বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/ত্রয়োবিংশ প্রবাহ
ত্রয়োবিংশ প্রবাহ
প্রভাত হইল। পাখীরা ঈশ-গান গাহিতে গাহিতে জগৎ জাগাইয়া তুলিল। অরুণোদয়ের সহিত যুদ্ধ-নিশান দামেস্ক-প্রান্তরে উড়িতে লাগিল। যে মস্তক জয়নাবের কর্ণাভরণের দোলায় দুলিয়াছিল, ঘুরিয়াছিল (এখনও দুলিতেছে, ঘুরিতেছে), আজ সেই মস্তক হানিফার অস্ত্রচালনার কথা মনে করিয়া মহাবিপাকে বিষম পাকে ঘুরিতে লাগিল। সঙ্গে সঙ্গে মারওয়ান, অলীদ, জেয়াদ ও ওমরের মস্তক পরিশুষ্ক—সৈন্যগণের হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার—না জানি আবার কি ঘটে।
উভয় পক্ষই প্রস্তুত। হানিফার বৈমাত্রেয় এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা ওমর আলী করজোড়ে হানিফার নিকট বলিলেন,—“আর্য্য! আজিকার যুদ্ধভার দাসের প্রতি অর্পিত হউক।”
হানিফা সস্নেহে বলিলেন,—“ভ্রাতঃ। গতকল্য যে উদ্দেশ্যে তরবারি ধরিয়াছিলাম, যে আশায় দুল্দুল্কে কশাঘাত করিয়াছিলাম, তাহা আমার সফল হয় নাই। বিপক্ষদল আমাকে বড়ই অপ্রস্তুত করিয়াছে। আমি মনে করিয়াছিলাম, যুদ্ধ শেষ না করিয়া আর তরবারি কোষে আবদ্ধ করিব না,—শিবির হইতে যে বাহির হইয়াছি, আর শিবিরে যাইব না, আজ প্রথম—আজই শেষ। শুনিয়াছি, বিশেষ সন্ধানে জানয়াছি—এজিদ স্বয়ং যুদ্ধে আসিয়াছে। যুদ্ধ-সময়েই হউক, কি যুদ্ধ-শেষেই হউক, অবশ্যই এজিদকে হাতে পাইতাম। আমার চক্ষে পড়িলে তাহার জীবন কালই শেষ হইত। এজিদ হোসেনের মস্তক কারবালা হইতে দামেস্কে আনাইয়াছিল। আমি তাহার মস্তক হস্তে করিয়া দামেস্কবাসীদিগকে দেখাইতে দেখাইতে বন্দীগৃহে যাইয়া জয়নালের সম্মুখে ধরিতাম, কিন্তু আমার মনের আশা মনেই রহিল। কি করি, বাধ্য হইয়া গত কল্য যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়াছি। আজ তুমি যাইবে,—যাও ভাই! তোমাকে ঈশ্বরে সঁপিলাম। দয়াময়ের নাম করিয়া, নূরনবী মোহাম্মদের নাম করিয়া, ভক্তিভাবে পিতার চরণোদ্দেশে নমস্কার করিয়া তরবারি হস্তে কর। শত সহস্র বিধর্ম্মী বধ করিয়া জয়নাল-উদ্ধারের উপায় কর। তোমার তরবাবির তীক্ষ্ণধার আজ শত্রু শোণিতে রঞ্জিত হউক, এই আশীর্ব্বাদ করি। কিন্তু ভাই, এজিদের প্রতি অস্ত্রনিক্ষেপ করিও না। ক্রোধ বশতঃ ভ্রাতৃ-আজ্ঞা উপেক্ষা করিয়া মহাপাপকূপে ডুবিও না; সাবধান, আমার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিও না।”
ওমর আলী ভ্রাতৃ-উপদেশ শিরোধার্য্য করিয়া ভক্তিভাবে ভ্রাতৃপদ চুম্বন করিয়া হানিফার উপদেশ মত তরবারি হস্তে করিলেন। রণবাদ্য বাজিয়া উঠিল। সৈন্যগণ সমস্বরে ঈশ্বরের নাম ঘোষণা করিয়া ওমর আলীর জয় ঘোষণা করিল।
মহাবীর ওমর আলী পুনরায় ঈশ্বরের নাম করিয়া অশ্বারোহণ করিলেন। বিদ্যুৎবেগে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইতেই এজিদ পক্ষীয় বীর সোহ্রাব-জঙ্গ অশ্ব-দাপটের সহিত অসিচালনা করিতে করিতে উপস্থিত হইল। স্থিরভাবে ক্ষণকাল ওমর আলীর আপাদমস্তক লক্ষ্য করিয়া সে বলিল,—“তোমার নাম কি মোহাম্মদ হানিফা?”
ওমর আলী বলিলেন,—“সে কথায় তোমার কাজ কি? তোমার কাজ তুমি কর।”
“কাহার সঙ্গে যুদ্ধ করিব? সিংহ কি কখনও শৃগালের সহিত যুঝিয়া থাকে? শুনিয়াছি মোহাম্মদ হানিফা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বীর। তুমি কি সেই হানিফা?”
“আমার সহিত যুদ্ধ করিতে তোমার হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হইয়া থাকে, ফিরিয়া যাও।”
সোহ্রাব হাসিয়া বলিল,—“এত দিন পরে আজ নূতন কথা শুনিলাম। সোহ্রাব-জঙ্গের হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার! তুমি যদি মোহাম্মদ হানিফা হও, বীরত্বের সহিত পরিচয় দাও। পরিচয় দিতে ভয় হয়, তুমিই ফিরিয়া যাও।”
“আমি ফিরিয়া যাইব?”
“তবে কি তুমি যথার্থই মোহাম্মদ হানিফা?”
“এত পরিচয়ের আবশ্যক কি? তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি: তুমি কি পাপাত্মা এজিদ?”
“সাবধান। দামেস্ক-অধিপতির অবমাননা করিও না।”
“আমি তোমার সঙ্গে কথা কহিতে ইচ্ছা করি না, তোমার তরবারির ক্ষমতা দেখিতে চাহি।”
“জানিলাম, তুমিই মোহাম্মদ হানিফা।”
“শোন্ কাফের। শোন্ নারকী! তুই তোর অস্ত্রের আঘাত ভিন্ন যদি পুনরায় কথা বলিস্, তবে তুই যে পাথর পুজিয়া থাকিস্, সেই পাথরের শপথ!
“আমি পাথর পূজা করি, তুই ত তাহাও করিস্ না? নিশ্চিন্তভাবে নিরাকারের উপাসনায় কি মনের তৃপ্তি হয়রে বর্ব্বর?”
“জাহান্নামী কাফের। আবার বাক্চাতুরী? তুই আমাদের জাতীয় নীতির বহির্ভূত বলিয়া কথা কহিতে সময় পাইতেছিস্?”
“আমি তোমার পরিচয় না পাইলে কখনও অপাত্রে অস্ত্রনিক্ষেপ করিব না। ভাল কথাই বলিতেছি,— তুমি যদি মোহাম্মদ হানিফা না হও তবে তোমার সঙ্গে আমার যুদ্ধ নাই—যুদ্ধ নাই। তুমি আমার পরম বন্ধু, প্রিয় সুহৃদ।”
“বিধর্ম্মীদিগের বাক্চাতুরীই এই প্রকার—প্রস্তর পূজকদিগের স্বভাবই এই।”
“ওরে বর্ব্বর। প্রস্তরে কি ঈশ্বরের মাহাত্ম্য নাই? দেখ,— দেখ্— লৌহতে কি আছে।” এই বলিয়া আঘাত—অমনি প্রতি-আঘাত!
সোহ্রাব বলিল,—“রে আম্বাজী! তুই-ই মোহাম্মদ হানিফা; কেন আমাকে বঞ্চনা করিতেছিস্? আমার আঘাত সহ্য করিবার লোক জগতে নাই। সোহ্রাবের অস্ত্র এক অঙ্গ দুইবার স্পর্শ করে না।”
এই কথাটা কেবল ওমর আলী শুনিলেন মাত্র। তারপর যদি কেহ দেখিয়া থাকেন, তবে তিনিই দেখিয়াছেন: সোহ্রাবের দেহ অশ্ব হইতে ভূতলে পড়িয়া গেল। কাহার আঘাত? আর কাহার,—ওমর আলীর!
সোহ্রাব-নিধন এজিদের সহ্য হইল না। মহাক্রোধে নিষ্কোষিত অসিহস্তে সমর-প্রাঙ্গণে আসিয়া তিনি বলিলেন,—তুই কে? আমার প্রাণের বন্ধু সোহ্রাবকে বিনাশ করিলি? বল্ত আম্বাজী, তুই কে?”
“আবার পবিচয়? বল্ত কাফের তুই কে?”
“আমি দামেস্কের অধিপতি। আরও বলিব? আমার নাম এজিদ।”
ওমর আলীর হৃদয় কাঁপিয়া গেল, ভয়শূন্য হৃদয়ে মহাভয়ের সঞ্চার হইল। ভ্রাতৃআজ্ঞা বারবার মনে পড়িতে লাগিল। প্রকাশ্যে তিনি বলিলেন:
“তুই কি যথার্থ ই এজিদ?”
“কেন, এজিদ নামে এত ভয় কেন?”
“সহস্র এজিদে আমার ভয় নাই, কিন্তু—”
“ও সকল ‘কিন্তু’ কিছুই নহে! ধর্ এজিদের আঘাত।”
“আমি প্রস্তুত আছি।”
এজিদ মহাক্রোধে তরবারি দ্বারা আঘাত করিলেন। ওমর আলী তাহা বর্ম্মে উড়াইয়া দিয়া বলিলেন—“তুই যদি যথার্থই এজিদ, তবে তোর আজ পরম সৌভাগ্য।”
“আমার সৌভাগ্য চিরকাল।”
“তা বটে—কি বলিব, ভ্রাতৃ-আজ্ঞা!”
এজিদ পুনরায় আঘাত করিলেন। ওমর আলী সে আঘাত উড়াইয়া দিয়া বলিলেন,—“আর কেন? তোমার বাহুবল, অস্ত্রবল সকলই দেখিলাম।”
এজিদ মহাক্রোধে পুনরায় আঘাত করিলেন। ওমর আলী সে আঘাতও অসিতে উড়াইলেন। ক্রমাগত এজিদের আঘাত ও ওমর আলীর আত্মরক্ষা!
এজিদ বলিলেন,—“ওহে তুমি যদি মোহাম্মদ হানিফা না হও, তবে যথার্থ বল তুমি কে?”
“এখন পরিচয়ের প্রয়োজন নাই। তোমার আর কি ক্ষমতা আছে দেখাও।”
“ক্ষমতা ত দেখাইব; কিন্তু দেখিবে কে? আমার একটু সন্দেহ হইতেছে, তাহাতেই বিলম্ব।”
“রণক্ষেত্রে সন্দেহ কি? হাতে অস্ত্র থাকিতে মুখে কথা কেন?”
“তোমার অস্ত্রে ধার আছে কিনা, দেখিলাম না। কিন্তু কথার ধারে গায়ে আগুন জ্বালিয়া দিয়ছি।”
“বাক্চাতুরী ছাড়, এখন আঘাত কর।”
এজিদ ক্রমে তরবারি, তীর, বর্শা, যাহা কিছু তাঁহার আয়ত্তে ছিল তাহার দ্বারা আঘাত করিলেন। কিন্তু ওমর আলী অচল পাষাণ প্রতিমাবৎ দণ্ডায়মান—এজিদ মহা লজ্জিত।
এজিদ বলিলেন, “আমার সন্দেহ ঘুচিল, তুমিই মোহাম্মদ হানিফা! হানিফা!! গতকল্য তোমার যুদ্ধ দেখিয়াছি, আজিও দেখিলাম। ধন্য তোমার বাহুবল! এত অস্ত্র নিক্ষেপ করিলাম, কিছুই করিতে পারিলাম! তোমার সহ্যগুণ—”
ওমর আলী হাসিয়া বলিলেন,—“এজিদ! তোমার আর কি ক্ষমতা আছে, দেখাও। অস্ত্র থাকিতে আজ আমি নিরস্ত্র, বল থাকিতে দুর্ব্বল। কি পরিতাপ! আমার হাতে পড়িয়াও আজ তুমি বাঁচিয়া গেলে।”
“ওরে পাষণ্ড! সাধ্য থাকিতে অসাধ্য কি? ভেকে কি কখনও অহিমস্তকে আঘাত করে। শৃগালের কি ক্ষমতা যে, শার্দ্দূলের গায়ে অঙ্গুলি স্পর্শ করিতে পারে? তুই যাহাই মনে করে থাকিস্, নিশ্চয় জানিস্, —আজ তোর জীবনের শেষ।”
“কথাটা মিথ্যা বোধ হইতেছে না। যাহা হউক, হয় অস্ত্রত্যাগ কর, না হয় পলাও।”
“আমি পলাইব? তোর জীবনের শেষ না করিয়া পলাইব?”
এজিদ পুনরায় তরবারি দ্বারা আঘাত করিলেন,—বৃথা হইল। পরিশেষে ফাঁস-হস্তে তিন চাবিবার ওমর আলীকে প্রদক্ষিণ করিয়া ওমর আলীর গলায় ফাঁস নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন, কিন্তু ফাঁসেতে আটকায় কৈ? ওমর আলী ভ্রাতার নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন যে, আজ তিনি এজিদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিবেন না। এজিদ এখন অস্ত্র ছাড়িয়া, মল্লযুদ্ধ আরম্ভ করিলেই ওমর আলীর মনের সাধ পূর্ণ হয়। তিনি সেই চিন্তায় আছেন, সময় খুঁজিতেছেন —কার্য্যেও তাহাই ঘটিল।
মোহাম্মদ হানিফা শিবিরে বসিয়া যুদ্ধের সংবাদ লইতেছেন মাত্র? এ পর্য্যন্ত কেহই পরাস্ত হয় নাই। এজিদ স্বয়ং যুদ্ধে আসিয়াছেন, আর হানিফ-বোধে ওমর আলীকে যথাসাধ্য আক্রমণ করিয়াছেন,—এ কথার তত্ত্ব কেহই সন্ধান করেন নাই, হানিফাও শুনিতে পান নাই। এজিদ স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে আসিবেন, ইহা কেহ মনেই করে নাই।
এজিদ নিশ্চয় জানিয়াছেন যে, ইনিই মোহাম্মদ হানিফা। উভয় ভ্রাতার আকৃতি প্রায় এক; তবে সামান্য একটু যে প্রভেদ, তাহা জগৎকার সৃষ্টির মহিমা ও কৌশল। এজিদ একদিন মাত্র দেখিয়া সে প্রভেদ বিশেষরূপে নির্ণয় করিতে পারেন নাই। তাহার উপর এ পর্যন্ত সে অস্ত্র নিক্ষেপ করিল না দেখিয়া এজিদ বিস্মিত হইলেন। মল্লযুদ্ধ করিয়া বাঁধিয়া ফেলিব—মল্লযুদ্ধে নিশ্চয়ই ধরিব—ইহাই এখন এজিদের মনের ভাব।
উভয়ের মনের আশাই উভয়ে সফল করিবেন। প্রকৃতি কাহার অনুকুল, তাহা কে বলিতে পারে। উভয় বীরই অস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন, মল্লযুদ্ধ আরম্ভ হইল। বীর-পদ-দলনে পদতলস্থ মৃত্তিকা স্বাভাবিক ছিদ্রে অঙ্গ মিশাইয়া ক্রমে সরিতে লাগিল।
মারওয়ান, আবদুল্লাহ্ জেয়াদ প্রভৃতি এই অলৌকিক যুদ্ধে এজিদকে লিপ্ত দেখিয়া মহাবেগে অশ্ব চালাইল। হানিফা-পক্ষীয় কয়েকজন যোদ্ধা ওমর আলীকে হঠাৎ মল্লযুদ্ধে রত দেখিয়া যুদ্ধস্থলে উপস্থিত হইলেন। এজিদ কতবার ওমর আলীকে ধরিতেছেন, কিন্তু ধরিয়া রাখিতে পারিতেছেন না! ওমর আলীও এজিদকে ধরিতেছেন, কিন্তু তাহাকে বশে আনিতে পারিতেছেন না!
মোহাম্মদ হানিফাপক্ষীয় বীরগণ এজিদকে চিনিয়া চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন এবং ওমর আলীর মল্লযুদ্ধের কারণ বুঝিলেন। এজিদের প্রতি কাহারও অস্ত্রনিক্ষেপ করিবার অনুমতি নাই। কাজেই ওমর আলীরও নিস্তার নাই। হায়! হায়!! একি কি হইল— মনে মনে এই আন্দোলন করিয়া মোহাম্মদ হানিফার নিকট এই কথা বলিতে কেহ কাহারও অপেক্ষা না করিয়া সকলেই শিবিরাভিমুখে ছুটিলেন।
এদিকে এজিদ মল্লযুদ্ধের প্যাঁচে ওমর আলীর গ্রীবা এবং উরু সাপটিয়া ধরিয়াছেন। ওমর আলী সে বন্ধন কাটাইয়া এজিদকে ধরিলেন। সেই সময় মারওয়ান, জেয়াদ প্রভৃতি সকলেই ত্রস্তে অশ্ব হইতে নামিয়া মহাবীর ওমর আলীকে ধরিলেন এবং ফাঁসের দ্বারা তাঁহার হস্ত, পদ, গ্রীবা বাঁধিয়া ‘জয় জয়’ রব করিতে করিতে আপন শিবিরাভিমুখে আসিতে লাগিল।
মোহাম্মদ হানিফা এজিদের সংবাদ পাইয়া সজ্জিত বেশে শিবির হইতে বহির্গত হইয়া দেখিলেন: সমরাঙ্গণে জন প্রাণী মাত্র নাই। এজিদের শিবিরের নিকট মহা কোলাহল—জয় জয় রব—তুমুল বাজনা! আর বৃথা সাজ—বৃথা গমন! ভ্রাতৃ-আজ্ঞা প্রতিপালন করিতে গিয়া আজ ওমর আলী বন্দী!
মোহাম্মদ হানিফা কি করিবেন, কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। অশ্ব হইতে অবতরণ করিয়া তিনি মহা চিন্তায় পড়িলেন।
বিপক্ষ দলে বাদ্যের তুফান উঠিল, দামেস্ক-প্রান্তর হর্ষে এবং বিষাদে কাঁপিয়া উঠিল। এজিদ-দলের প্রথম কথা—মোহাম্মদ হানিফা বন্দী; অবশেষে সাব্যস্ত হইল, মোহাম্মদ হানিফা নহে, এ তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা— নাম ওমর আলী। যাহা হউক, হানিফার দক্ষিণ হস্ত ভগ্ন, সিংহের এক অঙ্গ হীন—এজিদেরই জয়।
এজিদ আজ্ঞা করিলেন,—“আগামী কল্য যুদ্ধ বন্ধ থাকিবে; কারণ, ওমর আলীর প্রাণবধ। শত্রুকে যখন হাতে পাইয়াছি, তখন ছাড়িব না; নিশ্চয়ই তাহার প্রাণদণ্ড দিব। কিসে প্রাণদণ্ড? তরবারিতে নহে, অন্য কোন প্রকারে নহে—শূলে প্রাণদণ্ড। হানিফা দেখিবে, তাহার সৈন্য সামন্তও দেখিবে। প্রকাশ্য স্থানে শূলে ওমর আলীর প্রাণবিনাশ করিতে হইবে। এখনই ঘোষণা করিয়া দাও যে—হানিফার ভ্রাতা মহারাজ এজিদের হস্তে বন্দী, আগামী কল্য তাহার প্রাণবধ।”
মারওয়ান তখনই রাজ-আজ্ঞা প্রতিপালনে প্রস্তুত হইল। মুহূর্ত্তমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে ও নগরে ঘোষণা হইল: মোহাম্মদ হানিফার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ওমর আলী এজিদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছিল, রাজ-কৌশলে সে পাপী আজ বন্দী!—আগামী কল্য দামেস্ক-নগরের পূর্ব্ব প্রান্তরে সমরক্ষেত্রের নিকট শূলেতে চড়াইয়া তাহার প্রাণবধ হইবে।”
মোহাম্মদ হানিফার কর্ণেও এ নিদারুণ ঘোষণা প্রবেশ করিল। শিবিরস্থ সকলেই এই মর্ম্মভেদী ঘোষণায় মহা আকুল হইলেন। গাজী রহ্মানের বিশাল মস্তক ঘুরিয়া গেল, মস্তিষ্কের মজ্জা আলোড়িত হইয়া তড়িৎবেগে চালিত হইতে লাগিল।