বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/সপ্তদশ প্রবাহ
সপ্তদশ প্রবাহ
মন্ত্রণাগৃহে এজিদ একা! দেখিয়াই বোধ হয়, কোন বৃহৎ চিন্তায় এখন তাঁহার মস্তিষ্ক-সিন্ধু উথলিয়া উঠিয়াছে। দুঃখের সহিত চিন্তা,— এ চিন্তার কারণ কি? কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া গৃহের চতুষ্পার্শে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন;—দেখিলেন: কেহই নাই। পূর্ব্ব নির্দ্দিষ্ট সময়ে মারওয়ান মন্ত্রণাগৃহে উপস্থিত থাকিবে; সময় উত্তীর্ণ হইয়াছে, অথচ, মন্ত্রিবর আসিতেছে না! এজিদের চিন্তাকুল অন্তর ক্রমেই অস্থির হইতেছে। দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া মৃদু মৃদু স্বরে তিনি বলিলেন,—“সীমার বন্দী! এত দিন পরে সীমার শত্রু-হস্তে বন্দী! অলীদেরও প্রাণের আশঙ্কা! আমারই সৈন্য—আমারই চির অনুগত সৈন্য যখন বিপক্ষ দলে মিশিয়াছে, তখন আর কল্যাণ নাই। হায়! কি কুক্ষণেই জয়নাব-রূপ নয়নে পড়িয়াছিল। সে বিশালাক্ষির দোলায়মান কর্ণাভরণের দোলায় কি মহা অনর্থই ঘটিল। অকালে কত প্রাণীর প্রাণপাখী দেহ-জগৎ হইতে একেবারে উড়িয়া চলিয়া গেল। শত শত নারী পতিহারা হইয়া মনের দুঃখে আত্মবিসর্জ্জন করিল। কত মাতা সন্তান-বিয়োগে অধীরা হইয়া অস্ত্রের সহায়তায় দৈহিক মায়া হইতে শোক-তাপের যন্ত্রণা হইতে—আত্মাকে রক্ষা করিল। কত শিশুসন্তান এক বিন্দু জলের জন্য শুষ্ককণ্ঠ হইয়া মাতার ক্রোড়ে চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইল! ছিঃ! ছিঃ!! সামান্য প্রেমের দায়ে, দুরাশার কুহকে মহাপাপী হইতে হইল! হায়! হায়!! রূপজমোহে মেহিত হইয়া, আত্মহারা, বন্ধুহারা, শেষে সর্ব্বস্বহারা হইতে হইল! বিনা দোষে, বিনা কারণে কৃত পুণ্যাত্মার জীবন-প্রদীপ নিভিয়া গেল। এত হইল, এত ঘটিল, তবুও আগুণ নিভিল না,সে জ্বলন্ত হুতাশনের তেজ কমিল না,—সে প্রেমের জ্বলন্ত শিখা আর নীচে নামিল না—সে রত্ন হস্তগত হইয়াও আশা পূর্ণ হইল না,—স্ববশে আসিল না!—হোসেনকে বধ করিয়াও সে চিন্তার ইতি হইল না। ক্রমেই আগুন দ্বিগুণ ত্রিগুণরূপে জ্বলিয়া উঠিল। সৈন্যহারা, মিত্রহারা রাজ্যহারা, ক্রমে সর্ব্বস্বহারা হইবার উপক্রম হইয়া উঠিল! ধিক্ রমণীর রূপে! শত ধিক্ কু-প্রেমাভিলাষী পুরুষে! সহ ধিক্ পরস্ত্রী-অপহারক রাজায়!”
এই পর্য্যন্ত বলিতেই মারওয়ান উপস্থিত হইয়া যথাবিধি সম্ভাষণ করিল। এজিদ অন্যমনস্কভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সীমারের কি হইল?”
“মহারাজ! সীমার যখন বিপক্ষদলের হস্তগত হইলেন, তখন তাঁহার আশা এক প্রকার পরিত্যাগ করিতে হইবে। এখন ওত্বে অলীদের রক্ষা, রাজ্যরক্ষা, প্রাণরক্ষা,—এই সকল রক্ষার উপায় চিন্তা করাই অগ্রে কর্ত্তব্য। সীমার উদ্ধারের, সীমারের আশা আর করিবেন না। কারণ, সীমার মোহাম্মদ হানিফার হস্তগত হইলে তাহার রক্ষা কিছুতেই নাই।”
“তবে কি সীমার নাই?”
“সীমার নাই—একথা বলিতে পারি না। তবে অনুমানে বোধ হয় যে, সীমার মোহাম্মদ হানিফার হস্তে পড়িয়াছে। সুতরাং সীমার-উদ্ধারের চিন্তা না করিয়া অলীদ-উদ্ধারের চিন্তাই এক্ষণে আবশ্যক হইয়াছে। তাহার পর এ কয়েক দিনে যদি অলীদ বন্দী হইয়া থাকে, কি যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া আত্মসমর্পণ করিয়া থাকে, তবে প্রথম চিন্তা দামেস্ক-রাজ্য রক্ষা—আপনার প্রাণরক্ষা। আপন সৈন্য যখন বিপক্ষদলে মিশিয়াছে, তখন দুঃসময়ের পূর্ব্ব-চিহ্ন, দুরাবস্থার পূর্ব্বলক্ষণ সম্পূর্ণ বিপদের সূচনা দেখাইয়া অমঙ্গলকে আহ্বান করিতেছে। আমাদের সৌভাগ্য-শশী চিররাহুগ্রস্ত হইবে বলিয়াই জগতের অন্ধকার ছায়ার দিকে ক্রমশঃই সরিতেছে।”
এজিদের কর্ণে কথা কয়টি বিষসংযুক্ত সূচিকার ন্যায় বিগ্ধ হইল। তাহার মনের পূর্ব্বভাব কে যেন হরণ করিয়া অন্তরময় মহাবিষ ঢালিয়া দিল। সিংহ-গর্জ্জনে তিনি গর্জ্জিয়া উঠিলেন, “কি, আমি বাঁচিয়া থাকিতে দামেস্কের সৌভাগ্য-শশী চিররাহুগ্রস্ত হইবে? একথা তুমি আজ কোথায় পাইলে? কে তোমার কর্ণে এ মূলমন্ত্র দিয়াছে? মারওয়ান! বুঝিলাম, হানিফার তরবারির তেজের কথা শুনিয়া তোমারও হৃৎপিণ্ডের শোণিতধার শুকাইয়া গিয়াছে। তুমিও নিশ্চয় জানিও, এজিদ বর্ত্তমান থাকিতে এ রাজ্যের সৌভাগ্যশশীর অল্প পরিমাণ অংশও রাহুর গ্রাসে পতিত হইবে না। আমি তোমাকে এইক্ষণে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি তাহারই উত্তর দাও। জয়নাল আবেদীন, হাসান-পরিবার ইহারা কি এখনও জীবিত থাকিবে। মোহাম্মদ হানিফা যদি সীমারের প্রাণবিনাশ করিয়া থাকে, তবে নিশ্চয়ই আমি জয়নালের শিরশ্ছেদ স্বহস্তে করিব।”
“মহারাজ! এ সময়ে জয়নাল আবেদীনের প্রাণ বিনাশ করিলে আর নিস্তার নাই। এ জ্বলন্ত অগ্নি এখনও নির্ব্বাণের উপায় আছে—এখনও রক্ষার উপায় আছে—এখনও সন্ধির আশা আছে। কিন্তু জয়নালের কোন অনিষ্ট ঘটাইলে ধন, জন, রাজ্য, প্রাণ সমূলে বিনাশের সুপ্রশস্ত পথ পরিস্কার করিয়া দেওয়া হইবে। দামেস্ক-রাজ্যের আশা, প্রাণের আশা পরিত্যাগ করিয়া জয়নাল আবেদীনকে যাহা ইচ্ছা হয়, করিতে পারেন। এখনও পরাজয় স্বীকার পূর্ব্বক জয়নালকে ছাড়িয়া দিলে দামেস্কনগর রক্ষার আশা করিলেও করা যাইতে পারে। দেখুন, হাসানের বধসাধন হইলে বৃদ্ধ মন্ত্রী হামান প্রকাশ্য সভায় যখন সারগর্ভ রাজনৈতিক উপদেশচ্ছলে নিজ মত প্রকাশ করিয়াছিলেন, সে সময় আমি তাঁহার মতেয় পোষকতা করি নাই। যদি জানিতাম যে, হোসেন ব্যতীত মোহাম্মদ হানিফা নামে প্রবল পরাক্রান্ত আরও এক বীর আছে, তাহা হইলে বৃদ্ধ সচিবের কথা কখনও অবহেলা করিতাম না। আপনার মত প্রবল করিয়া কোনকালেই অগ্রসর হইতাম না; যদি হইতাম, তবে অগ্রে হানিফার বধসাধন না করিয়া হোসেনের বিরুদ্ধে কিছুতেই অস্ত্র ধরিতাম না। ভ্রম লোকের সর্ব্বনাশের মূল। ভ্রমই মনুষ্যের অমঙ্গলের কারণ!
“মারওয়ান! তোমার এ দুর্ব্বুদ্ধি আজ কেন হইল? আমি পরাজয় স্বীকার করিয়া সন্ধি করিব? প্রাণের ভয়ে হানিফার সহিত সন্ধি করিব? জয়নালকে, হাসান-পরিজনকে ছাড়িয়া দিব? জয়নাবকে ছাড়িয়া দিব? ধিক্ তোমার কথায়। আর শত ধিক্ এজিদের প্রাণে! মারওয়ান! বল ত, এ মহাসংগ্রামের কারণ কি? এ ঘটনার মূল কি? তুমি কি . সকলি বিস্মৃত হইয়াছ? মনে হয়, তুমিই বলিয়াছিলে, স্ত্রীজাতি বাহ্যিক সুখপ্রিয়? কৈ এত দিনেও ত তোমার কথার সত্যতা-প্রমাণ বা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাইলাম না। জগতে সুখী হইতে কে না ইচ্ছা করে? —এও তোমারই কথা। কৈ, জয়নাব বন্দীগৃহে মহাক্লেশে থাকিয়াও ত সুখী হইতে ইচ্ছা করে না, পাটরাণী হইতেও চাহে না? মারওয়ান। তোমাদের পদে পদে ভ্রম। আমি ত উন্মাদ। গত বিষয়ের আলোচনা বৃথা। আমার আজ্ঞা এই যে, তোমাকে এখনই অলীদের সাহায্যে এবং সীমারের উদ্ধারে যাইতে হইবে।”
“আমি যাইতে প্রস্তুত। অলীদের সাহায্য ব্যতীত এ সময়ে হানিফাকে আক্রমণ করিতে আমি পারিব না।”
“সুযোগ পাইলে আক্রমণ করিবে না?”
“সুযোগ পাইলে মারওয়ান ছাড়িয়া দিবে, তাহা মনে করিবেন না। তবে বলিতেছি যে, অগ্রে অলীদকে রক্ষা করাই আমার প্রধান কার্য্য। সীমারের দেখা পাইলে, কিম্বা সে জীবিত থাকিলে অবশ্যই তাহার উদ্ধারের চেষ্টা করিব।”
“চেষ্টা করিবে,—এ কি কথা? উদ্ধার করিতেই হইবে।”
“মহারাজ। যে কঠিন সময় উপস্থিত হইয়াছে, নিশ্চিতরূপে আর কিছুই বলিতে পারি না। সময় মন্দ হইলে চতুর্দ্দিক হইতে বিপদ চাপিয়া পড়ে। এখন ভবিষ্যৎ ভাবিয়া কার্য্য না করিলে পরিণাম রক্ষা করা যাইবে না। একা মোহাম্মদ হানিফা আপনার শত্রু নহে। নানা দেশের, নানা রাজ্যের ভূপতি ও বীরপুরুষগণ আপনার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়াছে। বলিতে গেলে, মোহাম্মদভক্ত মাত্রেই আপনার প্রাণ লইতে দুই হস্ত বিস্তার করিয়াছে।”
“আমি কি এতই হীনবল হইয়া পড়িয়াছি যে, তোমার বর্ণিত রাজগণের সহিত যুদ্ধ করিয়া পরাস্ত হইব?”
“মহারাজ! জয়-পরাজয় ভবিষ্যতের গর্ভে।”
“তবে কি হানিফার খণ্ডিত মস্তক আমি দেখিব না?”
“অবশ্যই দেখিতে পারেন—বিলম্বে।”
“কথা অনেক শুনিলাম, তুমি অদ্যই পঞ্চদশ সহস্র সৈন্য লইয়া অলীদের সাহায্যের এবং সীমারের উদ্ধারের জন্য গমন কর,—এই আমার আজ্ঞা।”
এই আজ্ঞা করিয়া এজিদ রোষভরে মন্ত্রণাগৃহ হইতে উঠিয়া চলিয়া গেলেন।
মারওয়ান বলিতে লাগিল, “দুর্ম্মতির লক্ষণ এই, যেখানে উচিত কথা সেইখানেই রোষ। যাহা হউক, আমি এখনই যাত্রা করিব, সীমারের উদ্ধার যাহা হইবার, বোধ হয় এতদিনে হইয়া গিয়াছে, অলীদের উদ্ধার হয় কিনা তাহাই সন্দেহ।”