বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/চতুর্দ্দশ প্রবাহ

চতুর্দ্দশ প্রবাহ

 হায়! হায়!! এ আবার কি? এ দৃশ্য কেন চক্ষে পড়িল। উহু! কি ভয়ানক ব্যাপার! উহু! কি নিদারুণ কথা! এ প্রবাহ না লিখিলে কি “উদ্ধার পর্ব্ব” অসম্পূর্ণ থাকিত, না বিষাদ-সিন্ধুর কোন তরঙ্গের হীনতা জন্মিত? বুদ্ধি নাই, তাই সীমারের বন্ধনে মনে মনে একটু সুখী হইয়াছিলাম। কিন্তু এখন যে প্রাণ যায়! এ বিষাদ-প্রবাহে এখন যে প্রাণ যায়! হায়! হায়! হায়!! এ সিন্ধুমধ্যে কি মহা-শোকের কল্লোলধ্বনি ভিন্ন আনন্দ-হিল্লোলের সামান্য ভাবও থাকিবে না! হায় রে কৃপাণ! আবরণবিহীন কৃপাণ!! এজিদের হস্তের কৃপাণ!!! সম্মুখে মদিনার ভাবী রাজা ঊর্দ্ধদৃষ্টিতে দণ্ডায়মান। তিন পার্শ্বে সজ্জিত প্রহরী—এক পার্শ্বে প্রহরী নাই। হাসনেবানু, শাহ্‌রেবানু, জয়নাব প্রভৃতির দৃষ্টির বাধা না জন্মে—জয়নালের শিরশ্ছেদন স্বচ্ছন্দে যাহাতে তাহাদের চক্ষে পড়ে, সেই উদ্দেশ্যেই বন্দীগৃহের সম্মুখে বধ্যভূমি, এবং সেই দিক প্রহরীশূন্য! সন্তানের মস্তক কি প্রকারে ধরায় লুষ্ঠিত হয়, তাহাই মাকে দেখাইবার জন্য সে দিক প্রহরীশূন্য! এজিদ অসিহস্তে জয়নালের সম্মুখে দণ্ডায়মান। মারওয়ান নীরব, পুরবাসিগণ নীরব, দর্শকগণ ম্লানমুখে নীরব! এ ঘটনা কেহ ইচ্ছা করিয়া দেখিতে আসে নাই। প্রহরিগণ বলপূর্ব্বক নগরবাসিগণকে ধরিয়া আনিয়াছে।

 এজিদের আজ্ঞায় যে সময় জয়নাল আবেদীনকে বন্দীগৃহ হইতে বলপূর্ব্বক আনা হইয়াছে, সেই সময় হাসনেবানু অচৈতন্য হইয়াছেন, তাঁহার চক্ষু আর উম্মীলিত হয় নাই। শাহ্‌রেবানু, জয়নাব, বিবি সালেমা জয়নালের হাসিহাসি মুখখানির প্রতি স্থিরনেত্রে চাহিয়া আছেন। নিমেষশূন্য চক্ষে জলের ধারা বহিতেছে—অন্তরে, হৃদয়ে, শ্বাসে, প্রশ্বাসে সেই বিপদতারণ ভগবানের নাম, সহস্র বর্ণে, সহস্র প্রকারে, নিঃশব্দে বর্ণিত হইতেছে—জাগিতেছে।

 এজিদ বলিলেন, “জয়নাল! তোমার জীবনের এই শেষ সময়। কোন কথা বলিবার থাকে ত বল। তোমার পরমায়ু শেষ হইয়াছে। ঊর্দ্ধদৃষ্টিতে নীরবে আকাশ পানে চাহিয়া থাকিলে আর কি হইবে? আমি ভাবিয়াছিলাম, তুমি আমার বশ্যতা স্বীকার করিবে, আমার নামে খোৎবা পড়িবে, আমাকে রাজা বলিয়া মান্য করিবে, আমি তোমাকে ক্ষমা করিব! ঘটনাক্রমে তাহা ঘটিল না। কাজেই শত্রুর শেষ রাখিতে নাই—শত্রুকে হাতে পাইয়া ছাড়িতে নাই। আমি নিশ্চয় জানিয়াছি, তুমি আমার বশ্যতা স্বীকার করিবে না; এ অবস্থায় তোমাকে আর জীবিত মাখিতে পারি না। জীবিত রাখিয়া সর্ব্বদা সন্দিহান থাকা আমার বিবেচনায় ভাল বোধ হইল না। জয়নাল! ঊর্দ্ধে কি আছে? অনন্ত আকাশে সূর্য্য ভিন্ন আর কি আছে? তুমি আকাশে কি দেখ? আমায় দেখ! আমার হস্তস্থিত শাণিত কৃপাণের প্রতি চাহিয়া দেখ। তোমার মরণ অতি নিকট; যদি কোন কথা থাকে ত বল। আমি মনোযোগের সহিত শুনিব।”

 জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “তোমার সহিত আমার কোন কথা নাই। আমার জীবনে মরণে তোমার সমান ফুল। আমি বাঁচিয়া থাকিলেও তোমার নিস্তার নাই, মরিলেও তোমার নিষ্কৃতি নাই, বন্দীখানায় থাকিলেও তোমায় উদ্ধার নাই।”

 এজিদ সরোষে বলিলেন, “এখনও স্পর্ধা! এখনও অহঙ্কার! এখনও ঘৃণা! এখনও এজিদকে ঘৃণা! এ সময়েও কথার বাঁধুনি। দেখ্ এজিদের নিষ্কৃতি আছে কি না? দেখ্ এজিদের উদ্ধার আছে কি না? জীবনে মরণে সমান ফল?—দেখ্ জীবনে মরণে সমান ফল। এই দেখ্ জীবনে মরণে সমান—”

 এজিদ তরবারি উত্তোলন করিতেই মারওয়ান বলিল, “বাদশাহ্ নামদার! একটু অপেক্ষা করুন, ঐ দেখুন ওত্‌বে অলীদের সেই নির্দ্দিষ্ট বিশ্বাসী কাসেদ অশ্বারোহণে মহাবেগে আসিতেছে; ঐ দেখুন আসিয়া উপস্থিত হইল—একটু অপেক্ষা করুন। যদি হানিফার জীবন শেষ হইয়া থাকে, তবে সে সংবাদ জয়নালকে শুনাইয়া কার্য্য শেষ করুন। শত্রুর শেষ, কার্য্যের শেষ—সকল শেষ একেবারে হইয়া যাউক। বাদশাহ্-নামদার। একটু অপেক্ষা করুন।”

 এজিদের হস্ত নীচে নামিল। কাসেদ কি সংবাদ লইয়া আসিল শুনিতে তিনি এখন মহাব্যগ্র, তাই অতি অল্প সময়ের জন্য জয়নাল-বধে ক্ষান্ত দিলেন—কাসেদের প্রতি এখন তাঁহার লক্ষ্য।

 কাসেদ অভিবাদন করিয়া ওত্‌বে অলীদের লিখিত পত্র মারওয়ানের হস্তে দিয়া মলিন মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া রহিল। মারওয়ান উচ্চৈঃস্বরে পত্র পাঠ করিতে লাগিল:—

 “মহারাজাধিরাজ এজিদ বাদশাহ্-নামদারের সর্ব্বপ্রকারে জয় ও মঙ্গল। আজ্ঞাবহ কিঙ্করের নিবেদন এই যে, মোহাম্মদ হানিফা চতুর্দ্দশ সহস্র সৈন্যসহ মদিনার নিকটবর্ত্তী প্রান্তরে আসিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এ পর্য্যন্ত তিনি নগরে প্রবেশ করিতে পারেন নাই। প্রথম দিনের যুদ্ধে আমার সহস্রাধিক সেনা মানবলীলা সম্বরণ করিয়াছে। আগামী কল্য যে কি ঘটিবে, তাহা কে বলিতে পারে? যত শীঘ্ন হয়, মারওয়ানকে অধিক পরিমাণে সৈন্যসহ আমার সাহায্যে প্রেরণ করুন। হানিফাকে বন্দী করা দূরে থাকুক, মারওয়ান না আসিলে চিরদাস অলীদ বোধ হয় আর দামেস্কের মুখ দেখিতে পাইবে না।”

 এজিদ একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “কি বিপদ! এ অপদ কোথায় ছিল? এক দিনের যুদ্ধে হাজার সৈন্যের অধিক মারা পড়িয়াছে, এ কি কথা!”

 মারওয়ান বলিল, “বাদশাহ্-নামদার। এ সময়ে একটু বিবেচনার আবশ্যক। বন্দীর প্রাণ বিনাশ করিতে কতক্ষণ?”

 “না—না, ও-সকল কথা কথাই নহে। জয়নালকে আর মরজগতে রাখা যাইতে পারে না। আমি তোমার এ ভ্রমপূর্ণ উপদেশ আর শুনিতে ইচ্ছা করি না।”

 পুনরায় তরবারি উত্তোলন করিতেই দর্শকগণ মধ্যে মহাগোলযোগ উপস্থিত হইল। কেহ পিছু হটিল, কেহ পড়িয়া গেল, কেহ উভয় পার্শ্বে ধাক্কা খাইয়া একপার্শ্বে সরিল। জনতা ভেদ করিয়া দ্বিতীয় সংবাদবাহী এজিদ-সম্মুখে উপস্থিত হইয়া ম্লান মুখে বলিতে লাগিল, “মহারাজ। ক্ষান্ত হউন! জয়নাল-বধে ক্ষান্ত হউন! বড়ই অমঙ্গল সংবাদ আনিয়াছি। সাধারণের সমক্ষে বলিতে সাহস হয় না।”

 এজিদ মহারোষে বলিলেন, “এখানে মোহাম্মদ হানিফা নাই,—বল।”

 সংবাদবাহী বলিল, “আমরা যাইয়া দেখি,—সেনাপতি সীমার বাহাদুর নিশীথ সময়ে সৈন্যগণকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া বিপক্ষগণের শিবির বেষ্টন করিয়া রহিয়াছেন। প্রভাত বায়ুর সহিত বিপক্ষদল হইতে অসংখ্য তীরবর্ষণ হইতে লাগিল, দ্বিপ্রহর পর্য্যন্ত অবিশ্রান্তভাবে তীর ছুটিল। আমাদের সেনাপতি এক পদ ভূমিও অগ্রসর হইতে পারিলেন না। ক্রমে সৈন্যগণ শরাঘাতে জর জর হইয়া ভূতলশায়ী হইতে লাগিল। সেনাপতি সীমার কি মনে করিয়া সন্ধিসূচক শুভ্রপতাকা উড়াইয়া দিলেন। কিছুই বুঝিলাম না; যুদ্ধ বন্ধ হইল। কোন পক্ষ হইতেই আর যুদ্ধের আয়োজন দেখিলাম না। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইল, নিশার গভীরতার সহিত বিপক্ষ শিবিরে মহাগোলযোগ উপস্থিত হইল। তাহার পর দেখিলাম যে, বিপক্ষ শিবিরে আগুন লাগিয়াছে—দেখিতে দেখিতে কত অশ্ব, কত সৈন্য পুড়িয়া মরিল। তাহার পর দেখিলাম, শিবিরস্থ ভূপতিদ্বয়কে বন্দীভাবে সেনাপতি মহাশয় শিবিরে লইয়া আসিলেন। আনন্দের বাজনা বাজিয়া উঠিল। সূর্য্য উদয় হইলেই শিবির ভগ্ন করিয়া সেনাপতি মহাশয় দামেস্ক-নগরে আসিবার উদ্যোগ করিতেছেন, এমন সময় পূর্ব্বদিক হইতে বহুসংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্য বিশেষ সজ্জিতভাবে আসিয়া উপস্থিত হইল। বিপক্ষ দলের সৈন্যগণমধ্যে যাহারা পলাইয়া গত রাত্রের জ্বলন্ত হুতাশন হইতে প্রাণরক্ষা করিয়াছিল, দূর হইতে তাহাদের জাতীয় চিহ্নসংফুক্ত পতাকা দেখিয়া তাহারা ঐ আগন্তুক দলে ক্রমে ক্রমে মিশিতে লাগিল। দলের অধিনায়ক যেমনি রূপবান্, তেমনি বলবান্। পলায়িত সৈন্যগণের মুখে কি কথা শুনিয়া, তিনি চক্ষের পলকে সৈন্যগণসহ আমাদের সেনাপতি মহাশয়কে তাঁহার অশ্বারোহী সৈন্য দ্বারা ঘিরিয়া, শৃগাল-কুকুরের ন্যায় একে একে বিনাশ করিতে লাগিলেন। সেনাপতি মহাশয়ের সৈন্যগণ যেন মহামন্ত্রে মোহিত—যেন মায়াপ্রভাবে আত্মবিস্মৃত! শত্রুর তরবারি-তেজে তাহাদের প্রাণ যাইতেছে; দ্বিখণ্ডিত হইয়া তাহারা ভূতলে পড়িতেছে—এমন আশ্চর্য্য মোহ, কাহারও মুখে কথাটি নাই! কার যুদ্ধ কে করে? পলাইয়া যে, প্রাণরক্ষা করিবে, সে ক্ষমতা কাহারও দেখিলাম। মহারাজ! দেখিবার মধ্যে দেখিলাম—দামেস্ক-সৈন্যমধ্যে যাহারা জীবিত ছিল, হানিফার নাম করিয়া তাহারা ঐ মহাবীরের সম্মুখে সমুদয় অস্ত্র রাখিয়া নত শিরে দণ্ডায়মান। সেই দৃশ্য চক্ষু হইতে সরিতে না সরিতে আবার নূতন দৃশ্য!—কয়েকজন ভিন্ন দেশীয় সৈন্য আমাদের সেনাপতি মহাশয়কে বন্দী অবস্থায় সেই বীরকেশরীর সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল; এবং তিনি সেনাপতি বাহাদুরকে ঐ বন্ধনদশায় মদিনাভিমুখে লইয়া গেলেন।”

 এজিদ হাতের অস্ত্র ফেলিয়া বলিলেন, “সীমার বন্দী!”

 মারওয়ান ক্ষণকাল আধোবদনে থাকিয়া বলিল, “মহারাজ! আমি বারবার বলিতেছি, সময় অতি সঙ্কটপূর্ণ! চারিদিকে বিপদ! যে আগুন জুলিয়া উঠিল, ইহা নির্ব্বাপিত করিয়া রক্ষা পাওয়া সহজ নহে।”

 এজিদ বলিলেন, “জয়নাল! যাও, কয়েক দিনের জন্য জগতের মুখ দেখ! মারওয়ানের কথায় আরও কয়েক দিন বন্দীগৃহে বাস কর।”

 জয়নাল আবেদীন বলিলেন, “ঈশ্বর রক্ষা না করিলে তোমার কি সাধ্য? মারওয়ানেরই বা কি ক্ষমতা? আমি বলি—তুমি যাও। আজ হইতে তুমিও তোমার প্রাণের চিন্তা করিতে ভুলিও না! তোমার সময় অতি নিকট। আমি কিছু দিন জগতের মুখ দেখিব, কি তুমি কিছু দিন দেখিবে— ইহাতে নিশ্চয়তা কি?”

 এজিদ মহারোষে জয়নাল আবেদীনকে লক্ষ্য করিতে করিতে চলিয়া গেলেন। বন্দীগৃহে বন্দী আনীত হইলেন।

 জয়নাল আবেদীনের চির-বিরহে আর আমাদিগকে কাঁদিতে হইল না। ঈশ্বরের কি মহিমা!