বিষাদ-সিন্ধু/উদ্ধার পর্ব্ব/অষ্টাদশ প্রবাহ

অষ্টাদশ প্রবাহ

 কি মর্ম্মভেদী দৃশ্য! কি হৃদয়বিদারক বিষাদ ভাব! কাহারও মুখে কথা নাই, হর্ষের চিহ্ন নাই, যুদ্ধ-জয়ের নাম নাই, সীমার-বধের প্রসঙ্গ নাই, অলীদ-পরাজয়ের আলোচনা নাই।—রাজার রাজবেশ-শূন্য, শির শিরস্ত্রাণশূন্য, পদ পাদুকাশূন্য,—পরিধেয় নীলবাস, বিষাদ-চিহ্ন নীলবাস! সৈন্যদলে বাজনা বাজিতেছে না, তুরীডঙ্কার আর শব্দ হইতেছে না, ‘নকীব’ উষ্ট্রপৃষ্ঠে বসিয়া ভেরীরবে ভূপতিগণের শুভাগমন-বার্ত্তা আর যোষণা করিতেছে না। সকলেই পদব্রজে, সকলেরই ম্লানমুখ, সকলেই নীরব। তীর তুণীরে, তরবারি কোষে, খঞ্জর পিধানে, সকলের চক্ষুই জলে পরিপূর্ণ। কারুকার্য্যখচিত সুন্দর নিশান-স্থানে আজ নীল নিশান। হানিফা সসৈন্যে রাজপথে—পুণ্যভূমি মদিনা নগরের রাজপথে। নগরের উচ্চ উচ্চ প্রাসাদে, অত্যুচ্চ মঞ্চে, সিংহদ্বারে, নানা স্থানে অনন্ত শোক-প্রকাশক নীল পতাকাসকল বায়ু তাড়িত হইয়া অনন্ত নীলাকাশে মিশিয়া হোসেনজনিত অনন্ত শোক কাঁপিয়া কাঁপিয়া প্রকাশ করিতেছে। যে দিকে দৃক্‌পাত কর, সেই দিকেই শোকের চিহ্ন-বিষাদের রেখা। হোসেন-শোকে মদিনার এই দশা। এ দশা কে করিল? এ অন্তর্ভেদী দুর্দ্দশা কে ঘটাইল? মর্ত্ত্যে, শূন্য়ে, আকাশে, নীলিমা-রেখা কে অঙ্কিত করিল? হায়! হায়!! হোসেন-শোকের অন্ত নাই। এ বিষাদ সিন্ধুর শেষ নাই। বিমানে সুর্য্যদেবের অধিকার, রজনী দেবীর তারকামালার অধিকার থাকা পর্য্যন্ত মোহাম্মদীয়গণের অন্তরাকাশ হইতে এ মহাবিষাদ-নীলিম-রেখা কখনই সরিবে না!

 মোহাম্মদ হানিফা নিদারুণ শোকে, মর্ম্মভেদী বেশে নগরে প্রবেশ করিলেন। নগরবাসিগণ হোসেনের নাম করিয়া দিতে দিতে মোহাম্মদ হানিফার পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত হইতে লাগিল। হায়! পুণ্যভূমি মদিনায় আজ অন্ধকার। মোহাম্মদ হানিফার অন্তরে শোক-সিন্ধুর তরঙ্গ উঠিয়াছে—প্রবাহ ছুটিয়াছে। নূরনবী হজরত মোহাম্মদের রওজার চতুষ্পার্শ্বে যাইয়া সকলে একত্রে হাসান, কাসেম প্রভৃতির শোকে অধীর হইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। ক্রমেই ক্রন্দনের আবেগ বৃদ্ধি, আরও বৃদ্ধি! কিন্তু বৃদ্ধি। হইতে হইতেই হ্রাস, ক্রমেই মন্দীভূত, ক্রমেই নীরব, ক্রমেই হা-হুতাশ, ক্রমেই দুই একটি কথা শুনা যাইতে লাগিল। মোহাম্মদ হানিফা সকলের কথাই শুনিতে লাগিলেন, অনেককে আশ্বস্ত করিলেন, অনেককে সাহস দিলেন, কাহাকেও বা সস্নেহ মিষ্ট সম্ভাষণে আদর করিলেন। ক্রমে নাগরিকদলকে বিদায় দিয়া সঙ্গীয় রাজগণ, সৈন্যগণ, আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবগণ কে কোথায় আছেন, কি করিতেছেন, তাহার তত্ত্বাবধান করিয়া আহার বিহার বিশ্রামের শৃঙ্খলায় মনোনিবেশ করিলেন।

 মদিনার প্রধান প্রধান ও মাননীয় সম্ভ্রান্ত মহোদয়গণ আসিয়া বলিতে লাগিলেন, “যাহা হইবার হইয়াছে, এক্ষণে কি করা যায়?”

 মোহাম্মদ হানিফা বলিলেন, “মদিনার সিংহাসনে জয়নাল আবেদীনকে বসাইতে না পারিলে আমার মনে শান্তি হইবে না। দুঃখ করিবার সময় অনেক রহিয়াছে। মদিনার যেরূপ বিশ্রী অবস্থা দেখিতেছি, ইহাতে আমার মন অত্যন্ত চঞ্চল ও ব্যথিত হইয়া মহা কষ্টভোগ করিতেছে। জয়নাল আবেদীন নিশ্চয়ই জীবিত আছে। জয়নাল মদিনা ও দামেস্ক উভয় রাজ্যই করতলস্থ করিয়া একচ্ছত্ররূপে রাজত্ব করিবে—ইহা নিশ্চিত, অব্যর্থ। যাঁহার ভবিষ্যদ্বাণী এতদূর সফল হইল, তাঁহার বাক্যের শেষ অংশ কি আর সফল হইবে না? আপনারা সকলে অনুমতি করিলেই আমি দামেস্ক-আক্রমণের জন্য যাত্রা করিতে পারি।”

 নাগরিক দলমধ্য হইতে একজন বলিলেন, “জয়নাল আবেদীন ঈশ্বরানুগ্রহে অবশ্যই মক্কা, মদিনা ও দামেস্কের সিংহাসন অধিকার করিবেন, সে বিষয়ে আমাদের জ্বলন্ত বিশ্বাস ও অটল আশা আছে; তবে কয়েকদিন বিলম্ব মাত্র। আপনি পথশ্রমে শ্রান্ত, সৈন্যগণও অলীদের সহিত যুদ্ধে ক্লান্ত হইয়াছে; এ অবস্থায় কয়েকদিন এই পবিত্রধামে বিশ্রাম করিয়া দামেস্কে যাত্রা করুন,—এই আমাদের প্রার্থনা। জয়নাল উদ্ধারে মদিনার আবালবৃদ্ধবণিতা আপনার পশ্চাদ্বর্ত্তী হইবে, কেহই ঘরে বসিয়া থাকিবে না। এত দিন আমরা নায়কবিহীন হইয়া পথে পথে ঘুরিয়াছি; যাহার যাহা ইচ্ছা তাহাই বলিয়াছি; কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। হজরতের চরণপ্রান্তে আশ্রয় লইব বলিয়াই আমরা কাসেদ পাঠাইয়াছিলাম। আপনি এত অল্প সৈন্য লইয়া কখনই দামেস্কে যাইবেন না। এজিদের চক্র, মারওয়ানের মন্ত্রণা ভেদ করা বড়ই কঠিন,আমরাও আপনার সঙ্গে যাইব। এখনও মদিনা বীরশূন্য হয় নাই—এখনও মদিনা পরাধীন বা পরপদভরে দলিত হয় নাই।—এখনও মদিনার স্বাধীনতা-সূর্য্য নিঃসহায়, কি কোন বিষয়ে নিরাশ হয় নাই। এজিদের অত্যাচার—নূরনবী মোহাম্মদের বংশধরগণের প্রতি অত্যাচারের কথা মদিনা ভুলে নাই। যাহার জন্য এই সিংহাসন শূন্য আছে, তাহার কথা সকলের অন্তরে গাঁথা রহিয়াছে, তাহার উদ্ধারের চেষ্টা দিবানিশি অন্তরে জাগিতেছে। আপনি যে-দিন মদিনা হইতে যাত্রা করিবেন, সেই দিন মদিনার লোকের প্রভুভক্তি, রাজভক্তি, একতার আদর্শ, হোসেনের বিয়োগজনিত দুঃখের চিহ্ন—সকলই দেখিতে পাইবেন। আমি আর অধিক বলিতে পারি না; এইমাত্র নিবেদন যে, সপ্তাহকাল এই নগরে বিশ্রাম করুন, সপ্তাহকাল পরে আমরা সকলে আপনার সঙ্গী হইব।”

 মোহাম্মদ হানিফা নগরবাসীদিগের অনুরোধে সপ্তাহকাল সসৈন্য়ে মদিনায় থাকিতে সম্মত হইলেন।

 ওদিকে মারওয়ানের মদিনাভিমুখে আগমন এবং অলীদের দামেস্কে গমন, পথিমধ্যে উভয় সেনাপতির সাক্ষাৎ—উভয় দলের মিলন! অলীদের সঙ্গে অল্প মাত্র সৈন্য; তাহার অধিকাংশ আহত, কতক জরাগ্রস্ত, বা অর্দ্ধমৃত, কতক অসুস্থ। তাহাদের মুখ মলিন, বসন মলিন। তাহাদের পৃষ্ঠদেশে তুণীর ঝুলিতেছে, তীর নাই—কোষ রহিয়াছে, তরবারি নাই। বর্শার ফলক কোথায় উড়িয়া গিয়াছে, কেবল দণ্ড বর্ত্তমান। পতাকাছিন্ন, দণ্ড ভগ্ন—সাহস উৎসাহের নাম মাত্র যেন নাই। তাহারা তাড়িত,—ভয়ে চকিত, তাহাদের সর্ব্বদাই পশ্চাদৃষ্টি। মনঃসংযোগে অশ্ব-পদ-শব্দ শুনিতে তাহাদের কর্ণ স্থির। সৈন্যগণের অবস্থা দেখিলেই অনুমান হয় যে, প্রবল ঝঞ্ঝাবাতেই ইহাদের সর্ব্বস্ব উড়িয়া গিয়াছে। আহারাভাবে তাহারা মহা-ক্লান্ত।

 মন্ত্রীপ্রবর মারওয়ান অলীদের অবস্থা দেখিয়া আর অগ্রসর হইতে সাহসী হইল, না, ঐ সংযোগস্থলেই উভয় দল একত্রিত হইয়া গমনে ক্ষান্ত হইল। পরস্পর কথাবার্ত্তা আরম্ভ হইলে মারওয়ান বলিল, “এইক্ষণে মদিনা আক্রমণ, কি হানিফার সহিত যুদ্ধ করা উচিত নহে; আমাদের বলবিক্রমের সহিত তুলনা করিলে হানিফার সৈন্যদল সহস্রাংশে শ্রেষ্ঠ; এ অবস্থায় আত্মরক্ষাই সর্ব্বতোভাবে শ্রেয়।”

 অলীদ বলিল, “আত্মরক্ষা ভিন্ন আর উপায় কি? সীমারের দুর্দ্দশা দেখিয়া আমার প্রাণ কাঁপিয়া উঠিয়াছে।”

 “সীমারের দুর্দ্দশা কি?”

 অণীদ সীমারের শাস্তির বৃত্তান্ত আদি-অন্ত বিবৃত করিল।

 মারওয়ান বলিল, “সীমারের যে, দুর্দ্দশা ঘটিবে—তাহা আমি অগ্রেই ভাবিয়া স্থির করিয়াছিলাম।”

 অলাদ বলিল, “ভ্রাতঃ। হানিফার বল বিক্রম দেখিয়া স্বদেশের আশা, জীবনের আশা, ধন-জন-পরিজন-আশা হইতে একেবারে নিরাশ হই নাই বটে, কিন্তু সন্দেহ অনেক ঘটিয়াছে।”

 “ওরে ভাই! আমি ত সীমার-উদ্ধার ও তোমার সাহায্য,—এই দুই কার্য্যের ভার গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি। সীমারের উদ্ধার ত এ জীবনে এক প্রকার শেষ হইল। এখন তোমার সাহায্যেরই বাকী। যাহা হউক, এই সকল অবস্থা লিখিয়া মহারাজ-সমীপে কাসেদ প্রেরণ করি। উত্তর পাওয়া পর্য্যন্ত আমরা এই স্থানেই অবস্থান করিব। এই স্থানটি অতি মনোহর ও মনোরম।”