বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/পঞ্চদশ প্রবাহ
পঞ্চদশ প্রবাহ
এই ত সেই মদিনার নিকটবর্ত্তী প্রান্তর। উভয় শিবিরের উচ্চ মঞ্চে রঞ্জিত মহানিশান উড়িতেছে, সমরাঙ্গণে সামরিক নিশান গগন ভেদ করিয়া বায়ুর সহিত ক্রীড়া করিতেছে—অস্ত্র অবিশ্রান্তে চলিতেছে, ‘মার্ মার্’ শব্দ হইতেছে। আজ ব্যুহ নাই, সৈন্যশ্রেণীর শ্রেণীভেদ নাই, অস্ত্রচালনার পারিপাট্য নাই, আত্মপর ভাবিয়া আঘাত নাই,—মরিতেছে, মারিতেছে, আহত হইয়া ভূতলে পড়িতেছে, হুহুঙ্কার বজ্রনাদে সমরাঙ্গণ কাঁপাইতেছে! আজ উভয় দলের সৈন্য-শোণিতে রণভূমি রঞ্জিত হইতেছে। জয়-পরাজয় কাহারও ভাগ্যে ঘটিতেছে না; কিন্তু অলীদ-সৈন্য অধিক পরিমাণে মারা পড়িতেছে। আজ মহাসংগ্রাম। উভয় দলে আজ বিষম সমর, দুর্ধর্ষ রণ। সৈন্যগণের চক্ষু ঊর্দ্ধে উঠিয়াছে, মুখাকৃতি অতি কদর্য্য বিকৃত ভাব ধারণ করিয়াছে— তাহারা রোষে, ক্রোধে যেন উন্মত্ত হইয়াছে;— তাহাদের মুখব্যাদনে জিহ্বা, তালু, কণ্ঠ, কণ্ঠনালী পর্য্যন্ত দৃষ্ট হইতেছে। অস্ত্রঘাতে যুদ্ধ-প্রবৃত্তির নিবৃত্তি হইবে না—মনের তৃপ্তি জন্মিবে না বলিয়াই যেন নখাঘাত ও দন্তাঘাতের জন্য তাহার ব্যাকুল রহিয়াছে। প্রান্তরময় সৈন্য, প্রান্তরময় যুদ্ধ। হানিফা আজ স্বয়ং সৈন্যগণের পৃষ্ঠপোষক ও রক্ষক, গাজী রহমান পরিচালক! মহাবীর অলীদও আজ মহাবিক্রম প্রকাশ করিতেছে। এক প্রভাত হইতে অন্য প্রভাত গত হইয়াছে, এখন সূর্য্যদেব মধ্য গগনে, —কোন পক্ষই পরাজয় স্বীকার করিতেছে না—যুদ্ধও ইতি হইতেছে না। অলীদের প্রতিজ্ঞা,—আজ হানিকার শিরশ্ছেদ করিয়া জগতে মহাকীর্ত্তি স্থাপন করিবে। হানিফারও চেষ্টা যে, আজ মদিনার পথ পরিস্কার না করিয়া ছাড়িবেন না—হয় অলীদ-হস্তে জীবন বিসর্জ্জন, না হয় সসৈন্যে মদিনায় প্রবেশ।
গাজী রহ্মান বলিলেন, “সৈন্যগণ মহাক্লান্ত হইয়াছে। কি করিবে? এত মারিয়াও যখন শেষ করিতে পারিতেছে না, তখন আর উপায় কি?”
মোহাম্মদ হানিফা অশ্ব-বল্গা ফিরাইয়া বলিলেন, “আজ উভয় দলেরই সৈন্য যে প্রকারে ক্ষয় হইতেছে, ইহাতে মহাবিপদের আশঙ্কা দেখিতেছি। এখন না নিবারণের উপায় আছে, না উপদেশের সময় আছে, না কথা বলিবার সময় আছে। অলীদের সমস্ত সৈন্য শেষ হইলেও অলীদ কখনই পরাভব স্বীকার করিবে না, আমরাও তাহাকে পরাস্ত না করিয়া ছাড়িব না।”
এই প্রকার কথা হইতেছে, এমন সময় অলীদ-দলে আনন্দের বাজনা বাজিয়া উঠিল। ওত্বে অলীদ তাহার নূতন সৈন্যদলের ব্যবহারের জন্য যে সাজ প্রস্তুত করিয়াছিল, ঠিক সেইরূপ সাজে সজ্জিত সেনাগণ মস্হাব কাক্কার সঙ্গে আসিতেছিল। দূর হইতে তাহাদিগকে দেখিয়া আপন সেনা মনে করিয়া অলীদ মনের আনন্দে বাজনা বাজাইতে আদেশ করিয়াছিল; গাজী রহ্মানের কর্ণে হঠাৎ ঐ বাজনার রোল মহা বিপদজনক ও বিষম বোধ হইতে লাগিল। কারণ, উভয় দলই প্রমত্ত, কেহই পরাজয় স্বীকার করে নাই; এ সময়ে সন্তোষের বাজনা কেন? গাজী রহ্মানের বিশাল চক্ষু মদিনা-প্রান্তরের চতুর্দ্দিকে ঘুরিতে লাগিল, চিন্তাস্রোত খরতর বেগে বহিতে লাগিল,—পূর্ব্বদিকে দৃষ্টি পড়িতেই শরীর রোমাঞ্চিত হইল। যুদ্ধ-জয়ের আশা, মদিনা-প্রবেশের আশা, তাঁহার অন্তর হইতে একেবারে সরিয়া গেল।
গাজী রহ্মান মোহাম্মদ হানিফাকে বলিলেন, “বাদশাহ্-নামদার। ঈশ্বরের অভিপ্রেত কার্য্যে বিপর্য্যয় ঘটাইতে মানুষের ক্ষমতা নাই। সৈন্যশ্রেণী যে প্রকারে চালনা করিয়াছিলাম, সৈন্যগণও যে বীর-বিক্রমে আক্রমণ করিয়াছিল, অতি অল্প সময় মধ্যে অলীদ বাধ্য হইয়া পরাভব স্বীকারে মদিনার পথ ছাড়িয়া দিত; আর সে যদি পথ না ছাড়িত, গাজী রহ্মানের হস্তে নিশ্চয়ই আজ বন্দী হইত। কিন্তু কি করি? ঐ দেখুন, উহারা যখন আমাদের পশ্চাদ্দিক হইতে আসিতেছে, তখন আর রক্ষার উপায় নাই। সম্মুখে, পশ্চাতে —উভয় দিকেই শত্রুসেনা, আর নিষ্কৃতি কোথা? নিশ্চয় আমরা বন্দী। আজ সৈন্যসহ আমরা নিশ্চয়ই বন্দী!!” মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “বহু অশ্বারোহী সৈন্য বটে, পদাতিক সৈন্যও আছে। উহারা যেরূপ বীরদর্পে আসিতেছে, শত্রু-সেনা হইলে মহা বিপদ,—তাহাতে আর সন্দেহ নাই। কিন্তু সন্দেহ অনেক!—বাজনাই কি নিশ্চয়তার একমাত্র প্রমাণ? অথবা ওত্বে অলীদ কি এমনই অবোধ যে, না জানিয়া,— আপন-পর না ভাবিয়া আনন্দবাজনা বাজাইতেছে?—ইহারা কি নিশ্চয় দামেস্কের সৈন্য?”
আগন্তুক সৈন্যদল ক্রমেই নিকটে আসিতে লাগিল। অলীদের মনে ধ্রুব বিশ্বাস যে, দামেস্ক হইতে মারওয়ান তাহার সাহায্যে আসিতেছে।
অলীদ সদর্পে বলিতে লাগিল, “বন্দী। বন্দী!! মোহাম্মদ হানিফা আজ সৈন্যসহ নিশ্চয়ই বন্দী! আর কি সন্দেহ আছে? আমারই নির্ব্বাচিত চিহ্ন-সংযুক্ত নূতন সাজ! উহারা দামেস্কের সৈন্য না হইয়া যায় না। বাজাও ভঙ্কা। বাজাও ভেরী! কিসের ভয়? সহস্র হানিফা আসিলেও আজ তাদের অলীদ-হস্তে নিশ্চিত পরাজয়—সম্মুখে অস্ত্র, পশ্চাতে অস্ত্র, ইহাতে কি আর রক্ষা আছে? কার সাধ্য? জগতে এমন কোন বীর নাই যে, সম্মুখ পশ্চাৎ উভয় দিক রক্ষা করিয়া সমানভাবে শত্রু সম্মুখীন হইতে পারে।”
মনের উল্লাসে অলীদ উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল,—“মোহাম্মদ হানিফা, তুমি কোথায়? তোমার চক্ষু কোন্ দিকে? তুমি কায়মনে যে ঈশ্বরে নির্ভর করিয়া যুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছ, সেই ঈশ্বরের দোহাই,—একবার পশ্চাৎ দিকে চাহিয়া দেখ। এখনও অলীদের সম্মুখে অস্ত্র রাখিলে না—এখনও যুদ্ধে বিরত হইলে না? একবার পশ্চাতে চাহিয়া দেখ, তোমার জীবন-প্রদীপ এখনই নির্ব্বাপিত হইবে। তোমার বুদ্ধিমান মন্ত্রী গাজী রহ্মানের জীবন এখনই শেষ হইবে। সম্মুখে অলীদ, পশ্চাতে মারওয়ান, এখনও যুদ্ধ? রাখ তরবারী—কর পরজয় স্বীকার—মঙ্গল হইবে!—ক্ষান্ত হও,—ক্ষান্ত হও; আত্মসমর্পণের এই-ই উপযুক্ত সময়। বীরের মান বীরই রক্ষা করিয়া থাকে। আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোমাদের সকলের পরমায়ু শেষ হইয়াছে, আর অধিক বিলম্ব নাই। আবার বলি, পশ্চাতে চাহিয়া দেখ,—মহারাজ এজিদের কারুকার্য্যখচিত উড্ডীয়মান নিশানের প্রতি চাহিয়া দেখ।” গাজী রহ্মান এ পর্য্যন্ত নিশানের প্রতি লক্ষ্য করেন নাই। অলীদের কথায় নিশানের প্রতি চাহিয়াই ঈশ্বরকে শত শত ধন্যবাদ দিলেন। এদিকে অলীদও ভয়ে বিহ্বলপ্রায় হইয়া অশ্ব ছুটাইয়া শিবিরাভিমুখে চলিয়া গেল।
মোহাম্মদ হানিফা গাজী রহমানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহার কারণ কি? নিশান দেখিয়া অলীদের মুখ ভারী হইল কেন? ওরূপ দ্রুতবেগে সে হঠাৎ শিবিরেই বা চলিয়া গেল কেন?”
“বাদশাহ্-নামদার! অলীদের বাজনার ধূমে আমি আমার চিন্তাকে ভ্রমপূর্ণ বিপথে চালনা করিয়াছিলাম। অনিশ্চয়তা, সন্দেহ, অনুমান প্রভৃতির উপর নির্ভর করিয়া যে কার্য্য করে, তাহাকে বাতুল ভিন্ন আর কি বলিব? আরও অধিক আশ্চর্য্য যে, একজন সেনাপতি এইরূপ করিয়াছেন। অলীদ যে কি প্রকৃতির সেনাপতি, তাহা আমি এখনও বুঝিতে পারি না। কি গুণে এত অধিক সৈন্যের অধিনায়ক হইয়া সে প্রকাশ্য যুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছে, তাহা এখনও বুঝিতে পারিতেছি না। অলীদের প্রতি আমার কিছুই ভক্তি নাই। আমি আরও আশ্চর্য্যান্বিত হইতেছি যে, ইহারা কি প্রকারে মহাবীর হাসান-হোসেনের সহিত যুদ্ধ করিয়াছে! একটু অপেক্ষা করুন, সকলি দেখিতে পাইবেন।”
“আমারও সন্দেহ হইতেছে। ঐ সকল চিহ্নিত পতাকা কখনই এজিদের নহে।”
“বাদশাহ্-নামদার! অলীদ আমাকে ভ্রম-কূপে ডুবাইয়াছে, এখন আর কিছুই বলিব না—সকলই ঈশ্বরের মহিমা।”
এদিকে রণপ্রাঙ্গণে অলীদ-পক্ষীয় সৈন্য তিষ্ঠিতে পারিতেছে না, বাত্যাহত কদলী বৃক্ষের ন্যায় ভূমিসাৎ হইতেছে। পূর্ব্বে একদল হত হইলেই যে অন্য দল আসিয়া শূন্য স্থান পূর্ণ করিতেছিল, এখন তাহা আর হইতেছে না। যাহারা সমরে লিপ্ত ছিল, তাহারা ক্রমেই ক্ষয় পাইতে লাগিল।
সন্দেহ দূর হইল। মোহাম্মদ হানিফার সৈন্যগণ জাতীয় পতাকা স্পষ্টভাবে দেখিয়া সজোরে ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিয়া প্রান্তরের সহিত রণস্থলও কাঁপাইয়া তুলিল। দেখিতে দেখিতে মস্হাব কাক্কা সৈন্যসহ আসিয়া হানিফার সহিত যোগ দিলেন। মস্হাব কাক্কা হানিফার পদচুম্বন করিয়া বলিলেন— “বিলম্বের কারণ পরে সবলিব, এখন কি আজ্ঞা?”
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “ভাই! পরে শুনিব,—কথা পরে শুনিব, এখন ধর তরবারি—মার কাফের, তাড়াও অলীদ। মনের কথা কহিতে, দুঃখের কান্না কাঁদিতে, অনেক সময় পাইবে। সে সকল কথা মনেই গাঁথা আছে। এখন প্রথম কার্য্য,—মদিনায় প্রবেশ। তোমার তরবারি এদিকে চলিতে থাকুক, আমি অন্য দিকে চলিলাম।”
হানিফা অসি উঠাইলেন। মস্হাব কাক্কাও ঈশ্বরের নাম করিয়া শত্রুনিপাতে অসি নিষ্কোষিত করিলেন। উভয়ের সম্মিলনে এক অপূর্ব্ব নব ভাবের আবির্ভাব হইল। উভয় দলের বাজনা একত্রে বাজিতে লাগিল, উভয় দলের সৈন্য মিলিয়া এক হইয়া চলিল,—অলীদের মনেও নানারূপ চিন্তার লহরী খেলিতে লাগিল। মোহাম্মদ হানিফার বিরুদ্ধেই জয়ের আশা ছিল না, তাহার পর তত্তুল্য আর একটি বীর হঠাৎ উপস্থিত হইল—অস্ত্রও ধারণ করিল—“আর রক্ষা নাই। কিছুতেই আর রক্ষা নাই!!”
অলীদ মহা সঙ্কটে পড়িল, কি করিবে কিছুই স্থির করিতে পারিতেছে না। অনেকক্ষণ চিন্তার পর সে মনে মনে সাব্যস্ত করিল: ভাগ্যে যাহা থাকে হইবে, সহসা মস্হাব কাক্কার সম্মুখে যুদ্ধে যাইব না। দেখি, মস্হাব কাক্কা কি করে।
অলীদ গুপ্তস্থানে বসিয়া দেখিতে লাগিল যে, হানিফা দক্ষিণ পার্শ্বে যাইয়া মদিনার গমন-পথ পরিষ্কার করিতেছেন; মস হাব কাক্কা বাম পার্শ্বে (তাহারই দিকে) অস্ত্রচালনা করিয়া অগ্রসর হইতেছেন, আর বারবার ‘অলীদ’ নাম উচ্চারণ করিয়া তাহাকে যুদ্ধে আহ্বান করিতেছেন এবং বলিতেছেন, “অলীদ! শীঘ্র বাহির হও,—শিবির হইতে শীঘ্র বাহির হও। তোমার বীরত্ব দেখিতেই আজ ক্লান্ত, পথশ্রান্ত শরীরেই অস্ত্র ধরিয়াছি—আইস, আর বিলম্ব কি অলীদ? অলীদ! আইস, আজ তোমাকে দেখিব। ঈশ্বরের দোহাই, তোমাকে আজ ভাল করিয়া দেখিব। তোমার বল, বিক্রম, সাহস সবই দেখিব। যদি সময় পাই, তবে তোমার তরবারির তেজ, বর্শার ধার, তীরের লক্ষ্য, খঞ্জরের হাত, গদার আঘাত,—সকলই দেখিব। ভয় কি? শত্রু যুদ্ধপ্রার্থী,—তুমি শিবিরে? ছিঃ ছিঃ! বড় ঘৃণার কথা। ছিঃ ছিঃ। অলীদ! তুমি না সেনাপতি?—এজিদের বিশ্বাসী সেনাপতি?
মস্হাব কাক্কা অলীদকে ধিক্কার দিয়া, তাহার উপর ঘৃণা জন্মাইয়া তাহাকে যুদ্ধে আহ্বান করিতেছেন; কিন্তু অলীদ গুপ্তভাবে থাকিয়া কি দেখিতেছে, কি চিন্তা করিতেছে, তাহা সেই-ই জানে। তাহার সৈন্যগণের হাবভাবে তাহাকে আরও ব্যতিব্যস্ত হইতে হইল; চতুর্দ্দিকে ভীষণ বিভীষিকাময় মুর্ত্তি সে দেখিতে লাগিল। যুদ্ধে পরাস্ত হইতে হইবে, মদিনার পথ ছাড়িয়া দিতে হইবে, এখনই ছাড়িয়া দিতে হইবে,—না হয় বন্দীভাবে হানিফার পদানত হইতে হইবে, ইহাতে দুঃখ নাই,অপমানের কথা নাই। কিন্তু আপন সৈন্য দ্বারা অপমানিত হওয়া বড়ই ঘৃণার কথা এবং লজ্জার কারণ মনে করিয়া, অলীদ বাধ্য হইয়া সশস্ত্র মস্হাব কাক্কার সম্মুখীন হইল।
মস্হাব কাক্কা বলিলেন, “অলীদ! শত্রুসম্মুখে আসিতে, যুদ্ধার্থে রণক্ষেত্রে পদবিক্ষেপ করিতে, তোমার আমার কি এত বিলম্ব শোভা পায়? যাহা হউক, আইস, অগ্রে তোমার বাহুবল পরীক্ষা করি। আমি তোমাকে অস্ত্রাঘাতে মারিব না—নিশ্চয় বলিতেছি, তোমার প্রতি মস্হাব কাক্কা কখনই অস্ত্র নিক্ষেপ করিবে না।”
অলীদ চক্ষু দুইটি পাকাইয়া বলিল, “মহাবীরের দর্প দেখ, অস্ত্রাঘাতে মারিবেন না, কথার আঘাতে মারিবেন।”
“আরে পামর! কথা রাখ, অস্ত্র ধর।”
“মস্হাব? তুমি এইমাত্র আসিয়াছ—এখনই যুদ্ধ? কে না বলিবে—যে দেখিবে সেই-ই বলিবে, যে শুনিবে সেই-ই বলিবে যে, মস হাব দুর্গম পথশ্রান্তিতে কাতর ছিল, ক্ষণকালও বিশ্রাম করে নাই, যেমনই দেখা অমনই যুদ্ধ—কাজেই পরাস্ত। তাই আমার বিলম্বের কারণ। কিন্তু তুমি তাহা বুঝিলে না— তোমার মঙ্গলের জন্যই আমি এতক্ষণ আসি নাই।”
মস্হাব কাক্কা রোষে অধীর হইয়া সিংহনাদে অলীদের দুই হস্ত নিজের দুই হস্তে ধরিয়া সজোরে তাহার অশ্বকে পদাঘাত করিলেন, অশ্ব বহু দূরে ছিট্কাইয়া পড়িল। অলীদ কাক্কার হস্তে রহিয়া গেল। মস্হাব অলীদকে লইয়া এক লম্ফে অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া মৃত্তিকায় দণ্ডায়মান হইলেন। বীর অলীদ যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও কাক্কার হস্ত হইতে হস্ত ছাড়াইতে পারিল না।
মস্হাব বলিলেন, “এই ত প্রথম পরীক্ষা; দ্বিতীয় পরীক্ষাও দেখ্।”
এই কথা বলিয়াই অলীদকে শূন্যে উঠাইয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, “দেখ কাফের দেখ্, কাহার কথা সত্য,—আমি কথার আঘাতে পারি, কি আছাড় মারিয়া মারিতে পারি?” চতুর্দ্দিক হইতে তখন মহাগোলযােগ হইয়া উঠিল। সৈন্যাধক্ষের প্রাণ যায়, দামেস্করাজ এজিদের সেনাপতি শূন্যে চক্রাকারে ঘুরিতে ঘুরিতে প্রাণ হারায়—বড়ই লজ্জার কথা! অলীদ-সৈন্য় মস্হাবের দিকে ‘মার্ মার্’ শব্দে মহারােষে অসি নিষ্কোষিত করিয়া আসিতে লাগিল। এদিকে মােহাম্মদ হানিফা ঐ গােলযােগের কারণ জানিতে আসিয়া দেখিলেন: অলীদ কাক্কার হস্তে উত্তোলিত হইয়া চক্রাকারে ঘুরিতেছে, তাহার আর রক্ষা নাই।
মােহাম্মদ হানিফা উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভাই মস্হাব, আমার কথা রাখ। ভাই, আমার দিকে একবার চাহিয়া দেখ, কথা রাখ। ভাই, ক্ষান্ত হও, অলীদকে প্রাণে মারিও না। মারিও না!! আমি বারণ করিতেছি, উহাকে প্রাণে মারিও না।”
মস্হাব বলিলেন, “আপনার আজ্ঞা শিরােধার্য্য; কিন্তু আমি ইহাকে একটি আছাড় না মারিয়া ছাড়িব না,—তাহাতেই যদি উহার প্রাণ দেহপিঞ্জরে আর না থাকে, কি করিব? উহার প্রতি আমি অস্ত্রের আঘাত করিব না, এ কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। এজিদের সেনাপতির বীরত্ব দেখুন, বাহুবল দেখুন!”
এই কথা বলিয়াই মস্হাব কাক্কা অলীদকে সজোরে বহুদূর শূন্য হইতে মাটিতে ফেলিয়া দিলেন। অলীদ চতুর্দ্দিকে অন্ধকার দেখিতে দেখিতে বিংশতি হস্ত ব্যবধানে ছুটিয়া ছিট্কাইয়া পড়িল। সে ক্ষণকাল অচেতন হইয়া জগৎ অন্ধকার দেখিল। একটু চমক ভাঙ্গিলেই দক্ষিণে, বামে, পশ্চাতে চাহিয়াই উঠিতে উঠিতে পড়িতে পড়িতে রণ-প্রাঙ্গণ হইতে সভয়ে ফিরিয়া চাহিতে চাহিতে অলীদ শিবিরাভিমুখে মহাবেগে প্রস্থান করিল। সে এখন কাক্কার হস্ত হইতে প্রাণ বাঁচাইবার উপায় খুঁজিতে লাগিল। আর কি করিবে? শেষ পন্থা—পলায়ন।
মস্হাব কাক্কা বীরদর্পে বলিতে লাগিলেন, “আয় রে কাফেরগণ! আয়, মদিনার পথে বাধা দিতে আয়। এই মস হাব চলিল।”
মস্হাব সমুদয় সৈন্য লইয়া অলীদ-শিবির পশ্চাতে রাখিয়া যাইতে লাগিলেন। কার সাধ্য মস্হাবকে বাধা দেয়? কে সেই বীরকেশরীর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়ায়?
গাজী রহ্মান বলিলেন, “আজ মদিনায় প্রবেশ করিব না, এই যুদ্ধক্ষেত্রের প্রান্তঃসীমাতেই থাকিব। সৈন্যগণ মহাক্লান্ত হইয়াছে। আরও কথা আছে, মদিনা প্রবেশের পূর্ব্বে আমাদের কতক সৈন্য নগরের বহির্ভাগে, নগর-প্রবেশদ্বারে সর্ব্বদা সজ্জিভাবে অবস্থিতি করিবে। দামেস্কের মন্ত্রী, সৈন্যাধ্যক্ষ, কাহাকেও বিশ্বাস করিতে নাই। ছল, চাতুরি, অধর্ম্ম, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা তাহাদের আয়ত্তাধীন— জাতিগত স্বভাব।”
মস্হাব কাক্কা সম্মত হইলেন, মোহাম্মদ হানিফাও গাজি রহ্মানের কথা গ্রাহ্য করিলেন। সৈন্যগণ অলীদের শিবির লুটপাট করিয়া, খাদ্যসামগ্রী অস্ত্র-শস্ত্র যাহা পাইল লইয়া, ‘জয় জয়’ রবে প্রান্তর কাঁপাইয়া বীরনাদে পদবিক্ষেপ করিতে করিতে চলিল।
মস্হাব কাক্কা মোহাম্মদ হানিফাকে বলিলেন, “হজরত! আর একটি কথা। তুরস্ক ও তোগান রাজ্যের ভূপতিদ্বয় আমার সঙ্গে আছেন, তাঁহারা পথে সীমার-হস্তে যেরূপ বিধ্বস্ত, বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ পরে বলিব। এক্ষণে একটি শুভ-সংবাদ অগ্রে না দিয়া আমি কি থাকিতে পারিতেছি না। সেই পাপাত্মা সীমারকে আমি বন্দী করিয়া আনিয়াছি।”
হানিফার মনের আগুন জ্বলিয়া উঠিল—নির্ব্বাপিত আগুন দ্বিগুণ বেগে জ্বলিয়া উঠিল— কারবালার কথা মনে পড়ল। হুহু শব্দে তিনি কাঁদিয়া উঠিলেন, মস্হাব অপ্রতিভ হইলেন। কিছুক্ষণ পরে হানিফা মস্হাবের হস্ত ধরিয়া বলিলেন, “ভ্রাতঃ! তুমি আমার মাথার মণি, হৃদয়ের বন্ধু, প্রাণের ভাই। আইস। তোমাকে একবার আলিঙ্গন করি। তুমি সীমারকে বন্দী করিয়াছ—তোমার এ গৌরব-কীর্ত্তি অক্ষরূপে জগতে চিরকাল সমভাবে থাকিবে— তুমি বিনামূল্যে আজ হানিফাকে ক্রয় করিলে। ভ্রাতঃ! আর আমার গমনে সাধ্য নাই। সীমারের নাম শুনিয়া আমি অধীর হইয়াছি। আরবের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মহাবীর ভ্রাতৃবরের শিরশ্ছেদ-বিবরণ শ্রবণ অবধি, সীমারকে একবার দেখিব বলিয়া মনে করিয়াছি। দেখিব তাহার দক্ষিণ হস্তে কত বল, সে খঞ্জর ধরিতে কেমন পটু! তাহাকে কয়েকটি কথা মাত্র জিজ্ঞাসা করিব। ইহা ছাড়া সীমারে আর আমার কোন সাধ নাই। সীমার সম্বন্ধে তুমি যাহা করিবে আমি তাহার সঙ্গী আছি। আর বেশী দূর যাইব না, আজ এইখানেই বিশ্রাম।