বিষাদ-সিন্ধু/এজিদ-বধ পর্ব্ব/দ্বিতীয় প্রবাহ

দ্বিতীয় প্রবাহ

 সমরাঙ্গণে পরাজয়-বায়ু একবার বহিয়া গেলে সে বাতাস ফিরাইয়া বিজয়-নিশান উড়ান বড় শক্ত কথা। পরাজয়-বায়ু হঠাৎ চারিদিক হইতে মহাবেগে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করে না; প্রথমতঃ মন্দ মন্দ গতিতে রহিয়া রহিয়া বহিতে থাকে, পরে ঝঞ্ঝাবাত সহ তুমুল ঝড়ের সৃষ্টি করিয়া এক পক্ষকে উড়াইয়া দেয়। নেতৃপক্ষের ঘন ঘন হুঙ্কারে, অস্ত্রের চাকচিক্যে মহাবীরের হৃদয়ও কম্পিত হয়, হতাশায় বুক ফাটিয়া যায়।

 আজ দামেস্ক-প্রান্তরে তাহাই ঘটিয়াছে। মদিনার সৈন্যদিগের চালিত অস্ত্রের চাকচিক্যে এজিদ-সৈন্য ক্ষণে ক্ষণে আত্মহারা হইতেছে। তাহারা, আসমানে কি জমিনে, তাহার কিছুই নির্ণয় করিতে পারিতেছে না। বিপক্ষগণের অস্ত্রের ঝন্‌ঝনা-শব্দে চমক ভাঙ্গিয়া রণরঙ্গের কথা তাহাদের মনে পড়িতেছে বটে, কিন্তু সে সময় প্রাণভয়ে তাহাদের প্রাণ চতুর্গুন আকুল হইতেছে;—তাহারা দেখিতেছে, যেন প্রান্তরময় বৃষ্টিপাত হইতেছে! গগনস্থ ঘনঘটা হইতে বৃষ্টি হইতেছে না, সে রক্তবৃষ্টি মেঘ হইতে ঝরিতেছে না, ঝরিতেছে দামেস্ক-সৈন্যের শরীর হইতে; আর ঝরিতেছে—আম্বাজী সৈন্যের তরবারির অগ্রভাগ হইতে। মেঘ-মালার খণ্ড খণ্ড অংশই শিলা,— তাহারও অভাব হয় নাই—খণ্ডিত দেহের খণ্ড খণ্ড অংশই সে ক্ষেত্রে শিলারূপ দেখাইতেছে।

 দামেস্ক-প্রান্তর দামেস্ক-সৈন্য-শোণিতেই ডুবিয়াছে।—রক্তের ঢেউ খেলিতেছে। মহাবীর হানিফার সম্মুখে যে সৈন্যদলই পড়িয়াছে, সংখ্যায় যতই হউক, তৃণবৎ উড়িয়া তাহারা খণ্ডিত দেহে ভূতলশায়ী হইয়াছে। সে রঞ্জিত তরবারিধারে খণ্ডিত দেহের রক্তধার, ধরণী বহিয়া মরুভূমি সিক্ত করিয়া, প্রান্তরময় ছুটিতেছে। কিন্তু হানিফার মনের আগুন নিভিতেছে না,— মদিনাবাসীর ক্রোধানল একটুও কমিতেছে না।

 প্রভু হোসেনের কথা, কারবালা প্রান্তরে এক বিন্দু জলের কথা, হােসেনের ক্রোড়স্থিত শিশুসন্তানের কোমল বক্ষ ভেদ করিয়া লৌহ তীর প্রবেশের কথা মনে হইয়া হানিফার প্রাণ আকুল করিয়াছে! বিস্ফারিত চক্ষে রােষাগ্নির তেজ বহিয়া অবশেষে বাষ্পরাশি বহাইয়া তাহাকে এক প্রকার উন্মাদের ন্যায় করিয়া তুলিয়াছে। “কৈ এজিদ! কৈ সে দুরাত্মা এজিদ! কৈ সে নরাধম এজিদ!—কৈ এজিদ! কৈ এজিদ!” মুখে বলিতে বলিতে এজিদ-অন্বেষণে তিনি অশ্বে কশাঘাত করিয়াছেন। সে মুর্ত্তি এজিদের চক্ষে পড়িতেই এজিদ ভাবিয়াছিলেন যে, এ মহাকালের হস্ত হইতে আত্মরক্ষা নাই, অতএব পলায়নই শ্রেয়ঃ। বীরের ন্যায় বক্ষবিস্তারে হানিফার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া, “আমি এজিদ—আমিই সেই মদিনার মহাবীরগণের কালস্বরূপ এজিদ! হানিফা! আইস, তোমাকে ভবন্ত্রণার দায় হইতে মুক্ত করিয়া দিই।”—এই সকল কথা বলা দূরে থাকুক, যেই দেখা অমনই এজিদের পলায়নের চেষ্টা; প্রাণভয়ে পলায়নের চেষ্টা!—প্রাণ-ভয়ে দামেস্করাজ অশ্বারােহণ করিয়া যথাসাধ্য বেগে অশ্ব চালাইতেছেন।

 হানিফাও এজিদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দুলদুল্ চালাইয়াছেন। এই দৃশ্য অনেকেই দেখেন নাই। রণরঙ্গে মাতােয়ারা বীর সকল একথা অনেকেই শুনেন নাই। যাঁহারা দেখিয়াছেন, যাঁহারা শুনিয়াছেন, তাঁহারাও তাহার পর কি ঘটিয়াছে, কি হইয়াছে, এ পর্য্যন্ত তাহার কোন সন্ধান প্রাপ্ত হন নাই। কোন সন্ধানীও সন্ধান আনিতে পারে নাই।

 এদিকে মস্‌হাব কাক্কা, ওমর আলী, আক্কেল আলী (বাহ্‌রাম) প্রভৃতি মহামহিম যােদ্ধাসকল কাফেরদিগকে পশুপক্ষীর ন্যায় যথেচ্ছা বধ করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। গাজী রহ্‌মানের পূর্ব্ববচন সফল হইল। এজিদ-সৈন্য প্রাণভয়ে পলাইয়াও প্রাণরক্ষা করিতে পারিতেছে না। অশ্বের দাপটে, তরবারির আঘাতে, বর্শার সূক্ষাগ্রে, তীরের লক্ষ্যে, গদার প্রহারে, খঞ্জরের আঘাতে তাহারা প্রাণ হারাইতেছে। কত শিবির, কত চন্দ্রাতপ, কত উষ্ট্র, কত অস্ত্র, প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় হুহু শব্দে পুড়িয়া ছাই হইতেছে। এজিদ পক্ষের জীবন্ত প্রাণী আর কাহারও চক্ষে পড়িতেছে না। দৈবাৎ কাহারও দেখা পাইলে ‘মার্ মার্’ শব্দে চারিদিক হইতে হানিফার সৈন্যগণ তাহাকে ঘিরিয়া, ক্রীড়া-কৌতুক, হাসি-রহস্য করিয়া মারিয়া ফেলিতেছে। ক্রোধের ইতি নাই, ‘মার্ মার্’ শব্দের বিরাম নাই। সময়ে সময়ে মুখে এই হৃদয়বিদারক, মর্ম্মঘাতী কথা কহিয়া নিজেরাও কাঁদিতেছে, জগৎকেও কাঁদাইতেছে। হায় হাসান! হায় হােসেন! তােমরা আজ কোথায়? সে মহাপ্রান্তর কার্‌বালা কোথায়? ফোরাতের উপকূল কোথায়? যে সৈন্যদল ফোরাতের জল লইতে পথ বন্ধ করিয়াছিল, তাহারাই বা আজ কোথায়? কৈ এজিদের সৈন্য? কৈ এজিদ? কৈ তাহার শিবির? কিছুই ত চক্ষে দেখিতেছি না। প্রভু হােসেন! তুমি কোথায়? এ দৃশ্য তােমাকে দেখাইতে পারিলাম না। আহো কাসেম! মদিনার শ্রেষ্ঠ বীর কাসেম। একবিন্দু জলের জন্য, হায়! হায়!! একবিন্দু জলের জন্য কি না ঘটিয়াছে। উহু!। কি নিদারুণ কথা! পিপাসায় কাতর হইয়া প্রভুপুত্র আলী আকবর পিতার জিহ্বা চুষিয়াছিল। হায়! হায়!! সে দুঃখ ত কিছুতেই যায় না। কারবালার কথা কিছুতেই ভুলিতে পারিতেছি না। সে দিন রক্তের ধারা ছুটিয়া কারবালা-প্রান্তর ডুবিয়াছে। আজ দামেস্ক-প্রান্তর দামেস্ক-সৈন্য়-শােণিতে ডুবিতেছে, দামেস্করাজা মদিনার সৈন্য-পদতলে দলিত হইতেছে। কিন্তু আশা মিটিতেছে না, সে মনােবেদনার অণুমাত্রও উপশমবােধ হইতেছে না। বুঝিলাম—হােসেনশােক অন্তর হইতে অন্তর হইবার নহে; মানিলাম,—কারবালার ঘটনা, মদিনাতে মায়মুনার কীর্ত্তি ও জাএদার আচরণ জগৎ হইতে একেবারে যাইবার নহে! চন্দ্র, সূর্য্য, তারা, নক্ষত্র যতদিন জগতে থাকিবে, ততদিন তাহা সকলের মনে সমভাবে জ্বলন্তরূপে বিষাদ-কালিমারেখায় অঙ্কিত থাকিবে।

 সমরাঙ্গণে অস্ত্রাগ্নি নির্ব্বাণ হইয়াছে, কিন্তু আগুন জ্বলিতেছে। উর্দ্ধে অগ্নিশিখা—নিম্নে রক্তের লেখা। রক্তমাখা দেহসকল রক্তস্রোতেই ভাসিতেছে, ডুবিতেছে, গড়াইয়া যাইতেছে।

 সৈন্যদলসহ মস্‌হাব কাক্কা প্রভৃতি সকলে নগরের নিকট পর্য্যন্ত আসিলেন। শত্রুপক্ষীয় একটি প্রাণীও তাঁহাদের চক্ষে আর পড়িল না। জয়নাল আবেদীনসহ গাজী রহ্‌মান নগরের প্রবেশদ্বার পর্য্যন্ত যাইয়া হানিফার অপেক্ষা করিতেছিলেন। কাক্কার দল আসিয়া জুটিলেই—“জয় মদিনার ভূপতির জয়! জয় মহারাজ জয়নাল আবেদীনের জয়!” ঘোষণা করিতে করিতে সকলে বীরদর্পে নগরে প্রবেশ করিলেন। কার সাধ্য বাধা দেয়। কে মাথা উঠাইয়া সেই বীরগণের সম্মুখে বক্ষ বিস্তারে দণ্ডায়মান হয়? কাহার সাধ্য একটি কথাও কহিয়া সরিয়া যায়। জনপ্রাণী দ্বারে নাই। রাজপথেও কোন লোক কোন স্থানে কোন কার্য্যে নিয়োজিত নাই। পথ পরিষ্কার—জনতা, কোলাহলের নামমাত্র নাই। কেবল স্বদল মধ্যে, মধ্যে মধ্যে ‘মার্ মার্’ ‘কাট্ কাট্’ শব্দ—“জয় জয়নাল আবেদীন! “জয় মোহাম্মদ হানিফা!” রব,—আর বহু দূরে লোকের প্রাণভয়ে পলায়নের কোলাহল-আভাস। শত্রু-হস্তে ধন, মান, প্রাণ রক্ষা হইবে না ভাবিয়া, অনেকেই ঘর বাড়ী ছাড়িয়া পলায়নের উদ্যোগ করিতেছে, স্ব স্ব জীবন রক্ষার উপায় ভাবিতেছে। পরস্পরের এই সকল কথা,— ‘ডাক-হাঁক’, প্রস্থানের লক্ষণ অনুমানে অনুভূত হইতেছে। বিনা যুদ্ধে, বিনা বাক্যব্যয়ে, গাজী রহমান মহা মহা বীরগণ ও সৈন্যগণসহ জয়নাল আবেদীনকে লইয়া সহস্র মুখে বিজয়ঘোষণা করিয়া দীন মোহাম্মদী নিশান উড়াইয়া, বিজয় ডঙ্কা বাজাইয়া সিংহদ্বার পার হইলেন।

 যেখানে সমাজ, সেইখানেই দল। যেখানে লোকের বসতি, সেইখানেই গোলযোগ—সেইখানেই পক্ষাপক্ষ; সঙ্গে সঙ্গে হিংসা, শত্রুতা, মিত্রতা, আত্মীয়তা, বাধ্যবাধকতা। যেমন এক হস্তে তালি বাজিবার কথা নহে, তেমনই দলাদলি না থাকিলেও কথা জন্মিবার কথা নহে। কথা জন্মিলেই পরিচয়, স্বপক্ষ বিপক্ষ সহজেই নির্ণয়। সে সময় খুঁজিতে হয় না —কে কোন্ পথে, কে কোন্ দলে।

 এজিদ দামেস্কের রাজা। প্রজামাত্রেই যে মহারাজগত প্রাণ—অন্তরের সহিত রাজানুগত—সকলেই যে তাঁহার হিতকারী—তাহা নহে, সকলেই যে তাঁহার দুঃখে দুঃখিত,—তাহাও নহে। দামেস্ক-সিংহাসন পরপদে দলিত হইল ভাবিয়া সকলেই যে দুঃখিত হইয়াছে, চক্ষের জল ফেলিয়াছে, সকলের হৃদয়ে যে আঘাত লাগিয়াছে, তাহাও নহে। অনেকে পূর্ব্ব হইতেই হজরত মাবিয়ার পক্ষীয়, প্রভু হাসান-হোসেনের ভক্ত রহিয়াছে। আজ পরিচয়ের দিন—পরীক্ষার দিন। সহজে নির্ব্বাচন করিবার এই-ই উপযুক্ত সময় ও অবসর।

 বিজয় ঘোষণা এবং বিজয় বাজনার তুমুলরবে নগরবাসীরা ভয়ে অস্থির হইল। কেহ পলাইবার চেষ্টা করিল,—পারিল না। কেহ যথাসর্ব্বস্ব ছাড়িয়া জাতি-ধন-মন-প্রাণ বিনাশ-ভয়ে দীন-দরিদ্র-বশে গৃহ হইতে বহির্গত হইল। কেহ ফকির-দরবেশ, কেহ বা সন্ন্যাসী-রূপ ধারণ করিয়া জন্মভূমির মায়া পরিত্যাগ করিল। কেহ আনন্দবেগ সম্বরণে অপারগ হইয়া “জয় জয়নাল আবেদীন!” মুখে উচ্চারণ করিতে করিতে জাতীয় সম্ভাষণ, জাতীয় ভাব প্রকাশ করিয়া গাজী রহ্‌মানের দলে মিশিয়া চিরশত্রু-বিনাশের বিশেষ সুবিধা করিয়া লইল। কাহারও মনে দারুণ আঘাত লাগিল,—“জয় জয়নাল আবেদীন!” কথাগুলি বিশাল, শেলসম তাহার অন্তরে বিঁধিতে লাগিল, কর্ণেও বাজিল। কাহারও সাধ্য নাই।—নগর রক্ষার কোন উপায়ই নাই। রাজ-বলের কোন লক্ষণও নাই। আর উপায় কি?—পলাইয়া প্রাণরক্ষা করাই কর্ত্তব্য, তাই অনেকেই যথাসাধ্য পলায়নের উপায় দেখিতে লাগিল। যাহারা জয়নাল আবেদীনের দলে মিশিল না, তাহাদের ভাগ্যে যাহা হইবার হইতে লাগিল। বিপক্ষ দলের জাতক্রোধে এবং সৈন্যদলের অন্তরের মহারোষে অধিবাসীরা যন্ত্রণার একশেষ ভোগ করিতে লাগিল। সন্তানসন্ততি লইয়া ত্রস্তপদে যাহারা পলাইতে পারিয়াছিল, বা প্রকাশ্য পথ ছাড়িয়া গুপ্ত পথে, কোন গুপ্তস্থানে লুকাইয়া আত্মগোপন করিয়াছিল, তাহারাই রক্ষা পাইল, তাহারাই বাঁচিল। বাড়ীঘরের মায়া ছাড়িতে, জন্মের মত জন্মভূমি হইতে বিদায় লইতে যাহাদের একটু বিলম্ব হইল, তাহাদের প্রাণবায়ু মুহূর্ত্তমধ্যে অনন্ত আকাশে—শূন্যে উড়িয়া গেল। কিন্তু জন্মভূমির মায়াবশে তাহাদের দেহ দামেস্কেই পড়িয়া রহিল। কা’র অন্তেষ্টিক্রিয়া কে করে? কার কান্না কে কাঁদে। সুন্দর সুন্দর বাস-ভবন সকল ভূমিসাৎ হইতেছে; ধনরত্ন, গৃহসামগ্রী হস্তে হস্তে চক্ষের পলকে উড়িয়া যাইতেছে। কে কথা রাখে, আর কেইবা কথা শুনে? কোথাও ধূ ধূ করিয়া অগ্নি জ্বলিয়া উঠিতেছে, দেখিতে দেখিতে সজ্জিত গৃহসকল জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইতেছে। নগরময় হাহাকার! নগরময় অন্তরভেদী আর্ত্তনাদ! আবার মধ্যে মধ্যে আনন্দধ্বনি, বিজয়ের উচ্চরব। আবার মাঝে মাঝে কান্নার রোল, আর্ত্তনাদ, কোলাহল, হৃদয়বিদারক “ম’লাম —গেলাম—প্রাণ যায়!” শব্দ,—বিষাদের কণ্ঠ! উঁহু! এ কি ব্যাপার। ভীষণ কাণ্ড! পিতার সম্মুখে পুত্রের বধ। মাতার বক্ষের উপর কন্যার শিরশ্ছেদ। পত্নীর সম্মুখে পতির দেহে বর্শা প্রবেশ। পুত্রের সম্মুখে বৃদ্ধ মাতার মস্তক চূর্ণ! সুদীর্ঘ কৃষ্ণকেশযুক্ত রমণী-শির,—কৃষ্ণ, শুভ্র, লোহিত ত্রিবিধ রঙ্গের আভা দেখাইয়া পিতার সম্মুখে—ভ্রাতার সম্মুখে—স্বামীর সম্মুখে দেখিতে দেখিতে গড়াইয়া পড়িতেছে —কলিজা পার হইয়া রক্তের ফোয়ারা ছুটিয়াছে। কি ভয়ানক ভীষণ ব্যাপার! কত নরনারী ধর্ম্ম-রক্ষায় নিরাশ হইয়া পাতালস্পর্শী কূপে আত্ম-বিসর্জ্জন করিতেছে। কেহ অন্য উপায়ে—যে প্রকারে যে সুবিধা পাইতেছে, সেই উপায়েই অত্যাচায়ের ভয়ে আত্মঘাতিনী হইয়া পাপীর মস্তকে পাপভার অধিকতররূপে চাপাইতেছে। মারবার সময় তাহারা বলিয়া যাইতেছে,—“রাজার দোষে রাজ্যনাশ, প্রজার বিনাশ।—ফল হাতে হাতে। প্রতিকার কাহার না আছে? রে এজিদ। রে জয়নাব।”

 সৈন্যদল নগরের যে পথে যাইতেছে, সেই পথেই এইরূপ জ্বলন্ত আগুন জ্বালাইয়া পাষাণ-হৃদয়ের পরিচয় দিয়া যাইতেছে। দয়ার ভাগ যেন জগৎ হইতে একেবারে উঠিয়া গিয়াছে! মায়া-মমতা যেন দুনিয়া হইতে জন্মের মত সরিয়া পড়িয়াছে।

 কিন্তু এত করিয়াও হানিফার সৈন্যদিগের হিংসার নিবৃত্তি হইতেছে না। এত অত্যাচার, এত রক্তধারায়ও সে বিষম তৃষ্ণা নিবারণ হইতেছে না। এত করিয়াও শত্রুবধ-আকাঙ্খা মিটিতেছে না! মদিনার বীরগণ করুণস্বরে বলিতেছে-“আম্বাজী সৈন্যগণ! গঞ্জামের ভ্রাতাগণ! তোমরা মনে মনে ভাবিতেছ যে, আমরা সময় পাইয়া শত্রুর প্রতি অন্যায় অত্যাচার করিতেছি। ভাইসকল! ভাবিয়া দেখিলে —একটু চিন্তা করিয়া দেখিলে দেখিবে তাহা সত্য নহে। এজিদ মদিনাবাসীদিগের প্রতি যেরূপ অত্যাচার, যেরূপ ব্যবহার করিয়াছে, তাহার প্রতিশোধ লওয়া এখনও হয় নাই। অস্ত্রের আঘাতে কত দিন শরীরের বেদনা থাকে? ভ্রাতাগণ! এরূপ আঘাত হৃদয়ে লাগিয়াছে যে, সে বেদনা এ দেহ থাকিতে উপশম হইবে না, প্রশান্ত হইলেও, এ প্রাণ হইতে সে নিদারুণ আঘাতের চিহ্ন সরিয়া যাইবে কি না, —জানি না। আপনারা চক্ষে দেখেন নাই, বোধ হয়, বিশেষ করিয়া শুনিতে অবসরও পান নাই—এক বিন্দু জলের জন্য কত বীর বিঘোরে কাফেরের হস্তে প্রাণ হারাইয়াছে। কত সতী পুত্রধনে-স্বামীরত্নে বঞ্চিত হইয়া নীরসকণ্ঠে আত্মবিসর্জ্জন করিয়াছে, খঞ্জরের সাহায্যে সেই জ্বালা-যন্ত্রনা নিবারণ করিয়াছে! কত বালকের কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া “জল জল” রব করিতে করিতে কণ্ঠরোধ এবং বাক্‌রোধ হইয়াছে—আভাসে, ইঙ্গিতে জলের কথা মনের সহিত প্রকাশ করিয়া জগৎ কাঁদাইয়া কত বালক জগৎ ছাড়িয়া গিয়াছে। ভ্রাতাগণ! আর কত শুনিবেন? আমাদের প্রতি লোমকূপে, প্রতি রক্তবিন্দুতে এজিদের অত্যাচার-কাহিনী জাগিতেছে। মদিনার সিংহাসনের দুর্দ্দশা, রাজ-পরিবারের বন্দীদশা, তাঁহাদের প্রতি অত্যাচার—অবিচারের কথা শুনিয়া আমরা বুদ্ধি হারাইয়াছি; আজরাইল[১]সম্মুখে বক্ষ পাতিয়া দিয়াছি; মৃত্যুমুখে দণ্ডায়মান হইয়াছি।”

 “ঈশ্বর মহান, তাঁহার কার্য্য ও মহৎ! কোন্ সূত্রে কোন সময়ে কাহার প্রতি তিনি কি ব্যবস্থা করেন, তাহা তিনিই জানেন। মদিনার বীরশ্রেষ্ঠ কাসেমের শোক কি আমরা ভুলিয়াছি? প্রভু হোসেনের কথা কি আমাদের মনে নাই? প্রভু-পরিবার এখনও বন্দীখানায়। নূরনবী মোহাম্মদের প্রাণতুল্য প্রিয় পরিজন এখনও এজিদের বন্দীখানায় আবদ্ধ —এ কি শুনিবার কথা! না—চক্ষে দেখিবার কথা! মার কাফের, জ্বালাও নগর—সকলেই আসুন আমাদের সঙ্গে।”

 এই সকল কথা কহিয়া নগরের পথে পথে, দলে দলে, মার মার শব্দে হানিফার সৈন্যগণ ছুটিল। গাজী রহ্‌মান, মস্‌হাব কাক্কা প্রভৃতি জয়নাল আবেদীনকে লইয়া প্রকাশ্য রাজপথে চলিয়াছেন! রাজপুরী নিকটবর্ত্তী, বন্দীগৃহ কিছুদূরে। গাজী রহ্‌মানের আজ্ঞায় সকলের গমনবেগ ক্ষান্ত হইল। সঙ্কেত-চিহ্নে সমুদয় সৈন্য দামেস্ক-রাজপথে যে যে পদে, যে যে ভাবে দাঁড়াইয়াছিল, সেই সেই পদে, সেই সেই স্থানেই দাঁড়াইয়া রহিল। কি সংবাদ? ব্যস্ত হইয়া সকলেই জয়নাল আবেদীনের চন্দ্রাতপোপরিস্থ পতাকার প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন। তাঁহারা কোনরূপ বিরূপ বা বিপর্য্যয় ভাব দেখিলেন না। জাতীয় নিশান হেলিয়া দুলিয়া গৌরবের সহিত শূন্যে উড়িতেছে। বিজয়বাজনা সমভাবে বাজিতেছে। গাজী রহ্‌মান অশ্বপৃষ্ঠে থাকিয়াই মস্‌হাব কাক্কা, ওমর আলী এবং আক্কেল আলির সহিত কথা কহিতেছেন। অশ্বসকল গ্রীবাবক্রে স্থিরভাবে দণ্ডায়মান, কিন্তু সময়ে সময়ে পুচ্ছগুচ্ছ হেলাইয়া ঘুরাইয়া কর্ণদ্বয় খাড়া করিয়া স্বাভাবিক চঞ্চলতা ও তেজোভাবের পরিচয় দিতেছে।

 গাজী রহ্‌মান বলিলেন: “রাজপুরী নিকটবর্ত্তী, বাদশাহ্-নামদারের কোন সংবাদই পাইতেছি না।”

 মস্‌হাব কাক্কা বলিলেন: “গুপ্তচর-সন্ধানীগণ যুদ্ধক্ষেত্রেই আছে। এ পর্য্যন্ত সংবাদ নাই, —এ কি কথা! কারণ কি?”

 গাজী রহ্‌মান বলিলেন: “যুদ্ধাবসানে, কি বিজয়ের শেষ মুহূর্ত্তে আপন আপন সৈন্যসামন্ত, ভারবাহী, সংবাদবাহী প্রধান প্রধান যোদ্ধা এবং সেনানায়কগণের প্রতি বিশেষ মনোযোগ রাখিতে হয়। বিজয়-আনন্দে কে কোথায় কাহার পশ্চাতে মার্ মার্’ শব্দে মাতোয়ারা হইয়া ছুটিতে থাকে, কিছুই জ্ঞান থাকে না; সে সময়ে বড়ই সতর্ক ও সাবধান হইয়া চলিতে হয়। আপন দলবল ছাড়িয়া কে কাহার পশ্চাৎ কতদূর তাড়াইয়া লইয়া যায়, সে জ্ঞান প্রায় কাহারও থাকে না। এই অবস্থায় যুদ্ধজয়ের পরেও অনেক যুদ্ধজয়ী সামান্য লোকের হস্তে প্রাণ হারাইয়াছেন, ইহারও বহুতর দৃষ্টান্ত আছে। পলায়িত শক্তগণ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া কে কোথায় লুকাইয়া থাকে, কে বলিতে পারে? এজিদের সৈন্য বলিতে একটি প্রাণী ও আর যুদ্ধক্ষেত্রে নাই। তবে মোহাম্মদ হানিফা কোথা রহিলেন? এজিদের কোন সংবাদও পাওয়া যায় নাই। বিপক্ষ দলেও কোন সংবাদ এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। তবে ইহা নিশ্চয় যে, বিপক্ষ দলের সংবাদ—শূন্য। মোহাম্মদ হানিফা কোথায়, আমার সেই চিন্তাই এইক্ষণে অধিকতর হইল। অশ্বারোহী সন্ধানী পাঠাইয়া এখনই সংবাদ আনিবে! আমরা রাজপুরী পর্য্যন্ত যাইতে না যাইতেই যুদ্ধস্থানের সংবাদ অবশ্যই পাইব—আশা করি।”

 আদেশমাত্র সন্ধানী দূতের অশ্ব ছুটিল। শুভ্র নিশানের অগ্রভাগ আরোহীর মস্তকোপরি বায়ুর সহিত ক্রীড়া করিতে লাগিল।

 গাজী রহ্‌মান পুনরার মস্‌হাব কাকাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “নগর-প্রবেশের সময় পৃথক পৃথক পথে সৈন্যদলকে প্রবেশ করিতে অনুমতি দেওয়া হইয়াছে। যে দিক হইতে যে দল রাজভবন পর্য্যন্ত যাইবে, সে দিক রক্ষার ভার তাহাদের উপর থাকিবে। যে পর্য্যন্ত সৈন্যদল পুরীমধ্যে দীন মোহাম্মদী নিশান উড়িতে না দেখিবে, জয়নাল আবেদীনের বিজয়-ঘোষণা যতক্ষণ পর্য্যন্ত কর্ণে না শুনিবে, সে পর্য্যন্ত কোন দলই পুরী মধ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে না। মোহাম্মদ হানিফার না সংবাদ জানিয়া, এজিদ-পুরীতে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা হইতেছে না।”

 “ভালই, সংবাদ না জানিয়া এজিদ-পুরীতে যাইব না। ভাল কথা, এই অবসরে বন্দীগণকে উদ্ধার করিলে ক্ষতি কি?”

 “না, না তাহা হইতে পারে না, অগ্রে মহারাজের সংবাদ, তাহার পর পুরী-প্রবেশ। পুরী-প্রবেশ করিয়াই সর্ব্বাগ্রে রাজসিংহাসনের মর্য্যাদা রক্ষা, পরে বন্দীমুক্তি।”

 “তবে ক্রমে অগ্রসর হওয়া যা’ক্। ঐ আমাদের সৈন্যগণের জয়ধ্বনি শুনা যাইতেছে। যাহারা ভিন্ন ভিন্ন পথে গিয়াছিল, তাহা শীঘ্রই আমাদের সহিত একত্রে মিশিবে।”

 আবার সঙ্কেত-সূচক বাঁশী বাজিয়া উঠিল। মহারাজ জয়নাল আবেদীনের চন্দ্রাতপসংযুক্ত জাতীয় নিশান হেলিয়া দুলিয়া চলিতে লাগিল। “জয় মহারাজ আবেদীনের জয়!” সৈন্যগণের মুখে বারবার উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারিত হইতে লাগিল। রাজপথে অন্য লোকের গতিবিধি নাই। এজিদ-পক্ষের জন-প্রাণীর নামমাত্রও নগরে নাই। সুন্দর সুন্দর বাড়ী-ঘর সকল শূন্য অবস্থায় পড়িয়া আছে।

 কিছু দূর যাইতেই দামেস্ক-রাজপুরীর স্বরঞ্জিত অত্যুচ্চ প্রবেশদ্বার সকলের নয়নগোচর হইল। এত সৈন্য, এত অশ্ব, এত উষ্ট্র, এত নিশান এত ডঙ্কা, এত কাড়া-নাকাড়া রাজপথ জুড়িয়া হুলুস্থুল ব্যাপার করিতে করিতে যাইতেছে! ঐ সকল কোলাহল ভেদ করিয়া দ্রুতগতি অশ্বসঞ্চালনের ‘তড়াক তড়াক’ পদশব্দ সকলেরই কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। কিন্তু গাজী রহ্‌মানের আজ্ঞা ব্যতীত-বলিতে কি, একটি মক্ষিকারও উড়িয়া বসিবার ক্ষমতা নাই! কাহার সাধ্য—স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখে? কাহার সাধ্য,—তাহার সন্ধান লয়? কে সে লোক,— তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করে?

 মনের কথা মন হইতে সরিতে না সরিতেই বাঁশীর স্বরে কয়েকটি কথা কর্ণে প্রবেশ করিল—“আম্বাজী সংবাদবাহী যুদ্ধক্ষেত্র হইতে সংবাদ লইয়া আসিতেছে। রাস্তা পরিষ্কার। দ্বিতীয়বার বাঁশী বাজিল, শব্দ হইল—“সাবধান!”

 সকলেই সাবধান হইলেন। সংবাদবাহীর অশ্ব যেন বায়ুভরে উড়িয়া সকলের বামপার্শ্ব হইয়া চক্ষের পলকে গাজী রহ্‌মানের নিকট চলিয়া গেল। গাজী রহ্‌মানের নিকটস্থ হইয়া অভিবাদন পূর্ব্বক সংবাদবাহী বলিতে লাগিল, “দামেস্ক নগরের মধ্য হইতে রণক্ষেত্র পর্য্যন্ত জীবন্ত জীবের মুখ দেখিতে পাইলাম না। নগর-অভ্যন্তরস্থ পথ, রণক্ষেত্রে গমনের পথ এবং অন্য অন্য পথ-ঘাট মৃতদেহে পরিপূর্ণ,—গমনে মহাকষ্ট। ধরাশয়ী খণ্ডিত দেহসকলের সে দৃশ্য দেখিতেও মহাকষ্ট। বহু কষ্টে রণক্ষেত্র পর্য্যন্ত যাইয়া দেখিলাম—সব শবাকার। খণ্ডিত নরদেহ এবং অশ্বদেহ সকল কতক অল্প রক্তে মাখা, কতক রক্তে প্লাবিত। দেখিলাম: মরুভূমিতে রক্তস্রোত প্রবাহিত। কি ভীষণ রণ! এজিদ-শিবিয়ের ভস্মাবশেষ হইতে এখনও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অগ্নিশিখাসহ ধূমরাশি অনবরত গগনে উঠিতেছে। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়াই দেখিলাম যে, একজন ফকির রণক্ষেত্রের মধ্যে খণ্ডিত দেহসকলের নিকটে যাইয়া কি যেন দেখিয়া দেখিয়া যাইতেছে। তাহার চলনভঙ্গী অনুসন্ধানের ভাব দেখিয়া যথার্থ ফকির বলিয়া সন্দেহ হইল। ত্রস্তে ঘোড়া ছুটাইয়া ফকির-বেশধারীর নিকটে যাইয়াই দেখি যে, আমাদের গুপ্তচর ওস্‌মান, —তাহার গলায় তস্‌বীহ্, হাতে আশা, গায়ে সবুজ পিরহান। দেখা হইবামাত্রই আমাদের পরিচয়, আদর, আহ্লাদ, সম্ভাষণ! তাহারই মুখে শুনিলাম, “মহারাজাধিরাজ মোহাম্মদ হানিফা মদিনাধিপতির সহিত দামেস্ক-নগরে প্রবেশ করেন নাই। ঘোর যুদ্ধের সময়েই তিনি এজিদের সন্ধান করেন। যুদ্ধজয়ের পরক্ষণেই এজিদ তাঁহার চক্ষে পড়ে। এজিদের চক্ষুও চঞ্চল; পশ্চাৎ চাহিতেই তিনি দেখেন যে, সে মহাবীর হানিফার বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয় হইতে ঘোর রক্তবর্ণের তেজ সহস্র শিখায় বহির্গত হইতেছে; তাঁহার ঘোড়াটিও রক্তমাখা হইয়া এক প্রকার নূতন বর্ণ ধারণ করিয়াছে। তাঁহার বাম হস্তে—অশ্বের বল্গা, দক্ষিণ হস্তে—বিদ্যুৎ-আভা-সংযুক্ত রক্তমাখা সুদীর্ঘ তরবারি, মুখে ‘কৈ এজিদ! কৈ এজিদ!” রব। এজিদ আপন নাম শুনিয়া পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিয়াই বুঝিলেন,—আর রক্ষা নাই, এক্ষণে পলায়নই শ্রেয়ঃ। যেমনি দেখা, অমনি যুক্তি—পলায়নই শ্রেয়ঃ। এজিদ তখনি অশ্বে কশাঘাত করিলেন—অশ্ব ছুটিল। মহারাজ হানিফাও এজিদের পাশ্চাৎ পশ্চাৎ সিংহ বিক্রমে দুল্‌দুল্‌ ছুটাইলেন। দেখিতে দেখিতে তিনি দামেস্ক-প্রান্ত অতিক্রম করিয়া প্রান্তরের পশ্চিম দিক পর্ব্বতশ্রেণীর নিকটস্থ হইলেন। পশ্চাৎ দিক হইতে তীর মারিলেই এজিদের জীবন-লীলা ঐ স্থানেই শেষ হইত। মহারাজ হানিফা একবার এজিদের এত নিকটবর্ত্তী হইয়াছিলেন যে, অসির আঘাত করিলে এজিদ শির তখনই ভূতলে লুণ্ঠিত হইত। পশ্চাৎ দিক হইতে এজিদকে কোন অস্ত্রাঘাত করিবেন না, সম্মুখ হইতেই আক্রমণ করিবেন,—এই আশাতেই বোধ হয়, মহাবেগে তিনি ঘোড়া ছুটাইলেন। কিন্তু এজিদও এমনভাবে অশ্ব চালাইলেন যে, কিছুতেই মহারাজকে তাঁহার অগ্রে যাইতে দিলেন না। দেখিতে দেখিতে আর দেখা গেল না। প্রথমতঃ, অশ্বের অন্তর্দ্ধান, শেষে আরোহীদ্বয়ের মস্তক পর্য্যন্ত চক্ষের অগোচর। আর কোনও সন্ধান নাই। কয়েকজন আম্বাজী অশ্বারোহী সৈন্য মহারাজ হানিফার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ছুটিল, কিন্তু তাহারা অনেক পশ্চাতে পড়িয়া রহিল। এই শেষ সংবাদ।”

 সংবাদবাহী অভিবাদন করিয়া বিদায় হইল। গাজী রহ্‌মান আর অপেক্ষা করিলেন না। রাজপুরীমধ্যে অগ্রে পদাতিক সৈন্য-প্রবেশের অনুমতি করিলেন। তাহার পর অশ্বারোহী বীরগণ পুরীমধ্যে প্রবেশের অনুমতি পাইলেন। তৎপরে মহারথিগণ এজিদপুরীমধ্যে প্রবেশ করিতে অগ্রসর হইলেন। বীর-দর্পে জয় ঘোষণা করিতে করিতে সকলেই প্রবেশ করিলেন। সে বীর-দর্পে, জয়-রবে রাজপ্রাসাদ কাঁপিতে লাগিল, সিংহাসন টলিল। সে রব দামেস্কের ঘরে ঘরে প্রবেশ করিল।

 গাজী রহ্‌মান, মস্‌হাব কাক্কা, ওমর আলী ও অন্যান্য রাজগণ মহারাজাধিরাজ জয়নাল আবেদীনকে ঘিরিয়া “বিস্‌মিল্লাহ্” বলিয়া পুরীমধ্যে প্রবেশ করিলেন। পুরীমধ্যে একটি প্রাণীও তাঁহাদের নয়নগোচর হইল না। সকলই রহিয়াছে, যেখানে যাহা প্রয়োজন,—সকলই পড়িয়া রহিয়াছে,—এখনই যেন পুরবাসীরা কোথায় চলিয়া গিয়াছে। পরে সকলে প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইলেন। সেখানেও ঐ ভাব; কেহই নাই। অস্ত্রধারী, অশ্বারোহী, পদাতিক প্রভৃতি যাহা কিছু নয়নগোচর হয়,—সকলই তাঁহাদের। ক্রমে ক্রমে তৃতীয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত; সেখানেও ঐ কথা। গৃহসামগ্রী যেখানে যেরূপ সাজান, ঠিক তাহাই আছে, কোনরূপ রূপান্তর হয় নাই। গৃহবাসীরা এখনই গৃহ ছাড়িয়া—এখনই তাড়াতাড়ি জিনিষপত্র ফেলিয়া যেন কোথায় চলিয়া গিয়াছে। এইরূপে প্রাসাদের পর প্রাসাদ, কক্ষের পর কক্ষ, শেষে অন্তপুর-মধ্যে তাঁহারা প্রবেশ করিলেন। কি আশ্চর্য্য-সেখানেও সেইভাব। সকলই আছে, রাজপুরী মধ্যে যাহা যাহা প্রয়োজন,—সকলই রহিয়াছে। কিন্তু তাঁহারা আপন সৈন্যসামন্ত ও তুরী, ভেরী, নিশানধারিগণ ব্যতীত অন্য কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। কক্ষে কক্ষে সন্ধান করিয়াও জন প্রাণীর দেখা পাইলেন না; ভাবে বোধ হইল, অন্তঃপুরবাসীরা যেন কোন গুপ্তস্থানে লুকাইয়া রহিয়াছে। কোথায় সে গুপ্ত স্থান?—তাহারও কোন সন্ধান করিতে পারিলেন না। জয়ের পর—যুদ্ধ জয়ের পর, বিপক্ষ রাজপুরীতে প্রবেশের পর,—রাজপ্রাসাদ অধিকারের পর যাহা হইয়া থাকে, তাহাই আরম্ভ হইল। দুই হস্তে লুট। প্রথমতঃ, সৈন্যগণের লুট, —তারপর যে যাহা পাইল, তাহা আপন অধিকারে আনিল। কত গুগুগৃহের কপাট ভগ্ন হইল। হীরা, মতি, মণি, কাঞ্চন,— কত রাজবসন, কত মণিমুক্তাখচিত আভরণ, রাজব্যবহার্য্য দ্রব্য। যাহার হস্তে যাহা পড়িতেছে,—সেই-ই তাহা লইতেছে। আর যাহা নিষ্প্রয়োজন মনে করিতেছে, তাহাই ভাঙ্গিয়া ছারখার করিতেছে।

 নব-ভূপতি মহারথিগণে বেষ্টিত হইয়া, ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হইয়া “আল্‌হাম্‌দ্‌-লিল্লাহ্” বলিয়া রাজসিংহাসনে উপবেশন করিলেন। বিজয়-বাজনা বাজিতে লাগিল। রাজ-নিশান শতবার শির নামাইয়া দামেস্কাধিপতির বিজয়-ঘোষণা করিল। অন্যান্য রাজগণ নতশিরে অভিবাদন করিয়া রাজ-সিংহাসনের মর্য্যাদা রক্ষা করিলেন এবং রক্তমাখা তরবারি হস্তে যথোপথুক্ত আসনে রাজাদেশে উপবেশন করিলেন। সৈন্যগণ নিষ্কোষিত অসি হস্তে নব ভূপতির বিজয় ঘোষণা করিয়া নতশিরে অভিবাদন করিলেন।

 গাজী রহ্‌মান রাজসিংহাসন চুম্বন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “বিভিন্ন দেশীয় মহামাননীয় ভূপতিগণ!। রাজস্যগণ! মাননীয় প্রধান প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষগণ! সৈন্যগণ! যুদ্ধ-সংশ্রবী বীরগণ এবং সভাস্থ বন্ধুগণ! দয়াময় ঈশ্বরের প্রসাদে এবং আপনাদের বলবিক্রমের সহায়ে ও সাহায্যে আজ জগতে অপূর্ব্ব কীর্ত্তি স্থাপিত হইল। ধর্ম্মের জয়,—অধর্ম্মের ক্ষয়, তাহারও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জ্বলন্ত রেখায় ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় অঙ্কিত রহিল। এই দামেস্ক-সিংহাসন আজ বক্ষ পাতিয়া যে ভূপতিকে উপবেশন-স্থান দিয়াছে, ইহা এই নব ভূপতিরই পৈতৃক আসন। যে কারণে এই আসন হজরত মাবিয়ার করতল হয়, তদ্বিবরণ এক্ষণে উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। বোধ হয়, আপনারা সকলেই তাহা অবগত আছেন। মহাত্মা মাবিয়া যে যে কারণে এজিদের প্রতি নারাজ হইয়া যাঁহাদের রাজ্য তাঁহাদিগকে পুনরায় প্রতিদান করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন; যে কৌশলে এজিদ মহামান্য প্রভু হাসান-হোসেনকে বঞ্চনা করিয়া এই রাজ্য যে ভাবে নিজ অধীনে রাখিয়াছিলেন, সে বিষয়ও কাহারও অবিদিত নাই। ইমাম-বংশ একেবারে ধ্বংস করিয়া নির্ব্বিবাদে দামেস্ক এবং মদিনারাজ একচ্ছত্ররূপে ভোগ করিবার অভিলাষ করিয়া যে কৌশলে এজিদ—প্রভু হাসানের প্রাণ বিনাশ করিয়াছিলেন, যে কৌশলে ইমাম হোসেনকে নূরনবী মোহাম্মদের রওজা হইতে বাহির করিয়া কুফায় পাঠাইয়াছিলেন, তাহা সকলেই শুনিয়ছেন। মহাপ্রান্তর কারবালার ঘটনা যদিও আমরা চক্ষে দেখি নাই, কিন্তু মদিনাবাসীদিগের মুখে যে প্রকার শুনিয়াছি, তাহা আমার বলিবার শক্তি নাই। যাহা ঈশ্বরের অভিপ্রায় ছিল, তাহাই হইয়াছে। তাহার পর যে ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহা ত আপনারা স্বচক্ষেই দেখিয়াছেন।”

 “যে দিন দামেস্ক-প্রান্তরে আমাদের শেষ আশা—মুসলমান জগতের শেষ আশা—ইমাম বংশের একমাত্র রত্ন, পবিত্র সৈয়দ-বংশের একমাত্র অমুল্য নিধি,—এই নবীন মহারাজ জয়নাল আবেদীনকে এজিদ শূলে চড়াইয়া প্রাণবধের আজ্ঞা করিয়াছিলেন, সে দিন এজিদ-প্রেরিত সন্ধিপ্রার্থী দূতবরকে যে যে কথা বলিয়া যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়াছিলাম, মহাশক্তিসম্পন্ন ভগবান আজ আমাদিগকে সেই শুভদিনের মুখ দেখাইলেন, আমাদের পূর্ব্ব প্রতিজ্ঞা রক্ষা করাইলেন। কিন্তু আশা মিটিল না, মনোবিকার মন হইতে একেবারে বিদূরিত হইল না,—সম্পূর্ণরূপে মনের আনন্দ অনুভব করিতে পারিলাম না। ঈশ্বরের লীলা কে বুঝিবে? সিংহাসন অধিকারের পূর্ব্বে মহারাজ হানিফার তরবারি এজিদ-রক্তে রঞ্জিত হইতে দেখিলাম না। সে মহাপাপীর পাপময় শোণিতবিন্দু মোহাম্মদ হানিফার তরবারি বহিয়া দামেস্ক-ধরায় নিপতিত হইতে দেখিলাম না। সেই স্বেচ্ছাচারী, পরশ্রীকাতর, দামেস্কের কলঙ্ক, মহাত্মা মাবিয়ার মনোবেদনাকারী এজিদের শির দামেস্ক-প্রান্তরে লুণ্ঠিত হইতে দেখিলাম না। আক্ষেপ রহিয়া গেল। আরও আক্ষেপ এই যে, এই শুভ সময়ে রাজশ্রী মোহাম্মদ হানিফাকে রাজসিংহাসনের পাশে উপবিষ্ট দেখিলাম না। সময়ে সকলই হইল। কিন্তু সুখসময়ে উপস্থিত দুইটি অভাব রহিয়া গেল। না জানি বিধাতা ইহার মধ্যে কি আশ্চর্য্য কৌশল করিয়াছেন দয়াময় ভগবান কি কৌশল করিয়া, কি কৌশলজাল বিস্তারে আম্বাজ-অধিপতিকে কোথায় রাখিয়াছেন, তাহা তিনিই জানেন। যে পর্য্যন্ত সন্ধান পাইলাম, তাহাতে আশঙ্কার কথা কিছুই নাই। তবে সম্পূর্ণরূপে মনের আনন্দ অনুভব করিতে পারিলাম না (আনন্দধ্বনি)। অনেক শুনিলাম, এ জীবনে অনেক দেখিলাম। আশ্চর্য্য ঈশ্বর-লীলা। ঈশ্বরভক্ত—ঈশ্বর-প্রেমিকদিগের সাংসারিক কার্য্য কখনই সর্ব্বাঙ্গীন সুন্দর হয় না। তাঁহারা আজীবন কষ্ট, ক্লেশ, যন্ত্রণা ভোগ করিয়া গিয়াছেন,—পরিবারগণকেও যে কি সুখস্বচ্ছন্দে রাখিতে পারিয়াছেন, তাহাও দেখিলাম! অনেক অজ্ঞ লোক এই সকল ঘটনায় প্রকাশ্যে কিছুই বলিতে না পারিলেও মনে মনে অবশ্যই বলিয়া থাকে যে, ভক্ত প্রেমিকের দশাই এইরূপ।”

 “পয়গম্বরগণ যে ঈশ্বরের এত ভালবাসার পাত্র, এত প্রিয়—প্রিয়জন, তাঁহারাও সময় সময় মহাকষ্টে পতিত হইয়া মহাদুঃখ ভোগ করিয়াছেন। প্রিয় বন্ধুগণ! সম্ভ্রান্ত সভ্যগণ! আপনারা অবগত আছেন, হজরত নূহকে তুফানে, ইব্রাহিমকে আগুনে মানবচক্ষে কতই না কষ্ট পাইতে হইয়াছে! —আর দেখুন। হজরত সোলেমান রাজা ও পয়গম্বর।—রাজা কেমন? —সব প্রাণীর উপর তাঁহার রাজত্ব, সর্ব্বজীবের উপর তাঁহার আধিপত্য ও অধিকার। পয়গম্বর কেমন—পরিবার-পরিজন ও সৈন্যসামন্ত-সহ তাঁহার সুসজ্জিত সিংহাসন এই জগদ্ব্যাপী বায়ু মাথায় করিয়া শূন্যে শূন্যে বহিয়া লইয়া যাইত। তাঁহার সামান্য ইঙ্গিতে দেব, দৈত্য, দানব, জ্বেন, পরী সাগরে —জঙ্গলে,—পর্ব্বতে কোথায় কে লুকাইত, তাহার আর সহজে সন্ধান পাওয়া যাইত না। এমন যে দেব-দৈত্য-দানব-দলনকারী নরকিন্নর পুজিত ভূপতি ও পয়গম্বর, তাঁহাকেও মহাবিপদে পতিত হইতে হইয়াছে। তাঁহার হস্তস্থিত মহাগৌরবান্বিত ও শক্তিশালী অঙ্গুরী হারাইয়া চল্লিশ দিবস তিনি কি কষ্টই না ভোগ করিয়াছিলেন। বিধির বিধানে, এক ধীবরের নিকট মজুরী-স্বরূপ দৈনিক দুইটি মৎস্য প্রাপ্ত হইবেন—এই নিয়মে চাকুরী স্বীকার করিয়া তাঁহাকে উদরাম্নের সংস্থান করিতে হইয়াছিল।—চাকুরী বাঁচাইতে মৎস্যের বোঝা মাথায় করিয়া বাজারে বিক্রয় করিতে হইয়াছিল।—বাধ্য হইয়া দায়ে পড়িয়া ধীবর-কন্যাকে বিবাহ করিতে পশ্চাৎপদ হইতে, কি অসম্মতি প্রকাশ করিতে তাঁহার সাধ্য হয় নাই—পারেন নাই। এত বড় মহাবীর হজরত মোহাম্মদের পিতৃব্য আমীর হাম্‌জা—কোরেশ-বংশে কেন, সমগ্র আরব দেশে যাঁহার তুল্য বীর আর কেহ ছিলেন না, সেই মহাবীর হাম্‌জাকেও একটি সামান্য স্ত্রীলোেক-হস্তে প্রাণ দিতে হইয়াছিল। পয়গম্বরই হউন, আর মহাবীর গাজীই হউন,—উচ্চমস্তকে, উচ্চগৌরবে, নিষ্কলঙ্কে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শুভ্রবসনে এই মায়াময় কুহকিনী ধরণী-পৃষ্ঠ হইতে সরিয়া যাইতে কেহই পারেন না।—ইহাতে মোহাম্মদ হানিফা—আমাদের আম্বাজ-অধীশ্বর যে, অক্ষত শরীরে নিষ্কলঙ্কভাবে সর্ব্বদিকে সুবাতাস বহাইয়া, বিজয়নিশান উড়াইয়া, বিজয়ডঙ্কা বাজাইয়া, জগতে অক্ষুন্ন কীর্ত্তিস্তম্ভ স্থাপন করিয়া সুখস্বচ্ছন্দে যাইবেন, ইহা ত কখনই বিশ্বাস হয় না। মহাকৌশলী অদ্বিতীয় ঈশ্বরের এ লীলার অর্থ কে বুঝিবে?—এ গুপ্ত রহস্য ভেদ কে করিবে? ধার্ম্মিক এবং ঈশ্বর-প্রমিক জীবনই কি এত কণ্টকময়—সে জীবনের কি এত বিপদ,—এত যন্ত্রণা! অপ্রেমিক অধার্ম্মিক এ জগতে এক প্রকার সুখী, অনেক কার্য্যই তাহারা সুন্দর মত সর্ব্বাঙ্গীন সুন্দরের সহিত সম্পন্ন করিয়া লয়!”

 “ঈশ্বর-প্রেমিকগণ এবং তাঁহাদের পরিবারগণ কেন সংসারচক্রের আবর্ত্তে পড়িয়া এত ক্লেশ, এত দুঃখ ভোগ করেন, তাহার কারণ হয় ত অনেকেই অনুসন্ধান করেন নাই। তাহা বুঝিলে এ প্রশ্নের উত্তরের, বোধ হয়, অতি সহজেই মীমাংসা হয়। প্রেমিকের প্রেম পরীক্ষাই ইহার মূলতত্ত্ব এবং তাহাই উদ্দেশ্য; দৈহিক কষ্ট জগতে কিছুই নহে। আত্মার বল এবং পরকালের সুখই যথার্থ সুখ,—অনন্তধামের অনন্ত সুখভোগই যথার্থ সম্ভোগ!”

 “দামেস্ক নগরের মাননীয় বন্ধুগণ! আপনারা পূর্ব্ব হইতেই ইমামবংশের প্রতি মনে মনে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিয়া আসিতেছেন, তাহার প্রমাণ ইতিপূর্ব্বে আমাদের এই নবীন ভূপতির কারাগারে আবদ্ধ অবস্থায় খোৎবা পাঠ-সময়ের ঘটনার কথা শুনিয়াছি। ভাগ্যক্রমে অদ্য স্বচক্ষেই তাহাও দেখিতেছি। ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন। রাজানুগ্রহ চিরকাল আপনাদের প্রতি সমভাবে থাকুক,—ইহাই সেই সর্ব্বাধীশ্বরের নিকট কায়মনে প্রার্থনা করি।”

 দামেস্ক নগরস্থ ইমামভক্ত দলপতিগণের মধ্য হইতে মহাসম্ভ্রান্ত এবং মাননীয় কোন মহোদয় দণ্ডায়মান হইয়া বলিতে লাগিলেন, “আমরা চিরকালই হজরত নূরনবী মোহাম্মদের আজ্ঞাবহ দাসানুদাস, মহাবীর হজরত মোরতজা আলীর চিরভক্ত। মধ্যে কয়েক দিন মহামহিম হজরত মাবিয়ার আনুগত্য স্বীকার করিয়া নিশ্চিন্তভাবে ধর্ম্মকর্ম্ম রক্ষা করিয়া সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিয়াছি। হজরত মাবিয়ার পীড়ার সময় হইতেই আমাদের দুর্দ্দশার সুচনা আরম্ভ হইয়াছিল। তাহার পর মন্ত্রিপ্রবর হামানের অপদস্থ হওয়ায় এবং এজিদ-দরবারে বৃদ্ধ মন্ত্রীর বয়সদোষে বুদ্ধি-বিবেচনায় ভ্রম জন্মিয়াছে, —মারওয়ানের বিবেচনায় এই কথা সাব্যস্ত হওয়ার পর হইতেই আমাদের দুর্দ্দশার পথ সহজেই পরিষ্কার হইয়াছে। আর কোথায় যাই, এক প্রকার জীবন্মৃতপ্রায় হইয়া দামেস্কে বাস করিতেছিলাম; এইক্ষণে দয়াময় জগদীশ্বর, যাঁহাদের রাজ্য তাঁহাদের হস্তেই পুনঃ অর্পণ করিলেন; আমাদের জ্বালা, যন্ত্রণা, দুঃখ সকলই ইহকাল পরকাল হইতে উপশম হইল। আমরা দুই হস্ত তুলিয়া সর্ব্বশক্তিমান্ ভগবান সমীপে প্রার্থনা করিতেছি যে, মহারাজাধিরাজ জয়নাল আবেদীনের রাজমুকুট চিরকাল অক্ষুন্নভাবে পবিত্র শিরে শোভাবর্দ্ধন করুক। আর আমরাও মনের সহিত রাজসেবা করি, পুণ্য ভূমি মদিনার অধীনস্থ হইয়া চিরকাল গৌরবের সহিত সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতে থাকি। মদিনার অধীনতা স্বীকার করিতে কাহার না ইচ্ছা হয়? আমরা সর্ব্বান্তঃকরণে মহারাজ জয়নাল আবেদীনের মঙ্গল কামনা করি। আজ মনের আনন্দে নবীন মহারাজের বিজয়-ঘোষণা করিয়া মনের আবেগ দূর হইল; শান্তি-সুখে সুখী হইয়া ভাগ্যবান্ হইলাম।”

 বক্তার কথা শেষ হইতে না হইতেই শাহী দরবার হইতে সহস্র মুখে “জয় জয়নাল আবেদীন” রব উচ্চারিত হইয়া প্রবাহিত বায়ু সহিত প্রতিযোগিতায় প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল, “জয় জয়নাল আবেদীন!” সকলেই নতশিরে নবীন মহারাজের সিংহাসন চুম্বন করিলেন এবং যথোপযুক্ত উপঢৌকনাদি রাজগোচর করিয়া অধীনতা স্বীকার করিলেন, ইহকাল এবং পরকালের আশ্রয়দাতা, রক্ষাকর্ত্তা বলিয়া শত শত বার সিংহাসন চুম্বন করিলেন। সে সময় সাদিয়ানা-বাদ্য বাদিত না হইয়া রণবাদ্যই বাজিতে লাগিল। কারণ, এজিদের কোন সংবাদ নাই; এজিদ-বধের কোন সমাচার প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। দরবার বরখাস্তু হইল। মহাজ জয়নাল আবেদীন, গাজী রহ মানের মন্ত্রণায় জননী, ভগ্নী এবং অন্যান্য পরিজনকে বন্দীগৃহ হইতে রাজপুরী মধ্যে আনয়ন করিতে ওমর আলী ও আক্কেল আলীসহ রাজপ্রাসাদ হইতে বন্দী-গৃহে যাত্রা করিলেন, অন্যান্য রাজগণ কিঞ্চিৎ বিশ্রাম-সুখ প্রয়াসী হইয়া বিশ্রাম-ভবনে গমন করিলেন। দ্বারে প্রহরী খাড়া হইল। সৈন্যাধ্যক্ষগণ, সৈন্যগণ, দামেস্ক-সৈন্যনিবাসে যাইয়া সজ্জিত কক্ষসকল নির্দ্দিষ্টরূপে গ্রহণ করিয়া বিশ্রাম-সুখ অনুভব করিতে লাগিলেন।

  1. স্বর্গীয় দুতের নাম। যিনি জীবের প্রাণ হরণ করেন তাঁহারই নাম আজরাইল।