বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/দ্বাবিংশ প্রবাহ
দ্বাবিংশ প্রবাহ
নিশার অবসান না হইতেই উভয় দলের রণবাদ্য বাজিতে লাগিল। এক পক্ষে হানিফার প্রাণবিনাশ, অপর পক্ষে এজিদের পরমায়ুর শেষ, দুই দলের এই দুই প্রকার আশা। দামেস্ক নগরবাসীরা কোন্ পক্ষের হিতৈষী, তাহা সহজে বুঝিবার সাধ্য নাই। কারণ, মােহাম্মদ হানিফার পক্ষে কেহ কোন কথা বলিলে, জয়নাল আবেদীনের জন্য কেহ দুঃখ করিলে, সে রাজদ্রোহী বলিয়া গণ্য হয়, কোতোয়ালের হস্তে তাহার প্রাণ যায়—তাই এ অবস্থায় সকলেই সন্তুষ্ট, সকলেই আনন্দিত। কেহ দূরে, কেহ অদূরে কেহ নগর-প্রাচীরে, কেহ কেহ উচ্চ বৃক্ষোপরি থাকিয়া উভয় দলের যুদ্ধ দেখিবার প্রয়াসী হইল। মােহাম্মদ হানিফার পক্ষ হইতে জনৈক আম্বাজী সৈন্য যুদ্ধার্থে রণ-প্রাঙ্গণে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী না পাঠাইয়া উপায় নাই। মারওয়ান বাধ্য হইয়া বল্লকীয়া নামে জনৈক বীরকে আম্বাজীর মস্তক শিবিরে আনিতে আদেশ করিল। যেই আজ্ঞা—অমনি গমন। সকলেই দেখিল, উভয় বীর অস্ত্রচালনায় প্রবৃত্ত হইয়াছে, অস্ত্রে অস্ত্রে সংঘর্ষণে সময়ে সময়ে চঞ্চলা চপলাবৎ অগ্নিরেখা দেখা দিতেছে। অনেকক্ষণ যুদ্ধের পর আম্বাজী বল্লকীয়া-হস্তে পরাস্ত হইলেন। বিপক্ষ পরাভর স্বীকার করিলেও বল্লকীয়া অস্ত্র নিক্ষেপে ক্ষান্ত হইল না।—সকলেই দেখিল, ইসলাম-শোণিতে দামেস্কের প্রান্তর প্রথমে রঞ্জিত হইল—এজিদের মন মহাহর্ষে নাচিয়া উঠিল।
বল্লকীয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, “আয়, কে যুদ্ধ করিবি, আয়! শুনিয়াছি, আম্বাজীরা বিখ্যাত বীর, আয় দেখি! বীরের তরবারির নিকটে কোন মহাবীর আসিবি আয়!”
আহ্বানের পূর্ব্বেই দ্বিতীয় আম্বাজী বল্লকীয়ার সহিত যুদ্ধ করিতে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু তাঁহাকে অধিকক্ষণ যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকিতে হইল না। উষ্ণীষের সহিত দ্বিতীয় আম্বাজী-শির ভূমিতে গড়াইয়া পড়িল। ক্রমে সপ্তজন আম্বাজী বল্লকীয়া-হস্তে শহীদ হইলেন।
এজিদ হর্ষোৎফুল্ল বদনে বলিতে লাগিলেন, “মারওয়ান! আজ কি দেখিতেছ? এই সকল সৈন্যই ত তোমাদিগকে পরাস্ত করিয়াছে, শৃগালকুক্কুরের ন্যায় তাড়াইয়া আনিয়াছে। তাহারাই ত ইহারা?”
“মহারাজ। ইহার কারণ কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না। আমাদের একটি সৈন্যহস্তে মোহাম্মদীয় সাত জন সৈন্য কোনও যুদ্ধক্ষেত্রেই যমপুরী দর্শন করে নাই। সকলই মহারাজের অনুগ্রহে আর দামেস্ক-প্রস্তরের পবিত্রতার গুণে সম্ভব হইল।
এজিদ-পক্ষে উৎসাহসূচক বাজনার দ্বিগুণ রোল উঠিয়াছে। বল্লকীয়ার সম্মুখে কেহই টিঁকিতেছে না! হানিফার সৈন্যশোণিতেই রণপ্রাঙ্গণ রঞ্জিত হইতেছে! এজিদ মহা সুখী!
গাজী রহ্মান মোহাম্মদ হানিফাকে বলিলেন, “বাদশাহ্-নামদার। এ প্রকারে যোদ্ধাগণকে শত্রু সম্মুখে পাঠান আর উচিত হইতেছে না। বুঝিলাম, দামেস্ক-রাজ্যের সৈন্যবল একেবারে সামান্য নহে।”
মস্হাব কাক্কা, ওমর আলী প্রভৃতি বল্লকীয়ার যুদ্ধ বিশেষ মনোযোগে দেখিতেছিলেন। এক বল্লকীয়া এতগুলি সৈন্য বিনাশ করিল দেখিয়া তাঁহারা সকলেই যুদ্ধে গমন করিতে প্রস্তুত হইলেন।
মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! আর সহ্য হইতেছে না, সমুদয় শরীরে আগুন জ্বালিয়া দিয়াছে। আর শিবিরে থাকিতে পারিলাম না। তোমরা আমার পশ্চাৎ রক্ষা করিবে। গাজী রহ্মান শিবিরের তত্ত্বাবধানে থাকিবে, সৈন্যদিগের শৃঙ্খলার প্রতি দৃষ্টি রাখিবে—আমি চলিলাম। আজ হানিফার অস্ত্র, আর এজিদের সৈন্য, এই দুইয়ে একত্র করিয়া দেখিব—বেশী বল কাহার।”
হানিফা ঐ কথা বলিয়াই অশ্বারোহণ করিলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যাইয়া বলিলেন, “বীরবর! তোমার বীরত্বে আমি সন্তুষ্ট হইয়াছি। কিন্তু তোমার জীবনের সকল সাধ মিটিল—ইহাই আক্ষেপ!”
বল্লকীয়া বলিল, “মহাশয়! আর একটি সাধের কথা বাকী রাখিলেন কেন?
“আর কি সাধ?”
“হানিফার মস্তকচ্ছেদন। দোহাই আপনার, আপনি ফিরিয়া যাউন। কেন আপনি আপনার সঙ্গী ভ্রাতৃগণের মত অসময়ে জগৎ ছাড়িবেন? আপনি ফিরিয়া যাউন। বল্লকীয়ার হস্তে রক্ষা নাই। আমি হানিফার শোণিতপিপাসু! আপনি ফিরিয়া যাউন!”
“তোমার সাধ মিটিবে। আমারই নাম মোহাম্মদ হানিফা।”
“সে কি কথা? এত সৈন্য থাকিতে মোহাম্মদ হানিফা সমরক্ষেত্রে? ইহা বিশ্বাস্য নহে। আচ্ছা, যদি তাই হয় তবে এই লও আঘাত।”
সে আঘাত কে দেখিল? পরে যাহা ঘটিল, তাহাতে এজিদের প্রাণে আঘাত লাগিল। বল্লকীয়ার শরীরের দক্ষিণভাগ দক্ষিণ হস্তসহ এক দিকে পড়িল—বাম ঊরু, বাম হস্ত, বাম চক্ষু, বাম কর্ণ লইয়া অপরার্দ্ধ ভাগ অন্য দিকে পড়িল।
এজিদ অলীদকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ওহে! বলিতে পার এ সৈন্যটির নাম কি?”
অলীদ মনোযোগের সহিত দেখিয়া বলিল, “মহারাজ! ইনিই মোহাম্মদ হানিফা।”
এজিদ চমকাইয়া উঠিলেন, কিন্তু সাহসে নির্ভর করিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “সৈন্যগণ। অসি নিস্কোষিত কর, বর্শা উত্তোলন কর, যদি দামেস্কের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে চাও, মহাবেগে হানিফাকে আক্রমণ কর। এমন সুযোগ আর হইবে না। তোমাদের বল-বিক্রমের ভালরূপ পরিচয় পাইলে হানিফা যুদ্ধক্ষেত্রে আর আসিবে না; নিশ্চয়ই পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিবে। যাও, শীঘ্র যাও, শীঘ্র হানিফার মস্তকচ্ছেদন করিয়া আন। তোমরাই আমার দক্ষিণ বাহু, তোমরাই আমার বল-বিক্রম, তোমরাই আমার সাহস, তোমরাই আমার প্রাণ। ঘোর বিক্রমে হানিফাকে আক্রমণ কর। হয় বন্ধন— নয় শিরশ্ছেদ,—এই দুইটি কার্য্যের একটি কার্য্য করিতে আজ জীবন-পণ কর। বীরগণ! বীরদর্পে চলিয়া যাও। তোমাদের পারিতোষিক আমার প্রাণ— মন—দেহ!—মণি, মুক্তা, হীরক ইত্যাদি ত তুচ্ছ কথা!”
সৈন্যগণ অসিহস্তে ‘মার্ মার্’ শব্দে সমরাঙ্গণে যাইয়া হানিফাকে আক্রমণ করিল। এজিদের চক্ষু হানিফার দিকে। এজিদের তরবারি ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুতের ন্যায় চাকচিক্য দেখাইয়া উর্দ্ধে, নিম্নে, বামে, দক্ষিণে ঘুরিল এবং লোহিত রেখায় তাহার পূর্ব্ব চাকচিক্য কিঞ্চিৎ মলিন ভাব ধারণ করিল। সম্মুখে একটি প্রাণীও নাই। চক্ষুর পলকে সৈন্যেরা যেন স্থির বায়ুর সহিত মিশিয়া অশ্বের সহিত অন্তর্হিত হইল।
মারওয়ান বলিল,—“বাদশাহ্-নামদার। দেখিলেন, অলীদ সহজে মদিনার পথ ছাড়িয়া দেয় নাই। এই যে হানিফার অস্ত্র চলিল, আমরা পরাজয় স্বীকার না করিলে এ অস্ত্র আর থামিবে না,— দিবা-রাত্রি সমানভাবে চলিবে,—হানিফার মন কিছুতেই টলিবে না—রক্তের স্রোত রহিয়া দামেস্ক-প্রান্তর ডুবিয়া গেলেও সে বিশাল হস্তের বল কমিবে না-হস্ত অবশ হইবে না,—তাহার তরবারির তেজ কমিবে না, ক্লান্ত হইয়া সে শিবিরেও ফিরিয়া যাইবে না।”
এজিদ রোষে জ্বলিতেছেন। পুনরায় তিনি পূর্ব্বপ্রেরিত সৈন্যের দ্বিগুণ সৈন্য হানিফা-বধে প্রেরণ করিলেন। সৈন্যগণ মহাবীরের সম্মুখে যাইয়া একত্র একযোগে নানাবিধ অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিল। যে যেরূপ অস্ত্র নিক্ষেপ করিল, ঈশ্বরের ইচ্ছায় হানিফা তাহাকে সেই অস্ত্রেই যমপুরী পাঠাইয়া দিলেন। এজিদের ক্রোধের সীমা রহিল না। পুনরায় তিনি চতুর্গুণ সেনা পাঠাইলেন। এইবার এজিদ হানিফাকে তরবারিহস্তে তাঁহার সৈন্যগণের নিকট যাইতে দেখিলেন মাত্র। পরক্ষণে দেখিলেন যে, প্রেরিত সৈন্যগণের অশ্বসকল দিগ্বিদিক ছুটিয়া বেড়াইতেছে, একটি অশ্বপৃষ্ঠেও আরোহী নাই।
এজিদ যুদ্ধক্ষেত্রে স্বয়ং যাইতে প্রস্তুত হইলেন। মারওয়ান করজোড়ে বলিলেন,—“মহারাজ! এমন কার্য্য করিবেন না, আজ মোহাম্মদ হানিফার সম্মুখে কখনই যাইবেন না। এখনও দামেস্কের অসংখ্য সৈন্য রহিয়াছে, আমরা জীবিত থাকিতে মহারাজকে হানিফার সম্মুখীন হইতে দিব না।”
এজিদ মারওয়ানের কথায় ক্ষান্ত হইলেন; সেদিন আর যুদ্ধ করিলেন না। সে দিনের মত শেষ বাজনা বাজাইয়া নিশান উড়াইয়া মারওয়ানসহ তিনি শিবিরে ফিরিলেন। মোহাম্মদ হানিফাও তরবারি কোষে আবদ্ধ করিয়া অশ্ববল্গা ফিরাইয়া শিবিরে গমন করিলেন।