বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/ত্রয়োদশ প্রবাহ
ত্রয়োদশ প্রবাহ
কে জানে, কাহার মনে কি আছে? এই অস্থি, চর্ম্ম, মাংসপেশীজড়িত দেহের অন্তরস্থ হৃদয়খণ্ডে কি আছে—তা কে জানে? ভূপালদ্বয় শিবিরমধ্যে শয়ন করিয়া আছেন—রজনী ঘোর অন্ধকার, শিবিরস্থ প্রহরিগণ জাগরিত,—হঠাৎ চতুর্থ দ্বারে মহা কোলাহল উত্থিত হইল। ঘোর আর্ত্তনাদ, ‘মার’ ‘ধর’ ‘কাট’ ‘জ্বালাও’ ইত্যাদি রব উঠিল। যাহারা জাগিয়াছিল; যাহারা ঐ সকল শব্দ ও গোলযোগের প্রতীক্ষায় ছিল, তাহারা ঘোর নিদ্রার ভাণেই পড়িয়া রহিল। যাহারা যথার্থ নিদ্রায় অচেতন ছিল, তাহারা ব্যস্তসমস্তে জাগিয়া উঠিল, তাহাদের অন্তরাত্মা কাঁপিতে লাগিল;—কোথায় অস্ত্র, কোথায় অশ্ব, কিছুই স্থির করিতে পারিল না! দেখিতে দেখিতে অসংখ্য অগ্নিশিখা সহস্র প্রকারে ধূম উদ্গীরণ করিতে করিতে ঊর্দ্ধে উঠিতে লাগিল। মহাবিপদ! কার কথা কে শুনে, কেই বা ভূপতির অন্বেষণ করে!
ভূপতিদ্বয়ের মধ্যে যিনি সৈন্যগণের কোলাহলে, অগ্নির দাহিকা শক্তির আরবে জাগরিত হইয়াছিলেন, তিনি যাহা দেখিলেন, তাহাতে নিশ্চয়ই মরণ জানিয়া মনে মনে ঈশ্বরের নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন। স্পষ্টভাবে ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিবার শক্তি তাঁহাদের নাই—কঠিনভাবে বস্ত্রে মুখ বন্ধ; শয্যা হইতে উঠিবার শক্তি নাই—হস্ত-পদ কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ। যাহারা বাঁধিল, তাহারা সকলেই পরিচিত, কেবল দুই একটি মাত্র অপরিচিত। তাঁহারা কি করিবেন? কোন উপায় নাই। মহা মহা বীর হইয়াও হস্তপদ বন্ধন অবস্থায় তাঁহাদের কোনই ক্ষমতা নাই। দেখিতে দেখিতে তাহারা ভূপালদ্বয়ের চক্ষুদ্বয়ও বস্ত্রে আবৃত করিয়া ফেলিল, ক্রমে তাঁহাদিগকে শষ্যা হইতে শূন্যে তুলিয়া কোথায় লইয়া চলিল।
শিবির মধ্যে যাহারা যথার্থ নিদ্রিত ছিল, তাহারা অনেকেই জ্বলিয়া ভস্মসাৎ হইয়া গেল। যাহারা এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, তাহারা কেহই মরিল না, শিবিরেও থাকিল না, সীমার-দলে মিশিয়া গেল। অবশিষ্টের মধ্যে যাহারা রহিল তাহার প্রাণ লইয়া পলাইল। কে জ্বলন্ত হুতাশন নিবারণ করে? কে প্রভুর অন্বেষণ করে? কে মন্ত্রীদের সন্ধান লয়? আপন আপন প্রাণ লইয়া সকলেই মহা ব্যস্ত।
ভূপতিদ্বয়কে বন্ধন-দশাতেই শিবিরে লইয়া সীমার নির্দ্দিষ্ট আসনে বসিল। বন্দীদ্বয়ের বন্ধন, চক্ষের আবরণ মোচন করিয়া সে নিজের সম্মুখে তাহাদিগকে দণ্ডায়মান করাইল। চারি পার্শ্বে প্রহরী, পদমাত্র হেলিবার সাধ্য নাই। বন্দীদ্বয় চক্ষে দেখিলেন: তাঁহাদের কতক সৈন্য ঐ দলে দণ্ডায়মান,— মহাহর্ষে বক্ষ বিস্তার করিয়া দণ্ডায়মান! কিন্তু সীমারের আজ্ঞাবহ!!
সীমার বলিল, “আপনার মহারাজ এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে হানিফার সাহায্যে মদিনা যাইতেছেন, সেই অপরাধে আপনারা অপরাধী এবং আমায় হস্তে বন্দী। মহারাজ এজিদ স্বয়ং আপনাদের বিচার করিবেন, ফলাফল তাঁহার হস্তে। আমি আপনাদিগকে এখনই দামেস্কে লইয়া যাইব। আপনারা বন্দী।” এই বলিয়া সে ভূপতিদ্বয়কে পুনর্ব্বার বন্ধন করিতে আজ্ঞা দিয়া দরবার ভঙ্গ করিল।
সীমার-শিবিরে আনন্দের লহরী ছুটিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতের প্রতীক্ষা। —গত রজনীতে সীমার প্রভাতের প্রতীক্ষায় ছিল, এখনও প্রভাতের প্রতীক্ষা। শিবির সৈন্য, যাহারা পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছিল, তাহাদেরও প্রভাতের প্রতীক্ষা! এ প্রভাত কাহার পক্ষে সুপ্রভাত হইবে, তাহা কে বলিতে পারে? দগ্ধীভূত শিবিরের অগ্নি এখনও নির্ব্বাপিত হয় নাই। কত সৈন্য নিদ্রার কোলে অচেতন অবস্থায় পুড়িয়া মরিয়াছে, কত লোক অর্দ্ধদগ্ধ অবস্থায় ছট ফট করিতেছে! ভূপতিদ্বয়ের অবস্থা কি হইল— তাঁহার পুড়িয়া খাক্ হইয়াছেন, কি পলাইয়া প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন— পলায়িত সৈন্যগণ তাহার কিছুই জানিতে পারে নাই। যাহাদের সম্মুখে ভূপতিদ্বয়কে বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহারা কে কোথায় লুকাইয়া আছে, এখনও জানা যায় নাই।
আজ সীমারের অন্তরে নানা চিন্তা। এ চিন্তার ভাব ভিন্ন, আকার ভিন্ন, প্রকার ভিন্ন। কারণ, সুখের চিন্তার ইয়ত্তা নাই, সীমা নাই, শেষ নাই। যে কার্য্যভার মস্তকে গ্রহণ করিয়া দামেস্ক হইতে সীমার যাত্রা করিয়াছিল, সে সর্ব্বতোভাবেই তাহাতে কৃতকার্য্য হইয়াছে। তাহার মনে আনন্দের তুফান উঠিয়াছে, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ উঠিয়া মহা গোলযোগ করিতেছে। ধনলাভ, মর্য্যাদাবৃদ্ধি, কি পদবৃদ্ধি— কি হইবে, কি চাহিবেন, কি গ্রহণ করিবেন, সীমার তাহার কিছুই স্থির করিতে পারিতেছে না। রাত্রি প্রভাত হইল। জগৎ জাগিল। প্রথমে পাখীকুল, শেষে মানবগণ বিশ্বরঞ্জন বিশ্বপতির নাম মুখে করিয়া জাগিয়া উঠিল। পূর্ব্বগগনে রবিদেব আরক্তিম লোচনে দেখা দিলেন। গত দিবাবসানে যে কারণে তিনি মলিনমুখ হইয়া অস্তাচলে মুখ ঢাকিয়াছিলেন, আজ যেন সে ভাব নাই। আজ তিনি ঘোর লোহিতবর্ণ, অসীম তাঁহার তেজ।—দেখিতে দেখিতে তিনি প্রখর কিরণ বিকীর্ণ করিয়া ক্রমে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
সীমার দামেস্ক-যাত্রার আয়োজনে ব্যস্ত,সৈন্যগণ সাজিতেছে, অশ্ব সকল সজ্জিত হইয়া আরোহীর অপেক্ষায় রহিয়াছে; বাজনার রোল ক্রমেই বাড়িতেছে, বিজয় নিশান উচ্চ শ্রেণীতে উর্দ্ধে উঠিয়া ক্রীড়া করিতেছে। এমন সময়ে যেন রবিদেবের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিমূর্ত্তির সহিত পূর্ব্ব দিকে প্রায় লক্ষাধিক সশস্ত্র দেবমূর্ত্তির আবির্ভাব। কি দৃশ্য! কি চমৎকার বেশ! স্বর্ণ-রজত নির্ম্মিত দণ্ডে কারুকার্য্য খচিত পতাকা! অশ্বপদ-বিক্ষেপের শ্রীই বা কি মনোহর! অস্ত্রের চাক্চিক্য আরও মনোহর, সূর্য্যতেজে অতি চমৎকার দৃশ্য ধারণ করিয়াছে। সীমার আশ্চর্য্যান্বিত হইল। পতাকার চিহ্ন দেখিতে দেখিতে তাহার বদনে বিষাদ-কালিমা রেখার মত শত শত চিহ্ন বসিয়া গেল; তাহার অঙ্গ শিহরিয়া উঠিল; হৃদয় কাঁপিতে লাগিল; চঞ্চল অক্ষি স্থির হইল। মুখে সীমার বলিল, “এ কাহার সৈন্য? এ যে নূতন বেশ, নুতন আকৃতি, নূতন সাজ! উষ্ট্রোপরি ডঙ্কা, নাকাড়া। নিশান-দণ্ড উষ্ট্রপৃষ্ঠে দণ্ডায়মান, আকার প্রকারে বীরভাবের পরিচয় দিতেছে! বংশীরবে উষ্ট্রসকল মনের আনন্দে নাচিতে নাচিতে আসিতেছে। ইহারা কাহারা? ইহারা কাহার সৈন্য?
উষ্ট্রপৃষ্ঠে নকিব উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করিয়া যাইতেছে, “ইরাকের অধিপতি মস্হাব কাক্কা, হজরত মোহাম্মদ হানিফার সাহায্যে মদিনায় যাইতেছেন। যদি গমনে বাধা দিতে কাহারও ইচ্ছা থাকে, সম্মুখ সমরে দণ্ডায়মান হও। না হয়, পরাজয় স্বীকারপূর্ব্বক পথ ছাড়িয়া প্রাণরক্ষা কর।”
এই সকল কথা সীমারের কর্ণে বিষসংযুক্ত তীরের ন্যায় বিঁধিতে লাগিল; তোগানের সৈন্যমধ্যে যাহারা নিশীথ সময়ে জ্বলন্ত অনল হইতে প্রাণ বাঁচাইয়া সীমারের ভয়ে জঙ্গলে লুকাইয়াছিল, তাহারা ঐ মধুমাখা রব শুনিয়া মহোল্লাসে মস্হাব কাক্কার নিকটে আসিয়া বলিতে লাগিল, “বাদশাহ্-নামদার! আমাদের দুর্দ্দশার কথা শুনুন,আমাদের দুর্দ্দশার কথা শুনুন!!”
সৈন্যগণ গমনে ক্ষান্ত দিয়া দণ্ডায়মান রহিল। ইরাক-অধিপতি সৈন্যগণের সম্মুখে শ্রেণীভেদ করিয়া বিবরণ জিজ্ঞাসা করিলে, ভুক্তভোগী সৈন্যগণ তাঁহার সম্মুখে রাত্রির সমুদয় ঘটনা বিবৃত করিল। তাহারা আরও বলিল, “বাদশাহ্-নামদার। ঐ যে জ্বলন্ত হুতাশন দেখিতেছেন—উহাই শিবিরের ভগ্নাবশেষ; এখনও পর্য্যন্ত খাকে পরিণত হয় নাই! কত সৈন্য়, কত আহারীয় দ্রব্য, কত অর্থ, কত বীর যে, ঐ মহা-অগ্নির উদরস্থ হইয়াছে, তাহার অন্ত নাই। তোগান ও তুরস্কের ভূপতিদ্বয় মোহাম্মদ হানিফার সাহায্যের জন্য মদিনায় যাইতেছেন; এজিদ-সেনাপতি সীমার রাত্রে দস্যুতা করিয়া মহা অনর্থ ঘটাইয়া, ভূপতিদ্বয়কে বন্দী করিয়া ঐ শিবিরে লইয়া গিয়াছে, এখনই দামেস্কে লইয়া যাইবে। গতকল প্রাতঃকাল হইতে দিবা দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত আমরা কেবল তীর-ধনুর লড়াই করিয়াছিলাম। বিপক্ষদিগকে এক পদও অগ্রসর হইতে দিই নাই। শেষে তাহারা সন্ধির প্রস্তাব করিয়া ঐ দিনের যুদ্ধ বন্ধ রাখিল। তাহার পর রাত্রে এই ঘটনা। সীমার ভয়ানক চতুর। বাদশাহ্-নামদার! মিথ্যা সন্ধির ভাণ করিয়া শেষে সে এই সর্ব্বনাশ করিয়াছে।”
মস্হাব বলিলেন, “তোমরা বলিতে পার, এ কোন্ সীমার?”
“বাদশাহ্-নামদার। গতকল্য ইহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। এই সীমারই স্বহস্তে ইমাম হোসেনের শির খঞ্জর দ্বারা খণ্ডিত করিয়াছিল। এই সীমারই ইমাম হোসেনের বুকের উপর বসিয়া দুই হাতে খঞ্জর চালাইয়া ‘মহাবীর’ নামে খ্যাত হইয়াছে, লক্ষ টাকা পুরস্কারও পাইয়াছে। সে পাষাণপ্রাণ না হইলে এত লোককে আগুনে পোড়াইয়া মারিতে পারিত কি?”
ইরাক-ভূপতি চক্ষু আরক্তবর্ণ করিয়া বলিলেন—“উঁহু! তুমি সেই সীমার! হায়! তুমি সেই!!” এই কথা বলিয়া তিনি অশ্ব ফিরাইলেন। সৈন্যগণও প্রভুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ অশ্ব ছুটাইল। অশ্ব-পদনিক্ষিপ্ত ধূলারাশিতে চতুষ্পার্শ অন্ধকার হইয়া গেল। প্রবল ঝঞ্ঝাবাতের ন্যায় মস্হাব কাক্কা সীমার-শিবির আক্রমণ করিলেন। অশ্বের দাপট, অস্ত্রের চাকচিক্য দেখিয়া সীমার চতুর্দ্দিকে অন্ধকার দেখিতে লাগিল। আজ নিস্তার নাই। কাক্কা স্বয়ং অসি ধরিয়াছেন, রক্ষা নাই!
মস্হাব বলিতে লাগিলেন, “সীমার! আমি তোমাকে বাল্যকাল হইতেই চিনি, তুমিও আমাকে সেই সময় হইতেই বিশেষরূপে জান। আর বিলম্ব কেন? আইস, দেখি তোমার দক্ষিণ হস্তে কত বল? (ক্রোধে অধীর হইয়া) আয় পামর! দেখি তোর খঞ্জরের কত তেজ।”
সীমার মস্হাব কাক্কার বলবিক্রম পূর্ব্ব হইতেই অবগত ছিল। তাহার সহিত সম্মুখ সমরাশা দূরে থাকুক, ভয়ে সে কাঁপিতে লাগিল—কি বলিবে, কাহাকে কি আজ্ঞা করিবে, কিছুই স্থির করিতে পারিল না।
মস্হাব কাকা সৈন্যগণকে বলিলেন, “সেই সীমার! এ সেই সীমার। ইহার মস্তক দেহ-বিচ্ছিন্ন করিতে আমার জীবন-পণ। এ সেই পাপিষ্ঠ, এ সেই নরাধম সীমার! আইস, আমার সঙ্গে আইস, বিষম বিক্রমে চতুর্দ্দিক হইতে পামরের শিবির আক্রমণ করি। কাক্কা অশ্বে কশাঘাত করিতেই অশ্বারোহী সৈন্যগণ ঘোর নিনাদে সিংহবিক্রমে সীমার শিবিরোপরি যাইয়া পড়িল। আজ সীমারের মহাসঙ্কট উপস্থিত। আত্মরক্ষার অনেক উপায় সে উদ্ভাবন করিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না, কিছুই কার্য্যে আসিল না। সে পরাভব স্বীকারের চিহ্ন দেখাইল, কোন ফলই হইল না; কাক্কা সে দিকে দৃকপাতও করিলেন না; কেবল মুখে বলিলেন, “সীমার! তাের সঙ্গে যুদ্ধের রীতি কি? তাের সঙ্গে কথা কি? তুই কোথায়? শীঘ্র আসিয়া আমার তরবারির নীচে স্কন্ধ পাতিয়া দে! তােকে পাইলেই আমি যুদ্ধে ক্ষান্ত হই, তাের সৈন্যগণের প্রাণবধ করিতে বিরত হই। তুই কেন গােপনভাবে আছিস্? তুই নিশ্চয়ই জানিস্, আজ তাের নিস্তার নাই। এই অশ্বচক্রমধ্যে তাের প্রাণ, তাের সৈন্যসামন্ত—সকলেরই প্রাণ বাঁধা রহিয়াছে। একটি প্রাণীও এ চক্র ভেদ করিয়া যাইতে পারিবে না। নিশ্চয় জানি, তােদের সকলের জীবন আমাদের তরবারির তেজের উপর নির্ভর করিতেছে। তুই সেই সীমার! আবার আজকাল ‘মহাবীর সীমার’ নামে পরিচিত! শুনিলাম, তুই নাকি এজিদের সেনাপতি? তোর আত্মগােপন কি শােভা পায়? ছিঃ ছিঃ, সেনাপতির নাম ডুবাইলি। ‘মহাবীর’ নামে কলঙ্ক রটাইলি! তাের অধীনস্থ সৈন্যগণের নিকট অপদস্থ হইলি! ভীরু ও কাপুরুষের পরিচয় প্রদান করিলি! নিজেও মজিলি, অপরকেও মজাইলি! তাের শুভ্র নিশানে ভুলিব না; তুই গত কল্য যাহা করিয়াছিস্, তাহাতে সন্ধির প্রস্তাব আর কর্ণে শুনিব না। তাের কোন প্রার্থনাই গ্রাহ্য করিব না। তুই যে খেলা খেলিয়াছিস্, যে আগুন জ্বালাইয়াছিস্, তাহার ফল চক্ষের উপর রহিয়াছে, —এখনও জ্বলিতেছে, এখনও পুড়িতেছে। তুই অনেক প্রকারের খেলা খেলিয়াছিস্! কি ধূর্ত্ত! পরকালের পথও একেবারে নিষ্কণ্টক করিয়া রাখিয়াছিস্? তাের চিন্তা কি? তোর মরণে ভয় কি? জােগান ও তুর্কী ভূপতিদ্বয়ের যে দশা ঘটিয়াছে, ইহা তাঁহাদের ভ্রম নহে। বিশ্বাসী না হইলে বিশ্বাসঘাতকতা করিবার সাধ্য কাহার? আমি নিশ্চয় বলিতেছি, তাের জীবন-প্রদীপ নির্ব্বাণ না করিলে আমার অন্তরের জ্বালা নিবারণ হইবে না।”
কাক্কা কথা কহিতেছেন, এদিকে সীমারের সৈন্যদল বাত্যাহত কদলীর ন্যায় কাক্কার সৈন্যহস্তে পতিত হইতেছে,—কথাটি বলিবার অবসর পাইতেছে না, নিঃশব্দে রক্তমাখা হইয়া ভূতলে পড়িতেছে। সীমার কোনও চাতুরী করিয়া আর উদ্ধারের পথ আবিষ্কার করিতে পারিল না। বহু চিন্তার পর সে মনে মনে স্থির করিল: ভূপতিদ্বয়কে ছাড়িয়া দিলেই বোধ হয়, মস্হাব কাক্কা যুদ্ধে ক্ষান্ত দিবেন। বাঁচিলে ত পদোন্নতি? আজ এই কালান্তক কালের হস্ত হইতে রক্ষা পাইলে ত অন্য আশা? অদৃষ্টে যাহাই থাকুক, ঘটনাস্রোত যে দিকে যায়, সেই দিকেই অঙ্গ ভাসাইব; এক্ষণে ভূপতিদ্বয়কে ছাড়িয়া দেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।”
সীমার ভূপতিদ্বয়কে নিস্কৃতি দিল। তোগান ও তুরস্কের ভূপতিদ্বয়কে দেখিয়া মস্হাব কাক্কা সাদরে ও মিষ্ট সম্ভাষণে বলিলেন, “ঈশ্বর আপনাদিগকে রক্ষা করিয়াছেন, আর চিন্তা নাই। সৈন্যসামন্ত, আহারীয় দ্রব্য, অর্থ ইত্যাদি যাহা ভস্মীভূত হইয়াছে, সে জন্য দুঃখ নাই। বিপদগ্রস্ত না হইলে নিরাপদে সুখ কখনই ভোগ করা যায় না; দুঃখভোগ না করিলে সুখের স্বাদ পাওয়া যায় না। ভ্রাতাগণ! কথা কহিবার অনেক সময় পাই, কিন্তু সীমার হাতছাড়া হইলে আর তাহাকে পাইব না। আপনারা আমার সাহায্যে অস্ত্রধারণ করুন। ঐ অশ্বসকল সজ্জিত আছে,—অস্ত্রের অভাব নাই! যে অস্ত্র লইতে ইচ্ছা করেন, রক্ষীকে আদেশ করিলেই সে তাহা যোগাইবে; বিলম্বের সময় নহে, শীঘ্র সজ্জিত হইয়া আমায় সাহায্য করুন, যুদ্ধে ব্যাপৃত হউন। দেখি, সীমার যায় কোথা?”
সীমারের সেনাগণ সেনাপতির কাপুরুষতা দেখিয়া বলিয়া উঠিল, “ছিঃ। ছিঃ! আমরা কাহার অধীনতা স্বীকার করিয়াছি? এমন ভীরুস্বভাব নীচমনার আজ্ঞাবহ হইয়া সমরসাজে আসিয়াছি। ছিঃ! ছিঃ! এমন সেনাপতি ত কখনও দেখি নাই;—বিনাযুদ্ধে সৈন্য়ক্ষয় করিতেছে! কি কাপুরুষ! যুদ্ধ করিবার আজ্ঞাও মুখ হইতে বহির্গত হইতেছে না। ছিঃ! ছিঃ! এমন যোদ্ধা ত জগতে দেখি নাই! ধিক্ আমাদিগকে! এমন ভীরু-স্বভাব সেনাপতির অধীনে আর থাকিব না। চল ভ্রাতাগণ! চল, ঐ বীর-কেশরীর আজ্ঞাবহ হইয়া প্রাণরক্ষা করি; যদি বল, আমাদিগকে তাহারা বিশ্বাস করিবে না; বিশ্বাস না করুক, আগে পাছে উহাদের হাতেই মরণ—নিশ্চয় মরণ! চল, ঐ মহাবীর মস্হার কাক্কার পদানত হই, অদৃষ্টে যাহা থাকে হইবে।”
সীমার-সৈন্যগণ “জয় মোহাম্মদ হানিফা! জয় মোহাম্মদ হানিফা!!”
মুখে উচ্চারণ করিয়া বিপক্ষদল-সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল এবং তরবারি প্রভৃতি সমুদয় অস্ত্র তাঁহাদের সম্মুখে রাখিয়া দিয়া আত্মসর্পণ করিল। মহাবীর মস্হাব তাহাদিগকে অভয়দানে আশ্বস্ত করিয়া সাদরে গ্রহণ করিলেন, কিন্তু তাহাদের সঙ্গে অস্ত্র লইতে দিলেন না।
সীমার অর্থ-লোভ দেখাইয়া, পদোন্নতির আশা দিয়া, অর্থে বশীভূত করিয়া যে সকল সৈন্য ও সৈনাধ্যক্ষকে নিজ শিবিরে আনাইয়াছিল, তাহারা বলিতে লাগিল, “আমরা যে ব্যবহার করিয়াছি, সীমারের কূহকে পড়িয়া যে কুকাণ্ড করিয়াছি, ইহার প্রতিফল অবশ্যই আমাদিগকে পাইতে হইবে। কি ভ্রমে পড়িয়া এই কুকার্য্যে যোগ দিয়াছিলাম। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত না হইয়া যায় না, হওয়াই উচিত। কিন্তু এখন কথা এই যে, সেনাপতি মহাশয় নিজ সৈন্যদিগকে বশে রাখিতে যখন অক্ষম, তখন আমাদের দশা কি হইবে? অতি অল্প সময় মধ্যেই আমরা কাক্কার হস্তে ধরা পড়িব। কোনও দিক হইতেই আর জীবনের আশা নাই। এ অবস্থায় আর বিলম্ব করা উচিত নহে। কোনও দিক হইতেই আমাদের জীবনের আশা নাই। আর বিলম্ব করিব না। ভাইসকল! যত সত্বর হয়, এস সকলে মহাবীর মস হাব কাক্কার হস্তে আত্মসর্পণ করি। কিন্তু সেনাপতি মহাশয়কে রাখিয়া যাইব না। শেষে ভবিতব্যে যাহা থাকে হইবে। আমরা বিখ্যাত যোদ্ধা, আমাদের এ কলঙ্ক-কালিমা-রেখা, জগতে চিরকাল সমভাবে আঁকা থাকিবে। মনে হইলেই লোকে বলিবে: তুর্কী সৈন্ত্যের সৈন্যাধ্যক্ষ অর্থলোভে বিশ্বাসঘাতকতার কার্য্য করিয়া সর্ব্বনাশ করিয়াছে। ভাইসকল। তাহাতেই বলি, কথার শেষে আর একটি কথা সংলগ্ন করিয়া রাখিয়াই যাই;—সীমার! সীমার!! সীমার!!”
সীমার-শিবির মধ্য হইতে ঘোররবে—“জয় ইরাক অধিপতি! জয় মোহাম্মদ হানিফা” রব উখিত হইতে লাগিল। মুহূর্ত্তমধ্যে তাহারা সীমারকে হস্তপদে বন্ধন করিয়া রণপ্রাঙ্গণে মস্হাব কাক্কার সম্মুখে রাখিয়া করজোড়ে বলিতে লাগিল, “আমরা অপরাধী, দণ্ডবিধান করুন। বাদশাহ্-নামদার! সেনাপতি মহাশয়কে বাঁধিয়া আনিয়াছি, গ্রহণ করুন।”
মস্হাব কাক্কা প্রথমে ইহা সীমারের চাতুগী মনে করিয়া দ্রুত অসিচালনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন; পরে আমূল বৃত্তান্ত শুনিয়া বলিলেন, “সৈন্যগণ! তোমরাই বাহাদুর! তোমরাই সীমারের রক্ষক, তোমরাই সীমারকে বন্দীভাবে লইয়া আমার সহিত মদিনায় চল। মোহাম্মদ হানিফার সম্মুখে তোমাদের এবং সীমারের বিচার হইবে।”
এদিকে কাক্কা সৈন্যগণকে গোপনে আজ্ঞা করিলেন, “বিদ্রোহী সৈন্য ও সীমারকে কৌশলে মদিনায় লইয়া যাইতে হইবে। সাবধান! উহাদের একটি প্রাণীও যেন হাতছাড়া না হয়। বিশেষতঃ, সীমার বড় ধূর্ত্ত।” এই আদেশ করিয়া মস্হাব কাক্কা মদিনাভিমুখে যাত্রা করিলেন।
জগদীশ! তোমার মহিমার অন্ত নাই। কাল কি করিলে?—আবার রাত্রে কি ঘটাইলে!—প্রভাতেই বা কি দেখাইলে!—আবার এখনই বা কি কৌশল খাটাইয়া কি খেলা খেলাইলে! ধন্য তোমার মহিমা! ধন্য তোমার কারিগিরি! যে ফণীর দ্বারা দংশন করাইলে, সেই বিষধর ফণীর বিষেই ঔষধ তৈরী করিয়া নির্ব্বিষ করিয়া দিলে! ধন্য তোমার মহিমা। ধন্য তোমার লীলা!
যাও সীমার, মদিনায় যাও। তোমার বাক্য আজ সফল হইল। আর ও-হাতে লৌহ-অস্ত্র ধরিতে হইবে না। যাও, মদিনায় যাও। মদিনায় গিয়া তোমার কৃতকার্য্যের ফলভোগ কর। সেখানে অনেক দেখিবে।—সে প্রান্তরে অনেক দেখিতে পাইবে। তোমার প্রাণপ্রতিম প্রিয়সখা ওত্বে অলীদকে দেখিতে পাইবে। অশ্ব, শিবির, অস্ত্র, যুদ্ধ, যোদ্ধা, সমরাঙ্গণ— সকলই দেখিতে পাইবে; কিন্তু তুমি পরহস্তে থাকিবে। সীমার! একবার মনে করিও সীমার!! ফোরাতকূলের ঘটনা একবার মনে করিও। আজরের কথা মনে করিও। তুমি জগৎ কাঁদাইয়াছ,—বন, উপবন, পর্ব্বত, গিরিগুহা, গগন, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য্য বায়ু ভেদ করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে যে হৃদয়বিদারক শব্দ উত্তোলন করাইয়াছ, সে কথাটাও একবার মনে করিও। এই ত সে দিনের কথা। হাতে হাতেই এই ফল!—ইহাতে আর আশা কি? এই নশ্বর জীবনে, এই অস্থায়ী জগতে আর আশা কি, সীমার? প্রাতে তোমার মনে যে ভাবনা ছিল, এইক্ষণে তাহার কি কিছু আছে? বল মানুষের সাধ্য কি? বাহুবল, অর্থবল লইয়া মূর্খেরাই দর্প করে। তুমি না দামেস্কের অভিমুখে মহা হর্ষে যাত্রা করিয়াছিলে?—সুসময়ে যাত্রার চিহ্নম্বরূপ কত পতাকাই না উড়াইয়াছিলে?—কত বাজনাই না বাজাইয়াছিলে? দেখ দেখি, মুহূর্ত্ত মধ্যে কি ঘটিয়া গেল! ভবিষ্যৎ-গর্ভে যে কি নিহিত আছে, তাহা জানিবার কাহারও সাধ্য নাই। যাও সীমার, মদিনায় যাও, তোমার কৃতকার্য্যের ফল ভোগ কর।