নিকট অনুনয় বিনয় করিয়াছিলেন, মাতৃ-আজ্ঞা প্রতিপালনে অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই যিনি বীররমণী বীরবালার বঙ্কিম আঁখির ভাব দেখিয়া এবং তাহার রণোত্তেজক কথা শুনিয়া অসংখ্য বিধর্ম্মীর প্রাণ বিনাশ করিয়াছিলেন,—তুমি কি সেই আবদুল ওহাব?

 বীরবরের পদ প্রান্তে এ আবার কে? এ বিশাল অক্ষি দুইটি উদ্ধে উঠিয়াও বীরশ্রেষ্ঠ আবদুল ওহাবের সজ্জিত শরীর-শোভা দেখিতেছে। এক বিন্দু জল!—ওহো, এক বিন্দু জলের জন্য আবদুল ওহাব-পত্নী হতপতির পদপ্রান্তে শুষ্ককণ্ঠ হইয়া আত্মবিসর্জ্জন করিয়াছেন। এ বৃদ্ধা রমণী-হৃদয়ে কে আঘাত করিল? এ কোমল শরীরে, কোন্ পাষাণ-হস্ত অস্ত্রাঘাত করিয়া বৃদ্ধ বয়সে তাহার জীবন-লীলা শেষ করিল? রে কাফেরগণ! হোসেনের সহিত শত্রুতা করিয়া রমণী-বধেও পাপ মনে করিস নাই? বীরধর্ম্ম, বীর-নীতি, বীর-শাস্ত্র কি বলে? যে হস্ত রমণীদেহ আঘাত করিতে উত্তোলিত হয়, সে হস্ত বীর-অঙ্গের শোভনীয় নহে, সে বাহু বীর-বাহু বলিয়া গণনীয় নহে। সে বাহু নরাকার পিশাচের বাহু।

 সে বীর-কেশরী, সে বীরকুল-গৌরব, সে মদিনার ভাবী রাজা কোথায়? মহা মহা রথী যাহার অশ্বচালনায়, তীরের লক্ষ্যে, তরবানির তেজে, বর্শার ভাঁজে মুগ্ধ,—সে বীরবর কৈ?—সে অমিত-তেজা রণকৌশলী কৈ?—সে নব পরিণয়ের নূতন পাত্র কৈ? এই ত শাহানা বেশ! এই ত বিবাহকালীন জাতিগত পরিচ্ছদ! এই কি সেই—যে সখিনার প্রণয়নুরাগ নব পুষ্পহার পরিণয়সূত্রে গলায় পরিয়াছিল? এই কি সেই কাসেম? হায়! হায়! রুধিরের কি অন্ত নাই!

 সখিনা সমুদয় অঙ্গে, পরিধেয় বসনে রুধির মাখিয়া, বীর-জায়ার পরিচয়-বিবাহের পরিচয় দিয়াছেন; তবু রুধিরের ধারা বহিতেছে, মণিময় বসন-ভূষণ ও তরবারি অঙ্গে শোভা পাইতেছে! তূণীর, তীর বর্শা দেহপার্শ্বে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বাম পার্শ্বে এ মহাদেবী কে? এ নবকমলদলগঠনা নব যুবতী সতী কে? চক্ষু দুইটি কাসেমের মুখ দেখিতে দেখিতে যেন বন্ধ হইয়াছে, জানিত কি অজানিতভাবে বাম হস্তখানি কাসেমের বক্ষের উপর রহিয়াছে। সতি! তুমি কে? তোমার দক্ষিণ হস্তে এ কি? একি ব্যাপার—কমলকরে লৌহ অস্ত্র! অন্ত্রের অগ্রভাগ কৈ? উহু! কি মর্ম্মঘাতী দৃশ্য! বদ্ধমুষ্টিতে অস্ত্র ধরিয়া হৃদয়কন্দরে প্রবেশ করাইয়াছ! তুমি কি সখিনা? তাহা না হইলে এত দুঃখ কার? স্বামীর বিরহ বেদনায় কাতর হইয়া আত্মবিসর্জ্জন করিয়াছ? না—না—বীর-জায়া, বীর-দুহিতা কি কখনও স্বামী-বিরহে, কি বিয়োগে আত্মবিসর্জন করে? কি ভ্রম! তাহা হইলে এ বদনে হাসির আভা কেন থাকিবে? জ্যোতির্ম্ময় কমলাননে জ্বলন্ত প্রদীপ-প্রভা কেন রহিবে? বুঝিলাম—বিরহ কি বিয়োগ-দুঃখে এ তীক্ষ্ণ খঞ্জরের হৃদয়-শোণিত, স্বামীদেহবিনির্গত শোণিতে মিশ্রিত হয় নাই, স্বামী-বিয়োগে অধীর হইয়া দুঃভার হ্রাস করিতে খঞ্জরের আশ্রয় গ্রহণ করা হয় নাই। ধন্য সতী, ধন্য সতী সখিনা! তুমি জগতে ধন্য, তোমার সুকীর্তি জগতে অদ্বিতীয় কীর্তি! কি মধুময় কথা বলিয়া খঞ্জর হস্তে করিয়াছিলে, জগৎ দেখুক! জগতের নরনারীকুল তোমায় দেখুক! এত প্রণয়, এত ভালবাসা, এত মমতা, এত স্নেহ। এক শোণিতে গঠিত যে কাসেম, সেই-ই আবার নব প্রেমে দীক্ষিত—যে ঘটনায় নিতান্ত অপরিচিত হইলেও মুহূর্তমধ্যে প্রণয়ের প্রেমের সঞ্চার হয়,—
কারবালায় হজরত হোসেনের মাজার শরীফ
সতীত্ব ধন রক্ষা করিতে সেই কাসেমকেই তুমি মুক্তকণ্ঠে বলিলে, “ভুলিলাম কাসেম! এখন তোমায় ভুলিলাম!” এই চিরস্মরণীয় মহামূল্য কথা বলিয়া যাহা করিলে তাহাতে অপরের কথা দূরে থাকুক,—নির্দয় হৃদয় মারওয়ানের অন্তরেও দয়ার সঞ্চার হইয়াছিল। ধন্য ধন্য সখিনা! সহস্র ধন্যবাদ তোমাকে!

 এ প্রান্তরে এ রূপরাশি কাহার? এ অমূলারত্ন ধরাসনে কেন? ঈশ্বর! তুমি কি না করিতে পার? একাধারে এত রূপ প্রদান করিয়া শেষে কি ভ্রম হইয়াছিল? সেই আজানুলম্বিত বাহু,—সেই বিস্তারিত বক্ষঃ—সেই আকর্ণ বিস্তারিত অক্ষিদ্বয়,—কি চমৎকার যুগল,—ঈষৎ গোঁফের রেখা! হায়! হায় ভগবান। এত রূপবান করিয়া কি শেষে তোমারই ঈর্ষা হইয়াছিল? তাহাতেই কি এই কিশোর বয়সে আলী আকবর আজ চির-ধরাশায়ী?

 এ যুগলমুর্ত্তি এ স্থানে পড়িয়া কেন? এ ননীর পুতুল রক্তমাখা অঙ্গে মহাপ্রান্তরে পড়িয়া কেন? বুঝিলাম, ইহাও এজিদের কার্য্য। রে পাষণ্ড পিশাচ! হোসেনের ক্রীড়ার পুত্তলি দুইটিও ভগ্ন করিয়াছিল? হায়! হায়!! এই ত সেই ফোরাত নদী, ইহার ভয়ানক প্রবাহ মৃত শরীর সকল স্রোতে ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে। নদীগর্ভে স্থানে স্থানে লোহিত, স্থানে স্থানে কিঞ্চিৎ লোহিত, কোন স্থানে ঘোর পীত, কোন স্থানে নীল-বর্ণের আভা-সংযুক্ত স্রোত বহিয়া নিদারুণ শোক প্রকাশ করিতেছে,—হোসেন-শোকে ফোরাতের প্রতি তরঙ্গ মস্তক নত করিয়া রঞ্জিত জলে মিশিয়া যাইতেছে।

 শব্দ হইল, “এ যে আমার কোমরবন্ধ, এ যে আমার শিরস্ত্রাণ, এ যে আমারই তরবারি, এ সকল এখানে পড়িয়া কেন?” আবার শব্দ হইল, “এ সকলই হোসেনের আয়ত্তাধীনে ছিল।”

 এই ত সেই মহাপুরুষ-মদিনার রাজা। তিনি র প্রান্তরে বৃক্ষতলে পড়িয়া কেন? রক্তমাখা খঞ্জর কাহার? এ ত হোসেনর অস্ত্র নহে! অঙ্গের বসন, শিরস্ত্রাণ কবচ স্থানে স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে,কারণ কি? এ কি আত্মবিকারের চিহ্ন, না ইচ্ছামৃত্যুর লক্ষণ? তাহাতেই কি এই দশা? বাম হস্তের অর্দ্ধ পরিমাণ খণ্ডিত হইয়াও দুই হস্ত দুই দিকে পড়িয়া যে উপদেশ দিতেছে, তাহার অর্থ কি জগতে কেহ বুঝিয়াছে? বাম হস্তে আবার কে আঘাত করিল? মস্তক খণ্ডিত হইয়াও জন্মভূমি মদিনার দিকে ফিরিয়া রহিয়াছে! হায় রে জন্মভূমি!!

 সীমার মস্তক লইয়া কাপিতে কাঁপিতে গিয়াছিল, আজর সেই মস্তক এই দেহে সংযুক্ত করিবার আশায় পুত্রগণের মস্তক কাটিয়া দিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। এজিদ,—কত খেলা খেলিবেন, কত অপমান করিবেন—এই আশা করিয়া মস্তক দামেস্কে লইয়া গিয়াছিলেন। ধন্য রে কারিগিরি! ধন্য রে ক্ষমতা! জগদীশ! তোমার মহিমা অপার। তুমি যাহা সংঘটন করিয়া একত্র করিতে ইচ্ছা কর,তাহা অত্যুচ্চ পর্ব্বতশিখরে থাক্‌, ঘোর অরণ্যে থাক্‌, অতল জলধিতলে থাক, অনন্ত আকাশে থাক্‌, বায়ু-অভ্যন্তরে থাক—তাহা তুমি সংগ্রহ করিয়া একত্র করিবেই করিবে। এ লীলা বুঝা মানবের সাধ্য নহে, এ কীর্তির কণামাত্র বুঝাও ক্ষুদ্র নরমস্তকের কার্য্য নহে। জগদীশ! প্রাণ খুলিয়া বলিতেছি, “তুমি সর্বশক্তিমান্ অদ্বিতীয় প্রভু! তোমার মহিমা অপার!!”

 স্বর্গীয় দূতগণ, পবিত্র আত্মাগণ শহীদগণের দৈহিক ক্রিয়ায় যোগ দিলেন; স্বর্গীয় সুগন্ধে সমাধিস্থান আমোদিত হইতে লাগিল।

 শহীদগণের শেষক্রিয়া জানাজা করিতে অন্য অন্য মৃত শরীরের ন্যায় জলে স্নান করাইতে হয় না, অন্য বসন দ্বারা শরীর আবৃত করিতে হয় না,—ঐ রক্তমাখা শরীরে, সজ্জিত বেশে, ঐ বীরসাজেই মন্ত্র পাঠ করিয়া মৃত্তিকায় প্রোথিত করিতে হয়। ধর্ম্মযুদ্ধের কি অসীম বল, কি অসীম পরিণাম-ফল।

 দৈহিক কার্য্য শেষ হইলে শহীদগণ দিব্যজ্ঞান লাভ করিয়া ঈশ্বরের আদেশে স্বর্গে নীত হইলেন।