বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/চতুর্বিংশ প্রবাহ

চতুর্বিংশ প্রবাহ

 হােসেন সপরিবারে ষষ্টি সহস্র সৈন্য লইয়া নির্ব্বিঘ্নে কুফায় যাইতেছেন। কিন্তু এত দিন যাইতেছেন, কুফার পথের কোন চিহ্নই দেখিতে পাইতেছেন না। একদিন হোসেনের অশ্বপদ মৃত্তিকায় দাবিয়া গেল। ঘােড়ার পায়ের খুর মৃত্তিকার মধ্যে প্রবেশ করিয়া যাইতে লাগিল। কারণ কি? এইরূপ কেন হইল? কারণ অনুসন্ধান করিতে করিতে হঠাৎ প্রভু মােহাম্মদের ভবিষ্যদ্বাণী হােসেনের মনে পড়িল। নির্ভীক হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হইল, অঙ্গ শিহরিয়া উঠিল! হােসেন গণনা করিয়া দেখিলেন, আজ মহর্‌রম মাসের ৮ই তারিখ। তাহাতে আরও ভয়ে ভয়ে অশ্বে কশাঘাত করিয়া কিঞ্চিৎ অগ্রে গিয়া তিনি দেখিলেন যে, এক পার্শ্বে ঘাের অরণ্য, সম্মুখে বিস্তৃত প্রান্তর। চক্ষুনির্দ্দিষ্ট সীমামধ্যে মানব কিম্বা—জীব-জন্তুর নাম মাত্র নাই; আতপ-তাপ নিবারণােপযােগী কোন প্রকার বৃক্ষও নাই, কেবল প্রান্তর—মহাপ্রান্তর। প্রান্তর-সীমা যেন গগনের সহিত সংলগ্ন হইয়া ধূ ধূ করিতেছে! চতুর্দ্দিকে যেন প্রকৃতির স্বাভাবিক স্বরে আক্ষেপ “হায়! হায়!” শব্দ উত্থিত হইয়া নিদারুণ দুঃখ প্রকাশ করিতেছে। জনপ্রাণীর নামমাত্র নাই, কে কোথা হইতে করিতেছে, তাহাও জানিবার উপায় নাই। বােধ হইল, যেন শূন্যপথে শত সহস্র মুখে “হায়! হায়!” শব্দ চতুর্দ্দিক আকুল করিয়া তুলিয়াছে।

 হােসেন সকরুণ স্বরে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া সঙ্গীগণকে বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল! হাস্য-পরিহাস দূর কর; সর্ব্বশক্তিমান জগৎ-নিদান করুণাময় ঈশ্বরের নাম মনে কর। আমরা বড় ভয়ানক স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। এই স্থানের নাম করিতে আমার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিতেছে, প্রাণ ফাটিয়া যাইতেছে। ভাই রে! মাতামহ বলিয়া গিয়ছেন, যে স্থানে তােমার অশ্বপদ মৃত্তিকায় দাবিয়া যাইবে, নিশ্চয় জানিও, সেই-ই তােমার জীবন বিনাশের নির্দ্দিষ্ট স্থান এবং তাহারই নাম দাস্ত-কারবালা। মাতামহের বাকা অলঙ্ঘনীয়; পথ ভুলিয়া আমরা কারবালায় আসিয়াছি, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। তোমরা কি কর্ণে কিছু শুনিতেছ?” তখন সকলেই মনোনিবেশ করিয়া শুনিতে লাগিলেন—চতুর্দ্দিকেই “হায়! হায়!!” রব। ধণ্ঠ নূরনবী মোহাম্মদ! হোসেন বলিলেন, “মাতামহ ইহাও বলিয়া গিয়াছেন, চতুর্দ্দিক হইতে যে স্থানে “হায়! হায়!!” শব্দ উত্থিত হইবে, নিশ্চয় জানিও সেই-ই কারবালা। ঈশ্বরের লীলা কাহারও বুঝিবার সাধা নাই। কোথায় যাইব? যাইবারই বা সাধ্য কি? কোথায় দামেস্ক, কোথায় মদিনা, কোথায় কুফা, আর কোথায় কারবালা! আমি কারবালায় আসিয়াছি, আর উপায় কি? ভাই সকল! ঈশ্বরের নাম করিয়া ক্ষান্ত দাও।” ক্রমে সঙ্গীরা সকলেই আসিয়া একত্রিত হইল। হোসেনের মুখে কারবালার বৃত্তান্ত এবং চতুর্দ্দিকে “হায়! হায়!” রব স্বকর্ণে শুনিয়া সকলেই মুখে কালিমা রেখা পড়িয়া গেল। সে যেখান হইতে শুনিল, সে সেইখানেই অমনি নীরবে বসিয়া পড়িল।

 হোসেন বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! আর চিন্তা কি? ঈশ্বরের নিয়োজিত কার্য্যে ভাবনা কি? এই স্থানে শিবির নির্ম্মাণ করিয়া ঈশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া তাঁহারই নাম ভরসা করিয়া থাকিব। সম্মুখে প্রান্তর, পার্শ্বে ভয়ানক বিজন বন, কোথায় যাই? অদৃষ্টে যাহা লেখা আছে, তাহাই ঘটিবে, এক্ষণে চিন্তা বিফল। শিবির নির্ম্মাণের আয়োজন কর। আমি জানি, ফোরাত নদী এই স্থানের নিকট প্রবাহিত হইতেছে। কতদূর এবং কোন্ দিকে তাহা নির্ণয় করিয়া কেহ কেহ জল আহরণে প্রবৃত্ত হও! পিপাসায় অনেকেই কাতর হইয়াছে, আহারাদি সংগ্রহ করিয়া আপাততঃ ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ কর।”

 শিবির নির্ম্মাণ করিবার কাষ্ঠ স্তম্ভ সংগ্রহ করিতে এবং রন্ধনপযোগী কাষ্ঠ আহরণ করিতে যাহারা বনমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল, শোণিতাক্ত কুঠার-হস্তে অত্যন্ত বিষাদিত চিত্তে বাষ্পকুললোচনে তাহারা হোসেনের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিতে লাগিল, “হজরত! এমন অদ্ভুত ব্যাপার আমরা কোন স্থানে দেখি নাই, কোন দিন কাহারও মুখে শুনিও নাই। কি আশ্চর্য্য! এমন আশ্চর্য্য ঘটনা জগতে কোন স্থানে ঘটিয়াছে কি না, তাহাও সন্দেহ। আমরা বনে নানা প্রকার কাষ্ঠ সংগ্রহ করিতে গিয়াছিলাম; যে কোন বৃক্ষের যে কোন স্থানে কুঠারাঘাত করিলাম, সেই বৃক্ষেই অজস্র শোণিত-চিহ্ন দেখিয়া ভয় হইল। ভয়ে ভয়ে ফিরিয়া আসিলাম। এই দেখুন! আমাদের সকলের কুঠারেও সদ্যশোণিত-চিহ্ন বিদ্যমান রহিয়াছে।”

 হোসেন কুঠার সংযুক্ত শোণিত দর্শনে বলিতে লাগিলেন, “নিশ্চয় এই-ই কারবালা। তোমরা সকলে এই স্থানে ‘শহীদ’-স্বর্গসুখ ভোগ করিবে, তাহারই লক্ষণ ঈশ্বর এই শোণিত-চিহ্নে দেখাইতেছেন। উহাতে আর আশ্চর্যান্বিত হইও না, ঐ বন হইতেই কাষ্ঠ সংগ্রহ করিয়া আন। দারুরস শোণিতে পরিণত হইয়াছে, দেখিয়া আর ভীত হইও না।”

 এমামের বাক্যে সকলেই আনন্দোৎসাহে শিবির সংস্থাপনে যত্নবান হইলেন। সকলেই আপন আপন স্থানোপযোগী এবং এমামের পরিজনবর্গের অবস্থানের জন্য অতি নির্জ্জন স্থানে শিবির সংস্থাপন করিয়া সকলেই যথাসম্ভব বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।

 আরব দেশে দাসের অভাব নাই! যে সকল ক্রীতদাস হোসেনের সঙ্গে ছিল, তাহারা কয়েকজন একত্রিত হইয়া ফোরাতের অন্বেষণে বহির্গত হইয়াছিল; ম্লানমুখে ফিরিয়া আসিয়া সকাতরে এমামের নিকট তাহারা বলিতে লাগিল, “বাদশাহ্-নামদার! আমরা ফোরাত নদীর অন্বেষণে বহির্গত হইয়াছিলাম। পূর্ব্ব উত্তর প্রদক্ষিণ করিয়া শেষে পশ্চিম দিকে দেখিতে পাইলাম যে, ফোরাত নদী কুলুকুলুরবে দক্ষিণবাহিনী হইয়া প্রবাহিত হইতেছে। জলের নির্ম্মলতার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া জলপানেচ্ছা আরও চতুর্গুণ বলবতী হইল, কিন্তু নদীর তীরে অসংখ্য সৈন্য সশস্ত্রে শ্রেণীবদ্ধ হইয়া অতি সতর্কতার সহিত নদীর জল রক্ষা করিতেছে। যত দূর দৃষ্টির ক্ষমতা হইল, দেখিলাম—এমন কোন স্থানই নাই যে, নির্ব্বিঘ্নে এক বিন্দু জল লইয়া পিপাসা নিবৃত্তি করা যায়। আমরা সৈন্যদিগকে কিছু না বলিয়া যেমনই নদীতীরে যাইতে অগ্রসর হইয়াছি, তাহারা অমনই অতি কর্কশ বাক্যে বিশেষ অপমানের সহিত আমাদিগকে বিতাড়িত করিয়া দিয়া বলিল, “মহারাজ এজিদের আজ্ঞায় ফোরাত নদীকূল রক্ষিত হইতেছে, এই রক্ষক বীরগণের একটি প্রাণ, যাঁচিয়া থাকিতে এক বিন্দু জল কেহ লইতে পারিবে না। আমাদের মস্তকের শোণিত ভূতলে প্রবাহিত না হইলে ফোরাত প্রবাহে কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে দিব না। জল লইয়া পিপাসা নিবৃত্তি করা ত অনেক দূরের কথা! এবার ফোরাতকূল চক্ষে দেখিয়াই ইহজীবন সার্থক করিয়া গেলে,—যাও; ভবিষ্যতে এদিকে আসিলে আমাদের দৃষ্টির সীমা পর্য্যন্ত থাকিতে হইবে। নদীতীরে এক পদও অগ্রসর হইতে দিব না। এবং সুতীক্ষ্ণ শরই তোমাদের পিপাসার শান্তি করিবে। প্রাণ বাঁচাইয়া ফিরিয়া যাও! নিশ্চয় জানিও, ফোরাতের সুস্নিগ্ধ বারি তোমাদের কাহারও ভাগ্যে নাই।”

 কথা শুনিয়া হোসেন মহাব্যস্ত হইলেন। খাদ্যাদির অভাব না থাকিলেও জলবিহনে কিরূপে বাঁচিবেন, এই চিন্তাই তাঁহার প্রবল হইল। মদিনার বহুসংখ্যক লোক সঙ্গে রহিয়াছে। অল্পবয়স্ক বালক-বালিকাগণ যখন পিপাসায় কাতর হইবে, যখন তাহাদের জিহ্বকণ্ঠ শুষ্ক হইয়া অর্দ্ধোচ্চারিত কথা বলিতেও ক্ষমতা থাকিবে না, তখন কি করিবেন? এই চিন্তায় হোসেন ফোরাত নদীর দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া কি উপায়ে জল সংগ্রহ করিবেন ভাবিতেছেন—এমন সময় দেখিতে পাইলেন যে, চারি জন সৈনিক পুরুষ তাঁহার শিবির লক্ষ্য করিয়া সম্ভবতঃ কিছু ত্রস্তে চলিয়া আসিতেছে। তিনি মনে মনে ভাবিলেন, ‘মোস্‌লেম আমার কুফা গমনে বিলম্ব দেখিয়া হয়তো সৈনিকগণকে কোন স্থানে রাখিয়া অগ্রে আমার সন্ধান লইতে আসিতেছে!’

 আগন্তুক চতুষ্টয় যতই নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল, ততই তাঁহার কল্পনা যে ভ্রমসঙ্কুল তাহা প্রমাণিত হইল। শেষে তিনি দেখিলেন যে, তাহারা অপরিচিত; এমন কি, কোন স্থানে তাহাদিগকে দেখিয়াছেন কি না, তাহাও মনে হইল না। সৈন্যচতুষ্টয় নিকটে আসিয়াই হোসেনের পদচুম্বন করিল। তন্মধ্য হইতে অপেক্ষাকৃত সজ্জিত পুরুষ কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া নতশিরে বলিতে লাগিলেন, “হজরত, দুঃখের কথা কি বলিব, আমরা এজিদের সৈন্য, কিন্তু আপনার মাতামহের উপদিষ্ট ধর্ম্মে দীক্ষিত। আমাদের কথায় অবিশ্বাস করিবেন না, শত্রুর বেতনভোগী বলিয়াও শত্রু মনে করিবেন না। আমরা কিছুরই প্রত্যাশী নহি, কেবল আপনার দুঃখে দুঃখিত হইয়া কয়েকটি কথা মাত্র বলিতে অতি সাবধানে আপনার শিবিরে আসিয়াছি। সময় যখন মন্দ হইয়া উঠে, তখন চতুর্দ্দিক হইতেই অমঙ্গল ঘটিয়া থাকে; এক্ষণে আপনার চতুর্দ্দিকেই অমঙ্গল দেখিতেছি। মোস্‌লেমের ন্যায় হিতৈষী বন্ধু জগতে আপনার কেহই হইবে না। আবদুল্লাহ্ জেয়াদ আপনার প্রাণ বিনাশ করিবার আশায় ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। ভাগ্যগতিকে মোস্‌লেম কুফায় যাইয়া আবদুল্লাহ্‌ জেয়াদের হস্তে বন্দী হইলেন। শেষে তাহারি চক্রান্তে ওত্‌বে অলীদ ও মারওয়ানের সহিত যুদ্ধে মোস্‌লেম বীরপুরুষের ন্যায় শত্রু বিনাশ করিয়া সেই শক্রহস্তেই প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে যে সহস্র সৈন্য ছিল, তাহারাও ওত্‌বে অলীদ ও জেয়াদের হস্তে প্রাণ বিসর্জ্জন দিয়া স্বর্গবাসী হইয়াছে। এক্ষণে সীমার, ওমর প্রভৃতি আপনার প্রাণবধের জন্য নানা প্রকার চেষ্টায় আছে। মারওয়ান, ওত্‌বে অলীদ এ পর্য্যন্ত আসিয়া উপস্থিত হয় নাই। এজিদের আজ্ঞাক্রমে আমরাই ফোরাত নদীকূল একেবারে বন্ধ করিয়া দিয়াছি। মনুষ্য দূরে থাকুক, পশু-পক্ষীকেও ছাড়িয়া দিলে নদীতীরে যাইতে কাহারও সাধ্য নাই। সংক্ষেপে সকলই বলিলাম, যাহা ভাল বিবেচনা হয়, করিবেন।”—এই বলিয়াই আগন্তুক চতুষ্টয় হোসেনের পদচুম্বন করিয়া চলিয়া গেল।

 মোস্‌লেমের দেহত্যাগের সংবাদে হোসেন মহা শোকাকুল হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিলেন, “হা ভ্রাতঃ মোস্‌লেম! যাহা বলিয়া গিয়াছিলে তাহাই ঘটিল!—‘হোসেনের প্রাণবিনাশ করিতেই যদি আবদুল্লাহ্ জেয়াদ কোন ষড়যন্ত্র করিয়া থাকে, তবে সে যড়যন্ত্রে আমিই পড়িব, হোসেনের প্রাণ ত রক্ষা পাইবে।’ ভাই! নিজ প্রাণ দিয়া হোসেনকে জেয়াদের হস্ত হইতে রক্ষা করিলে! তুমি ত মহা অক্ষয় স্বর্গসুখে সুখী হইয়া জগৎ-যন্ত্রণা হইতে পরিত্রাণ পাইলে। আমি দুরন্ত কারবালা প্রান্তরে অসহায় হইয়া বিন্দুমাত্র জলের প্রত্যাশায় বোধ হয় সপরিবারে জীবন হারাইলাম! রে দুরন্ত পাপিষ্ঠ জেয়াদ! তোর চক্রান্তে মোস্‌লেমকে হারাইলাম। তোর চক্রান্তেই আজ সপরিবারে জল-বিহনে মারা পড়িলাম।” মোস্‌লেমের জন্য হোসেন অনেক দুঃখ করিতে লাগিলেন। ওদিকে জলাভাবে তাঁহার সঙ্গিগণের মধ্যে মহাকোলাহল উপস্থিত হইল।

 প্রথমে সকলেই পিপাসাক্রান্ত হইয়া হোসেনের নিকট আসিয়া বলিতে লাগিলেন—“জলাভাবে সমস্ত লোক মরে। পিপাসায় সকলেরই শুষ্ককণ্ঠ, এক্ষণে আর কষ্ট সহ্য হয় না!”

 সকাতরে হোসেন বলিলেন, “কি করি! বিন্দুমাত্র জলও পাইবার প্রত্যাশা আর নাই। ঈশ্বরের নামামৃতপান ভিন্ন পিপাসা নিবৃত্তির আর এখন উপায় কি আছে? বিনা জলে যদি প্রাণ যায়, সকলেই সেই করুণাময় বিশ্বনাথের নাম করিয়া পিপাসা নিবৃত্তি কর। সকলেই আপন আপন স্থানে যাইয়া ঈশ্বরোপাসনায় মনোনিবেশ কর।”

 অতঃপর সকলেই পরমেশ্বরের আরাধনায় মনোনিবেশ করিলেন। ক্রমে নয় তারিখ কাটিয়া গেল। দশম দিবসের প্রাতে হোসেনের শিবিরে মহাকোলাহল উঠিল! “প্রাণ যায়, আর সহ্য হয় না!” এই প্রকার গগনভেদী শব্দ উঠিতে লাগিল। পরিবারস্থ সকলের আর্ত্তনাদে এবং কাতরস্বরে হোসেন আর তিষ্ঠিতে পারিলেন না। উপাসনায় ক্ষান্ত দিয়া হাস্‌নেবানু ও জয়নাবের বস্ত্রাবাসে যাইয়া তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন। পুত্র-কন্যা এবং অল্পবয়স্ক বালক-বালিকারা আসিয়া এক বিন্দু জলের জন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।

 শাহ্‌রেবানু দুগ্ধপোষ্য শিশুসন্তানটি ক্রোড়ে করিয়া আসিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতে লাগিলেন, “আজ সাত দিনের মধ্যে এক বিন্দু জলও স্পর্শ করিলাম না, পিপাসায় আমার জীবন শেষ হউক, তাহাতে কিছুমাত্র দুঃখ করি না; কিন্তু স্তনের দুগ্ধ পর্য্যন্ত শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। এই দুগ্ধপোষ্য শিশুর প্রাণনাশের উপক্রম হইল। এই সময়ে এক বিন্দু জল যে কোন উপায়ে ইহার কণ্ঠে প্রবেশ করাইতে পারিলেও বোধ হয় এ বাঁচিতে পারিত।”

 হোসেন বলিলেন, “জল কোথায় পাইর? এজিদের সৈন্যগণ ফোরাত নদীর কূল আবদ্ধ করিয়াছে, জল আনিতে কাহারও সাধ্য নাই!”

 শাহেরেবানু বলিলেন, “এই শিশুসন্তানটির জীবন রক্ষার্থে যদি আপনি নিজে গিয়াও কিঞ্চিৎ জল উহাকে পান করাইতে পারেন, তাহাতেই বা ক্ষতি কি? একটি প্রাণ ত রক্ষা হইবে? আমাদের জন্য আপনাকে যাইতে বলিতেছি না।”

 হোসেন বলিলেন, “জীবনে কোনও দিন শত্রুর নিকট, কি বিধর্ম্মীর নিকট কোন বিষয়েই প্রার্থী হই নাই। কাফেরের নিকট কোন কালে কিছু প্রার্থনাও করি নাই। জল চাহিলে কিছুতেই পাইব না। আর আমি এই শিশুর প্রাণ রক্ষার কারণেই যদি তাহাদের নিকট জল ভিক্ষা করি, তবে আমি চাহিলে তাহারা জল দিবে কেন? আমাকে মনোকষ্ট, মনোবেদনা দিতেই ত তাহারা ফোরাতকূল আবদ্ধ করিয়াছে?”

 শাহ্‌রেবানু বলিলেন, “তাহা যাহাই বলুন, আমরা বাঁচিয়া থাকিতে কি বলিয়া এই দুগ্ধপোষ্য সন্তান দুগ্ধ পিপাসায়,—শেষে জল পিপাসায় প্রাণ হারাইবে, ইহা কিরূপেই বা স্বচক্ষে দেখিব?”

 হোসেন আর দ্বিরুক্তি করিলেন না। সত্বর উঠিয়া গিয়া অশ্ব সজ্জিত করিয়া আনিয়া বলিলেন, “দাও, আমার ক্রোড়ে দাও! দেখি, আমার সাধ্যানুসারে যত্ন করিয়া দেখি।”—এই বলিয়া হোসেন অশ্বে উঠিলেন। শাহ্‌রেবানু সন্তানটি হস্তে লইয়া অশ্বপৃষ্ঠে স্বামীর ক্রোড়ে বসাইয়া দিলেন। হোসেন পুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া অশ্বে কশাঘাত করিলেন। মুহূর্ত্তমধ্যে তিনি ফোরাত নদীতীরে উপস্থিত হইয়া নদীতীরস্থ সৈন্যগণকে বলিলেন, “ভাই সকল, তোমাদের মধ্যে যদি কেহ মুসলমান থাক, তবে এই দুগ্ধপোশ্য শিশুর মুখের দিকে চাহিয়া কিঞ্চিৎ জলদান কর। পিপাসায় ইহার কণ্ঠতালু শুকাইয়া একেবারে নীরস কাষ্ঠের ন্যায় হইয়াছে। এ সময় কিঞ্চিৎ জলপান করাইতে পারিলেও বোধ হয় এ বাঁচিতে পারে! তোমাদের ঈশ্বরের দোহাই, এই শিশু সন্তানটির জীবন রক্ষার্থ ইহার মুখের প্রতি চাহিয়া কিছু জলদান কর। এই দুগ্ধপোষ্য শিশুর প্রাণরক্ষা করিলে পরমেশ্বর তোমাদের প্রতি প্রসন্ন হইবেন।”

 কেহই উত্তর করিল না। সকলেই একদৃষ্টে হোসেনের দিকে চাহিয়া রহিল। হোসেন পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “ভাই সকল, এ দিন— চিরদিন তোমাদের সুদিন থাকিবে না; কোন দিন ইহার সন্ধ্যা হইবেই হইবে। ঈশ্বরের অনন্ত ক্ষমতার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত কর; তাঁহাকে একটু ভয় কর। ভ্রাতৃগণ! পিপাসায় জলদান মহাপুণ্য, তাহাতে আবার অল্পবয়স্ক শিশু! ভ্রাতৃগণ! ইহার জীবন তোমাদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিতেছে। আমি সামান্য সৈনিক পুরুষ নহি; আমার পিতা মহামান্য হরজত আলী, মাতামহ নূরনবী হজরত মোহাম্মদ, মাতা ফাতেমা জোহরা খাতুনে জেন্নাত। এই সকল পুণ্যাত্মাদিগের নাম স্মরণ করিয়াই এই শিশু সন্তানটির প্রতি অনুগ্রহ কর। মনে কর, যদি আমি তোমাদের নিকট কোন অপরাধে অপরাধী হইয়াও থাকি, কিন্তু এই দুগ্ধপোষ্য বালক ত তোমাদের কোন অনিষ্ট করে নাই, তোমাদের নিকট কোন অপরাধে অপরাধীও হয় নাই। ইহার প্রতি দয়া করিয়াই তোমরা ইহার জীবন রক্ষা কর।”

 সৈন্যগণ মধ্য হইতে একজন বলিল, “তোমার পরিচয় জানিলাম; তুমি হোসেন। তুমি সহস্র অনুনয়-বিনয় করিয়া বলিলেও তোমাকে জল দিব না। তোমার পুত্র জল-পিপাসায় জীবন হারাইবে, তাহাতে তোমার দুঃখ কি? তোমার জীবনই ত এখনই যাইবে; সন্তানের দুঃখে না কাঁদিয়া তোমার নিজের প্রাণের জন্য একবার কাঁদ—অসময়ে পিপাসায় কাতর হইয়া কারবালায় প্রাণ হারাইবে, সেই দুঃখে একবার ক্রন্দন কর, শিশুসন্তানের জন্য আর কষ্ট পাইতে হইবে না। এখনই তোমার সকল জ্বালাযন্ত্রণা একেবারে নিবারণ করিয়া দিতেছি।” এই বলিয়া সেই ব্যক্তি হোসেনের বক্ষঃ লক্ষ্য করিয়া এক বাণ নিক্ষেপ করিল। ক্ষিপ্রহস্তনিক্ষিপ্ত সেই সুতীক্ষ্ণ বাণ হোসেনের বক্ষে না লাগিয়া ক্রোড়স্থ শিশুসন্তানের বৃক্ষ বিদীর্ণ করিয়া পৃষ্ঠদেশ পার হইয়া গেল। হোসেনের ক্রোড় রক্তে ভাসিতে লাগিল।

 হোসেন বলিতে লাগিলেন, “ওরে পাষাণহৃদয়! ওরে শরনিক্ষেপ কারি! কি করিলি! এই শিশুসন্তান-বধে তোর কি লাভ হইল? হায় হায়! আমি কোন মুখে ইহাকে ফিরাইয়া লইয়া যাইব? শাহ্‌রেবানুর নিকটে গিয়াই বা কি উত্তর দিব!” হোসেন মহাখেদে এই কথা কয়েকটি বলিয়াই সরাষে অশ্বচালনা করিলেন। শিবির সম্মুখে আসিয়া মৃত সন্তান ক্রোড়ে লইয়া লম্ফ দিয়া তিনি অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন; শাহ্‌রেবানুর নিকটে গিয়া বলিলেন, “ধর, তোমার পুত্র ক্রোড়ে লও! আজ বাছাকে স্বর্গের সুশীতল জল পান করাইয়া আনিলাম।” শাহ্‌রেবানু সন্তানের বুকের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াই অজ্ঞান হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন; বলিলেন, “ওরে! কোন্ নির্দ্দয় নিষ্ঠুর এমন কার্য্য করিলি! কোন্ পাষাণ হৃদয় এমন কোমল শরীরে লৌহশর নিক্ষেপ করিলি! ঈশ্বর! সকলই তোমার খেলা! যে দিন মদিনা পরিত্যাগ করিয়াছি, সেই দিনই দুঃখের ভার মাথায় ধরিয়াছি। শিবিরস্থ পরিজনেরা সকলেই শাহ্‌রেবানুর শিশুসন্তানের জন্য কাঁদিতে লাগিল। কেহ কাহাকেও সান্ত্বনা দিতে সক্ষম হইল না। মদিনাবাসীদিগের মধ্যে আবদুল ওহাব নামক একজন বীরপুরুষ হোসেনের সঙ্গীদল মধ্যে ছিলেন। আবদুল ওহাবের মাতা এবং স্ত্রীও সঙ্গে আসিয়াছিলেন। হোসেনের এবং তাঁহার পরিজনগণের দুঃখ দেখিয়া আবদুল ওহাবের মাতা সরোষে তাঁহাকে বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! তোমাকে কি জন্য গর্ভে ধারণ করিয়াছিলাম? হোসেনের এই দুঃখ দেখিয়া তুমি এখনও বসিয়া আছ? এখনও তোমাকে অস্ত্রে সুসজ্জিত দেখিতেছি না? এখনও তুমি অশ্ব সজ্জিত করিয়া ইহার প্রতিশোধ লইতে অগ্রসর হইতেছ না? জল বিহনে সকলেই মরিবে, আর কতক্ষণ বাঁচিবে? ধিক্ তোমার জীবনে। কেবল কি পশুবধের জন্যই শরীর পুষিয়াছিলে? এখনও স্থির হইয়া আছ? ধিক্ তোমার জীবনে! ধিক্ তোমার বীরত্বে। হায়! হায়! হোসেনের দুগ্ধপোষ্য সন্তানটির প্রতি যে হাতে তীর মারিয়াছে, আমি কি সেই পাপীর সেই হাতখানা দেখিয়াই পরিতৃপ্ত হইব? তাহা মনে করিও না। তোমার শরসন্ধানে সেই বিধর্ম্মী নারকীর তীরবিদ্ধ মস্তক আজ আমি দেখিতে ইচ্ছা করি। হায়! হায়! এমন কোমল শরীরে যে নরাধম তীর বিদ্ধ করিয়াছে, তাহার শরীরে মানব-রক্ত, মানব-ভাব— কিছুই নাই! আবদুল ওহাব! তুমি স্বচক্ষে শাহ্‌রেবানুর ক্রোড়স্থ সন্তানের সাংঘাতিক মৃত্যু দেখিয়াও নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া আছ? শিশুশোকে শুধু নয়নজলই ফেলিতেছ! নিতান্ত আক্ষেপের বিষয়! বিপদে দুঃখে তোমরাই যদি কাঁদিয়া অনর্থ করিলে, তবে আমরা কি করিব? অবলা নিঃসহায় স্ত্রীজাতির জন্যই বিধাতা কান্নার সৃষ্টি করিয়াছেন, বীরপুরুষের জন্য নহে।”

 মাতার উৎসাহসূচক ভর্ৎসনায় আবদুল ওহাব তখনই সজ্জিত হইয়া আসিলেন; মাতার চরণ চুম্বন করিয়া বলিলেন, “আবদুল ওহাব আর কাঁদিবে না! তাহার চক্ষে জল আর দেখিবেন না; ফোরাত নদীর কুল হইতে শত্রুদিগকে তাড়াইয়া সে মোহাম্মদের আত্মীয়-স্বজন পরিবারদিগের জলপিপাসা নিবারণ করাইবে, আর না হয় আজ কারবালাভূমি আবদুল ওহাবের শোণিতে রঞ্জিত হইবে! কিন্তু না, এমন কঠিন প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ করিবার আশায় যুদ্ধক্ষেত্রে গমন সময়ে আমার সহধর্ম্মিণীর মুখখানি একবার দেখিয়া যাইতে ইচ্ছা করি।”

 মাতা বলিলেন, “ছি! ছি! বড় ঘৃণার কথা। যুদ্ধযাত্রার যোগ্য অঙ্গসজ্জা রমণীর নয়নতৃপ্তির জন্য নহে। বীর বেশ বীরপুরুষেরই চক্ষুরঞ্জন। বিশেষতঃ, এই সময়ে যাহাতে মনে মায়ার উদ্রেক হয়, বাঁচিবার আশা বৃদ্ধি হয়, এমন কোন স্নেহ-পাত্রের মুখ দেখিতেও নাই, দেখাইতেও নাই। ঈশ্বর-প্রসাদে ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া অগ্রে হোসেন-পরিবারের জীবন রক্ষা কর, মদিনাবাসিগণের প্রাণ বাঁচাও, তাহার পর বিশ্রামসময়ে বিশ্রামের উপকরণ যাহা যাহা, তাহা সকলই পাইবে। বীরপুরুষের মায়া-মমতা কি? বীরধর্ম্মে অনুগ্রহ কি? একদিন জন্মিয়াছ, একদিন মরিবে, শত্রুর সম্মুখীন হইবার অগ্রে স্ত্রী-মুখ দেখিবার অভিলাষ কি জন্য? তুমি যদি মনে মনে স্থির করিয়া থাক যে,—এই শেষ যাত্রা, আর ফিরিব না, জন্মশোধ মুখখানি দেখিয়া যাই, তবে তুমি কাপুরুষ, বীরকুলের কণ্টক, বীরবংশের গ্লানি, বীরকুলের কুলাঙ্গার!

 আবদুল ওহাব আর একটি কথাও না বলিয়া জননীর চরণচুম্বন পূর্ব্বক ঈশ্বরের নাম করিয়া অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ফোরাতকূলে যাইয়া বিপক্ষগণকে বলিতে লাগিলেন, “ওরে পাষাণহৃদয় বিধর্ম্মিগণ! যদি প্রাণের মমতা থাকে, যদি আর কিছু দিন জগতে বাস করিবার ইচ্ছা থাকে, তবে শীঘ্র নদীকূল ছাড়িয়া পলায়ন কর্। দেখ, আবদুল ওহাব নদীকূল উদ্ধার করিয়া দুগ্ধপােষ্য শিশুহন্তার মস্তক নিপাত করিবার জন্য আসিয়াছে। তোদের বুদ্ধিজ্ঞান একেবারেই দূর হইয়াছে, তােরা কি এই অকিঞ্চিৎকর জীবন চিরদিনেরই জন্য মনে করিয়াছিস? এ জীবনের কি আর অন্ত নাই? ইহার কি শেষ হইবে না? শেষ দিনের কথা কি একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিস? যে দিন স্বর্গাসনে বিচারপতি স্বয়ং বিচারাসনে বাসয়া জীবমাত্রের পাপপুণ্যের বিচার করিবেন, বল ত কাফের, সেদিন আর তােদের কে রক্ষা করিবে। সেই সহস্র সহস্র সূর্য্যকিরণের অগ্নিময় উত্তাপ হইতে কে বাঁচাইবে? সেই বিষম দুর্দ্দিনে অনুগ্রহ-বারি সিঞ্চনে কে আর তােদের পিপাসা নিবারণ করিয়া শান্তি দান করিবে? বল্ ত কাফের! কাহার নাম করিয়া সেই দুঃসহ নরকাগ্নি হইতে রক্ষা পাইবি? অর্থের দাস হইলে কি আর ধর্ম্মাধর্ম্মের জ্ঞান থাকে না? যদি যুদ্ধের সাধ থাকে, সে সাধ অবশ্যই মিটাইব। এখনও বলিতেছি, ফোরাতকূল ছাড়িয়া দিয়া সেই বিপদকাণ্ডারী প্রভু হজরত মােহাম্মদের পরিজনগণের প্রাণ রক্ষা কর। অবলা অসহায়দিগকে শুষ্ককণ্ঠ করিয়া মারিতে পারিলেই কি বীরত্ব প্রকাশ পায়? এই কি বীরধর্ম্মের নীতি? দুগ্ধপােষ্য শিশুসন্তানকে দূর হইতে চোরের ন্যায় বধ করাই কি তােদের বীরত্ব? যদি যথার্থ যুদ্ধের সাধ থাকে, যদি যথার্থই বীরত্ব দেখাইয়া মরিতে ইচ্ছা থাকে, আবদুল ওহাবের সম্মুখে আয়! যদি মরিতে ভয় হয়, তবে ফোরাতকূল ছাড়িয়া পলায়ন কর্। ন্যূনতা স্বীকার কিংবা যাচ্ঞা করিলে আবদুল ওহাব পরম শত্রুকেও তাহার প্রাণ ভিক্ষা দিয়া থাকে। মদিনাবাসীরা তােদের ন্যায় যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত নহে—এই অহঙ্কারেই তােরা মাতিয়া আছিস্। কিন্তু ঈশ্বরপ্রসাদে তাহারা যথার্থই বীর ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী।

 আবদুল ওহাব অশ্বে কশাঘাত করিয়া শক্রদলের সম্মুখে চক্রাকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, কেহই তাঁহার সম্মুখে আসিতে সাহস করিল না, নদীকূলও ছাড়িয়া দিল না। আবদুল ওহাব পুনরায় সক্রোধে বলিতে লাগিলেন, “যোদ্ধাই হউক, বীরেন্দ্রই হউক, উদ্যোগী পুরুষই হউক,—সেই ধন্য, যে সময়কে অতি মূল্যবান জ্ঞান করে। তোদের সকল বিষয়েই জ্ঞান আছে, দেখিতেছি। যদি সাহস থাকে, যদি আবদুল ওহাবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে কাহারও ইচ্ছা হয়, তবে শীঘ্র আয়্। আবদুল ওহাব আজ বিধর্ম্মীর রক্তপাতে ফোরাত-জল রক্তবর্ণে রঞ্জিত করিয়া দ্বিগুণ রঞ্জনে রঞ্জিত করিবে, এই আশাতেই তোদের সম্মুখে আসিয়াছে। শত্রুসম্মুখীন হইতে তোদের এত বিলম্ব কেন? শত্রু যুদ্ধপ্রার্থী, তোরা বিশ্রামপ্রার্থী। ধিক্ তোদের বীরত্বে! ধিক্ তোদের সাহসে! আজ সাত রাত নয় দিন আবদুল ওহাব জলস্পর্শ করে নাই; ফোরাত নদী তীরে তোরা মহানন্দে ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করিয়া রহিয়াছিস্। তবু তোদের ইহাতে এত বিলম্ব, এত ভয়! শীঘ্র আয়্। একে একে তোদের সকলকেই নরকে প্রেরণ করিতেছি।”

 বিপক্ষদল হইতে এক দীর্ঘকায় বীরপুরুষ বহির্গত হইয়া অতি উচ্চ লোহিতবর্ণ অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণপূর্ব্বক বিশেষ দক্ষতার সহিত অসি চালনা করিতে করিতে আবদুল ওহাবের সম্মুখীন হইয়া বলিতে লাগিলেন, “মূর্খেরাই দর্প করে। কাপুরুষেরাই অহঙ্কার প্রদর্শন করিয়া থাকে। শৃগাল! বাক্‌চাতুরি ছাড়িয়া পুনরায় শিবিরে প্রস্থান কর্‌—তোকে মারিয়া কি হইবে? আবদুল ওহাব, তুই কাহার সন্তান! তোর জননী কাহার কন্যা! সেই সকল পরিচয় লইয়া আসিতেই আমার একটু বিলম্ব হইয়াছে। তুই কেন এই নব যৌবনে পরের জন্য আপন প্রাণ হারাইবি? তোকে বধ করিলে এজিদের নিকট যশোলাভ হইবে না। তোদের হোসেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে আসিতে বল্‌। তুই যদি কিছু দিন সংসারে বাস করিতে বাসনা করিস্‌, ফিরিয়া যা, তোকে চাহিনা।”

 আবদুল ওহাব ক্রোধে অধীর হইয়া বলিলেন, “বিধর্ম্মী কাফের! এত বড় আস্পর্ধা তোর! অগ্রেই তুই হোসেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে আহ্বান করিস্‌? আবদুল ওহাবের পদাঘাতের কি কিছুমাত্র বল নাই? রে ক্ষুদ্র কীট। চিরশাগত দাস বাঁচিয়া থাকিতে প্রভুকে আহ্বান কেন? অগ্রে আবদুল ওহাবের পদাঘাত সহ্য কর, তাহার পর অন্য কথা।”—সদর্পে এই কথা বলিয়া আবদুল ওহাব অশ্ব ঘুরাইয়া বিধর্ম্মীর নিকট যাইয়া এমনই জোরে তরবারি আঘাত করিলেন যে, এক আঘাতে অশ্বের সহিত আরোহীকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ফেলিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অশ্বচক্র দিয়া শত্রুবিনাশী আবদুল ওহাব প্রত্যেক চক্রপরিবর্ত্তনে বিপক্ষগণকে আহ্বান করিতে লাগিলেন। একে একে সত্তরজন বিধর্ম্মীকে নরকে প্রেরণ করিয়া পুনরায় পরিক্রমণের জন্য শত্রুগণকে আহ্বান করিতে লাগিলেন; কিন্তু কেহই তাঁহার সম্মুখে আর অগ্রসর হইল না, দূর হইতে শর নিক্ষেপ করিয়া তাঁহাকে পরাস্ত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। আবদুল ওহাব ভীত হইলেন না—দুই হস্তে অসি চালনা করিয়া নিক্ষিপ্ত শরজাল খণ্ডে খণ্ডে বিচ্ছিন্ন করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে শত্রুনিক্ষিপ্ত শরে আবদুল ওহাবের গাত্র বিদ্ধ হইয়া রক্তধারা প্রবাহিত হইতে লাগিল। সে দিকে আবদুল ওহাবের দৃষ্টি নাই, কেবল শত্রু বিনাশেই তিনি কৃতসঙ্কল্প!

 বহু পরিশ্রম করিয়া আবদুল ওহাব পিপাসায় আরও কাতর হইলেন। কি করেন, কোন উপায় না পাইয়া বেগে যুদ্ধক্ষেত্র হইতে হোসেনের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “হজরত! বড় পিপাসা! এই সময় ওহাবকে যদি জল দান করিতে পারেন, তাহা হইলে শত্রুকুল—”

 “জল?— জল আমি কোথা পাইব ভাই?” হোসেন অধিকতর কাতর হইয়া বলিতে লাগিলেন, “ভাই, সে ক্ষমতাই যদি থাকিত, তবে তোমার আর এমন দুর্দ্দশা হইবে কেন?”

 দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া মহা উত্তেজিত কণ্ঠে আবদুল ওহাবের জননী বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব, যুদ্ধক্ষেত্র হইতে কি ফিরিতে আছে? তুমি যদি ইচ্ছা করিয়াও না ফিরিয়া থাক, যদি কাহারও আদেশে ফিরিয়া থাক, তাহা হইলেও কি শত্রু হাসিবে না? কি ঘৃণা! কি লজ্জা! কেন তুমি আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলে? শত্রুকে পিঠ দেখাইয়া সামান্য জল-পিপাসা হইতে প্রাণ রক্ষা করিতে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়িয়া ফিরিয়া আসিলে? তোমার ও-কলঙ্কিত মুখ আমি আর দেখিব না। আমি তোমাকে জীবিত ফিরিয়া আসিবার জন্য যুদ্ধে পাঠাই নাই। হয় ফোরাতকূল উদ্ধার করিয়া হোসেনের পুত্র-পরিজনকে রক্ষা করিতে দেখিব, না হয় রণক্ষেত্র-প্রত্যাগত তোমার মস্তকশূন্য দেহ দেখিয়া এই বৃদ্ধ বয়সে জীবন শীতল কবি, এই আমার আশা ছিল। তুমি বীরকূল-কলঙ্ক, আমার আশা ফলবতী হইতে দিলে না।”

 সভয়ে কম্পিত হইয়া আবদুল ওহাব কহিলেন, “জননি! আবার আমি যাইতেছি, আর ফিরিব না—হয় নদীকূল উদ্ধার, নয় আবদুল ওহাবের মস্তক দান। কিন্তু জননি! পিপাসায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। পিপাসা নিবারণ করিবার আর উপায় নাই। একটিমাত্র নিবেদন, তোমার চরণদর্শনেই পিপাসার শান্তি! আর-একবার আমার স্ত্রীর মুখখানি—”

 হাঁ, বুঝিয়াছি। সেই মুখখানি দেখিতে পার, কিন্তু অশ্ব হইতে নামিতে পারিবে না।” মাতার অজ্ঞানুযায়ী সেই অবস্থাতেই আবদুল ওহাব আপন স্ত্রীর নিকট যাইয়া বলিলেন, “জীবিতেশ্বরি! আমি যুদ্ধযাত্রী। যুদ্ধ করিতে করিতে তোমার কথা মনে পড়িল, পিপাসাতেও প্রাণ আকুল। ভাবিলাম, তোমাকে দেখিলে বোধ হয়,—কিছু শ্রান্তি দূর হইবে, পিপাসা নিবারণ হইবে। এই মনে করিয়াই আসিয়াছি, কিন্তু অশ্ব হইতে নামিবার আদেশ নাই। মাতার আজ্ঞা, তাই—অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়াই সাক্ষাৎ করিলাম।”

 পতিপরায়ণা পতিব্রতা সতী পতির নিকটে যাইয়া অশ্ববঙ্গ ধারণপূর্ব্বক মিনতিবচনে কহিতে লাগিলেন, “জীবিতেশ্বর! সমরাঙ্গণে অঙ্গনার কথা মনে করিতে নাই। যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তঃপুরের কথা যাহার মনে পড়ে, সে আবার কেমন বীর? শত্রুকে পৃষ্ঠ দেখাইয়া যে যোদ্ধা স্ত্রীর মুখ দেখিতে আসে, সেই বা কেমন বীর প্রাণেশ্বর? আমি নারী, আমি ত ইহার মর্ম্ম কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। প্রভু মোহাম্মদের বংশধরগণের বিপদ-সময়ে সাহায্য করিতে স্ত্রী-পরিবার, সন্তানসন্ততির কথা যে যোদ্ধা মনে করে, তাহাকে আমি বীরপুরুষ রলি না। যদি আপনারা ভয় করেন, তবে আমরাই—এই ক্ষুৎ-পিপাসাপীড়িত স্ত্রীলোকেরাই, এলোচুলে রণরঙ্গিণী হইয়া রণবেশে সমরাঙ্গণে অসিহস্তে নৃত্য করিব; রণরঞ্জিত বস্ত্রে আমরাও রণসাজে সজ্জিত হইতে কুণ্ঠিত হইব না। দেখি, কোন্ বিপক্ষ যোদ্ধা আমাদের সম্মুখে অগ্রসর হইতে পারে? দেখার দিন, কথার দিন, বিশ্রামের দিন, ঈশ্বরপ্রসাদে যদি পাই, তবে মনের আনন্দে আপনার সেবা করিব। হোসেনের বিপদ চিরকাল থাকিবে না। কিন্তু এমন দিন পাইয়া আপনি আর সময় নষ্ট করিবেন না। এমন দিন আপনি আর পাইবেন না। এমন সময় কি বিলম্ব করা উচিত? ছিঃ। ছিঃ! বীরপুরুষ!—তোমাকে ছিঃ! ছিঃ! শত্রু যুদ্ধার্থী হইয়া অপেক্ষা করিতেছে, তুমি কিনা কাপুরুষের মত অবরোধপুরে আসিয়া অবরোধ-বাসিনী কুলবালার মুখ দেখিতে অভিলাষী হইয়াছ! ছিঃ তোমাকে।”

 অশ্ব হইতেই নতশিরে সাধ্বী সতীর কপোল চুম্বন করিয়া আবদুল ওহাব আর তাঁহার দিকে ফিরিয়াও চাহিলেন না। সতীর মিষ্ট ভর্ৎসনায় অন্তরে লজ্জিত হইয়া সজোরে অশ্বে কশাঘাত করিয়া তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন; শত্রুগণকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “রে বিধর্ম্মী কাফেরগণ! ভাবিয়াছিলি যে, আবদুল ওহাব পলাইয়াছে? আবদুল ওহাব পলায় নাই। ঈশ্বরের নামে অতি অল্প সময়ের জন্য এই জগৎ দেখিতে আমি তোদের অবসর দিয়াছিলাম। আয় দেখি, কত জনে আবদুল ওহাবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিবি, আয়?”

 আবদুল ওহাবের মাতা পুত্রের অজ্ঞাতে যুদ্ধক্ষেত্রের নিকট যাইয়া তাহার যুদ্ধ দেখিতে লাগিলেন। পূর্ব্বেই সেনাপতি ওমর সকলকেই বলিয়া রাখিয়াছিলেন যে, আবদুল ওহাব কোন কারণ বশতঃ ফিরিয়া গিয়াছে, এখনই আবার আসিবে। এবার সকলে একত্র হইয়া আবদুল ওহাবকে আক্রমণ করিতে হইবে। যাহার যে অস্ত্র আয়ত্ত আছে, সে সেই অস্ত্র আবদুল ওহাবের প্রতি নিক্ষেপ করিবে।

 রণক্ষেত্রে একবারে একযোগে বহুসংখ্যক সৈন্য মওলাকারে চতুর্দ্দিকে ঘুরিয়া একেশ্বর আবদুল ওহাবের প্রতি অস্ত্র বর্ষণ করিতে লাগিল। বীরবর আবদুল ওহাব শক্রবেষ্টিত হইয়া দুই হস্তে অসিচালনা করিতে লাগিলেন। এজিদের সৈন্যের অন্ত নাই; কত মারিবেন! শেষে শত্রুপক্ষের আঘাতে আবদুল ওহাবের মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দূরে বিনিক্ষিপ্ত হইল। সেই ছিন্ন মস্তক আবদুল ওহাবের মাতার সম্মুখে গিয়া পড়িল। বীরজননী পুত্রশির ক্রোড়ে লইয়া ত্রস্তে শিবিরে আসিয়া নির্জ্জনকক্ষে হোসেনের সম্মুখে রাখিয়া দিলেন। এই অবসরে আবদুল ওহাবের শিক্ষিত অশ্ব শিরশূন্য দেহ লইয়া অতি বেগে শিবিরের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল।সকলের সম্মুখে শিরশূন্য দেহ অশ্বপৃষ্ঠ হইতে মৃত্তিকায় পড়িয়া গেল। আবদুল ওহাবের মাতা শোণিতাক্ত হস্ত উত্তোলন করিয়া ঈশ্বর সমীপে প্রার্থনা করিলেন এবং আবদুল ওহাবের উদ্দেশে আশীর্ব্বাদ করিলেন,—“আবদুল ওহাব! তুমি ঈশ্বরকৃপায় স্বর্গীয় সুখভোগে সুখী হও। হোসেনের বিপদ-সময়ে তুমি প্রাণ দিয়া সাহায্য করিলে, প্রভু মোহাম্মদের বংশধরগণের পিপাসার শান্তিহেতু কাফের হস্তে জীবন বিসর্জ্জন করিলে, তোমায় শত শত আশীর্ব্বাদ! তুমি যে জননীর গর্ভে জন্মিয়াছিলে, তাঁহারও সার্থক জীবন! তোমার মস্তক দেহ হইতে কে বিচ্ছিন্ন করিল?” আবদুল ওহাবের মাতা পুত্রের ছিন্ন মস্তকটি লইয়া পতিত দেহে সংলগ্ন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! বৎস! প্রাণাধিক! অশ্ব সজ্জিত আছে, তোমার হাতের অস্ত্র হাতেই রহিয়াছে, বিধর্ম্মীর রক্তে অস্ত্র রঞ্জিত করিয়াছ, তবে আর ধূলায় পড়িয়া কেন? বাছা! দুঃখিনীর জীবন-সর্ব্বস্ব! উঠিয়া অশ্বে আরোহণ কর। এইবার যুদ্ধক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিলে আর আমি তোমাকে যুদ্ধে পাঠাইব না। ঐ দেখ, তোমার অর্দ্ধাঙ্গরূপিণী বণিতা তোমার যুদ্ধবিজয়-সংবাদ শুনিবার জন্য উৎকণ্ঠিত কর্ণে সতৃষ্ণনয়নে আক্ষেপ করিতেছে!”

 আবদুল ওহাবের বিয়োগে হোসেন কাঁদিলেন। হোসেনের পরিজন বর্গ ডাক ফুক্‌রাইয়া দিলেন। আবদুল ওহাবের মাতা অশ্রুনয়নে রোষভরে বলিতে লাগিলেন, “আবদুল ওহাব! এত ডাকিলাম, উঠিলে না; তোমার মায়ের কথা আর শুনিলে না!” শোকাবেগে এই কথা বলিয়া বৃদ্ধ পুনরায় পুত্রমস্তক বক্ষে ধারণ করিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, আমার পুত্রহন্তা কে? আবদুল ওহাব কাহার হস্তে জীবন বিসর্জ্জন করিল। কে আমার আবদুল ওহাবের মস্তক আমার ক্রোড়ে আনিয়া নিক্ষেপ করিল? দেখি, দেখি—দেখিব, দেখিব!” বলিয়া আবদুল ওহাব-জননী তখনি ত্বরিত পদে আবদুল ওহাবের অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করিলেন। হােসেন অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া নিষেধ করিলেন, তিনি কিছুতেই শুনিলেন না। পুত্রমস্তক কোলে করিয়াই অশ্বপৃষ্ঠে যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “কোন কাফের, কোন্ পাপাত্মা, কোন শৃগাল আমার পুত্রের মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়াছে? ঈশ্বরের দোহাই, এই যুদ্ধক্ষেত্রে একবার আসিয়া সেই পাপাত্মা, সেই পিশাচ, সেই কাফের আমার সম্মুখে দেখা দিক্‌।”

 ‘ঈশ্বরের দোহাই’ শুনিয়া আবদুল ওহাব-হন্তা যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়া দর্পের সহিত বলিতে লাগিল, “আমারই এই শাণিত অস্ত্রে আবদুল ওহাবের মস্তক সেই পাপদেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে।” আর কোন কথা হইল না। আবদুল ওহাব-জননী পুত্র-ঘাতককে দেখিয়া সক্রোধে আবদুল ওহাবের মস্তক এমন জোরে তাহার মস্তক লক্ষ্য করিয়া মারিলেন যে, ঐ আঘাতেই কাফেরের মস্তক ভগ্ন হইয়া মজ্জা নির্গত হইতে লাগিল! তাহার তখনই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি।

 এই ঘটনা দেখিয়া ওমর মহারােষে আবদুল ওহাবের জননীর চতুর্দ্দিকে সৈন্য বেষ্টন করিলেন। বৃদ্ধা বলিতে লাগিলেন, “বৎসগণ! তােমাদের মঙ্গল হউক। আমার জীবনে মায়া নাই। পুত্রশােক নিবারণ করিবার জন্য এই বৃদ্ধ বয়সে যুদ্ধক্ষেত্রে আসিয়াছি। তােমরা আমাকে নিপাত কর। যে পথে আমার আবদুল ওহাব গিয়াছে, আমিও সেই পথে যাই। কিন্তু আকাশে যদি কেহ বিচারকর্ত্তা থাকেন, তিনি তােমাদের বিচার করিবেন।” অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আবদুল ওহাব-জননী শত্রুহস্তে প্রাণত্যাগ করিয়া স্বপ্নবাসিনী হইলেন।

 আবদুল ওহাবের মাতা প্রাণত্যাগ করিলে গাজী রহ্‌মান হােসেনের পদচুম্বন করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইলেন। তিনিও বহুসংখ্যক বিধর্ম্মীকে জাহান্নামে পাঠাইয়া শত্রুহস্তে শহীদ হইলেন। ক্রমে জাফর প্রভৃতি প্রধান প্রধান বীরগণ হােসেনের সাহায্যের জন্য শত্রুর সম্মুখীন হইয়া যুদ্ধ করিলেন, কিন্তু কেহই জয়লাভে কৃতকার্য্য হইতে পারিলেন না। প্রায় দেড় লক্ষ বিপক্ষসৈন্য বিনাশ করিয়া মদিনার প্রধান প্রধান যােদ্ধা মাত্রেই শত্রুহস্তে আত্মসমর্পন করিয়া স্বর্গধামে মহাপ্রস্থিত হইলেন।