বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/ষড়্বিংশ প্রবাহ
ষড়বিংশ প্রবাহ
এমাম হোসেনের অশ্বের পদধ্বনি শ্রবণ করিয়া এজিদের সৈন্যগণ চমকিত হইল। সকলের অন্তর কাঁপিয়া উঠিল। সকলেই দেখিতে লাগিল, হোসেন স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে আসিতেছেন। দেখিতে দেখিতে চক্ষের পলকে মহাবীর হোসেন যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ওরে বিধর্ম্মী পাপাত্মা এজিদ! তুই কোথায়? তুই নিজে দামেস্কে থাকিয়া নিরীহ সৈন্যদিগকে কেন রণস্থলে পাঠাইয়াছি। আজ তোকে পাইলে জাতি-বধ-বেদনা, ভ্রাতুপুত্র কাসেমের বিচ্ছেদ-বেদনা এবং স্বকীয় পুত্রগণের বিয়োগ বেদনা, সমস্তই আজ তোর পাপশোণিতে শীতল করিতাম—তোর প্রতি লোমকূপ হইতে হলাহল বাহির করিয়া লোমে লোমে প্রতিশোধ লইতাম। জানিলাম কাফেরমাত্রেই চতুর। রে নৃশংস! অর্থলোভ দেখাইয়া পরের সন্তানদিগকে অকালে নিধন করিবার নিমিত্ত পাঠাইয়াছিস্। ওরে অর্থলােভী পিশাচেরা, ধর্ম্মভয় বিসর্জ্জন দিয়া আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিস্; আয় দেখি, কে সাহস করিয়া আমার অস্ত্রের সম্মুখে আসিবি, আয়। আর বিলম্ব কেন? যাহার পক্ষে ইহজগৎ ভার বােধ হইয়াছে যে হতভাগ্য আপন মাতাকে অকালে পুত্রশোকে কঁদাইতে ইচ্ছা করিয়াছে, যৌবনে কুলস্ত্রীর বৈধব্য কামনা যাহার অন্তরে উদয় হইয়াছে, শীঘ্র আয়! আর আমার বিলম্ব সহ হইতেছে না।”
এজিদ-পক্ষীয় সর্বশ্রেষ্ঠ যােদ্ধা আবদুর রহ্মান; হােসেনের সহিত যুদ্ধ করিতে তাহার চিরসাধ! অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করিয়া সেই আবদুর রহ্মান অসি চালনা করিতে করিতে হােসেনের সম্মুখে আসিয়া বলিতে লাগিল, “হােসেন! তুমি আজ শােকে তাপে মহাকাতর; বােধ হয়, আজ দশ দিন তােমার পেটে অন্ন নাই, পিপাসায় কণ্ঠতালু বিশুদ্ধ; এই কয়েক দিন যে কেন বাঁচিয়া আছ বলিতে পারি না। আর এই কষ্টভােগ করিতে হইবে না, শীঘ্রই তোমার মনের দুঃখ নিবারণ করিতেছি। বড় দর্পে অশ্বচালনা করিয়া বেড়াইতেছ; এই আবদুর রহ্মান তােমার সম্মুখে দাঁড়াইল! যত বল থাকে, অগ্রে তুমিই আমাকে আঘাত কর। লােকে বলিবে যে, ক্ষুৎ-পিপাসাকুল, শােক-তাপবিদগ্ধ, পরিজন-দুঃখকাতর উৎসাহহীন বীরের সহিত কে না যুদ্ধ করিতে পারে? এ দুর্নাম আমি সহ্য করিব না—তুমিই অগ্রে আঘাত কর। তােমার বল বুঝিয়া দেখি; যদি আমার অস্ত্রাঘাত সহ্য করিবার উপযুক্ত হও, আমি প্রতিঘাত করিব; নতুবা ফিরিয়া যাইয়া তােমার ন্যায় হীন, ক্ষীণ, দুর্ব্বল যােদ্ধাকে খুঁজিয়া তােমার সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিব।”
হােসেন বলিলেন, “এত কথার প্রয়ােজন নাই। আমার বংশমধ্যে কিংবা জাতিমধ্যে অগ্রে অস্ত্র নিক্ষেপের রীতি থাকিলে তুমি এত কথা কহিবার সময় পাইতে না। হারামজাদা! বেঈমান্! কাফের! শীঘ্র যে কোন অস্ত্র হয়, আমার প্রতি নিক্ষেপ কর। সময়ক্ষেত্রে আসিয়া বাগ্বিতণ্ডার দরকার কি? অস্ত্রই বল—পরীক্ষার প্রধান উপকরণ। কেন বিলম্ব করিতেছিস্? যে কোন অস্ত্র হউক, একবার নিক্ষেপ করিলেই তোর যুদ্ধসাধ মিটাইতেছি। বিলম্ব তোর পক্ষে মঙ্গল বটে, কিন্তু তাহা আমার অসহ্য!
হোসেনের মস্তক লক্ষ্য করিয়া তরবারি উত্তোলন পূর্ব্বক “তোমার মস্তকের মুল্য লক্ষ টাকা” এই বলিয়াই আবদুর রহ্মান ভীমবেগে তরবারি আঘাত করিল। হোসেনের বর্ম্মোপরি আবদুর রহ্মানের তরবারি সংলগ্ন হইয়া অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বহির্গত হইল। রহ্মান লজ্জিত হইয়া পলায়নের উপক্রম করিলে হোসেন বলিলেন, “অগ্রে সহ্য কর্, শেষে পলায়ন করিস্।” এই কথা বলিয়াই এক আঘাতে অশ্ব সহিত রহ্মানের দেহ তিনি দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন। এই ঘটনা দেখিয়া এজিদের সৈন্যগণ মহাভয়ে কম্পিত হইতে লাগিল। কেহই আর হোসেনের সম্মুখীন হইতে সাহস করিল না। তাহারা বলিতে লাগিল, “যদি হোসেন আজ এ সময় পিপাসা নিবারণ করিতে বিন্দুমাত্রও জল পায়, তাহা হইলে আমাদের একটি প্রাণীও ইহার হস্ত হইতে প্রাণ বাঁচাইতে পারিবে না। যতই যুদ্ধ হউক না কেন, বিশেষ সতর্ক হইয়া দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা ফোরাতকূল এখনি ঘিরিয়া রাখাই কর্ত্তব্য। যে মহাবীর এক আঘাতে মহাবীর আবদুল রহ্মানকে নিপাত করিলেন, তাহার সম্মুখে কে সাহস করিয়া দাঁড়াইবে। আমরা রহ্মানের গৌরবেই চিরকাল গৌরব করিয়া বেড়াই, তাহারই যখন এই দশা হইল, তখন আমরা ত হোসেনের অশ্বপদাঘাতেই গলিয়া যাইব।” পরস্পর এইরূপ বলাবলি করিয়া সকলেই এক মত হইয়া দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা বিশেষ সুদৃঢ়রূপে ফোরাতকুল বন্ধ করিল।
হোসেন অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত সমরপ্রাঙ্গণে কাহাকেও না পাইয়া শত্রু শিবিরাভিমুখে অশ্বচালনা করিলেন। তদ্দর্শনে অনেকেরই প্রাণ উড়িয়া গেল। কেহ অশ্ব-পদাঘাতে নরকে গমন করিল, কেহ কেহ সাহসের উপর নির্ভর করিয়া হোসেনের সম্মুখে সশস্ত্র হইয়া দাঁড়াইল। কিন্তু তাহাদের হাতের অস্ত্র হাতেই রহিয়া গেল, মস্তকগুলি দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দূরে দূরে বিনিক্ষিপ্ত হইল।
মহাবীর হোসেন বিধর্ম্মীদিগকে যেখানে পাইলেন, যে অস্ত্রে যে সুযোগে যাহাকে মারিতে পারিলেন, সেই অস্ত্রের দ্বারাই তাহাকে মারিয়া নরক পরিপূর্ণ করিতে লাগিলেন। শিবির অবশিষ্ট সৈন্যগণ প্রাণভয়ে যে দিকে সুবিধা উর্দ্ধশ্বাসে সেই দিকে দৌড়াইয়া প্রাণরক্ষা করিল। যাহারা তাহার সম্মুখে দৌড়াইয়া আসিল, তাহারা কেহই প্রাণরক্ষা করিতে পারিল না। সকলেই হোসেনের অস্ত্রে দ্বিখণ্ডিত হইয়া পাপময় দেহ পাপরক্তে ভাসাইয়া নরকগামী হইল। অবশিষ্ট সৈন্যগণ কারবালা পার্শ্বস্থ বিজন বনমধ্যে পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিল। ওমর, সীমান, আবদুল্লাহ জেয়াদ প্রভৃতি সকলেই হোসেনের ভয়ে বনমধ্যে লুকাইলেন।
শত্রুপক্ষের শিবির সৈন্য একেবারে নিঃশেষিত করিয়া হোসেন ফোরাতকুলের দিকে অশ চালাইলেন। ফোরাত-রক্ষীরা হঠাৎ পলাইল না, কিন্তু অতি অল্পক্ষণের জন্যও হোসেনের অসির আঘাত সহ করিয়া তিষ্ঠিবার আর তাহাদের সাধ্য হইল না। কেহ জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল, কেহ জঙ্গলে লুকাইল, কেহ কেহ অন্যদিকে পলাইল, কিন্তু বহুতর সৈন্যই হোসেনের অস্ত্রাঘাতে দ্বিখণ্ডিত হইয়া রক্তস্রোতের সহিত ফোরাত-স্রোতে ভাসিয়া চলিল। কোন স্থানে শত্রুসৈন্যের নাম মাত্রও নাই, রক্তস্রোত মধ্যে শরীরের কোন কোন ভাগ লক্ষিত হইতেছে মাত্র। যে এজিদের সৈন্যকোলাহলে প্রচণ্ড কারবালা প্রান্তর, সুপ্রশস্ত ফোরাতকুল ঘন ঘন বিকম্পিত হইত, এক্ষণে হোসেনের অস্ত্রাঘাতে সেই কারবালা একেবারে জনশূন্য নীরব প্রান্তর! হোসেন ব্যতীত প্রাণীশূন্য ফোরাত-তীরে প্রকৃতি দেবীর বক্ষঃক্ষেত্রস্থ স্বাভাবিক শোভা একেবারে পরিবর্তিত হইয়া লোহিত বর্ণ ধারণ করিয়াছে। নিম্নভূমিতে রক্তস্রোত কল কল শব্দে প্রবাহিত হইতেছে। রক্তমাখা খণ্ডিতদেহ ভিন্ন আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। হোসেন জল-পিপাসায় এমনই কাতর হইয়াছেন যে, তাহার আর কথা কহিবার শক্তি নাই। তিনি এতক্ষপ কেবল শত্রু-বিনাশের উৎসাহে উৎসাহিত ছিলেন। বিধর্মীর রক্তস্রোত বহাইয়া তাঁহার পিপাসার অনেক শান্তি হইয়াছিল, এখন শত্রু শেষ হইল, পিপাসাও অসহ্য হইয়া উঠিল। শীঘ্র শীঘ্র ফোরাত কুলে যাই তিনি অশ্ব হইতে অবতরণ পূর্ব্বক একেবারে জলে নামিলেন। জলের পরিষ্কার স্নিগ্ধভাব দেখিয়া তিনি ইচ্ছা করিলেন যেন, এককালে নদীর সমুদয় জল পান করিয়া ফেলেন। অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া মুখে দিবেন, এমন সময় তাহার সমুদয় কথা মনে পড়িল। আত্মীয়-বন্ধুর কথা মনে পড়িল, কাসেমের কথা মনে পড়িল, আলী আক্বর প্রভৃতির কথা মনে পড়িল, পিপাসার্ত্ত দুগ্ধপোষ্য শিশুর কথাও মনে পড়িল। এক বিন্দু জলের জন্য ইহারা কত লালায়িত হইয়াছে, কাতরতা প্রকাশ করিয়াছে, কত কষ্টভোগ করিয়াছে। এই জলের নিমিত্তই আমার পরিজনেরা পুত্রহারা, পতিহারা, ভ্রাতৃহারা হইয়া মাথা ভাঙ্গিয়া মরিতেছে, আমি এখন শত্রুহস্ত হইতে ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া সর্বাগ্রেই নিজে সেই জলপান করিব!—নিজের প্রাণ পরিতৃপ্ত করিব!—আমার প্রাণের মায়াই কি এত অধিক হইল? ধিক্ আমার প্রাণে!-এই জলের জন্য আলী আক্বর আমার জিহবা পর্য্যন্ত চুষিয়াছে! এক পাত্র জল থাকিলে আমার বংশের উজ্জ্বল মণি, মহাবীর কাসেম আজ শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিত না। এখনও যাহার জীবিত আছে, তাহারা ত শোকতাপে কাতর হইয়া পিপাসায় মৃতবৎ হইয়া রহিয়াছে। এ জল আমি কখনই পান করিব না,—ইহজীবনেও আর পান করিব না।”—এই কথা বলিয়া হস্তস্থিত জল নদীগর্ভে ফেলিয়া দিয়া তিনি তীরে উঠিলেন। কি ভাবিলেন, তিনিই জানেন। একবার আকাশের দিকে লক্ষ্য করিয়া পবিত্র শিরস্ত্রাণ শির হইতে দূরে নিক্ষেপ করিলেন; দুই এক পদ অগ্রসর হইয়াই কোমর হইতে কোমরবন্ধ খুলিয়া দূরে ফেলিয়া দিলেন, সেই পবিত্র মোজা আর পায়ে রাখিলেন না। ভ্রাতৃশোক, পুত্রশোক, সকল শোক একত্রে আসিয়া তাহাকে যেন দগ্ধ করিতে লাগিল। কি মনে হইল, তাহাতেই বোধ হয়, পরিহিত পায়জামামাত্র অঙ্গে রাখিয়া আর আর সমুদয় বসন খুলিয়া ফেলিলেন। অস্ত্রশস্ত্র দূরে নিক্ষেপ করিয়া তিনি ফোরাত স্রোতের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। হোসেনের অশ্ব প্রভুর হন্ত, পদ ও মস্তক শুন্য দেখিয়াই যেন মহাকষ্টে দুই চক্ষু হইতে অনবরত বাষ্পজল নির্গত করিতে লাগিল। আবদুল্লাহ, জেয়াদ, ওমর, সীমার, আর কয়েকজন সৈনিক যাহারা জঙ্গলে লুকাইয়াছিল, তাহারা দূর হইতে দেখিল যে, এমাম্ হোসেন জলে নামিয়া অঞ্জলিপূর্ণ জল তুলিয়া পুনরায় ফেলিয়া দিলেন, পান করিলেন না। তদনন্তর তিনি তীরে উঠিয়া সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র, অঙ্গের বসন পর্যন্ত দূরে নিক্ষেপ করিয়া শূন্যশিরে, শূন্যশরীরে অশ্বের নিকট দণ্ডায়মান আছেন। এতদ্দর্শনে ঐ কয়েকজন একত্রে ধনুর্বাণ হস্তে হোসেনকে ঘিরিয়া ফেলিল। হোসেন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া আছেন, কাহাকেও কিছু বলিতেছেন না। স্থিরভাবে স্থিরনেত্রে ধনুর্ধারী শত্রুদিগকে দেখিতেছেন, মুখে কোন কথা নাই। এমন নিরস্ত্র অবস্থায় শক্রহস্তে পতিত হইয়াও মনে কোনপ্রকার শঙ্কাও নাই। অন্যমনস্ক তিনি কি ভাবিতেছেন, তাহা ঈশ্বর জানেন, আর তিনিই জানেন। ক্ষণকাল পরে তিনি ফোরাত-কূল হইতে অরণ্যাভিমুখে দুই এক পদ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। শত্রুগণ চতুষ্পর্শ্বে দূরে দূরে উঁহাকে ঘিরিয়া চলিল। যাইতে যাইতে জেয়াদ পশ্চাদ্দিক হইতে তাহার পৃষ্ঠ লক্ষ্য করিয়া এক বিষাক্ত লৌহশর নিক্ষেপ করিল। সে ভাবিয়াছিল যে, এক শরে হোসেনের পৃষ্ঠ বিদ্ধ করিয়া বক্ষঃস্থল ভেদ করিবে, কিন্তু, ঘটনাক্রমে সে শর হোসেনের বামপার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেল, গাত্রে লাগিল না। শব্দ হইল, সে শব্দেও হোসেনের ধ্যানভঙ্গ হইল না। তাহার পর ক্রমাগতই শর নিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল, কিন্তু একটিও এমামের অঙ্গে বিদ্ধ হইল না। সীমার শর সন্ধানে বিশেষ পারদর্শী ছিল না বলিয়াই খঞ্জর[১] হস্তে করিয়া যাইতেছে। এত তীর নিক্ষিপ্ত হইতেছে, একটিও হোসেনের অঙ্গে লাগিতেছে না, কি আশ্চর্য্য। সীমার—এই ভাবিয়া জেয়াদের হস্ত হইতে তীরধনু গ্রহণ পূর্বক হোসেনের পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করিয়া একটি শর নিক্ষেপ করিল। তীর হোসেনের পৃষ্ঠে লাগিয়া গ্রীবাদেশের এক পার্শ্ব ভেদ করিয়া চলিয়া গেল। হোসেনের ভ্রুক্ষেপ নাই। তিনি এমন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন আছেন যে, শরীরের বেদনা পর্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছেন। যাইতে যাইতে অন্যমনস্ক তিনি একবার গ্রীবাদেশের বিদ্ধস্থান হস্ত দিয়া ঘর্ষণ করিলেন; জলের ন্যায় কিছু বোধ করিলেন, করতলের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলেনঃ জল নহে, গ্রীবা নিঃসৃত সদ্যরক্ত! রক্তদর্শনে হোসেন চমকিয়া উঠিলেন। আজ ভয়শূন্য মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। সভয়ে চতুর্দ্দিকে চাহিয়া দেখিলেনঃ আবদুল্লাহ জেয়াদ, ওমর, সীমার এবং আর কয়েকজন সেনা তাহার চতুর্দ্দিক ঘিরিয়া যাইতেছে। সকলের হস্তেই তীরধনু! ইহা দেখিয়াই তিনি চমকাইয়া উঠিলেন!—যে সমুদয় বসনের মাহাত্মে তিনি নির্ভয়হৃদয়ে ছিলেন—তৎসমুদয় এখন পরিত্যাগ করিয়াছেন; তরবারি, তীর, নেজা, বল্লাম, বর্ম্ম, খঞ্জর কিছুই তাঁহার সঙ্গে নাই, কেবল দুখানি হাত মাত্র সম্বল। অন্যমনস্কভাবে তিনি দুই এক পদ করিয়ায় চলিলেন; শত্রুরাও পূর্ববৎ ঘিরিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
কিছু দূরে যাইয়া হোসেন আকাশ পানে দুই তিন বার চাহি ভূতলে পড়িয়া গেলেন। বিষাক্ত তীরবিদ্ধ ক্ষতস্থানের জ্বালা, পিপাসার জ্বালা, শোকতাপ, বিয়োগ-দুঃখ,—নানা প্রকার জ্বালায় তিনি অধীর হইয়া পড়িলেন। জেয়াদ এবং ওমর প্রভৃতি ভাবিল যে, হোসেনের মৃত্যুই হইয়াছে—কিছুক্ষণ পরে হোসেনের হস্তপদ-সঞ্চালনের ক্রিয়া দেখিয়া তাহার যে নিশ্চয়ই মৃত্যু হইয়াছে—ইহা আর মনে করিল না; তাঁহার মৃত্যু নিকটবর্তী জ্ঞান করিয়া কিঞ্চিৎ দূরে তাহারা স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিল।—হোসেন ভূমিতলে পড়িয়া রহিয়াছেন। সীমারের সামান্য শরাঘাতে তাদৃশ মহাবীরের প্রাণ বিয়োগ অসম্ভব ভাবিয়া কেহই হোসেনের নিকট যাইতে সাহসী হইল না। কেহ কেহ অনুমান করিতেছে—নিশ্চয়ই মৃত্যু! মুখেও বলিতেছে যে, “হোসেন আর নাই। চল, হোসেনের মস্তক কাটিয়া আনি।” কিন্তু দুই এক পদ যাইয়া আর কাহারও অগ্রসর হইতে সাহস হয় না। হোসেনের মৃত্যু-সংবাদ এজিদের নিকট লইয়া গেলে কোন লাভ নাই। এজিদ সে সংবাদ বিশ্বাস করিয়া কখনই পুরস্কার দান করিবেন না! মস্তক চাই!'—ভাবিয়া ভাবিয়া সীমার বলিল, “জেয়াদ! তুমি ত খুব সাহসী; তুমিই মৃত হোসেনের মাথা কাটিয়া আন।”
জেয়াদ বলিলেন, “হোসেনের মাথা কাটিতে আমার হস্ত স্থির থাকিবে না, সাহসও হইবে না। আমি উহা পারিব না। যদি দুর্বলতা বশতঃ হোসেন ধরাশায়ী হইয়া থাকে, কিংবা অন্য কোন অভিসন্ধি করিয়া মরার ন্যায় মাটিতে পড়িয়া থাকে, আমাকে হাতে পাইলে, বল ত আমার কি দশা ঘটিবে? যাহার ভয়ে জলে পলাইয়া প্রাণরক্ষা করিয়াছি, ইচ্ছা করিয়া তাহার হাতে পড়িব? আমি ত কখনই যাইব না! মাথা কাটিয়া আনা ত শেষের কথা, নিকটেও যাইতে পারিব না।”
অলীদকে সম্বোধন করিয়া সীমার বলিল, “ভাই অলীদ! তোমার অভিপ্রায় কি? তুমি হোসেনের মাথা কাটিয়া আনিতে পারিবে কি না?”
অলীদ উত্তর করিলেন, “আমি হোসেনের বিরুদ্ধে যাহা করিয়াছি, তাহাই যথেষ্ট হইয়াছে। এজিদের বেতনভোগী হইয়া আজ কারবালা প্রান্তরে যাহা আমি করিলাম, জগৎ বিলয় না হওয়া পর্যন্ত মানবহৃদয়ে সমভাবে তাহা পাষাণে খোদিত হইয়া থাকার মতই থাকিবে। ইহার পরিণাম ফল কি আছে,—ভবিতব্য কি আছে, তাহা কে জানে ভাই!—ভাই! তোমরা আমাকে মার্জ্জনা কর, আমি পারিব না—হোসনের মাথাও আমি কাটিতে চাই না, লক্ষ টাকা পুরস্কারেরও আশা করি না। যাহার হৃদয়ে রক্তমাংসের লেশমাত্রও নাই, লক্ষ টাকার লোভে সে এই নিষ্ঠুর কার্য্য করুক।
সদর্পে সীমার বলিয়া উঠিল, “দেখিলাম তোমাদের বীরত্ব—দেখিলাম তোমাদের সাহস—বুঝিলাম তোমাদের ক্ষমতা!—এই দেখ, আমি এখনই হোসেনের মাথা কাটিয়া আনি?”—এই কথা বলিয়াই সীমার খঞ্জর-হস্তে এক লম্ফে হোসেনের বক্ষের উপর গিয়া বসিল।
যে সীমারের নামে অঙ্গ শিহরিয়া উঠিয়াছিল, যে সীমারের নামে হৃদয় কঁপিয়া উঠিয়াছিল, পাঠক! এই সেই সীমার! সু-ধার খঞ্জর-হস্তে সেই সীমার ঐ হোসেনের বক্ষের উপর বসিয়া গলা কাটিতে উদ্যত হইল!! হোসেন জীবিত আছেন, উঠিবার শক্তি নাই। অন্যমনস্ক কি চিন্তায় অভিভূত ছিলেন, তিনিই জানেন। চক্ষু মেলিয়া বক্ষের উপর খর-হস্তে সীমাকে দেখিয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, “তুমি ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব—তুমি আমার বক্ষের উপর বসিলে? নূরনবী মোহাম্মদের মতাবলম্বী হইয়া এমাম হোসেনের বক্ষের উপর পা রাখিয়া বসিলে? তোমার কি পরকাল বলিয়া কিছুই মনে নাই? এমন গুরুতর পাপের জন্য তুমি কি একটুও ভয় করিতেছ না?”
সীমার বলিল, “আমি কাহাকেও ভয় করি না!—আমি পরকাল মানি না; নূরনবী মোহাম্মদ কে? আমি তাহাকে চিনি না। বুকের উপর বসিয়াছি বলিয়া পাপের ভয় দেখাইতেছ, সে ভয় আমার নাই। কারণ, আমি এখনই খঞ্জরে তোমার মাথা কাটিয়া লইব। যাহার মাথা কাটিয়া লক্ষ টাকা পুরস্কার পাইব, তাহার বুকের উপর বসিতে আমার পাপ কি? সীমার পাপের ভয় করে না।”
“সীমার। আমি এখনই মরিব। বিষাক্ত তীরের আঘাতে আমি অস্থির হইয়াছি। বক্ষের উপর হইতে নামিয়া আমায় নিঃশ্বাস ফেলিতে দাও। একটু বিলম্ব কর? একটু বিলম্বের জন্য কেন আমাকে কষ্ট দিবে? আমার প্রাণ বাহির হইয়া গেলে মাথা কাটিয়া লইও। আমার দেহ যত খণ্ডে খণ্ডিত করিতে ইচ্ছা হয়, করিও! একবার নিঃশ্বাস ফেলিতে দাও। নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু। এই কারবালা-প্রান্তরে হোসেনের জীবনের শেষ কার্য্য সমাপ্ত! তাহার জীবনের শেষ এই কারবালায়। ভাই সীমার! তুমি নিশ্চয়ই আমার মাথা কাটিয়া লইতে পারিবে। আমি আশাবাদ করিতেছি, এই কার্য্য করিয়া তুমি জগতে বিখ্যাত হইবে। ক্ষণকাল অপেক্ষা কর।
অতি কর্কশস্বরে সীমার বলিল “আমি তোমার বুকের উপর চাপিয়া বসিয়াছি, মাথা না কাটিয়া উঠিব না। যদি অন্য কোন কথা থাকে, বল। বুকের উপর হইতে একটুও সরিয়া বসিব না।”—এই বলিয়া সীমার আরও দৃঢ়রূপে চাপিয়া বসিয়া হোসেনের গলায় খঞ্জর চালাইতে লাগিল।
হোসেন বলিতে লাগিলেন, “সীমার। আমার প্রাণ এখনই বাহির হইবে। একটু বিলম্ব করা-এই কষ্টের উপর আর কষ্ট দিয়া আমাকে মারিও না!”
সীমার তীক্ষ্মধার খঞ্জর হোসেনের গলায় সজোরে চালাইতে লাগিল, কিন্তু চুল পরিমাণ স্থানও কাটতে পারি না। সে বার বার খরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল, হস্ত দ্বারা বারংবার খঞ্জরের ধার পরীক্ষা করিয়া দেখিল। পুনরায় অধিক জোরে সে খঞ্জর চালাইতে লাগিল। কিছুতেই কিছু হইল না! তিলমাত্র চর্ম্মও কাটিল না! সীমার অপ্রস্তুত হইল। আবার সে খঞ্জরের প্রতি ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল—আবার ভাল করিয়া দেখিয়া খঞ্জরের ধার পরীক্ষা করিল।
হোসেন বলিলেন, “সীমার? কেন বারবার এ সময় আমাকে কষ্ট দিতেছ? শীঘ্রই মাথা কাটিয়া ফেল! আর সহ্য হয় না। অনর্থক আমাকে কষ্ট দিয়া তোমার কি লাভ হইতেছে? বন্ধুর কার্য্য কর।—শীঘ্রই আমার মাথা কাটিয়া ফেল।”
“আমি ত কাটিতে বসিয়াছি, সাধ্যানুসারে চেষ্টাও করিতেছি। খঞ্জরে না কাটিলে আমি আর কি করিব? এমন সুতীক্ষ খঞ্জর তোমার গলায় বসিতেছে না, আমার অপরাধ কি—আমি কি করিব?”
হোসেন বলিলেন, “সীমার! তোমার বক্ষের বসন খোল দেখি?”
“কেন?”
“কারণ আছে। তোমার বক্ষ দেখিলেই জানিতে পারি যে, তুমি আমার ‘কাতেল’ (হস্তা) কি না?”
“তাহার অর্থ কি?
“অর্থ আছে। অর্থ না থাকিলে বৃথা তোমাকে এমন অনুরোধ করিব কি জন্য? তোমরা সকলেই জান,অন্ততঃ শুনিয়া থাকিবে, হোসেন কখনও বৃথা বাক্যব্যয় করে না। মাতামহ আমাকে বলিয়া গিয়াছেনঃ রক্তমাংসে গঠিত হইলেও যে বক্ষ লোমশূন্য, সে বক্ষ পাষাণময়, সেই লোমশূন্য বক্ষই তোমার কাতেল; যাহার বক্ষ লোমশূন্য তাহারই হস্তে তোমার নিশ্চয়ই মৃত্যু! মাতামহের বাক্য অলঙ্ঘনীয়। সীমার! তোমার বক্ষের বস্ত্র খুলিয়া ফেল।আমি দেখি, যদি তাহা না হয়, তবে তুমি বৃথা চেষ্টা করিবে কেন? তোমার জীবনকাল পর্যন্ত আমাকে এ প্রকারে যন্ত্রণা দিয়া,—সহস্র চেষ্টা করিলেও আমার দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করিতে পারিবে না।” সীমার গাত্রের বসন উন্মোচন করিয়া হোসেনকে দেখাইল; নিজেও দেখিল। হোসেন সীমারের বক্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া দুই হস্তে দুই চক্ষু আবরণ করিলেন। সীমার সজোরে হোসেনের গলায় খঞ্জর দাবাইয়া ধরিল, কিন্তু এবারেও কাটিল না! বারবার খঞ্জর ঘর্ষণে হোসেন বড়ই কাতর হইলেন। তিনি পুনরায় সীমারকে বলিতে লাগিলেন, “সীমার! আর একটি কথা আমার মনে হইয়াছে, বুঝি তাহাতেই খঞ্জরের ধার ফিরিয়া গিয়াছে; তোমার পরিশ্রম বৃথা হইতেছে, আমিও যারপরনাই কষ্টভোগ করিতেছি। সীমার! মাতামহ জীবিতাবস্থায় অনেক সময় স্নেহ করিয়া আমারই গলদেশ চুম্বন করিয়াছিলেন। সেই পবিত্র ওষ্ঠের চুম্বনমাহাত্ম্যেই তীক্ষ্ণধার অস্ত্র ব্যর্থ হইয়া যাইতেছে। আমার মস্তক কাটিতে আমি তোমাকে বারণ করিতেছি না; আমার এই প্রার্থনা যে, আমার কণ্ঠের পশ্চাদভাগে, যেখানে তীরের আঘাতে শোণিত প্রবাহিত হইতেছে, সেইখানে খঞ্জর বসাও, অবশ্যই দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন হইবে।
“না, তাহা কখনই হইবে না। আমি অবশ্যই এই প্রকারে তোমার মাথা কাটিব।”
“সীমার! আমাকে এ প্রকার কষ্ট দিয়া তোমার কি লাভ? কিছুতেই তোমার কার্য্যসিদ্ধি হইবে না। আমি মিনতি করিয়া বলিতেছি, আমার গলার সম্মুখ দিকে আর খঞ্জর চালাইও না। তোমার যত্ন নিস্ফল হইবে, আমিও কষ্ট পাইব, অথচ তুমি মাথা কাটিতে পারিবে না। দেখ, নিশ্বাস ফেলিতে আমার বড়ই কষ্ট হইতেছে। শীঘ্র শীঘ্র তোমার কার্য্য শেষ করিলে, তোমারও লাভ, আমারও কষ্ট নিবারণ হয়। এ জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলি নাই। তুমি ঐ তীরবিদ্ধ স্থানে খঞ্জর বসাও, এখনই ফল দেখিতে পাইবে। আমাকে এ প্রকার কষ্ট দিলে এজিদের অঙ্গীকৃত লক্ষ টাকা অপেক্ষা তোমার অধিক আর কি লাভ হইবে?”
“তোমার কথা শুনিলে আমার কি লাভ হইবে?”
“অনেক লাভ হইবে। তুমি আমার প্রতি সদয় হইয়া এই অনুগ্রহ কর যে, আমার গলার এদিকে আর খঞ্জর চালাইও না; তীরবিদ্ধ স্থানে অস্ত্র বসাইয়া আমার মস্তক কাটিয়া লও—আমি ধর্ম্মতঃ প্রতিজ্ঞা করিতেছি, পরকালে তোমাকে অবশ্যই মুক্ত করাইব।—বিনা বিচারে তোমাকে স্বর্গসুখে সুখী করাইব। পুনঃপুনঃ ঈশ্বরের নাম করিয়া আমি ধর্ম্মতঃ প্রতিজ্ঞা করিতেছি, তোমাকে স্বর্গে লইয়া যাইতে না পারিলে আমি কখনই স্বর্গের দ্বারে পদনিক্ষেপ করিব না। ইহা অপেক্ষা তুমি আর কি লাভ চাও, ভাই?”
হোসেনের বক্ষের পরিবর্ত্তে সীমার এইবার তাহার পৃষ্ঠোপরি চাপিয়া এমামের দুইখানি হস্ত দুই দিকে পড়িয়া গেল,—তিনি বলিতে লাগিলেন, “জগৎ দেখুক, আমি কি অবস্থায় চলিলাম! নূরনবী মোহাম্মদের দৌহিত্র,—মদিনার রাজা-মহাবীর আলীর পুত্র হইয়া শূন্যহস্তে সীমারের অস্বাঘাতে কি ভাবে আমি ইহসংসার হইতে বিদায় হইলাম, জগৎ দেখুক।”
সীমার যেমন তীরবিদ্ধ স্থানে খঞ্জর স্পর্শ করিল অমনি হোসেনের শির দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল, অরণ্য, সাগর, পর্ব্বত, বায়ু ভেদ করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে রব উত্থিত হইতে লাগিল, “হায় হোসেন! হায় হোসেন!! হায় হোসেন!!!”
সীমার ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে হোসেনের শির লইয়া প্রস্থান করিল। রক্তমাখা খঞ্জর এমামের দেহের নিকট পড়িয়া রহিল।
মহরম পর্ব্ব সমাপ্ত
- ↑ খঞ্জর—এক প্রকার ছোরা যাহার দুই দিকেই ধাত