বিষাদ-সিন্ধু/এজিদ-বধ পর্ব্ব/চতুর্থ প্রবাহ
চতুর্থ প্রবাহ
আশা মিটিবার নহে। মানুষের মনের আশা পূর্ণ হইবার নহে। ঘটনার সূত্রপাত্র হইতে শেষ পর্যন্ত অনেকের মনে অনেক প্রকারের আশার সঞ্চার হয়। আশার কুহকে মাতিয়া অনেকেইপথে—বিপথে ছুটিয়া বেড়ায়। ঘটনাচক্রে যতদুর গড়াইয়া লইয়া যায়, তাহাতেই বোধ হয় যেন পূর্বব আশা পূর্ণ হইল। এই পূর্ণবোধ হইতে হইতে দুই তিন চারি, এমন কি, পঞ্চ প্রকারের আশা পঞ্চাশ ভাগে, পঞ্চ শত বিভাগে ঘটনালিপ্ত মানুষের হৃদয়কাশে সচঞ্চল চঞ্চলার ন্যায় ছুটিতে থাকে,—খেলিতে থাকে। জীবনের সহিত আশার সম্বন্ধ। আকাঙক্ষার নিবৃত্তি, আশার শাস্তি, জীবনের ইতি—এই তিনেই এক, আবার একেই তিন। সুতরাং জীবন্ত দেহে মনের আশ মিটিবার নহে। আশা মিটিল না—মোহাম্মদ হানিফার আশা পূর্ণ হইল না।
যুগল অশ্ব বেগে ছুটিয়াছে। এজিদের অশ্ব অগ্রে রহিয়াছে। হানিফার মনের আশা, এজিদকে না মারিয়া জীবন্ত ধরিবেন, পূর্ব প্রতিজ্ঞানুসারে তাহাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, কিন্তু তাহা পারিতেছেন না। এজিদ অশ্বচালনায় পপিঙ্ক; প্রাণের দায়ে তিনি পথ, পথ, ব, জলের খি দিয়া অশ্ব চালাইতেছেন—পলাইতে পারিলেই রক্ষা—কিন্তু পারিতেছেন না। হানিফাকে দূরে ফেলিয়া এজিদ আত্মগোপন করিতে সক্ষম হইতেছেন না। সেই একই ভাব। যাহা কিছু প্রভেদ-অগ্র আর পশ্চাৎ। এজিদ প্রাণপণে অশ চালাইতেছেন, কিন্তু হানিফাকে দূরে ফেলিয়া তাঁহার চক্ষুর অগোচর হওয়া দুরে থাকুক, হানিফার হস্তস্থিত তরবারি অগ্রভাগ হইতে মুচ পরিমাণ গানও অগ্রে যাইতে পারিতেছেন না। সূর্য্যতেজ কমিতেছে, মোহাম্মদ হানিফার থোষও বাড়িতেছে। যতই ক্লান্ত, ততই তাঁহার রোষ বৃদ্ধি!
মোহাম্মদ হানিফা অশবগা দন্তে ধারণ করিয়া এজিদকে ধরিবার নিমিত্ত দুই হস্ত বিস্তার করিয়াছেন। দুলদুল প্রাণপণে দৌড়িতেছে, কিন্তু এদিকে ধরিতে পারিতেছে না। মোহাম্মদ হানিফা এই ধরিলেন, এইবারেই ধরিবেন, আর একটু অগ্রসর হইলেই ধরিতে পারিবেন, অশ্ব হইতে এজিদকে চুত করিবেন, কিন্তু কিছুতেই তাহা পারিতেছেন না।
এজিদ প্রাণভয়ে পলাইতেছেন। অন্য কোন কথা সে সময়ে মনে তার উদয় হইবার কথা নহে। প্রাণ বাঁচাইবার পন্থাই নানা প্রকারে মনে মনে আঁকিতেছেন। আর একটা কথাও তিনি বেশ বুঝিতেছিলেন যে, মোহাম্মদ হানিফা তাহার প্রাণধের ইচ্ছা করিলে বহু পূর্বে তাহা শেষ করিতে পারিতেন, অথচ তাহা করিতেছেন না। তাহার মন ভাকিয়া বলিতেছে, এজিদকে হানিফা ধরিবেন-মারিবেন না-প্রাণে মারিবেন না।” হইতে পারে এজিদের উপর অস্ত্র নিক্ষেপ নিষেধ! এ দুয়ের এক না হইয়া এরূপভাবে বীরের সম্মুখে—বীরের অস্ত্রের সম্মুখ হইতে এতক্ষণ পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকা সৌভাগ্যের কথা। এখন যে কোন উপায়েই হউক হানিফার চক্ষুর অগোচর হইতে পারিলেই রক্ষা। হানিফা চিরদিন দামেস্কে বাস করিবেন না। এই সন্ধ্যা পর্যন্ত যমের হস্ত হইতে বাঁচিতে পারিলেই প্রাণ বাঁচে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই প্রকার যোরাফেরা করিয়া কাটাইতে পারিলেই আর ভয়ের কারণ নাই। দেশ এবং পথ আমার পরিচিত কিন্তু হানিফার সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমি অনায়াসেই অন্ধকায়ে চলিতে পারি। আজিকার অন্তই আমায় কাজ অজীবন রক্ষার একমাত্র উপায়।
এই সকল চিন্তা শ্রেণীবদ্ধরূপে যে এজিদের মনে উদয় হইয়াছিল, তা নহে। মৃত্যুর পূর্বের পূর্ব লক্ষণ—ক্ষণকাল বিকার, ক্ষণকাল অজ্ঞান, ক্ষণকাল ঘোর অচৈতন্যভার! ক্ষণকাল সজ্ঞান সময়টুকুর মধ্যে চিন্তার ঢেউ ঐরূপে সময়ে সময়ে এজিদের মনে উঠিতেছিল। এজিদ হন্তু হইতে অশ্ববল্প। ছাড়িয়া দিলেন। অশে সজোরে কশাঘাত করিতে লাগিলেন। এখন আর দিগ্বিদিক জ্ঞান নাই। অশের স্বেচ্ছাধীন গতিই তাঁহার গতি। মনোমত পথই তাহার বাঁচিবার পথ—আর অশ্বকে দক্ষিণে বামে ফিরাইয়া পলাইবার চেষ্টা করিতেছেন না। ঘোড় আপন ইচ্ছামত ছুটিয়াছে।
হানিফা কিঞ্চিৎ দুরে পড়িলেন। উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন— “এজিদ! হানিফার হস্ত হইতে আজি তোর নিস্তার নাই। কিন্তু এক্ষিণ! এ অবস্থায় তোকে প্রাণে মারিব না, জীবন্ত ধরিব তোর খণ্ডিত শিরে ধরালুষ্টিত ভার, শিশুশ দেহের স্বাভাবিক ক্রিয়ার দৃশ্য,হানিফা একা দেখিতে ইচ্ছা করে না। বিশেষতঃ বীৱেৱ আঘাত চারি চক্ষু একত্র করিয়া। আমি কাপুরুষ নহি যে, তোর পশ্চাৎ দিক হইতে অস্ত্র নিক্ষেপ করিব। হানিফার অস্ত্র আজ পর্যন্ত কাহারও পৃষ্ঠদেশে নিক্ষিপ্ত হয় নাই, অগ্রে চক্ষে ধাধা না লাগাইয়া অদৃশ্যভাবে কাহারও শরীরে প্রবেশ করে না। তুই মনে করি না যে, তোর পিছনে থাকিয়া আমি আঘাত করিব। তুই জঙ্গলে বাস, পাহাড়ে যাস, হানিফা তোর সঙ্গছাড়া নহে।”
এজিদ হানিফার রক্তমাখা শরীর প্রতি একবারমাত্র দৃষ্টি করিয়াছেন। একবার মাত্র চারি চক্ষু একত্র হইয়াছে। এজিদ হানিফার দিকে দ্বিতীয় বার চাহিতে সাহসী হন নাই। কিন্তু সে রক্তজবা সদৃশ আঁখি, রক্তমাখা তরবারি তাহার চক্ষের উপর অনবরত ঘুরিতেছে, হৃদয়ে জাগিতেছে। মুহুর্তে মুহুর্ত্ত তাহার প্রাণ কাঁপিতেছে। আতঙ্কে দক্ষিণে বামে তাঁহার দেহ দুলিতেছে, কোন কোন সময়ে সম্মুখে ঝুকিতেছে। অশ্বচালনে বিশেষ পরিপক্কতা হেতুই এজিদের আসন টলিতেছে না। মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় উচ্চৈঃস্বরে বীরবিক্রমে বলিতে লাগিলেন, “এজিদ। বহু পরিশ্রমের পর তোর দেখা পাইয়াছি। তুই কথনই চক্ষের অন্তরাল হইতে পারিবি না। তুই জানিস, হানিফার বল-বিক্রম প্রকাশের আজই শেষ দিন। আজই হানিফারও ক্রোধাঙ্কের শেষ অভিনয়। আজই বিষাদের শেষ,বিষাদ-সিন্ধুর শেষ,—তোর জীবনের শেষ। ঐ দেখ, সূর্য্য অস্ত যায়। এই অস্তের সহিত কত অস্তের যে যোগ আছে, তাহা কে বলিতে পারে। আমি দেখিতেছি, তিন অস্ত একত্র মিশিবে, একসঙ্গে একযোগে ঘটিবে—তো পরমায়ু, দামেস্কের স্বাধীনতা এবং উপস্থিত সূর্য্য। চাহিয়া দেখ,যদি জ্ঞানের বিপর্যয় না ঘটিয়া থাকে, তবে চাহিয়া দেখ,—গমনমুখ সূর্য্য কেমন চাকচিক্য দেখাইয়া স্বাভাবিক নিয়ম রক্ষা করিতেছে, নির্বাণোম্মুখ দীপও ঐরূপ তেজে জুলিয়া ওঠে। প্রাণবিয়োগ-সময়ে শয্যাশায়ী রোগীর নাড়ীর বলও ঐরূপ সতেজ হয়। তোর কিঞ্চিৎ অগ্রসরতাও তাহাই। আর বিলম্ব নাই। যে এতটুকু অগ্রসর হইয়াছিস, সে বাঁচিবার জন্য নহে, মরিবার জন্য। মরুভূমিতে ঘুরিয়াছি, বনে প্রবেশ করিয়াছি, পর্বতে উঠিয়াছিস, চক্ষু হইতে সরিয়া যাইতে কত চক্রই খেলিয়াছিস্, সরিতে পারিস নাই, হানিফার চক্ষে ধূলি দিয়া চক্ষের অন্তরাল হইতে সাধ্য নাই। এখন নিকটে বন জঙ্গল নাই যে, অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়া বঁচিয়া যাইবি। তুই নিশ্চয়ই জানিস, এই রঞ্জিত অসি তোর পরিশুদ্ধ হৃদয়ের বিকৃত রক্তধারায় আবার রঞ্জিত হইবে। সূর্যরাগে মিশাইয়া উদয়-অস্ত একত্র দেখিব। তুই যাবি কোথা? তোর মত মহাপাপীর স্থান কোথা?”
অশ্বারোহী যদি বাগডোর জোরে না রাখে, ঘোড়ার ইচ্ছানুযায়ী গতিতে যদি বাধা না দেয়, তবে অশ্বমাত্রই আপন বাসস্থানে ছুটিয়া আসিতে চেষ্টা করে। এজিদ নিরাশ হইয়া হস্তস্থিত অশ্ববল্পা ছাড়িয়া দিয়াছেন। কোথায় যাইবেন, কি করিবেন, কোন্ পথে কোথায় গেলে পশ্চাদ্ধাবিত যমের হস্ত হইতে রক্ষা পাইবেন, স্থির করিতে না পারিয়াই তিনি তুরঙ্গ-গতিস্রোতে অঙ্গ ভাসাইয়া দিয়াছেন। রাজ-অশ্ব রাজধানী অভিমুখে ছুটিয়াছে। দামেস্ক এজিদের রাজ্য। পথ ঘাট সকলই পরিচিত। রাজধানী অভিমুখে অশ্বের গতি দেখিয়া তাহার হৃদয়ে নূতন একটি আশার সঞ্চার হইল—রাজপুরী মধ্যে যাইতে পারিলেই রক্ষা, মনের ব্যগ্রতায় এবং প্রাণের মায়ায় আকুল হইয়া দুই হস্তে তিনি অশ্বে কশাঘাত করিতে লাগিলেন—রাজপুরী মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিলেই যেন প্রাণ বাঁচাইতে পারেন এই ভাবে। মুগল অশ্ব বেগে দৌড়িতে থাকুক, এই অবসরে এজিদের নূতন কথাটা ভাঙ্গিয়া বলি।
হজরত মাবিয়ার লোকান্তর গমনের পর এজিদ মারওয়ানের মন্ত্রণায় দামেস্কপুরী-সংলগ্ন উদ্যানমধ্যে ভূগর্ভে এক সুন্দর পুরী নির্মাণ করিয়াছিলেন। ঐ গুপ্তপুরীর প্রবেশদ্বারও এমন সুন্দর কৌশলে নির্মিত হইয়াছিল যে, ইহাকে উদ্যানলতার নিকুঞ্জ ভিন্ন, দ্বার বলিয়া কেহই নির্ধারণ করিতে পারিত না। ঐ পুরী, যে সময়ের অপেক্ষায় আছে আজ সেই সময় উপস্থিত। এজিদের প্রিয় পরিজন, আত্মীয়-স্বজন প্রাণ ভয়ে সকলেই ঐ গুপ্তপুরীর মধ্যে আশ্রয় লইয়াছিলেন। তাহার প্রমাণও পূর্বে পাওয়া গিয়াছে। যেখানকার যে জিনিষ, সেইখানেই পড়িয়া আছে, অথচ জনপ্রাণী মাত্র নাই। কোথায় যাইবে। শত্রু-সেনাপরিবেষ্টিত পুরীমধ্য হইতে কোথায় পলাইবে? ঐ গুপ্তপুরীই প্রাণরক্ষার উপযুক্ত স্থান। এক্তিদের মনেও সেই আশা। তাঁহার সে নীরস হৃদয়ক্ষেত্রে এই একমাত্র আশা-বীজের নব অঙ্কুর। পুরীর কথা মনে পড়িতেই পরিবার-পরিজনের কথা মনে হইয়াছে। তিনি কিঞ্চিৎ আশ্বস্তও হইয়াছেন। রাজপুরী হস্তগত হইলেও পরিবার-পরিজন কখনই পরহস্তগত হইবে -দামেস্কপুরী তন্ন তন্ন করিলেও তাহাদের বিষাদিত কায়া চক্ষে পড়া দূরে থাকুক, ছায়া পর্যন্তও নজরে আসিবে না। এখন উদ্যান পর্যন্ত যাইতে পারিলেই আর পায় কে? লতা-পুষ্পজড়িত কুঞ্জ পর্যন্ত যাইতে পারিলেই হানিফা দেখিবেন যে, এজিদ লতাপাতায় মিশিয়া গেল, পরমাণু আকারের পূষ্পরেণুর সহিত মিশিয়া পুষ্পদলে দেহ ঢাকিয়া ফেলিল। যাহাই হউক, উদ্যান পর্যন্ত যাইতে পারিলেই এজিদের জয়। নগরও নিকটবর্তী। এজিদ জন্মের মত দামেস্ক নগরের পতন-দৃশ্য দেখিয়া চলিলেন। দেখিতে দেখিতে নগরের সুরঞ্জিত সিংহদ্বারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দ্বার অমিত—প্রহরি-বজ্জিত। মৃতদেহে রাজপথ পরিপূর্ণ। শবাহারী, পশুপক্ষিগণ মহা আনন্দিত। চক্ষের পলকে প্রবেশ দ্বার পার হইয়া তিনি নগরে প্রবেশ করিলেন। রাজপুরী চক্ষে পড়িতেই দেখিলেন: উচ্চ উচ্চ মঞ্চে নানা আকারে নূতন পতাকাসকল নগর লোহিত আভায় মিশিয়া অর্ধচন্দ্র এবং পূর্ণতারা প্রত্যক্ষভাবে দেখাইয়া দামেস্কের পতন-দৃশ্য দর্শকগণকে দেখাইতেছে। বিজয়-বাজনা তুমুল বেগে কর্ণে আসিতেছে!-ক্রমেই তিনি নিকটবর্তী হইলেন, রাজপুরী অতি নিকটে। বন্দীগৃহ দূর হইলেও দৃষ্টির অদূর নহে। বন্দীগৃহ চক্ষে পড়িল। এজিদের চক্ষে দামেস্কের বন্দীগৃহ পড়িতেই তাঁহার মন যেন কেমন করিয়া চমকিয়া উঠিল। এমন সঙ্কট সময়েও এজিদের মন যেন কেমন করিয়া উঠিল। যে রূপ হৃদয়ের নিভৃত স্থানে লুকাইয়া ছিল, সরিয়া আসিল।—কিন্তু বেশীক্ষণ রহিল না। চিত্তক্ষেত্র হইতে সে রূপরাশি একেবারে সরিয়া গেল। নামটি মনে উঠিল, কিন্তু মুখে ফুটিল না। দীর্ঘনিশ্বাসও বহিল না। প্রমাণ হইল, প্রমোেদ অপেক্ষা প্রাণের দায়ই সমধিক প্রল। এই সামান্য অন্যমনস্কতায় এজিদের অশ্বগতি কিঞ্চিৎ শিথিল হইল।
মোহাম্মদ হানিফা এই অবসরে ঐ পরিমাণ স্থান অগ্রসর হইয়া গভীর গর্জনে বলিতে লাগিলেন, “এজিদ। মনে করিয়াছি যে, পুরীমধ্যে প্রবেশ করিলেই আজিকার মত বাঁচিয়া যাইবি? তাহা কখনই মনে করি না। এই সন্ধ্যাপ্রদীপ জুলিতে জুলিতে তোর জীবন-প্রদীপও নির্বাণ হইবে। তোর পক্ষে দামেস্ক-রাজপুরী এইক্ষণে সাক্ষাৎ যমপুরী। কি আশায় সেদিকে দৌড়িয়াছিস্? দেখিতেছি না? উচ্চ মঞ্চে কাহার নিশান উড়িতেছে, দেখিতেছিস না? রে নরাধম। তুই সেই এজিদ, যে আরবের সর্ব প্রধান বীর হাসানকে কৌশল করিয়া মারিয়াছিস? কি সেই পামর, যে সীমার দ্বারা হোসেনের মস্তক কাটাইয়া লক্ষ টাকা পুরস্কার দিয়াছিল?
মোহাম্মদ হানিফা ক্রোধে অধীর হইয়া অশ্বে কষাঘাত করিলেন। দ্রুতগতি অশপদ-শব্দে পুৱজনগণ চমকিয়া উঠিলেন। বিজয়-বাজনা, আরোল, জয়ধ্বনির কোলাহল ভেদ করিয়া অপদশব্দ মহাশব্দে সকলের কর্ণে প্রবেশ করিল। যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, শশব্যস্ত হইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে সিংহদ্বার দিকে ছুটিলেন। এজিদ অশ্ব হইতে প্রথমে উদ্যান, শেষে পুষ্পলতাসজ্জিত নিকুঞ্জ দেখিয়া একটু আশ্বস্ত হইলেন।
মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি মহারথিগণ, কেহ অশ্বে, কেহ পদব্রজে দ্রুতবেগে অসি-হস্তে আসিতেই হানিফা উচ্চৈঃস্বরে বলিতে লাগিলেন, “ভ্রাতাগণ! ক্ষান্ত হও! দোহাই তোমাদের ঈশ্বরের— ক্ষান্ত হও! এজিদ তোমাদের বধ্য নহে। বাধা দিও না! এজিদের গমনে বাধা দিও না। এজিদের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিও না।”
মোহাম্মদ হানিফার কথা শেষ হইতে না হইতে এজিদ এক লম্ফে অশ্ব হইতে নামিয়া উদ্যান অভিমুখে চলিলেন! হানিফাও ত্রস্তভাবে দুল্দুলের পৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিয়া অসিহস্তে এজিদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়াইলেন। এজিদ যথাসাধ্য দৌড়িয়া উদ্যানস্থ নির্দ্দিষ্ট নিকুঞ্জ মধ্যে যাইয়া ফিরিয়া তাকাইতেই দেখিলেন, মোহাম্মদ হানিফাও অতি নিকটে—বিকৃত ও ভগ্নস্বরে বলিলেন, “হানিফা ক্ষান্ত হও! আর কেন? তোমার আশা, তোমার প্রতিজ্ঞা, তোমার মুখেই রহিল, এজিদ চলিল।” এই কথা বলয়াই এজিদ গুপ্তপুরীর প্রবেশদ্বার কূপমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
মোহাম্মদ হানিফা রোষে অধীর হইয়া——“যাবি কোথা নরাধম” এই কথা বলিয়া, বীর-বিক্রমে হুঙ্কার ছাড়িয়া অসি-হস্তে কূপ মধ্যে লম্প দিবার উপক্রম করিতেই বজ্রনাদে শব্দ হইল, “হানিফা! এজিদ তোমার বধ্য নহে।” মোহাম্মদ হানিফা থতমত খাইয়া ঊর্দ্ধদিকে চাহিতেই প্রভু হোসেনের তোজোময় ছায়া দেখিয়া চম্কিয়া উঠিয়া পিছনে হটিলেন এবং ভয়ে চক্ষু বন্ধু করিলেন।
পুনরায় গভীর নিনাদে শব্দ হইল, “হানিফা ক্ষান্ত হও, এজিদ তোমার বধ্য নহে।”
মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় চক্ষু মেলিয়া তাকাতেই দেখিলেন, মহাঅগ্নিময় মহাতেজ অসংখ্য শিখা বিস্তারে সহস্র অশনিপাত সদৃশ বিকট শব্দ করিয়া নিকুঞ্জ মধ্যস্থ কূপমধ্যে মহাবেগে প্রবেশ করিল। এজিদের আর্ত্তনাদে উদ্যানস্থ পক্ষীকুল বিকট কণ্ঠে ভয়ে ডাকিয়া উঠিল, বাসা ছাড়িয়া, শাখা ছাড়িয়া, দিগ্বিদিকে উড়িয়া বেড়াইতে আরম্ভ করিল। ভূকম্পনে তরুলতাসকল ভয়ে কাঁপিতে লাগিল। গাজী রহ্মান, মস্হাব কাক্কা, ওমর আলী, আক্কেল আলী প্রভৃতি উপস্থিত ঘটনা দেখিয়া নির্ব্বাকে হানিফার পশ্চাতে দণ্ডায়মান হিলেন। মোহাম্মদ হানিফার ভাব ভিন্ন— মুখাকৃতি বিকৃত অথচ হিংসায় পরিপূর্ণ। তাঁহার হৃদয় হিংসানলে দগ্ধীভূত। স্থির নেত্রে উর্দ্ধমুখ হইয়া তিনি দণ্ডায়মান। তরবারি-মুষ্টি তাঁহার দক্ষিণ হস্তে, তরবারির অগ্রভাগ তাঁহার বামস্কন্ধে স্থাপিত।
আবার দৈববাণী হইল—“হানিফা! দুঃখ করিও না। এজিদ কাহারও বধ্য নহে। রোজ-কেয়ামত (শেষ দিন) পর্য্যন্ত এজিদ এই কূপে এই জ্বলন্ত হুতাশনে জ্বলিতে থাকিবে—পুড়িতে থাকিবে, অথচ প্রাণ বিয়োগ হইবে না।”
মোহাম্মদ হানিফা চম্কিয়া উঠিলেন। তাঁহার তরবারির অগ্রভাগ স্কন্ধ হইতে মৃত্তিকা স্পর্শ করিল। অশ্ব-বল্গা বাম হস্তে ধরিয়া তিনি বলিতে লাগিলেন, “এজিদ আমার বধ্য নহে। আর কি করিব? ইচ্ছা করিলে এক তীব্র তীরে নরাধমের কলিজা পার করিতে পারিতাম; হৃদয়ের রক্তধারায় তরবারি দ্বারাই নারকীয় দেহ দুই খণ্ডে বিভক্ত হইত। তাহা করি নাই, চক্ষে চক্ষে সম্মুখে না যুঝিয়া, অস্ত্রের চাকচিক্য না দেখাইয়া কাহারও প্রাণ সংহার করি নাই। ইহজীবনে কাহারাও পৃষ্ঠে আঘাত করি নাই। এজিদ পৃষ্ঠ দেখাইল। আর অস্ত্রের আঘাত কি? জীবন্ত ধরিব, সকলের সম্মুখে ধরিয়া আনিব, একত্র এক সঙ্গে মনের আগুন নির্ব্বাণ করিব,—তাহা হইল না। মনের আশা মিটিল না! এত পরিশ্রম করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারিলাম না! এক্ষণে কি করি! প্রিয় গাজী রহ্মান! ভাই মস্হাব! হানিফার মনের আগুন নিভিল না! আশা পূর্ণ হইল না! কি করি?”
এই বলিয়া মোহাম্মদ হানিফা পুনরায় অশ্বে আরোহণ করিলেন,—চক্ষের পলকে উদ্যান হইতে বাহির হইলেন। গাজী রহ্মান মহা সঙ্কটকাল ভাবিয়া মস্হাব কাক্কা, ওমর আলী প্রভৃতিকে বলিলেন—“ভাবিয়াছিলাম, আজই বিষাদ-সিন্ধু পার হইয়া সুখ-সিন্ধুর দুখতটে সকলে একত্রে উঠিব, বোধ হয়, তাহা ঘটিল না। শীঘ্র আসুন! বিলম্ব করিবেন না। আমি ভবিষ্যৎ বড়ই অমঙ্গল দেখিতেছি। আম্বাজাধিপতির মতিগতি ভাল বোধ হইতেছে না! শীঘ্র অশ্বে আরোহণ করুন। বড়ই কঠিন সময় উপস্থিত, দয়াময়ের লীলা বুঝিয়া উঠা মানুষের সাধ্য নয়!”