বিষাদ-সিন্ধু/এজিদ-বধ পর্ব্ব/পঞ্চম প্রবাহ
পঞ্চম প্রবাহ
এখন আর সূর্য্য নাই—পশ্চিম গগনে মাত্র লোহিত আভা আছে। সন্ধ্যাদেবী সবেমাত্র একটু ঘোমটা খুলিয়াছেন। তারাদল দলে দলে দেখা দিতে দিতে অগ্রসর হইতেছেন; কেহ কেহ সন্ধা-সীমন্তিনীর সীমন্ত উপরিস্থ অম্বরে ঝুলিয়া জগৎ মোহিত করিতেছেন, কেহ বা সুদূরে থাকিয়া মিটিমিটিভাবে চাহিতেছেন—ঘৃণার সহিত চক্ষু বন্ধ করিতেছেন, আবার দেখিতেছেন। মানবদেহের সহিত তারাদলের কোন সম্বন্ধ নাই বলিয়া দেখিতে পাইতেছেন না; কিন্তু বহুদূরে থাকিয়াও চক্ষু বন্ধ করিতে হইতেছে—কে দেখিতে পারে? অন্যায় নরহত্যা, অবৈধ বধ, কোন্ চক্ষু দেখিতে পারে? আজিকার সূর্য্য উদয় না হইতেই হানিফার রোষের উদয়—তরবারি ধারণ। সে সূর্য্য অস্তমিত হইল। দামেস্ক-প্রান্তরের মরুভূমিতে রক্তের স্রোত বহিল, কিন্তু মোহাম্মদ হানিফার জিঘাংসা-বৃত্তি নিবৃত্ত হইল না। “এজিদ তোমার বধ্য নহে” এই দৈববাণীতে মোহাম্মদ হানিফার অন্তরে রোষ এবং ভয় একত্র এক সময়ে উদিত হইয়াছে। উদ্যান-মধ্যে ঊর্দ্ধমুখ হইয়া স্থির-নেত্রে ক্ষণকাল চিন্তার কারণও তাহাই। এক সময়ে দুইভাব, পরস্পর-বিপরীত ভাব—নিতান্তই অসম্ভব; কিন্তু হইয়াছে তাহাই—ভয় এবং রোষ। বীৱহৃদয় ভয়ে ভীত হইবার নহে। তরে যে কিঞ্চিৎ কাঁপিতেছিল, তাহা দৈববাণী বলিয়া—প্রভু হোসেনের জ্যোতির্ম্ময় পবিত্র ছায়া দেখিয়া। কিন্তু পরিশেষে নির্ভয় হৃদয়ে ভয়ের স্থান হইল না; সুতরাং রোষেরই জয়! প্রমাণ—অশ্বে আরোহণ, সজোরে কশাঘাত!
কানন-দ্বার পার হইয়া হানিফা এজিদের গুপ্তপুরী-প্রবেশদ্বার আবরণকারী লতাপাতা-বেষ্টিত নিকুঞ্জ প্রতি একবার চক্ষু ফিরাইয়া দেখিলেন: দুর্গন্ধময় ধুমরাশি হুহু করিয়া আকাশে উঠিতেছে, বাতাসে মিশিতেছে। রাজপুরী পশ্চাতে রাখিয়া তিনি দামেস্ক-নগরের পথে চলিলেন। যে তাঁহার সম্মুখে পড়িতে লাগিল, তাহারই জীবন শেষ হইল। বিনা অপরাধে হানিফার অস্ত্রে জীবনলীলা সাঙ্গ করিয়া খণ্ডিত দেহসকল ধূলায় গড়াগড়ি যাইতে লাগিল। জয়নালভক্ত প্রজাগণ এজিদের পরিণাম দশা দেখিতে আনন্দোৎসাহে রাজপুরীর দিকে দলে দলে আসিতেছিল। হানিফায় রোষাগ্নিতে পড়িয়া তাহারা এক পদও অগ্রসর হইতে পারিল না, আপন প্রতিপালক রক্ষকহস্তে প্রাণ বিসর্জ্জন করিতে লাগিল।
নগরের প্রবেশদ্বারে প্রহরিগণ বসিয়াছিল। এজিদ সহ মোহাম্মদ হানিফা নগরে প্রবেশ করিলে, প্রহরিগণ মোহাম্মদ হানিফাকে দেখিয়াই সতর্কতা ও সাবধানতার সহিত কর্ত্তব্যকার্য্যে তৎপর হইল। নিকটে আসিতেই প্রহরিগণ মাথা নোয়াইয়া অভিবাদন করিল; কিন্তু মস্তক উত্তোলন করিয়া দ্বিতীয়বার সম্ভাষণের আর তাহাদের অবসর হইল না। প্রভুর অস্ত্রে প্রহরীদের মস্তক দেহ হইতে ভিন্ন হইয়া সিংহদ্বারে গড়াইয়া পড়িল। দৈনিক কার্য্য সমাধা করিয়া দীনহীন দরিদ্র ব্যক্তি সন্ধ্যাগমে নগরে আসিতেছে, পথিক পথশ্রমে ক্লান্ত হইয়া বিশ্রামহেতু লোকালয়ে আসিতেছে, ত্রস্তে পদবিক্ষেপ করিতেছে—কত কথাই তাহাদের মনে উঠিতেছে। চক্ষের পলকে সে সকল কথা ফুরাইয়া গেল, বিনামেঘে বজ্রাঘাত সদৃশ হানিফার অস্ত্রে তাহাদের জীবনলীলা পথিমধ্যেই সাঙ্গ হইল।
গাজী রহ্মান, মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি যথাসাধ্য ত্রস্তে আসিয়াও মোহাম্মদ হানিফাকে নগরে পাইলেন না। সিংহদ্বারে আসিয়া যাহা দেখিবার দেখিলেন। প্রান্তরে আসিয়া স্পষ্টতঃ দেখিতে পাইলেন, আম্বাজভূপতি যাহাকে সম্মুখে পাইতেছেন, বিনা বাক্যব্যয়ে তাহার জীবন শেষ করিয়া অগ্রসর হইতেছেন। এখনও ঘোর অন্ধকারে দামেস্ক প্রান্তর আবৃত হয় নাই।
ঘোরনাদে শব্দ হইল—“মোহাম্মদ হানিফা!”
নিজ নাম শুনিতেই মোহাম্মদ হানিফা একটু থামিয়া দক্ষিণে বামে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। গাজী রহ্মান প্রভৃতিও ঐ শব্দ শুনিয়া অগ্রসর হইতে সাহসী হইলেন না;—স্থিরভাবে দাড়াইলেন, এবং স্পষ্ট শুনিতে লাগিলেন যেন আকাশ ফাটিয়া, প্রান্তর কাঁপাইয়া শব্দ হইতেছে, “হানিফা! একটি জীব সৃষ্টি করিতে কত কৌশল, তাহা কি তুমি জান? সৃষ্টজীব বিনাশ করিতে তোমাকে সৃষ্টি করা হয় নাই। বিনা কারণে জীবের জীবনলীলা শেষ করিতে তোমার হস্তে তরবারি দেওয়া হয় নাই। তোমার হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করিবার জন্য মনুষ্যকুলে জন্ম হয় নাই। বিনাশ করা অতি সহজ, রক্ষা করা বড়ই কঠিন। সৃজন করা আরও কঠিন। এত প্রাণী বধ করিয়াও তোমার বধে নিবৃত্তি হইল না! জয়ের পর বধ অপেক্ষা পাপের কার্য্য জগতে আর কি আছে? নিরপরাধীর প্রাণ বিনাশ করা অপেক্ষা পাপের কার্য্য জগতে আর কি আছে? তুমি মহাপাপী। তেমোর প্রতি ঈশ্বরের এই আজ্ঞা যে, দুল্দুল সহিত রণবেশে রোজ-কেয়ামত পর্য্যন্ত প্রস্তরময় প্রাচীরে বেষ্টিত হইয়া আবদ্ধ থাক।”[১]
বাণী শেষ হইতেই নিকটস্থ পর্ব্বতমালা হইতে অত্যুচ্চ প্রস্তরময় প্রাচীর আকাশ পাতাল কাঁপাইয়া বিকট শব্দে মোহাম্মদ হানিফাকে ঘিরিয়া ফেলিল। মোহাম্মদ হানিফা বন্দী হইলেন। রোজ-কেয়ামত পর্য্যন্ত ঐ অবস্থায়ই তিনি থাকিবেন।
গাজী রহ্মান, মস্হাব কাক্কা প্রভৃতি এই অভাবনীয় ঘটনা দেখিয়া শত শত বার ঈশ্বরকে নমস্কার করিলেন। ম্লানমুখে মন্দ গতিতে প্রাচীরের নিকট যাইয়া অনেক অনুসন্ধান করিলেন, কিন্তু মানুষ দূরে থাকুক, সামান্য একটি পিপীলিকা প্রবেশেরও সুযোগ-পথ তাঁহারা খুঁজিয়া পাইলেন না। ধন্যরে কৌশলীর কৌশল!
গাজী রহ্মান কোন সন্ধান করিতে না পারিয়াই হউক, কি কোন শব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিয়াই হউক, কয়েক বার ঐ প্রাচীর প্রদক্ষিণ করিয়া প্রাচীরের নিকট মাথা নোয়াইয়া কর্ণ পাতিয়া শুনিতে লাগিলেন: প্রাচীর-মধ্যে যেন ঘোড়ার পদশব্দ! মস্হাব কাক্কা প্রভৃতিও সে শব্দ শুনিতে পাইলেন।
পাঠক! সে প্রাচীর এক্ষণে পর্ব্বতে পরিণত। ঐ পর্ব্বতের নিকট কান পাতিয়া শুনিলে আজও পর্য্যন্ত ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনা যায়।
রোজ-কেরামত পর্য্যন্ত মোহাম্মদ হানিফা ঐ প্রাচীর-মধ্যে অশ্ব সহ আবদ্ধ থাকিবেন! দৈববাণী অলঙ্ঘনীয়! “যাহা অদৃষ্টে ছিল হইল। যাহা দয়াময়ের ইচ্ছা ছিল, সম্পূর্ণ হইল। আর বৃথা এ প্রান্তরে থাকিয়া লাভ কি?”— গাজী রহ্মান এই কথা বলিয়া নগরাভিমুখী হইলেন। সঙ্গীরাও তাঁহার পশ্চাৎবর্ত্তী হইলেন।
অন্ধকার আবরণে জগৎ অন্ধকার হইয়া আসিতে লাগিল। এ মহা মহাকাব্য “বিষাদ-সিন্ধুর” ইতিও এইখানে হইল। সিন্ধুপার হইয়াও হইতে পারিলাম না—আশা মিটিল না। পূর্ণ সুখ জগতে নাই। কাহারও ভাগ্যফলকে যোল আনা সুখভোগের কথা লেখা নাই। সুতরাং বিষাদ-সিন্ধু পার হইয়া সুখ-সিন্ধুতে মিশিতে পারিলাম না।
জয়নাল আবেদীন পৈতৃকরাজ্য উদ্ধার করিয়া সিংহাসনে বসিয়াছেন—পরিবার-পরিজনকে বন্দীখানা হইতে উদ্ধার করিয়া বিশেষ আদর সম্মানের সহিত রাজভবনে আনিয়াছেন। মদিনা, দামেস্ক—উভয় রাজ্যই এখন তাঁহার করতলে; উভয় সিংহাসনই এখন জয়নাল আবেদীনের বসিবার আসন। পরম শত্রু-পৈতৃক শত্রু এজিদের সর্ব্বস্ব গিয়াছে; ধনজন-রাজ্যপাট সকলই গিয়াছে। যদিও প্রাণ যায় নাই, কিন্তু দৈবাগ্নিতে দগ্ধ হওয়া ব্যতীত কূপ-মধ্যে এজিদ-দেহের অন্য কোন ক্রিয়া নাই। সেই দেহ মনুষ্যেরও আর দেখিবার সাধ্য নাই! সুতরাং সাধারণ চক্ষে এজিদবধই সাব্যস্ত করিতে হইবে। সুখের একশেষ! আরও অধিক সুখের কথা হইত, যদি মোহাম্মদ হানিফা দৈবনির্ব্বন্ধে প্রস্তর-প্রাচীরে চির আবদ্ধ না হইতেন। হায়! আক্ষেপ-শত আক্ষেপ! সিন্ধু পার হইয়াও হইতে পারিলাম না; বিষাদ রহিয়াই গেল! বিষাদ-সিন্ধু বিষাদ-সিন্ধুই রহিয়া গেল! হায় হোসেন! হায় হোসেন! হায় মোহাম্মদ হানিফা!- মুখে এই কথাগুলি উচ্চারণ করিতে করিতে বক্ষে করাঘাত করিয়া সঞ্জল নয়নে বিদায় হইতে হইল।
- ↑ কোন কোন গ্রন্থ মতে হানিফার এখনও প্রাচীরের ভিতর আবদ্ধ হওয়া ততদূর প্রমাণ-সিদ্ধ নহে।