বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/পঞ্চবিংশ প্রবাহ

পঞ্চবিংশ প্রবাহ

 সূর্য্যদেব যতই উর্দ্ধে উঠিতেছেন, তাপাংশ ততই বৃদ্ধি পাইতেছে। হোসেনের পরিজনেরা বিন্দুমাত্র জলের জন্য লালায়িত হইতেছেন; শত বীরপুরুষ শত্রু হস্তে প্রাণত্যাগ করিতেছেন। ভ্রাতা, পুত্র, স্বামীর শোণিতাক্ত কলেবর দেখিয়া কামিনীরা, সময়ে সময়ে পিপাসায় কাতর হইতেছেন। চক্ষুতে জলের নাম মাত্রও নাই, সে যেন একপ্রকার বিকৃত ভাব, কাঁদিবারও বেশী শক্তি নাই। হোসেন চতুর্দ্দিকে চাহিয়া দেখিলেন। বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আর কেহই নাই! রণসজ্জিত হইয়া জয়লাভের জন্য শত্রু সম্মুখীন হইতে আদেশের অপেক্ষায় তাঁহার সম্মুখে আজ কেহই আসিতেছে না। হোসেন এক দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “হায়। এক পাত্র বারি প্রত্যাশায় এত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব হারাইলাম, তথাপি কাহারও পিপাসা নিবারণ করিতে পারিলাম না। কারবালা-ভূমিতে রক্তস্রোত বহিতেছে, তথাপি স্রোতঃস্বতী ফোয়াতকে শত্রুহস্ত হইতে উদ্ধার করিতে পারিলাম না। এক্ষণে আর বাঁচিবার ভরসা নাই, আশাও নাই, আকাঙক্ষাও নাই।”

 হাসানপুত্র কাসেম পিতৃব্যের এই কথা শুনিয়া সুসজ্জিত বেশে সম্মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া বিনীতভাবে বলিতে লাগিলেন, “তাতঃ! কাসেম এখনও জীবিত আছে। আপনার আজ্ঞাবহ চিরদাস আপনার সম্মুখে দণ্ডায়মান আছে। অনুমতি করুন, শত্রুকূল নির্ম্মূল করি।”

 হোসেন বলিলেন, “কাসেম, তুমি পিতৃহীন, তোমার মাতার তুমিই এক মাত্র সন্তান; তোমাকে এই ভয়ানক শত্রুদলমধ্যে কোন প্রাণে পাঠাইব?”

 কাসেম বলিলেন, “ভয়ানক!—আপনি কাহাকে ভয়ানক শত্রুজ্ঞান করেন? পথে ক্ষুদ্র মক্ষিকা, পথের ক্ষুদ্র পিপীলিকাকে আমি যেমন ক্ষুদ্র জ্ঞান করি, আপনার অনুমতি পাইলে এজিদের ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সৈন্যাধ্যক্ষগণকেও সেই রূপ তৃণ জ্ঞান করিতে পারি। কাসেম যদি বিপক্ষ-ভয়ে ভয়ার্ত্ত হয়, হাসানের নাম ডুবিবে, আপনারও নাম ডুবিবে। অনুমতি করুন, একা আমি সশস্ত্র হইয়া সহস্র সহস্র লক্ষ্য লক্ষ্য রিপুবিনাশে সমর্থ।”

 হোসেন বলিলেন, “প্রাণাধিক! আমার বংশে তুমি সকলের প্রধান, তুমি এমাম বংশের বহুমুল্য রত্ন, তুমি পিতার জ্যেষ্ঠপুত্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র, তুমি সৈয়দ বংশের অমূল্য নিধি। তুমি তোমার মার একমাত্র সন্তান, তাঁহার সম্মুখে থাকিয়া তাঁহাকে এবং সমুদয় পরিজনকে সান্ত্বনা দান কর। আমি নিজেই যুদ্ধ করিয়া ফোরাতকূল উদ্ধার করিতেছি।”

 কাসেম বলিলেন, “আপনি যাহাই বলুন, কাসেমের প্রাণ দেহে থাকিতে আপনাকে অস্ত্র ধারণ করিতে হইবে না। যদি ফোরাতকূল উদ্ধার করিতে পারি, তবে ফোরাত নদী আজ লোহিত বর্ণে রঞ্জিত হইয়া এজিদের সৈন্য-শোণিতে যোগ দিয়া মহাসমুদ্রে প্রবাহিত হইবে।”

 হোসেন বলিলেন “বৎস! আমার মুখে এ কথার উত্তর নাই। তোমার মাতার আদেশ লইয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই কর।”

 হাসনেবানুর পদধূলি গ্রহণ করিয়া মহাবীর কাসেম যুদ্ধযাত্রা প্রার্থনা করিলে, হাসনেবানু কাসেমের মস্তক চুম্বন করিয়া আশীর্ব্বচন প্রয়োগ-পূর্ব্বক বলিলেন, “যাও বাছা, যুদ্ধে যাও। তোমার পিতৃঋণ পরিশোধ কর। পিতৃশত্রু এজিদের সৈন্যগণের মস্তক চূর্ণ কর, যুদ্ধে জয়ী হইয়া ফোরাতকূল উদ্ধার কর। তোমার আর আর ভ্রাতা-ভগ্নিগণ তোমারই মুখাপেক্ষা করিয়া রহিল। যাও বাপ! তোমায় আজ ঈশ্বরের পদতলে সমর্পণ করিলাম।”

 হাসনেবানুর নিকট হইতে বিদায় লইয়া পিতৃব্যের পদচুম্বনপূর্ব্বক কাসেম অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিবেন, এমন সময় হোসেন বলিলেন, “কাসেম। একটু বিলম্ব কর।” অনুজ্ঞা শ্রবণ মাত্র কাসেম তৎক্ষণাৎ অশ্ববল্গা ছাড়িয়া পিতৃব্য সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন।

 হোসেন বলিতে ডাকিলেন, “কাসেম! তোমার পিতার নিকট আমি এক প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ আছি, আমাকে সেই প্রতিজ্ঞা হইতে উদ্ধার করিয়া যুদ্ধে গমন কর। তোমাকে যুদ্ধে যাইতে দিতে আমার আর কোনও আপত্তি নাই। তোমার পিতা প্রাণবিয়োগের কিছু পূর্ব্বে আমাকে এই কড়ায়ে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন: আমার কন্যা সখিনার সহিত তোমার বিবাহ দিব। তুমি সখিনাকে বিবাহ না করিয়া যুদ্ধে যাইতে পারিবে না। তোমার পিতার আজ্ঞা প্রতিপালন, আমাকেও প্রতিজ্ঞা হইতে রক্ষা করা, উভয়ই তোমার সমতুল্য কার্য্য।”

 কাসেম মহাবিপদে পড়িলেন। এতাদৃশ মহাবিপদ সময়ে বিবাহ করিতে হইবে, ইহা ভাবিয়াই তিনি অস্থিরচিত্ত হইলেন। কি করেন, কোন উত্তর না দিয়া তিনি মাতার নিকটে সমুদয় বৃত্তান্ত বলিলেন।

 হাস্‌নেবানু বলিলেন, “কাসেম। আমিও জানি, আমার সম্মুখে তোমার পিতা তোমার পিতৃব্যের নিকট এই বিবাহের প্রস্তাব করিয়া তাঁহাকে কড়ারে আবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। শোক, তাপ এবং উপস্থিত বিপদে আমি সমুদয় ভুলিয়া গিয়াছি। ঈশ্বরানুগ্রহে তোমার পিতৃব্যের স্মরণ ছিল বলিয়াই তোমার পিতার উপদেশ প্রতিপালিত হইবে, বোধ হইতেছে। ইহাতে আর কোনও আপত্তি উত্থাপন করিও না। এখনই বিবাহ হউক। প্রাণাধিক! এই বিষাদ-সমুদ্র মধ্যে ক্ষণকালের জন্য একবার আনন্দস্রোত বহিয়া যাউক।”

 কাসেম বলিলেন “জননি! পিতা মৃত্যুকালে আমাকে একখানি কবচ দিয়া বলিয়া গিয়াছেন: যে সময় তুমি কোন বিপদে পড়িবে, নিজ বুদ্ধির দ্বারা যখন কোন উপায় স্থির করিতে না পারিবে, সেই সময়েই এই কবচের অপর পৃষ্ঠ দেখিয়া তদুপদেশ মত কার্য্য করিও। আমার দক্ষিণ হস্তে যে কবচ দেখিয়াছেন, ইহাই সেই কবচ। আপনি যদি অনুমতি করেন, তবে আজ এই মহাঘোর বিপদ সময়ে কবচের অপর পৃষ্ঠা পাঠ করিয়া দেখি,—কি লেখা আছে।”

 হাস্‌নেবানু বলিলেন, “এখনই দেখ! তোমার আজিকার বিপদের ন্যায় আর কোন বিপদই হইবে না। কবচের অপর পৃষ্ঠা দেখিবার উপযুক্ত সময়ই এই!” এই কথা বলিয়াই হাস্‌নেবানু কাসেমের বাহু হইতে কবচ খুলিয়া তাঁহার হস্তে দিলেন। কাসেম সম্মানের সহিত কবচ চুম্বন করিয়া অপর পৃষ্ঠ দেখিয়াই বলিলেন, “মা! আমার আর কোন আপত্তি নাই। এই দেখুন, কবচে কি লেখা আছে।” পরিজনেরা সকলেই দেখিলেন, কবচে লেখা আছে,—“এখনই সখিনাকে বিবাহ কর।” কাসেম বলিলেন, “আর আমার কোন আপত্তি নাই, এই বেশেই বিবাহ করিয়া পিতার আজ্ঞা পালন এবং পিতৃব্যের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিব।”

 প্রিয় পাঠকগণ! ঈশ্বরানুগ্রহে লেখনীর সাহায্যে আপনাদের সহিত আমি অনেক দূর আসিয়াছি। কোন দিন ভাবি নাই, একটু চিন্তাও করি নাই, লেখনীর অবিশ্রান্ত গতিক্রমেই আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে বিষাদ-সিন্ধুর পঞ্চবিংশ প্রবাহ পর্য্যন্ত আসিয়াছি কিন্তু আজ কাসেমের বিবাহপ্রবাহে মহাবিপদে পড়িলাম! কি লিখি, কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। হাস্‌নেবানু বলিয়াছেন, “বিষাদ-সমুদ্রে আনন্দস্রোত!” এমন কঠিন বিষয় বর্ণনা করিতে আমার মস্তক ঘুরিতেছে, লেখনী অসাড় হইয়াছে, চিন্তার গতিরোধ হইয়াছে, কল্পনাশক্তি শিথিল হইয়াছে। যে শিবিরে স্ত্রী-পুরুষেরা, বালকবালিকারা দিবারাত্র মাথা ফাটাইয়া ক্রন্দন করিতেছে, পুত্র-মিত্রশোকে জগৎসংসার অন্ধকার দেখিতেছে, প্রাণপতির চিরবিরহে সতী নারীর প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছে, ভ্রাতার বিয়োগ যন্ত্রণায় অধীর হইয়া প্রিয় ভ্রাতা বক্ষঃ বিদীর্ণ করিতেছে, শোকে তাপে স্ত্রী-পুরুষ একত্রে দিবানিশি “হায় হায়” রবে কাঁদিতেছে, জগৎকেও কাঁদাইতেছে; আবার মুহূর্ত্ত পরেই পিপাসা, সেই পিপাসারও শাস্তি হইল না;—সেই শিবিরেই আজ বিবাহ! সেই পরিজন, মধ্যেই এখন বিবাহ-উৎসব! বিষাদ-সিন্ধুতে হাসিবার কোন কথা নাই, রহস্যের নামমাত্র নাই, আমোদ-আহ্লাদের বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কও নাই—আদ্যান্ত কেবল বিষাদ, ছত্রে ছত্রে কেবল বিষাদ, বিষাদেই আরম্ভ এবং বিষাদেই শেষ। কাসেমের ঘটনা বড় ভয়ানক। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, মহাবীর কাসেমের ঘটনা বিষাদ-সিন্ধুর একটি প্রধান তরঙ্গ।

 কাহারও মুখে হাসি নাই, কাহারও মুখে সন্তোষের চিহ্ন নাই; বিবাহ অথচ বিষাদ! পুরবাসিগণ সখিনাকে ঘিরিয়া বসিলেন। রণবাদ্য তখন সাদীয়ানা বাদ্যের কার্য্য করিতে লাগিল। অঙ্গরাগাদি সুগন্ধি দ্রব্যের কথা কাহারও স্মরণ হইল না;—কেবল কণ্ঠবিনির্গত নেত্রজলেই সখিনার অঙ্গ ধৌত করিয়া পুরবাসিনীরা পরিষ্কৃত বসনে সখিনাকে সজ্জিত করিলেন, তঁহার কেশগুচ্ছ পরিপাটী করিয়া বাঁধিয়া দিলেন, সভ্যদেশ-প্রচলিত বিবাহের চিহ্নস্বরূপ দুই একখানি অলঙ্কার সখিনার অঙ্গে ধারণ করাইলেন। সখিনা পূর্ণবয়স্ক, তিনি সকলই বুঝিতেছেন। কাসেম অপরিচিত নহেন। প্রণয়, ভালবাসা, উভয়েরই রহিয়াছে। ভ্রাতাভগ্নীর মধ্যে যেরূপ বিশুদ্ধ ও পবিত্র প্রণয় হইয়া থাকে, তাহা কাসেম-সখিনার বাল্যকাল হইতেই রহিয়াছে। কাহারও স্বভাব কাহারও অজানা নাই, বাল্যকাল হইতে এই উপস্থিত যৌবনকাল পর্য্যন্ত একত্র ক্রীড়া, একত্র ভ্রমণ, একত্র বাস নিবন্ধন উভয়েরই মনে সবিশেষ সরল প্রণয় জন্মিয়াছে। উভয়েই এক পরিবার, এক বংশসম্ভূত, উভয়েরই পিতা পরস্পর সহোদর ভ্রাতা, সুতরাং লজ্জা, মান, অভিমান প্রভৃতি অপর স্বামী-স্ত্রীতে যেরূপ হইবার সম্ভাবনা, তাহা ইহাদের নাই। লগ্ন সুস্থির হইল। ওদিকে এজিদের সৈন্যমধ্যে ঘোর রবে যুদ্ধের বাজনা বাজিতে লাগিল। ফোরাত নদীর কূল উদ্ধার করিতে আর কোন বীরপুরুষই হোসেনের পক্ষ হইতে আসিতেছে না দেখিয়া, আজিকার যুদ্ধে জয় সম্ভব বিবেচনায়, তুমুল শব্দে বাজনা বাজিতে লাগিল। সেই শব্দে ফোরাতকূল হইতে কারবালার অন্তঃসীমা পর্য্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। হোসেনের শিবিরে পতিপুত্র-শোকাতুরা অবলাগণের কাতর নিনাদে সপ্ততল আকাশ ভেদ করিতে লাগিল। সেই কাতরধ্বনি ঈশ্বরের সিংহাসন পর্য্যন্ত যাইতে লাগিল! হোসেন বাধ্য হইয়া এই নিদারুণ দুঃখ সময়ে কাসেমের হস্তে প্রাণাধিকা দুহিতা সখিনাকে সমর্পন করিলেন। বিধিমতে বিবাহকার্য্য সম্পন্ন হইল। শুভ কার্য্যের পর আনন্দাশ্রু অনেকের চক্ষে দেখা যায়, কিন্তু হোসেনের শিবির পরিজনগণের চক্ষে কোন প্রকার অশ্রুই দেখা যায় নাই। কিন্তু কাসেমের বিবাহ বিষাদ-সিন্ধুর সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান তরঙ্গ। সেই ভীষণ তরঙ্গে সকলেরই অন্তর ভাসিয়া যাইতেছিল। বরকন্যা উভয়েই সমবয়স্ক। স্বামী-স্ত্রীতে দুই দণ্ড নির্জ্জনে কথাবার্ত্তা কহিতেও আর সময় হইল না। বিবাহ-কার্য্য সম্পন্ন করিয়াই গুরুজনগণের চরণ বন্দনা করিয়া, মহাবীর কাসেম অসিহস্তে দণ্ডায়মান হইয়া বলিলেন, “এখন কাসেম শত্রুনিপাতে চলিল।”

 হাস্‌নেবানু কাসেমের মুখে শত শত চুম্বন দিয়া আর আর সকলের সহিত দুই হস্ত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “হে রুণাময় জগদীশ্বর। কাসেমকে রক্ষা করিও, আজ কাসেম বিবাহ সজ্জা,—বাসরসজ্জা পরিত্যাগ করিয়া চিরশত্রু-সৈন্য সম্মুখে যুদ্ধসজ্জায় চলিল। পরমেশ্বর! তুমিই রক্ষাকর্ত্তা; তুমিই রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক হইয়া পিতৃহীন কাসেমকে এ বিপদে রক্ষা কর!”

 কাসেম যাইতে অগ্রসর হইলেন, হাস্‌নেবানু বলিতে লাগিলেন “কাসেম! একটু অপেক্ষা কর। আমার চির মনঃসাধ আমি পূর্ণ করি। তোমাদের দুই জনকে একত্রে নির্জ্জনে বসাইয়া আমি একটু দেখিয়া লই। উভয়কে একত্রে দেখিতে আমার নিতান্তই সাধ হইয়াছে।” এই বলিয়া সখিনা ও কাসেমকে বস্ত্রাবাস মধ্যে একত্রে বসাইয়া বলিলেন, “কাসেম। তোমার স্ত্রীর নিকট হইতে বিদায় লও।” হাস্‌নেবানু শিরে করাঘাত করিতে করিতে তথা হইতে বাহির হইয়া কাসেমের গম্য পথে দাড়াইয়া রহিলেন।

 কাসেম সখিনার হস্ত ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছেন! কাহারও মুখে কোন কথা নাই। কেবল সখিনার মুখপানে চাহিয়া কাসেম স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অনেকক্ষণ পরে কাসেম বলিলেন, “সখিনা! প্রণয়,— পরিচয়ের ভিখারী আমরা নহি; এক্ষণে নূতন সম্বন্ধে পূর্ব্ব প্রণয় নূতন ভাবে আজীবন সমভাবে রক্ষার জন্যই বিধাতা এই নূতন সম্বন্ধ সৃষ্টি করাইলেন। তুমি বীর-কন্যা—বীরজায়া; এ সময় তোমার মৌনী হইয়া থাকা আমার অধিকতর দুঃখের কারণ। পবিত্র প্রণয় ত পূর্ব্ব হইতেই ছিল, এক্ষণে তাহার উপর পরিণয়সূচক বন্ধন যুক্ত হইল। আর কি আশা কর? অস্থায়ী জগতে আর কি সুখ আছে বল ত?”

 সখিনা বলিলেন, “কাসেম! তুমি আমাকে প্রবোধ দিতে পারিবে না। তবে এইমাত্র বলি, যেখানে শত্রুর নাম নাই, এজিদের ভয় নাই, কারবালা প্রান্তরও নাই, ফোরাত-জলের পিপাসাও যেখানে নাই, সেই স্থানে যেন আমি তোমাকে পাই; এই আমার প্রার্থণা। প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর চাই কি?”—কাসেমের হস্ত ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সখিনা পুনঃ পুনঃ বলিলেন; “কাসেম! প্রণয় ছিল, পরিণয় হইল, আর কি আশা?”

 প্রিয়তমা ভার্য্যাকে অতি স্নেহের সহিত আলিঙ্গন করিয়া মুখের নিকটে মুখ রাখিয়া কাসেম বলিতে লাগিলেন, “আমি যুদ্ধযাত্রী, শত্রু শোণিত পিপাসু; আজ সপ্ত দিবস এক বিন্দু মাত্র জলও গ্রহণ করি নাই, কিন্তু এখন আমার ক্ষুধা-পিপাসা কিছুই নাই। তবে যে পিপাসায় কাতর হইয়া চলিলাম, বোধ হয় এ জীবনে তাহার তৃপ্তি নাই, হইবেও না। তুমি কাঁদিও না, মনের আনন্দে আমাকে বিদায় দাও। একবার কান পাতিয়া শুন দেখি, শত্রুদলের রণবাদ্য কেমন ঘোর রবে বাদিত হইতেছে! তোমার স্বামী—এই কাসেম কি ঐ বাদ্য শুনিয়া নব-বিবাহিত স্ত্রীর মুখপানে চাহিয়া বসিয়া থাকিতে পারে? সখিনা! আমি এক্ষণে বিদায় হই।”

 সখিনা বলিতে লাগিলেন—“তোমাকে ঈশ্বরের হাতে সঁপিলাম। যাও কাসেম, যুদ্ধে যাও! প্রথম মিলন-রজনীর সমাগম আশায় অস্তমিত সূর্য্যের মলিন ভাব দেখিয়া প্রফুল্ল হওয়া সখিনার ভাগ্যে নাই! যাও কাসেম!—যুদ্ধে যাও!”

 কাসেম আর সখিনার মুখের দিকে তাকাইতে পারিলেন না, স্ত্রীর আয়তলোচনের বিষাদিত ভাব চক্ষে দেখিতে আর তাঁহার ক্ষমতা হইল না; কোমল প্রাণা সখিনার সুকোমল হস্ত ধরিয়া বারংবার চুম্বন করিয়া বিদায় লইলেন। সখিনার আশা-ভরসা যে মুহূর্ত্তে অঙ্কুরিত হইল, সেই মুহূর্ত্তেই শুকাইয়া গেল। কাসেম শিবির হইতে বাহির হইয়া এক লম্ফে অশ্বে আরোহণ পূর্ব্বক সজোরে অশ্বপৃষ্ঠে কশাঘাত করিলেন। অশ্ব বায়ুবেগে দৌড়াইয়া চলিল—সখিনা চমকিয়া উঠিলেন, তাঁহার হৃদয়ে বেদনা লাগিল।

 কাসেম সমরক্ষেত্রে যাইয়া বলিতে লাগিলেন, “যুদ্ধ-সাধ যদি কাহারও থাকে, যৌবনে যদি কাহারও অমূল্য জীবন বিড়ম্বনা জ্ঞান হইয়া থাকে, তবে কাসেমের সম্মুখে অগ্রসর হও।”

 সেনাপতি ওমর পূর্ব্ব হইতেই কাসেমকে বিশেষরূপে জানিতেন। কাসেমের তরবারি-সম্মুখে দাঁড়াইতে পারে, এমন বলবান্ বীর তাঁহার সে মধ্যে এক বর্জ্জক ভিন্ন আর কেহই ছিল না। বর্জ্জককে সম্বোধন করিয়া তিনি বলিলেন, “ভাই বর্জ্জক! হাসান-পুত্র কাসেমের সহিত যুদ্ধ করিতে আমাদের সৈন্যদল মধ্যে তুমি ভিন্ন আর কেহই নাই। ভাই, কাসেমের বলবীর্য্য, কাসেমের বলবিক্রম, কাসেমের বীরত্ব-প্রতাপ সকলই আমার জানা আছে। তাহার সম্মুখে যাহাকে পাঠাইব, সে আর শিবিরে ফিরিয়া আসিবে না। আমি নিশ্চয়ই বলিতে পারি, কোন ক্রমেই কাসেমের হস্ত হইতে সে আর রক্ষা পাইবে না। নিরর্থক সৈন্যক্ষয় করা যুক্তিসিদ্ধ নহে। আমার বিবেচনায় তুমিই কাসেম অপেক্ষা মহাবীর। তুমিই কাসেমের জীবন-প্রদীপ নির্ব্বাণ করিয়া আইস।”

 বর্জ্জক বলিলেন, “বড় ঘৃণার কথা! শামদেশে মহা মহা বীরের সম্মুখে আমি দাঁড়াইয়াছি, মিশরে প্রধান প্রধান মহারথীরা বর্জ্জকের বীরত্ব, বীর্য্য অবগত আছে, আজ পর্য্যন্ত কেহই সম্মুখযুদ্ধে অগ্রসর হইতে সাহস করে নাই; এখন কি না, এই সামান্য বালকের সহিত ওমর আমাকে যুদ্ধ করিতে আদেশ করেন, বড়ই ঘৃণার কথা! হোসেনের সম্মুখে সমরক্ষেত্রে দণ্ডায়মান হইলে বরং কথঞ্চিৎ শোভা পায়; আর এ কি না কাসেমের সহিত যুদ্ধ! বালকের সহিত সংগ্রাম! কনখও না! কখনও না! কখনও আমি কাসেমের সহিত যুদ্ধ করিতে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা দিব না।”

 ওমর বলিলেন, “তুমি কাসেমকে জান না। তাহাকে অবহেলা করিও না। তাহার তুল্য মহাবীর মদিনায় আর নাই। ভাই বর্জ্জক, তুমি ভিন্ন কাসেমের অস্ত্রাঘাত সহ্য করে এমন বীর আমাদের দলে আর কে আছে?”

 হাসিতে হাসিতে বর্জ্জক বলিলেন, “কাহাকে তুমি কি কথা বল? ক্ষুদ্র কীট, ক্ষুদ্র পতঙ্গ কাসেম, তাহার মাথা কাটিয়া আমি কি বিশ্ববিজয়ী বীরহস্ত কলঙ্কিত করিব? কখনই না—কখনই না! সিংহের সহিত সিংহের যুদ্ধ হয়, শৃগালের সহিত সিংহ কোন কালে যুদ্ধ করে, ওমর? সিংহ—শৃগাল! তুলনা করিলে তাহাও নহে। বর্জ্জক সিংহ, কাসেম একটা পতঙ্গ মাত্র। কি বিবেচনায় ওমর! কি বিবেচনায় তুমি সেই তুচ্ছ পতঙ্গ কাসেমের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করিতে পাঠাও? আচ্ছা, তোমার যদি বিশ্বাস হইয়া থাকে—কাসেম মহাবীর, তবে আমি যাইব না, আমার অমিততেজা চারি পুত্র বর্ত্তমান, তাহারা রণক্ষেত্রে গমন করুক—এখনই তাহারা কাসেমের মাথা কাটিয়া আনিবে।”

 তাহাই ওমরের তথাস্তু। আদেশমত বর্জ্জকের প্রথম পুত্র যুদ্ধে গমন করিলেন। সে যুদ্ধক্ষেত্রে বর্ষা চালাইতে আরম্ভ করিল। বিপক্ষ পরাস্ত হইল না। অবশেষে অসিযুদ্ধ। সম্মুখে কাসেম! উভয়ে মুখোমুখী হইয়া দণ্ডায়মান আছেন। বর্জ্জকের পুত্র অস্ত্র প্রয়োগ করিতেছেন, কাসেম হাস্য করিতেছেন। বর্জ্জকের পুত্রের তরবারি-সংযুক্ত বহুমূল্য মণিমুক্তা দেখিয়া সহাস্য আস্য়ে কাসেম কহিলেন, “কি চমৎকার শোভা! মণিময় অস্ত্র প্রদর্শন করিলেই যদি মহারথী হয়, তবে বল দেখি, মস্তকে মণি শোভিত কালসর্প কেন মহারথী হইবে না?”

 কথা না শুনিয়াই বর্জ্জকের পুত্র কাসেমের মস্তক লক্ষ্য করিয়া অস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন।

 অস্ত্র ব্যর্থ হইয়া গেল। পুনর্ব্বার আঘাত। কাসেমের বর্শা বিদ্ধ হইয়া বাম হস্ত হইতে শোণিতের ধারা ছুটিল। ত্রস্তহস্তে শিরস্ত্রাণ ছিন্ন করিয়া ক্ষত স্থান বন্ধনপূর্ব্বক ক্ষতযোদ্ধা পুনর্ব্বার অস্ত্রধারণ করিলেন। বর্জ্জকের পুত্র বর্শা ধারণ করিয়া বলিলেন, “কাসেম! তলোয়ার রাখ। তোমার বাম হস্তে আঘাত লাগিয়াছে। বর্ম্মধারণে তুমি অক্ষম। অসিযুদ্ধে তুমি এখন অক্ষম। বর্শা ধারণ কর, বর্শাযুদ্ধই শ্রেয়ঃ।”

 বক্তার কথা মুখে থাকিতে থাকিতে, কাসেমের বর্শা প্রতিযোদ্ধার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া পৃষ্ঠ পার হইল। বর্জ্জকের পুত্রের শোণিতাক্ত শরীর অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূতলে পড়িয়া গেল। তাহার কটিবন্ধের মহামূল্য অসি সজোরে আকর্ষণ করিয়া কাসেম বলিলেন, “কাফের! মূল্যবান্ অস্ত্রের ব্যবহার দেখ।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই বর্জ্জক-পুত্রের মস্তক যুদ্ধক্ষেত্রে ধূলিলুণ্ঠিত হইল। কাসেম বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্ম্মী কাফেরগণ! আর কাহাকে রণক্ষেত্রে কাসেমের সম্মুখে পাঠাইবি, পাঠা?”

 পাঠাইবার বেশী বিলম্ব হইল না। দেখিতে দেখিতে মহাবীর কাসেম বর্জ্জকের অপর তিন পুত্রকে শীঘ্র শীঘ্র শমনসদনে পাঠাইলেন। এইবার পুত্রশোকাতুর বর্জ্জক সেনাপতির আদেশের অপেক্ষা না করিয়া ভীমগর্জ্জনে স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা দিলেন। বীরদর্পে তিনি বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তুমি ধন্য! ক্ষণকাল অপেক্ষা কর। তুমি আমার চারিটি পুত্র নিধন করিয়াছ, তাহাতে আমার কিছুমাত্র দুঃখ নাই। কাসেম! তুমি বালক। এত যুদ্ধ করিয়া অবশ্যই ক্লান্ত হইয়াছ। সপ্তাহকাল তোমার উদরে অন্ন নাই, কণ্ঠে জলবিন্দু নাই, এ অবস্থায় তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করা কেবল বিড়ম্বনা মাত্র।”

 কাসেম বলিলেন, “বর্জ্জক! সে ভাবনা তোমায় ভাবিতে হইবে না। তুমি পুত্রশোকে যে প্রকার বিহ্বল হইয়াছ দেখিতেছি, তাহাতে তোমার পক্ষে এ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়াই বিড়ম্বনা।”

 বর্জ্জক বলিলেন, “কাসেম আমি তোমার কথা স্বীকার করি, পুত্রশোকে অতি কঠিন হৃদয়ও বিহ্বল হয়, কিন্তু পুত্রহন্তার মস্তক লাভের আশা থাকিলে—এখনই পুত্রমস্তকের পরিশোধ হইবে নিশ্চয় জানিতে পারিলে, বীরহৃদয়ের বিহ্বলতাই বা কি? দুঃখই বা কি? কাসেম বল ত, তুমি ঐ তরবারিখানি কোথায় পাইলে? ও তরবারি আমার, আমি বহু যত্নে, বহু ব্যয়ে মণিমুক্তা সংযোগে সুসজ্জিত করিয়াছি।”

 কাসেম বলিলেন, “বেশ করিয়াছ।—তাহাতে দুঃখ কি? তোমার মণিমুক্তাসজ্জিত তরবারির দ্বারা তোমারই চারি পুত্র বিনাশ করিয়াছি। নিশ্চয় বলিতেছি, তুমিও এই মূল্যবান তরবারির আঘাত হইতে বঞ্চিত হইবে না। নিশ্চয় জানিও, অন্য তরবারিতে, অন্যের হস্তে তোমার মস্তক বিচ্ছিন্ন হইবে না। আক্ষেপ করিও না, তোমার এই মহামূল্য অসি তোমারই জীবন বিনাশের নির্দ্ধারিত অস্ত্র মনে করিও।”

 বর্জ্জক মহাক্রোধে বর্ষা ঘুরাইয়া বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তোমার বাকচাতুরী এই মুহূর্ত্তেই শেষ করিতেছি। তুমিও নিশ্চয় জানিও, বর্জ্জকের হস্ত হইতে তোমার রক্ষা নাই।” এই বলিয়া বর্জ্জক সজোরে বর্শা নিক্ষেপ করিলেন। কাসেম বর্ম্ম দ্বারা বর্শাঘাত ফিরাইয়া বর্জ্জকের বক্ষঃ লক্ষ্য করিয়া বর্শা উত্তোলন করিতেই বর্জ্জক লঘুহস্তের প্রভাবে কাসেমকে পুনরায় বর্শাঘাত করিলেন। বীরবর কাসেম বিশেষ চতুরতার সহিত বর্জ্জকের বর্শা ফিরাইয়া আপন বর্শা দ্বারা বর্জ্জককে আঘাত করিলেন। উভয় বীর বহুক্ষণ বর্শাযুদ্ধ করিয়া শেষে উভয়েই তরবারি ধারণ করিলেন। তরবারির ঘাত-প্রতিঘাতে উভয়ের বর্ম্ম হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। কাসেমকে ধন্যবাদ দিয়া বর্জ্জক বলিতে লাগিলেন, “কাসেম। আমি রুম, শাম, মিশর, আরব প্রভৃতি বহু দেশে বহু যোদ্ধর তরবারিযুদ্ধ দেখিয়াছি, কিন্তু তোমার ন্যায় তরবারিধারী বীর কুত্রাপি কখনও আমার নয়নগোচর হয় নাই। ধন্য তোমার শিক্ষাকৌশল! যাহা হউক, কাসেম! এই আমার শেষ আঘাত। হয় তোমার জীবন, না হয় আমার জীবন—এই শেষ কথা বলিয়া বর্জ্জক কাসেমের শির লক্ষ্য করিয়া তরবারি আঘাত করিলেন। কাসেম সে আঘাত তাচ্ছিল্যভাবে বর্ম্মে উড়াইয়া দিয়া বর্জ্জক সরিতে না সরিতেই তাঁহার গ্রীবাদেশে অসি প্রয়োগ করিলেন। বীরবর কাসেমের আঘাতে বর্জ্জকের শির রণক্ষেত্রে গড়াইয়া পড়িল। এই ভয়াবহ ঘটনা দৃষ্টে এজিদের সৈন্যমধ্যে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল।

 বর্জ্জেকের নিপাত দর্শনে এজিদের সৈন্যমধ্যে কেহই আর সমরাঙ্গণে আসিতে সাহসী হইল না। কাসেম অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিয়া বিপক্ষদিগকে দেখিতে না পাইয়া একেবারে ফোরাত-তীরে উপস্থিত হইলেন। নদী-রক্ষকেরা কাসেমের অশ্বপদধ্বনি শ্রবণে মহা ব্যতিব্যস্ত হইয়া মহাশক্ষিত হইল। কাসেম কাহাকেও কিছু বলিলেন না। তরবারি, তীর, নেজা, বল্লম,—যাহার দ্বারা যাহাকে মারিতে সুবিধা পাইলেন, তাহারি দ্বারা তাহাকে ধরাশায়ী করিয়া ফোরাতকূল উদ্ধারের উপক্রম করিলেন। ওমর, সীমার ও আবদুল্লাহ্ প্রভৃতিরা দেখিলেন,—নদীকূলরক্ষীরা কাসেমের অস্ত্র-সম্মুখে কেহই টিঁঁকিতেছে না। ইহারা কয়েকজনে একত্র হইয়া সমর-প্রাঙ্গণের সমুদয় সৈন্যসহ কাসেমকে পশ্চাৎদিক হইতে ঘিরিয়া তাঁহার প্রতি শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। অনবরত তীর কাসেমের অঙ্গে আসিয়া বিদ্ধ হইতেছে; কাসেমের সে দিকে দৃক্‌পাত নাই; কেবল ফোরাতকূল উদ্ধার করিবেন—এই আশাতেই সম্মুখস্থ শত্রুগণকে সংহার করিতেছেন। কাসেমের শ্বেতবর্ণ অশ্ব তীরাঘাতে রক্তধারায় লােহিতবর্ণ হইয়াছে। শােণিতধারা অশ্বপদ বহিয়া মৃত্তিকা রঞ্জিত করিতেছে। ক্রমেই কাসেম নিস্তেজ হইতেছেন;—শােণিতপ্রবাহে চতুর্দ্দিকেই অন্ধকার দেখিতেছেন, শেষে নিরুপায় হইয়া অশ্ববল্গা ছাড়িয়া দিলেন। শিক্ষিত অশ্ব কাসেমের শরীরের অবসন্নতা বুঝিতে পারিয়া দ্রুতপদে শিবির-সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; হাস্‌নেবানু ও সখিনা শিবিরমধ্য হইতে অশ্বপদধ্বনি শুনিতে পাইয়া বাহিরে আসিয়া দেখিলেন: কাসেমের পরিহিত শুভ্রবসন লােহিতবর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে, শােণিতধারা অশ্বপদ বহিয়া পড়িতেছে। কাসেম অশ্ব হইতে নামিয়া সখিনাকে বলিলেন, “সখিনা! দেখ, তােমার স্বামীর শাহানা[১] পােষাক দেখ। আজ বিবাহ-সময়ে উপযুক্ত পরিচ্ছদে তােমাকে বিবাহ করি নাই, কাসেমের দেহবিনির্গত শােণিতধারে শুভ্রবসন লােহিত বর্ণে পরিণত হইয়া বিবাহবেশ সম্পূর্ণ করিয়াছে! এই বেশ তােমাকে দেখাইবার জন্যই বহু কষ্টে শত্রুদল ভেদ করিয়া এখানে আসিয়াছি। আইস, এই বেশে তােমাকে আলিঙ্গন করিয়া প্রাণ শীতল করি। সখিনা! আইস, এই বেশেই আমার মানসের চিরপিপাসা নিবারণ করি।”

 কাসেম এই কথা বলিয়াই সখিনাকে আলিঙ্গন করিবার নিমিত্ত হস্ত প্রসারণ করিলেন। সখিনাও অগ্রবর্ত্তিনী হইয়া স্বামীকে আলিঙ্গন করিলেন। কাসেমের দেহবিনির্গত শোণিত-প্রবাহে সখিনার পরিহিত বস্ত্র বক্তবর্ণ হইল। কাসেম সখিনার গলদেশে বাহু বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন—নিজ বশে আর দাঁড়াইবার শক্তি নাই, শরাঘাতে সমুদয় অঙ্গ জরজর হইয়া সহস্র পথে শোণিতধারা শরীর বহিয়া মৃত্তিকায় পড়িতেছে। সজ্জিত মস্তক ক্রমশঃই সখিনার স্কন্ধদেশে নত হইয়া আসিতে লাগিল। সখিনার বিষাদিত বদন নিরীক্ষণ করা কাসেমের অসহ্য হইল বলিয়াই তাঁহার চক্ষু দুইটি নীল বর্ণ ধারণ করিয়া ক্রমেই বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। সে সময়েও কাসেম বলিলেন, “সখিনা! নব অনুরাগে পরিণয়-সূত্রে তোমারি প্রণয়-পুষ্পহার কাসেম আজ গলায় পরিয়াছিল; বিধাতা আজই সে-হার ছিন্ন করিয়া ফেলিলেন। জগতে তোমাকে ছাড়িয়া যাইতেছি; দৈহিক সম্বন্ধ-গ্রন্থি ছিঁড়িয়া গেল; কিন্তু সখিনা! সে জন্য তুমি ভাবিও না— কেয়ামতে অবশ্যই দেখা হইবে। সখিনা! নিশ্চয় জানিও, ইহা আর কিছুই নহে, কেবল অগ্রপশ্চাৎ মাত্র। ঐ দেখ, আমার পিতা অমরপুরীর সুবাসিত শীতল জলপূর্ণ মণিময় সোরাহী-হস্তে আমার পিপাসার শান্তির জন্য দাঁড়াইয়া আছেন! আমি চলিলাম।”

 কাসেমের চক্ষু একেবারে বন্ধ হইল!—প্রাণবিহঙ্গ দেহপিঞ্জর হইতে অনন্ত আকাশে উড়িয়া হাসানের নিকট চলিয়া গেল। শূন্যদেহ সখিনার দেহযষ্টি হইতে স্থলিত হইয়া ধরাতলে পতিত হইল। প্রবাসীরা সকলেই কাসেমের মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন।

 সখিনা সামীর মৃতদেহ অঙ্গে ধারণ করিয়া করুণ স্বরে বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! একবার চাহিয়া দেখ, তোমার সখিনা এখনও সেই বিবাহ-বেশ পরিয়া রহিয়াছে। কেশগুচ্ছ যে ভাবে দেখিয়াছিলে, এখনও সেইভাবে রহিয়াছে। তাহার একগাছিও স্থানভ্রষ্ট হয় নাই। লোহিত বসন পরিধান করিয়া বিবাহ হয় নাই; প্রাণেশ্বর! তাই আপন শরীরের রক্তধারে সেই বসন রঞ্জিত করিয়া দেখাইলে! আমি আর কি করিব? জীবিতেশ! জগতে সখিনা বাঁচিয়া থাকিতে তোমার দেহবিনির্গত শোণিত বিন্দু সে মৃত্তিকাসংলগ্ন হইতে দিবে না।” এই বলিয়া কাসেমের দেহবিনির্গত শোণিতবিন্দু সখিনা সমুদয় অঙ্গে মাখিতে লাগিলেন; মাখিতে মাখিতে কহিতে লাগিলেন, “বিবাহ-সময়ে এই হস্তদ্বয় মেহেদী দ্বারা সুরঞ্জিত হয় নাই—একবার চাহিয়া দেখ!—কাসেম! একবার চাহিয়া দেখ! তোমার সখিনার হস্ত তোমারি রক্ত-ধারে কেমন শোভিত হইয়াছে। জীবিতেশ্বর। তোমারি এই পবিত্র রক্ত মাখিয়া সখিনা চিরজীবন এই বেশেই থাকিবে। যুদ্ধজয়ী হইয়া আজ বাসর-শয্যায় শয়ন করিবে বলিয়াছিলে, সে সময় ত প্রায় আগত;—তবে ধূলিশয্যায় শয়ন কেন হৃদয়েশ?—বিধাতা! আজই সংসার-ধর্ম্মের মুখ দেখাইলে, আজই সংসারী করিলে, আবার আজই সমস্ত সুখ মিটাইলে —দিন এখনও রহিয়াছে; সে দিন অবসান না হইতেই সখিনার এই দশা করিলে! যে সূর্য্য সখিনার বিবাহ দেখিল, সেই সূর্য্যই সখিনার বৈধব্য-দশা দেখিয়া চলিল! সূর্য্যদেব! যাও, সখিনার দুর্দ্দশা দেখিয়া যাও। সৃষ্টিকাল হইতে আজ পর্য্যন্ত প্রতিদিন তুমি কত ঘটনা, কত কার্য্য, কত সুখ, কত দুঃখ দেখিয়াছ, কিন্তু দিবাকর! এমন ‘হরিষে বিষাদ’ কখনও কি দর্শন করিয়াছ?—সখিনার তুল্য দুঃখিনী কখনও কি তোমার চক্ষে পড়িয়াছে? যাও সূর্য্যদেব! সখিনার সদ্যবৈধব্য দেখিয়া যাও!”

 সখিনা এইরূপ নানা প্রকার বিলাপ করিতে করিতে অস্থির হইয়া পড়িলেন। কাসেমের অবস্থা দর্শনে হোসেন একেবারে অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিলেন; কিঞ্চিৎ পরে সংজ্ঞা পাইয়া বলিতে লাগিলেন, “কাসেম! তুমি আমার কুল-প্রদীপ, তুমি আমার বংশের উজ্জ্বল মণি, তুমিই আমার মদিনার ভাবী রাজা,—আমার অবর্ত্তমানে তোমার শিরেই রাজমুকুট শোভা পাইত। বৎস! তোমার বীরত্বে—তোমার অস্ত্র-প্রভাবে মদিনাবাসীরা সকলেই বিমুগ্ধ! আরবের মহা মহা যোদ্ধাগণ তোমার নিকট পরাস্ত; তুমি আজ কাহার ভয়ে রণক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিয়া লোহিত বসনে নিস্পন্দভাবে ধরাশায়ী হইয়া রহিলে? প্রাণাধিক!— বীরেন্দ্র! ঐ শুন, শত্রুদল রণবাদ্য বাজাইতেছে। তুমি সমরাঙ্গণ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছ বলিয়া তোমাকে তাহারা ধিক্কার দিতেছে। কাসেম! গাত্রোত্থান কর,—তরবারি ধারণ কর। ঐ দেখ, তোমার প্রিয় অশ্ব ক্ষতবিক্ষত শরীরে শোণিতাক্ত কলেবরে তোমাকে ধরাশায়ী দেখিয়া অবিশ্রান্ত অশ্রুবর্ষণ করিতেছে! শরাঘাতে তাহার শ্বেতকান্তি পরিবর্ত্তিত হইয়া শোণিতধারায় লোহিতবর্ণ ধারণ করিয়াছে; তথাপি রণক্ষেত্রে যাইবার জন্য উৎসাহের সহিত তোমারই দিকে চাহিয়া রহিয়াছে, সম্মুখস্থ পদ দ্বারা মৃত্তিকা উৎক্ষিপ্ত করিতেছে। কাসেম! একবার চক্ষু মেলিয়া দেখ, তোমার প্রিয়তম অশ্বের অবস্থা একবার চাহিয়া দেখ! কাসেম! আজ আমি তোমার বিবাহ দিয়াছি। যাহার সঙ্গে কোন দিন কোন সম্বন্ধ ছিল না, পরিচয় ছিল না, প্রণয় ছিল না, এমন কোন কন্যা আনিয়া তোমাকে সমর্পণ করি নাই; আমার হৃদয়ের ধনকেই তোমার হস্তে দিয়াছি। তোমারই পিতৃ-আদেশে সখিনাকে তোমার হস্তে সমর্পণ করিয়াছি।”

 হাসানকে উদ্দেশ করিয়া হোসেন অতি কাতরস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতঃ। জগৎ পরিত্যাগের দিন ভাল উপদেশ দিয়া গিয়াছিলে। যে দিন বিবাহ, সেই দিনই সর্ব্বনাশ! যদি ইহাই জানিয়াছিলে, যদি সখিনার অদৃষ্টলিপির মর্ম্ম বুঝিতে পারিয়াছিলে, তবে কাসেমের সঙ্গে সখিনার বিবাহের উপদেশ কেন দিয়াছিলে, ভাই!—তুমি ত স্বর্গসুখে রহিয়াছ, এ সর্ব্বনাশ একবার চক্ষেও দেখিলে না—এই অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে বলিয়াই অগ্রে চলিয়া গেলে। ভাই! মৃতুসময় তোমার যত্নের রত্ন হৃদয়ের অমুল্য মণি কাসেমকে আমার হাতে দিয়া গিয়াছিলে; আমি এমনই হতভাগ্য যে, সেই অমূল্য নিধিটি রক্ষা করিতে পারিলাম না। আর কি বলিব? তোমার প্রাণাধিক পুত্র কাসেম এক বিন্দু জলের প্রত্যাশায় শত্রুহস্তে প্রাণ হারাইল! কাসেম বিন্দুমাত্র জল পাইলে এজিদের সৈন্যের নাম মাত্র অবশিষ্ট থাকিত না; তাহাদের দেহ-সমষ্টি শোণিত প্রবাহের সহিত ফোরাত-প্রবাহে ভাসিয়া কোথায় চলিয়া যাইত তাহার সন্ধানও রহিত না! আর সহ্য হয় না! সখিনার মুখের দিকে আর চাহিতে পারি না। কৈ আমার অস্ত্র শস্ত্র কোথায়? কাসেমের শোকাগ্নি আজ শত্রুশোণিতে পরিণত হউক। সখিনার বৈধব্যসূচক চিরশুভ্রবসন শোণিতে রঞ্জিত করিয়া চিরকাল সধবার চিহ্নে রাখিব; কৈ আমার বর্ম্ম কোথায়? কৈ আমার শিরস্ত্রাণ কোথায়? (জোরে উঠিয়া) কৈ, আমার অর্থ কোথায়? এখনই অন্তর-জ্বালা নিবারণ করি।—শত্রু বধ করিয়া কাসেমের শোক ভুলিয়া যাই!” পাগলের মত এই সকল কথা বলিয়া হোসেন যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হইতে চলিলেন।

 হোসেনের পুত্র আলী আক্‌বর করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “পিতঃ! এখনও আমরা চারি ভ্রাতা বর্ত্তমান। যদিও আমরা শিশু, তথাপি মরণে ভয় করি না। আমরা বর্ত্তমান থাকিতে আপনি অস্ত্র ধারণ করিবেন? আমাদের বাঁচিবার আশা ত একরূপ শেষই হইয়াছে। জল-পিপাসায়, আত্মীয়স্বজনের শোকাগ্নি-উত্তাপে জিহ্বা, কণ্ঠ, বক্ষ, উদর সকলই ত শুষ্ক হইয়াছে; এরূপ অবস্থায় আর কয় দিন বাঁচিব? নিশ্চয়ই মরিতে হইবে। বীর পুরুষের ন্যায় মরাই শ্রেয়ঃ। স্ত্রীলোকের ন্যায় কাঁদিয়া মরিব না।” এই কথা বলিয়া পিতৃচরণে প্রণাম করিয়া আলী আক্‌বর অশ্বে আরোহণ করিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যাইয়া দ্বৈরথ যুদ্ধে কাহাকেও আহ্বান না করিয়া তিনি একেবারে ফোরাতকূল-রক্ষকদিগের প্রতি অস্ত্রবর্ষণ করিতে লাগিলেন। রক্ষীরা ফোরাতকূল ছাড়িয়া পলাইতে আরম্ভ করিল। এজিদের সৈন্যমধ্যে মহাহুলস্থূল পড়িয়া গেল। আলী আক্‌বর যেমন বলবান্, তেমনই রূপবান্ ছিলেন। আলী আক্‌বরের সুদৃশ্য রূপলাবণ্যের প্রতি যাহার চক্ষু পড়িল, তাহার অস্ত্র আর তাঁহার প্রতি আঘাত করিতে উঠিল না। যে দেখিল, সেই-ই আক্‌বরের রূপে মোহিত হইয়া তৎপ্রতি অস্ত্রচালনায় বিরত হইল। অস্ত্রচালনা দূরে থাকুক,—পিপাসায় আক্রান্ত, শীঘ্রই মৃত্যু হইবে, এই ভাবিয়াই অনেক বিধর্ম্মী দুঃখ করিতে লাগিল। আলী আক্‌বর বীরত্বের সহিত নদীকূলরক্ষীদিগকে তাড়াইয়া অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই ভাবিতেছেন: কি করি! সমুদয় শত্রু শেষ করিতে পারিলাম না! যাহারা পলাইতে অবসর পাইল না তাহারাই সম্মুখে দাঁড়াইল। ঐশ্বরী মায়ায় তাহাদের পরমায়ুও শেষ হইল। কিন্তু অধিকাংশ রক্ষীরাই প্রাণভয়ে নদীকূল ছাড়িয়া জঙ্গলে পলাইল। আমি এখন কি করি।’

 ঈশ্বরের মায়া বুঝিতে মানুষের সাধ্যমাত্র নাই। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ তাঁহার লক্ষাধিক সৈন্য় লইয়া সেই সময়েই ফোরাত-তীরে আসিয়া আলী আক্‌বরকে ঘিরিয়া ফেলিলেন। তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। জেয়াদের সৈন্য আলী আক্‌বরের তরবারির সম্মুখে শ্রেণীবদ্ধরূপে পড়িয়া যাইতে লাগিল। এ পর্যন্ত আলী আক্‌বরের অঙ্গে শত্রুপক্ষের কোন অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে পারে নাই; কিন্তু আলী তাঁর সাধ্যানুসারে বিধর্ম্মীমস্তক নিপাত করিয়াও শেষ করিতে পারিলেন না। যাহারা পলাইয়ছিল, তাহারাও জেয়াদের সৈন্যের সহিত যোগ দিয়া আলী আক্‌বরের বিরুদ্ধে দাঁড়াইল। আক্‌বর সৈন্যচক্র ভেদ করিয়া দ্রুতগতিতে শিবিরে আসিলেন; পিতার সম্মুখীন হইয়া বলিতে লাগিলেন, “ফোরাতকূল উদ্ধার হইত; কিন্তু কুফা হইতে আবদুল্লাহ্ জেয়াদ লক্ষাধিক সৈন্য লইয়া এজিদের সৈন্যের সাহায্যার্থে পুনরায় নদীতীর বন্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে। যে উপায়েই হউক, আমাকে এক পাত্র জল দিন, আমি এখনই জেয়াদকে সৈন্যসহ শমনভবনে প্রেরণ করিয়া আসি। এই দেখুন, আমার তরবারি কাফের-শোণিতে রঞ্জিত হইয়াছে। ঈশ্বরকৃপায় এবং আপনার আশীর্ব্বাদে আমার অঙ্গ কেহ এ পর্য্যন্ত একটিও আঘাত করিতে পারে নাই। কিন্তু পিপাসায় প্রাণ যায়।”

 হোসেন বলিলেন, “আক্‌বর, আজ দশ দিন কেবল চক্ষের জল ব্যতীত এক বিন্দু জল চক্ষে দেখি নাই। সেই চক্ষের জলও শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। জল কোথায় পাইব বাপ্?”

 আলী আক্‌বর বলিলেন, “আমার প্রাণ যায়, আর বাঁচি না!”—এই বলিয়া পিপাসার্ত্ত আলী আক্‌বর ভূমিতলে শয়ন করিলেন। হোসেন বলিতে লাগিলেন, “হে ঈশ্বর। জলে মানব-জীবন রক্ষা হইবে বলিয়া জলের নাম তুমি দিয়াছ ‘জীবন’!—জগদীশ্বর! সেই জীবন আজ দুর্ল্লভ। জগৎ-জীবন! সেই জীবনের জন্য মানব-জীবন আজ লালায়িত। কার কাছে জীবন ভিক্ষা করি দয়াময়? আশুতোষ! তোমার জগৎ-জীবন নামের কৃপায় শিশু কেন বঞ্চিত হইবে, জগদীশ?—করুণাময়। তুমি জগৎ সৃষ্টি করিয়াছ। ভূগোলে বলে, স্থলভাগের অপেক্ষা জলভাগই অধিক। আমরা এমনই পাপী যে, জগতের অধিকাংশ পরিমাণ যে জল, যাহা পশু পক্ষীরাও অনায়াসে লাভ করিতেছে, তাহা হইতেও বঞ্চিত হইলাম! ষষ্টি সহস্র লোকের প্রাণ বোধ হয়, এই জলের জন্যই বিনাশ হইল! দয়াময়! সকলই তোমার মহিমা!”

 আলী আক্‌বরের নিকটে যাইয়া হোসেন বলিলেন, “আক্‌বর। তুমি আমার এই জিহ্বা আপন মুখের মধ্যে দিয়া একটু শান্তিলাভ কর। জিহ্বাতে যে রস আছে, উহাতে যদি তোমার পিপাসার কিছু শাস্তি হয়, দেখ।—বাপ! অন্য জলের আশা আর করিও না।”

 আলী আক্‌বর পিতার জিহ্বা মুখের মধ্যে রাখিয়া কিঞ্চিৎ পরেই বলিলেন, “প্রাণ শীতল হইল, পিপাসা দূর হইল। ঈশ্বরের নাম করিয়া আবার চলিলাম।”

 এই বলিয়া আলী আক্‌বর পুনরায় অশ্বে আরোহণ পূর্ব্বক সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বহু শত্রু নিপাত করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে জেয়াদ এবং ওমর প্রভৃতি পরামর্শ করিলেন, আলী আক্‌বর আর ক্ষণকাল এইরূপ যুদ্ধ করিলেই আমাদিগকে এক প্রকার শেষ করিবে। আলী আক্‌বরকে যে কোন উপায়েই হউক, বিনাশ করিতে হইবে। সম্মুখযুদ্ধে আক্‌বরের নিকট অগ্রসর হইয়া কেহই জয়লাভ করিতে পারিবে না। এস, দূর হইতে গুপ্তভাবে আমরা কয়েকজন উহাকে লক্ষ্য করিয়া বিষাক্ত শর সন্ধান করি, অবশ্যই কাহারও না কাহারও শর আক্‌বরের বক্ষ ভেদ করিবেই করিবে।” এই বলিয়াই প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষেরা বহুদূর হইতে শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন! আলী আক্‌বর কাফেরবধে একেবারে জ্ঞানশূন্য হইয়া মাতিয়া গিয়াছেন। শরসন্ধানীরা শর নিক্ষেপ করিতেছে। একটি বিষাক্ত শর আলী আক্‌বরকে বক্ষে বিদ্ধ করিয়া পৃষ্ঠদেশ পার হইয়া গেল। আলী আক্‌বর সমুদয় জগৎ অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার পিপাসাও অধিকতর বৃদ্ধি পাইল। জলের জন্য তিনি কাতরস্বরে বারবার পিতাকে ডাকিতে লাগিলেন। সম্মুখে তিনি যেন দেখিতে পাইলেন, তাঁহার পিতৃব্য জলপাত্র হস্তে করিয়া বলিতেছেন, “আক্‌বর! শীঘ্র আইস! আমি তোমার জন্য সুশীতল পবিত্র বারি লইয়া দণ্ডায়মান আছি।” আলী আক্‌বর জলপান করিতে যাইতেছিলেন, পিপাসায় তাহার কণ্ঠ শুষ্ক হইতেছিল; কিন্তু তত দূর পর্যন্ত যাইতে হইল না, জল পিপাসার শান্তি করিতেও হইল না, জন্মের মত জীবন-পিপাসা ফুরাইয়া গেল। আলী আক্‌বর অশ্ব হইতে পড়িয়া গেলেন। তাঁহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইল—শূন্যপৃষ্ঠ অশ্ব শিবিরাভিমুখে দৌড়িল। অশ্বপৃষ্ঠ শূন্য দেখিয়া আলী আক্‌বরের ভ্রাতৃদ্বয়-আলী আস্‌গর ও আবদুল্লাহ ভ্রাতৃশোকে শোকাকুল হইলেন।তিলার্দ্ধকালও বিলম্ব না করিয়া, জিজ্ঞাসা কি অনুমতির অপেক্ষা না রাখিয়া, তাঁহার দুই ভ্রাতা দুইটি অশ্বারোহণে শত্রুসম্মুখীন হইলেন। ক্ষণকাল মহাপরাক্রমে বহু শত্রু বিনাশ করিয়া তাহারা রণস্থলে বিধর্ম্মীহস্তে শহীদ হইলেন। যুগল অশ্ব শূন্যপৃষ্ঠে শিবিরাভিমুখে ছুটিল। অশ্বপৃষ্ঠে পুত্রদ্বয়কে না দেখিয়া হোসেন আহত সিংহের ন্যায় গর্জ্জিয়া উঠিলেন, বলিলেন, “এখনও কি আমি বসিয়া থাকিব? এ সময়েও কি শক্রনিপাতে অস্ত্রধারণ করিব না? পুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র—সকলেই শেষ হইল, আমি কেবল বসিয়া দেখিতেছি। আমার মত কঠিন প্রাণ জগতে কি আর কাহারও আছে?”

 হোসেনের কনিষ্ঠ সন্তান জয়নাল আবেদীন ভ্রাতৃশোকে অধীর হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে শিবির হইতে দৌড়িয়া বাহির হইলেন। হোসেন পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়িয়া গিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিলেন; অনেক প্রবোধ দিয়া বুঝাইতে লাগিলেন। তাঁহার মুখে শত শত চুম্বন দিয়া তাহাকে ক্রোড়ে লইয়া শাহেরবানুর নিকট আসিয়া তিনি বলিলেন, “জয়নাল যদি শত্রু-হস্তে প্রাণত্যাগ করে, তবে মাতামহের বংশ জগৎ হইতে একেবারে নির্ম্মুল হইবে, সৈয়দ নাম আর ইহজগতে থাকিবে না। কেয়ামতের দিন পিতা এবং মাতামহের নিকট কি উত্তর করিব? তোমরা জয়নালকে সাবধানে রক্ষা কর; সর্বদাই চক্ষে চক্ষে রাখ। কোনক্রমেই ইহাকে শিবিরের বাহির হইতে দিও না।”

 হোসেন কাহারও জন্য আর দুঃখ করিলেন না। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আকাশ পানে তাকাইয়া দুই হস্ত তুলিয়া বলিতে লাগিলেন, “দয়াময়। তুমি অগতির গতি, তুমি সর্ব্বশক্তিমান, তুমি বিপদের কাণ্ডারী, তুমি অনুগ্রাহক, তুমিই সর্ব্বরক্ষক। প্রভো! তোমার মহিমায় অনন্ত জগতের সৃষ্টি হইয়াছে! দানব, মানব, পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, তরু, তৃণ, কীটাণু এবং পরমাণু পর্য্যন্ত স্থাবর-জঙ্গম সমস্ত চরাচর তোমার গুণগান করিতেছে। তুমি মহান, তুমি সর্ব্বত্রব্যাপী, তুমিই স্রষ্টা, তুমিই সর্ব্বকর্ত্তা, তুমিই সর্ব্ববপালক, তুমিই সর্ব্বসংহারক। দয়াময়। জগতে যে দিকেই নেত্রপাত করি, সেই দিকেই তোমার করুণ এবং দয়ার আদর্শ দেখিতে পাই। কি কারণে-কি অপরাধে আবার এই দুর্দ্দশা হইল বুঝিতে পারি না। বিধর্মী এজিদ আমাকে সর্ব্বস্বান্ত করিয়া একেবারে নিঃশেষ করিল, একেবারে বংশ নাশ করিল। দয়াময়! তুমি কি ইহার বিচার করিবে না?”

 হোসেন শূন্যপথে যাহা দেখিলেন, তাহাতে অমনি চক্ষু বন্ধ করিয়া ফেলিলেন—আর কোন কথাই কহিলেন না; ঈশ্বরের উদ্দেশে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিয়া কৃতজ্ঞতার সহিত উপাসনা করিলেন। উপাসনা শেষ করিয়া তিনি সমরসজ্জায় প্রবৃত্ত হইলেন।

 মণিময় হীরকখচিত স্বর্ণমণ্ডিত বহুমূল্য সুসজ্জায় সে সজ্জা নহে। হোসেন যে সাজ আজ অঙ্গে ধারণ করিলেন, তাহা পবিত্র ও অমূল্য। যাহা ঈশ্বর-প্রসাদাৎ হস্তগত না হইলে জগতের সমুদয় ধন দিয়াও হস্তগত হইবার উপায় নাই, জীবনান্ত পর্য্যন্ত চেষ্টা বা যত্ন করিলেও যে সকল অমূল্য পবিত্র পরিচ্ছদ-লাভে কাহারও ক্ষমতা নাই, হোসেন আজ সেই বসন-ভূষণ পরিধান করিলেন। প্রভু মোহাম্মদের শিরস্ত্রাণ, হজরত আলীর কবচ, হজরত দাউদ পয়গম্বরের কোমরবন্ধ, মহাত্মা সাহাব পয়গম্বরের মোজা,—এই সকল পবিত্র পরিচ্ছদ অঙ্গে ধারণ করিয়া তিনি যুদ্ধের আর আর উপকরণে সজ্জিত হইলেন। রণবেশে সুসজ্জিত হইয়া এমাম হোসেন শিবিরের বাহিরে দাঁড়াইলে স্ত্রীকন্যা, পরিজন সকলেই নির্ব্বাকে কাঁদিয়া তাহার পদলুণ্ঠিত হইতে লাগিলেন। উচ্চরবে কাঁদিবার কাহারও শক্তি নাই। কত কাঁদিতেছেন, কত দুঃখ করিতেছেন, এক্ষণে প্রায় সকলেরই কণ্ঠস্বর বন্ধ হইয়া যাইতেছে। এমাম হোসেন সকলকেই সবিনয় মিষ্টবাক্যে একটু আশ্বস্ত করিয়া এই কথাগুলি বলিতে লাগিলেন, এবং পরিজনের এমামের সম্মুখে দাঁড়াইয়া শুনিতে লাগিলেন:—“মদিনা পরিত্যাগ করিয়া আমার কুফায় আগমন-সঙ্কল্প তোমাদের অজানা কিছুই নাই। তোমরা আমার শরীরের এক এক অংশ। তোমাদের দুঃখ দেখিয়া আমার প্রাণ এতক্ষণ যে কেন আছে, তাহা আমি জানি না!”

 সকলে সেই একই প্রকার অব্যক্ত হুহু স্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। এমাম পুনর্বার বলিতে লাগিলেন, “ইহাতে নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, ঈশ্বরের কোন আজ্ঞা আমার দ্বারা সাধিত হইবে, মাতামহের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইবে। আমি ঈশ্বরের দাস, ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্য্য করিতে আমি বাধ্য। সেই কার্য্য সাধনে আমি সন্তোষের সহিত সম্মত আছি। জন্মিলেই মানুষকে মরিতে হইবে, তবে সেই দয়াময় কি অবস্থায় কখন কাহাকে কালের করাল গ্রাসে প্রেরণ করেন, তাহা তিনিই জানেন! ইহাও সত্য যে, এজিদের আদেশ-ক্রমে তাহার সৈন্যগণ আমাদের পিপসাশান্তির আশাপথ একেবারে বন্ধ করিয়াছে। জল-বিহনে জীবনশক্তি কয়দিন জীবনে থাকে? জলই মানুষের একমাত্র জীবন। এই অবস্থাতে শিবিরে বসিয়া কাদিলে আর কি হইবে?—পুত্রগণ, মিত্রগণ এবং অন্যান্য হৃদয়ের বন্ধুগণ যাঁহারা আজ প্রভাত হইতে এই সময়ের মধ্যে বিধর্ম্মীহস্তে শহীদ হইয়াছেন, তাহাদের জন্য নীরবে বসিয়া কাঁদিলে আর কি হইবে? আজ না হয় কাল এই পিপাসাতেই সকলকে মরিতে হইবে।”

 আবার সকলে নীরবে হুহু করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। এমাম আবার বলিতে লাগিলেন, “যদি নিশ্চয়ই মরিতে হইবে, তবে বীরপুরুষের ন্যায় মরিব। আমি হজরত আলীর পুত্র, মহাবীর হাসানের ভ্রাতা; আমি কি স্ত্রীলোকের সঙ্গী হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মরিব? তাহা কখনই হইবে না। পুত্র-মিত্রগণের অকাল মৃত্যুজনিত শোকের যাতনা শত্রুবিনাশে নিবারণ করিয়া প্রাণত্যাগ করিব। আজ কারবালা প্রান্তরে মহানদী, মহানদী কেন—ঐ শোকে মহাসমুদ্রস্রোত মহারক্তস্রোত বহাইয়া প্রাণত্যাগ করিব। জগৎ দেখিবে, বৃক্ষপত্র দেখিবে, আকাশ দেখিবে, আকাশের চন্দ্র-সূর্য্য দেখিবে,—হোসেনের ধৈর্য্য, শান্তি, বীর্য্য ও প্রতাপ কত দূর।—আজ এই সূর্য্যকেই আদি, মধ্য, শেষ,—তাহার পরেও যদি কিছু থাকে, তাহাও দেখাইব। তোমরা আমার অন্য কেহ কাঁদিও না। যদি এই যাত্রাই এ জীবনের শেষ যাত্রা হয়, বার বার বলিতেছি, আর যুদ্ধ করিও না; আর কোন প্রাণীকেও যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাইও না; জয়নাবকে মুহূর্ত্তের জন্য হাতছাড়া করিও না। আমি তোমাদিগকে সেই দয়াময় বিপত্তারণ জগৎকারণ জগদীশ্বরের চরণে সমর্পণ করিলাম,তিনি সকলকেই রক্ষা করিবেন। আমি প্রার্থনা করিতেছি, তোমরাও কায়মনে সেই জগৎপিতার সমীপে প্রার্থনা কর, শত্রু বিনাশ করিয়া তোমাদিগকে যেন উদ্ধার করিতে পারি।”

 পৌরজনমাত্রেই দুই হাত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন: “হে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডেশ্বর! আমাদিগকে আজ এই ঘোর বিপদ হইতে উদ্ধার কর! হে পরম কারুণিক পরমেশ্বর! আমাদিগকে দুরন্ত এজিদের দৌরাত্ম হইতে রক্ষা কর। হোসেন বলিতে লাগিলেন, “যদি তোমাদের সঙ্গে আমার এই দেখাই শেষ দেখা হয়, তবে তোমরা কেহই আমার জন্য দুঃখ করিও না—ঈশ্বরের নিন্দা করিও না। আমার মরণে তোমাদেরই মঙ্গল। আমি মরিলে অবশ্যই তোমরা সুখী হইবে, আমিই তোমাদের কষ্টের এবং দুঃখের কারণ ছিলাম।”

 পরিজনকে এই পর্য্যন্ত বলিয়া জয়নালকে ক্রোড়ে লইয়া হোসেন তাঁহাকে বলিতে লাগিলেন: “আমি বিদায় লইলাম, আমার জন্য কাঁদিও না। কেয়ামতে আমার সঙ্গে অবশ্যই দেখা হইবে। তুমি তোমার মায়ের নিকট থাকিও; কখনই শিবিরের বাহির হইও না, এজিদ তোমাদের কিছুই করিতে পারিবে না।”

 জয়নালের মুখচুম্বনপূর্ব্বক তাহাকে শাহ্‌রেবানুর ক্রোড়ে দিয়া সখিনাকে সম্বোধনপূর্ব্বক হোসেন বলিলেন, “মা, আমি এক্ষণে বিদায় লইলাম। কাসেমের সংবাদ আনিতে যাই। আর দুঃখ করিও না, ঈশ্বর তোমাদের দুঃখ দূর করিবেন। আর একটি বীরপুরুষ হনুফা নগরে এখনও বর্ত্তমান আছেন। যদি কোন প্রকারে এই লোমহর্ষণ সংবাদ তাহার কর্ণগোচর হয়, প্রাণান্ত না হওয়া পর্য্যন্ত তিনি তোমাদের এই কষ্টের প্রতিশোধ লইতে কখনই পরাঙ্মূখ হইবেন না; কখনই এজিদকে ছাড়িবেন না;—হয় তোমাদিগকে উদ্ধার করিবেন, নয় এজিদের হস্তে প্রাণত্যাগ করিবেন।”

 সখিনাকে এইরূপে প্রবোধ প্রদানপূর্ব্বক অবশেষে শাহ্‌রেবানুর হস্ত ধরিয়া রণবেশী রণযাত্রী পুনরায় বলিলেন, “বোধ হয় আমার সঙ্গে এই তোমার শেষ দেখা। শাহ্‌রেবানু! মায়াময় সংসারের দশাই এইরূপ, তবে অগ্রপশ্চাৎ—এইমাত্র প্রভেদ;—ঈশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া জয়নালকে সাবধানে রাখিও। আমার আর কোন কথা নাই—চলিলাম।”

 শিবিরের বাহিরে আসিয়া এমাম হোসেন অশ্বে আরোহণ করিলেন। ওদিকে শিবিরমধ্যে পরিজনেরা এক প্রকার বিকৃত স্বরে ‘হায় হায়’ রবে ধূলায় গড়াগড়ি যাইতে লাগিলেন।

  1. লাল পোষাক