বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/প্রথম প্রবাহ
অশ্ব ছুটিল। হোসেনের অশ্ব বিকট চীৎকার করিতে করিতে সীমারের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ, অলীদ প্রভৃতি অশ্ব লক্ষ করিয়া অবিশ্রান্ত শরনিক্ষেপ কহিতে লাগিল। সুতীক্ষ্ণ তীর অশ্ব-শরীর ভেদ করিয়া পার হইল না, কিন্তু শোণিতের ধারা ছুটিল। পশু-হৃদয়ে বেদনা নাই? কে বলে মানুষের জন্য পশুর প্রাণ কাদিয়া আকুল হয় না?—মানুষের ন্যায় পশুর প্রাণ ফাটিয়া যায় না?—বাহির হয় না। অশ্ব ফিরিল। কিছু দূর যাইয়া শরসংযুক্ত শরীরে হোসেনের দুল্দুল্[১] সীমারের পশ্চাদ্গমন হইতে ফিরিল।
তীর নিক্ষিপ্ত হইতেছে! এখন অশ্বের বক্ষে, গ্রীবাদেশে তীক্ষ্ণতর তীর ক্রমাগত বিধিতেছে; কিন্তু অশ্বের গতি মুহূর্তের জন্য থামিতেছে না! দুল্দুল্ মহাবেগে প্রভু হোসেনের শিরশূন্য-দেহ সন্নিধানে আসিয়া তাহার পদ হইতে স্কন্ধ, স্কন্ধ হইতে পদ পর্যন্ত নাসিকা দ্বারা ঘ্রাণ লইয়া আবার তাঁহার মস্তক লক্ষ্য করিয়া ছুটিবায় উদ্যোগ করিতেই বিপক্ষগণ নানা কৌশলে তাহাকে ধরিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। অর্শ্বশ্রেষ্ঠ দুল্দুল্ সকলই দেখিতেছে, বোধ হয়, অনেক কিছুই বুঝিতে পারিতেছে; ধরা পড়িলে তাহার পরিণাম-দশা যে কি হইবে, তাও বোধ হয় ভাবিতেছে। প্রভু হোসেন যে পৃষ্ঠে আরোহণ করিতেন, সেই পৃষ্ঠে প্রভু হন্তা কাফেরগণকে লইয়া আজীবন পাপের বোঝা বহন করিতে হইবে, এ কথা কি সেই প্রভুভক্ত বাকশক্তিহীন পশু-অন্তরে উদয় হইয়াছিল? সীমারের দিকে সে আর ছুটিল না, হোসেনের মৃত শরীরের নিকটেও আর রহিল না। বিপক্ষগণের বাধা, কৌশল অতিক্রম করিয়া মহাবেগে হোসেনের শিবিরাভিমুখে সে দৌড়াইয়া চলিল। সকলেই দেখিল, দুল্দুলের চক্ষু জলে পরিপূর্ণ। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ, মারওয়ান, ওমর এবং আর আর যোদ্ধাগণ দুল্দুলের পশ্চাৎ পশ্চাৎ হোসেন-শিবিরাভিমুখে বেগে ছুটিলেন। শিবিরমধ্যে বীর বলিতে আর কেহ নাই, একমাত্র জয়নাল আবেদীন! হোসেনের উপদেশক্রমে পরিজনের জয়নালকে বিশেষ সাবধানে গোপনভাবে রাখিয়াছেন। হাস্নেবানু কাসেম-দেহ বক্ষে ধারণ করিয়া শোকসন্তপ্ত হৃদয়ের জ্বলন্ত হতাশনে শোণিতের আহুতি দিতেছেন। সখিনা মৃত পতির পদপ্রান্তে ধূলায় লুটাইয়া অচেতনভাবে পড়িয়া রহিয়াছেন। যিনি যেখানে যে ভাবে ছিলেন, তিনি সেইখানেই সেই ভাবেই আছেন। কাহারও মুখে কোন কথাই নাই। নীরব! চতুর্দ্দিক নীরব। কিন্তু আকাশ পাতাল বায়ু ভেদ করিয়া যে একটি রব হইতেছে, বোধ হয়, শোকতাপ-পিপাসায় কাতরপ্রযুক্ত এতক্ষণ কেহই সে রব শুনিতে পান নাই। শাহ্রেবানুর মন, চক্ষু, কর্ণ, চিন্তা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভিন্ন ভিন্ন দিকে। সে রব তিনি শুনিলেন—তাঁহার অঙ্গ শিহরিয়া উঠিল। আবার তিনি শুনিলেন,—স্পষ্ট শুনিলেন,বন, উপবন, গগন, বায়ু, পর্ব্বত, প্রান্তর ভেদ করিয়া রব উঠিতেছে, “হায় হোসেন! হায় হোসেন!! হায় হোসেন!!!”
শাহ্রেবানুর মোহতন্দ্রা ভাঙ্গিয়া গেল, হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। তিনি মুখে বলিয়া উঠিলেন, “হায়! কি হইল? কি ঘটিল? কে বলিতেছে? চতুর্দ্দিক হইতে কেন রব হইতেছে? নাম উচ্চারণ কেন ‘হায় হায়’ করিতেছে? ‘হায় হায়’! কি নিদারুণ কথা! হায় রে। আবার সেই রব! আবার সেই অন্তরভেদী ‘হায় হায় রব!!”
“এ কি কথা! যে সকল পবিত্র বসন, পবিত্র অস্ত্র, তিনি পবিত্রভাবে ভক্তিসহকারে অঙ্গে ধারণ করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে কি কোন সন্দেহ হইতে পারে? ঐ যে অশ্বপদশব্দ! কে শিবিরাভিমুখে আসিতেছে। কাহার অশ্ব? হায় রে! এ কাহার অশ্ব? শহরেবানু শিবিরদ্বারদেশে যাইতেই রক্তমাখা শরীরে হোসেনের অশ্ব শিবিরে প্রবেশ করিল। “ভগ্নি! কপাল পুড়িয়াছে! আমাদের কপাল পুড়িয়াছে! দেখ, অশ্য দেখ, দুল্দুলের তীর-সংযুক্ত শরীর দেখ, রক্তের প্রবাহ দেখ!” বলিতে বলিতে শাহূরেবানু অচেতনভাবে পড়িয়া গেলেন। আর আর পরিজনের শূন্যপৃষ্ঠ দুল্দুলের সমস্ত শরীর রক্ত রঞ্জিত, আঘাতে জরজর এবং তাহার দেহ বিনির্গত শোণিতের ধারা দেখিয়া, মর্ম্মভেদী আর্ত্তনাদ—কেহ হতচেতন অবস্থায় বিকট চিৎকার করিয়া, অচেতনভাবে ধরাশায়ী হইলেন। দুল্দুল কাঁপিতে কাঁপিতে মাটিতে পড়িয়া গেল। হোসেনের প্রিয়তম অশ্বের প্রাণ বায়ুর সহিত মিশিয়া অনন্ত আকাশে চলিয়া গেল।
এদিকে মারওয়ান, ওমর, অলীদ, জেয়াদ প্রভৃতি যোদ্ধাগণ উগ্রমুর্ত্তিতেে বিকট শব্দে “কৈ জয়নাল? কোথায় সখিনা?” নাম উচ্চারণ করিতে করিতে শিবিরমধ্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু দক্ষিণে, বামে, সম্মুখে, কিঞ্চিৎ দূরে দৃষ্টি পড়িবামাত্র তাহাদের শরীর হঠাৎ শিহরিয়া উঠিল, বীরহৃদয় কম্পিত হইল;—সেই হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হইল!-কি মর্ম্মভেদী দৃশ্য!
বীরবর আবদুল ওহাবের খণ্ডিত দেহ, কাসেমের মৃত্যুশয্যা, হোসেনের অশ্ব, পতিপ্রাণ! সখিনার পতিভক্তির চিহ্ন দেখিয়া তাহারা স্তম্ভিত হইয়া দণ্ডায়মান রহিল! মন্ত্রি প্রবর মারওয়ান একদৃষ্টে সখিনার প্রতি অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত চাহিয়াও, সখিনা মৃত কি জীবিত কিছুই নির্ণয় করিতে পারিল না; কিঞ্চৎ অগ্রসর হইয়া দেখিলঃ সখিনা বিবি স্বামী-পদ দুখানি বক্ষোপরি স্থাপন করিয়া মনঃপ্রাণ যেন ঈশ্বরে ঢালিয়া দিয়া আত্মসমর্পণ করিয়াছেন! পতি-দেহ-বিনির্গত পবিত্র শোণিতে তাহার পবিত্র দেহ রঞ্জিত হইয়া অপূর্ব্ব এ শ্রী ধারণ করিয়াছে! মৃতদেহে চন্দন, আতর ও কপূর দিবার ব্যবস্থা শাস্ত্রে আছে। সখিনা অঙ্গে রক্তচন্দনে চর্চিত হইয়া জীবন্তভাবে যেন দয়াময়ের নিকট স্বামীর মঙ্গল-কামনায় আত্মবিসর্জ্জন করিয়া রহিয়াছেন।
মারওয়ান আরও একটু অগ্রসর হইল। সখিনাকে ধরিয়া তুলিতে আশা করিয়া সে হস্ত বিস্তার করিতেই যেন সখিনার মৃত শরীরে হঠাৎ জীবাত্মার সঞ্চার হইল। যেন স্বর্গীয় দূত জিব্রাইল মর্তে আসিয়া সখিনাকে কানে কানে বলিয়া গেলেন, “সখিনা! তুমি না সাধ্বী সতী? পরপুরুষ তোমার অঙ্গ স্পর্শ করিতে উদ্যত, এখনও স্বামী-চিন্তা? এখনও স্বামী-শোক? অবলার অবয়ব পরপুরুষের চক্ষে পড়িলে মহাপাপ! নিজে ইচ্ছা করিয়া তাহা দেখাইলে আরও পাপ! তুমি বীর-দুহিতা বীর-জায়া! ছিঃ, ছিঃ সখিনা! তোমারও এত ভ্রম! ছিঃ ছিঃ! সাবধান হও।”
সখিনা ত্রস্তভাবে উঠিয়া বসিলেন; সম্মুখে চাহিতেই দেখিলেনঃ অপরিচিত যোদ্ধাসকল চারিদিকে ছুটাছুটি করিতেছে, যে যাহা পাইতেছে, তাহাই লইতেছে। হঠাৎ দুল্দুলের প্রতি তাঁহার দৃষ্টি পড়িল। হজরত এমাম হোসেনের প্রিয় অশ্ব দুল্দুল মৃত্তিকায় শায়িত, তাহার সমুদয় অঙ্গ তীক্ষতর তীরে বিদ্ধ, তীরসকল অশ্বশরীর বিদ্ধ করিয়া কতক মৃত্তিকাসংলগ্ন, কতক শরীরোপরি পড়িয়া রহিয়াছে। প্রতি শরের মুখ হইতে শোণিতধারা ছুটিয়া,—শ্বেতঅশ্ন ঘোর লোহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে। সখিনা একদৃষ্টে অশ্বের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। পূর্ব্ব-কথা তাঁহার স্মরণ হইল। তাহার চক্ষু উর্দ্ধে উঠিল, মুখভাব ভিন্নভাব ধারণ করিল। সজোরে কাসেমের কটিদেশ হইতে খঞ্জর লইয়া তিনি মহারাষে বলিতে লাগিলেন,—
“ওরে কাফেরগণ! বুঝিয়াছি, কোন্ সাহসে শিবিরে আসিয়াছিস্? —কোন্ সাহসে অত্যাচার করিতে আসিয়াছিস? ওরে! আমরা অসহায়া হইয়াছি, সেই সাহসে!—ওরে! আমরা নিরাশ্রয়, সেই সাহসে! ওরে নরাধম! পুরুষ বীর আমাদের আর কেহই নাই, সেই সাহসে! ভুলিলাম! ভুলিলাম! এখন প্রাণসখা কাসেমকে ভুলিলাম! ভুলিলাম কাসেম! তোমায় এখন ভুলিলাম! নারী-জীবনের উদ্দেশ্য দেখাইতে তোমাকে এখন ভুলিলাম কাসেম! ঐ পিতার অশ্ব, তার সমুদয় অঙ্গ তীরবিদ্ধ, রক্তে রঞ্জিত,—সে মৃত্তিকায় শায়িত। আর কথা কি? আর আশা কি? এখন সখিনার আর আশা কি? কাসেম, চাহিয়া দেখ! প্রাণাধিক কাসেম! দেখ চাহিয়া, এই দেখ সখিনার হাতে তোমার খঞ্জর!!” মারওয়ানকে লক্ষ্য করিয়া সখিনা বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্মী কাফের! তুই এখানে কেন? দূর হ! সখিনার সম্মুখ হইতে দূর হ! তুই কি আশায় এখানে আসিয়াছিস্? দূর হ কাফের, দূর হ! এ পবিত্র শিবির হইতে দূর হ! ঐ দেখ্! যদি চক্ষু থাকে, তবে ঐ দেখ,! শূন্যে চাহিয়া দেখ,?—সাহানা বেশ! সেই নয়নমুগ্ধকারী সাহানা বেশ! লোহিত-রক্ত-রঞ্জিত সেই সাহানা বেশ! সেই সাহানা বেশ! শত্রু-অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত হইয়া সাহানা বেশ! ওরে নরাধম বর্ব্বর! চণ্ডালের অমৃতে আশা? শয়তানের বেহেশ্তে আশা? ঘোর নারকীর জেন্নাতে আশা? মহাপাতকীর হুরে আশা? দেখ্! এই দেখ্, কাসেম যার প্রাণ, সে এখন তারই নিকটে!—যেখানে কাসেম, সেইখানে সখিনা, রক্তমাখা সুতীক্ষ খঞ্জর—কাসেমের হস্তের খ—”এই বলিয়া সখিনা হস্তস্থিত খঞ্জর সুকোমল বক্ষে সজোরে বসাইয়া পৃষ্ঠ পার করিয়া দিলেন। হায় রে রুধির-ধারা! খঞ্জরের অগ্রভাগ বহিয়া বহিয়া শোণিতের ধারা ছুটিল। সখিনা কাসেমের মৃতদেহ পার্শ্বে অর্ধমুকুলিত ছিলতার ন্যায় ধরাশায়িনী হইলেন।[২]
মারওয়ান নিস্তব্ধ। অন্য অন্য যোদ্ধাগণ, যাহারা সখিনার—সাধ্বীসতী সখিনার কীর্ত্তি স্বচক্ষে দেখিল, তাহারা সকলেই নিস্তব্ধ এবং স্থিরভাবে দণ্ডায়মান! পদপরিমাণ ভূমিও অগ্রসর হইতে আর তাহারা সাহসী হইল না।
মারওয়ান বলিতে লাগিল, “ভ্রাতাগণ! হোসেন পরিবারের প্রতি কেহ কোন প্রকার অত্যাচার করিও না। সাবধান! তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া কেহ কোন কথা মুখে আনিও না। প্রত্যক্ষ প্রমাণ স্বচক্ষেই ত দেখিলে! কি অসীম সাহস! কি অসীম ক্ষমতা কি আশ্চর্য! বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখ, ইহাদের এখনকার ভাবভঙ্গি—মনের ভাবগতিক বড় ভয়ানক! সাবধানে কথাবার্তা কহিবে। দেখ, ভাবটি সহজ ভাব নহে, দেখিলেই বোধ হয়, ইহারা সন্তোষসহকারে কোথায় যেন যাইতে ব্যগ্র হইয়াছেন! দুঃখের চিহ্নমাত্র নাই! বিয়োগ, শোক, বেদনা, যন্ত্রণা, ইহাদের অন্তরের বিন্দুপরিমাণ স্থানও যেন অধিকার করিতে পারে নাই। সকলের হাতেই এক-একখানি শাণিত অস্ত্র। তরবারি, খঞ্জর, কাটারী, ছোরা, যে যাহা পাইয়াছে, তাহাই লইয়াছে। ধন্য রে আরবীয় নারী! তোমরাই ধন্য! পতি-পুত্র-বিয়োগ বেদনা ভুলিয়া তোমরা আজ সমরসাজে শত্রুসম্মুখীন। ধন্য তোমরা! ভ্রাতাগণ! আমাদের বীরত্বে ধিক্! অস্ত্রে ধিক্! নারীহস্তে অস্ত্র দেখিয়া কি আর এ সকল অস্ত্র ধরিতে ইচ্ছা করে? ইহারা আমাদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করুন বা না করুন, আমরা কিছুই বলিব না। ছিঃ! ছিঃ! অবলা কুলস্ত্রীর সহিত যুদ্ধ করিতে অস্ত্রের ব্যবহার শিক্ষা করি নাই। ভ্রাতাগণ! তোমরা আর কোন কথা বলিও না, সকলেই স্ব স্ব অস্ত্র কোষে আবদ্ধ কর। যাহা বলিবার আমিই বলিতেছি।”
মারওয়ান অবনত মস্তকে বলিতে লাগিল, “সাধ্বী-সতী দেবিগণ! আমরা মহারাজ এজিদের আজ্ঞাবহ এবং চিরানুগত দাস। মহারাজ-আদেশে আমরাই কারবালা-ক্ষেত্রে হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসিয়াছিলাম। যুদ্ধ শেষ হইয়াছে। আমরা জয়লাভ করিয়াছি। আমরাই আপনাদের সুখতরী আজ মহারাজ এজিদের আদেশাস্ত্রে খণ্ড খণ্ড করিয়া বিষাদ-সিন্ধুতে ভুবাইয়াছি। আজিকার অস্ত্রের সহিত আপনাদের স্বাধীনতা-সূর্য একেবারে চির অস্তমিত হইয়াছে। এখন আপনারা মহারাজ এজিদসৈন্য-হস্তে চিরবন্দী। বন্দীর প্রতি অত্যাচার অবিচার কাপুরুষের কার্য্য। বরং আপনাদের জীবনরক্ষার প্রতি সর্বদা আমাদের দৃষ্টি থাকিবে। ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ হেতু যদি কোন দ্রব্যের অভাব হইয়া থাকে, বলুন, আমি সে অভাব মোচন করিতে প্রস্তুত আছি।”
সকলেই নীরব!—কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ নীরব!—স্পন্দনহীন জড়বৎ নীরব! অনিমেষে নীরব! কেবল অল্পবয়স্ক বালিকারা শুষ্ককণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “জল! জল! আমরা তোমাদের নিকট জল চাহি; দয়া করিয়া এক পাত্র জল দাও—”
মারওয়ান অতি অল্প সময় মধ্যে ফোরাত-জল দ্বারা অনেকের তৃষ্ণা নিবারণ করিল। কিন্তু যাঁহাদের অন্তরে পতি-পুত্র-ভ্রাতা-বিয়োগজনিত শোকাগ্নি প্রচণ্ডবেগে হু হু করিতেছে—শরীরের প্রতি লোমকূপ হইতে সেই মহা অগ্নির জ্বলন্ত শিখা মহাতেজে নির্গত হইয়া জীবন্ত জীবন জ্বালাইতেছে, তাঁহাদের নিকট জলের আদর হইল না! ফোরাত-জলে সে জ্বলন্ত আগুন নির্ব্বাপিত হইল না; বরং আরও সহস্রগুণ জ্বলিয়া উঠিল।
মারওয়ান একটু উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিল, “বন্দিগণ! শিবিরস্থ বন্দিগণ! প্রস্তুত হও। যুদ্ধাবসানে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত পক্ষকে রাখিবার বিধি নাই। প্রস্তুত হও—তোমরা মহারাজ এজিদের বন্দী,—মারওয়ানের হস্তে। শীঘ্র প্রস্তুত হও। এখনই দামেস্কে যাইতে হইবে।”