বিষাদ-সিন্ধু/এজিদ-বধ পর্ব্ব/প্রথম প্রবাহ

এজিদ বধ পর্ব

 

প্রথম প্রবাহ

 বন্দীগৃহ। বন্দীগৃহ সুবর্ণে নির্ম্মিত, মহামূল্য প্রস্তরে খচিত, সুখসেব্য আরামের উপকরণে সুসজ্জিত হইলেও মহাকষ্টপ্রদ—যন্ত্রণাময় স্থান। সুখসম্ভোগের সুখময় সামগ্রী দ্বারা পরিপূরিত হইলেও বন্দীগৃহ, দেহদগ্ধকারী মহাকপ্রদ জ্বলন্ত অগ্নিময় নরকনিবাস। সুবর্ণ-পাত্র সুস্বাদু-সুমিষ্ট-সরস খাদ্যে পরিপূরিত, রসনা পরিতৃপ্ত করিতে সুন্দর বন্দোবস্ত ও সুব্যবস্থা থাকিলেও বন্দীগৃহ মহাকাল—যমালয়! কোন বিষয়ে অভাব অনটন না হইলেও সর্বতোভাবে মশান হইতে শ্মশান আদরের! অমুল্য রত্ন স্বাধীনতা-ধন যে স্থানে বর্জিত, সে স্থান অমরপুরী সদৃশ মন-নয়ন মুগ্ধকর সুখসম্ভোগের স্থান হইলেও মানবচক্ষে তাহা অতি কদাকার ও জঘন্য, বুদ্ধিশক্তি সম্পন্ন সঞ্জীব প্রাণীর নিকট তাহা কণ্টক সমাকীর্ণ বিসদৃশ বিজন বন। বিজন বনেও পশুদিগের স্বাধীনতা আছে, ইচ্ছানুসারে তাহাদের পরিভ্রমণ,—স্বজাতি-স্বজন পরিদর্শন ক্ষমতাও আছে, বন্দীখানায় বন্দীর ভাগ্যে তাহাও নাই। সুতরাং বাধ্য-বাধকতা, অধীন-অধীনতা সংস্রবে। স্বর্গসুখও মহা যন্ত্রণাদায়ক। যন্ত্রণাদায়ক কেন? কারণ, তাহা সুখস্বচ্ছন্দের আমূল পরিচ্ছেদক।

 বন্দীর মনে নানা ভাবনা চিন্তা,—নানা কথা। কাহারও অন্তরে আঙ্গানির মহা বেগ শতধারে ও সহস্র প্রকারে ছুটিয়া হৃদয়ের অন্তঃস্থল পর্যন্ত অগ্নিদাহের ন্যায় দগ্ধ করিয়া উত্তমাঙ্গতি সপ্তঘরে তাপের শেষ পর্যন্ত ক্রমে ক্রমে বহির্গত হইতেছে। কাহারও অনুতাপানল আক্ষেপ ইন্ধনে পরিবর্দ্ধিত হইয়া সতেজ রসনা আশ্রয়ে ছুটিয়া ছুটিয়া বাহির হইতেছে। মনের কথা মন-ভারে মনে মনে চাপিয়া হৃদয়ের রক্ত সমধিক হা-হুতাশ জলে পরিণত করিতেছে, কাহারও প্রতি লোমকূপ হইতে সে হা-হুতাশকৃত জলের কথঞ্চিৎ অংশ ঘর্ম্মচ্ছলে বহির্গত হইয়া তাহাকে অবসাদে নির্জীবপ্রায় করিতেছে। কেহ গত কথা স্মরণ করিয়া, বন্দীখানাস্থিত কুঠারহস্তে দণ্ডায়মান মনুষ্যঘাতী জল্লাদের উচ্চ মঞ্চের উপরিভাগ প্রতি স্থিরনেত্রে দৃষ্টিপাত করিয়া মস্তিষ্কের মজ্জা পরিশুদ্ধ করিতেছে। বন্দীমাত্রেই যে ন্যায় ও যথার্থ বিচারে দণ্ডিত—তাহা নহে। ভ্রান্তি ভ্রম মানবেই সম্ভবে! ইহাও নিশ্চয়, নির্ভুল অন্তর জগতে নাই। ভ্রমশূন্য মজ্জাও মানুষের নাই। ইহার পর নিরপেক্ষ সদ্বিচারকের সংখ্যা অতি অল্প। কত বন্দী—ভ্রমে, পক্ষপাতিত্বে, অনুরোধে, বিভ্রাটে আজীবন ফাটকে আটক রহিয়াছে।

 পাঠক! এই ত আপনার সম্মুখে দামেস্ক-কারাগারের অবিকল চিত্র। সুবিচার, অবিচার, হিংসা-দ্বেষে কত বন্দী, কত স্থানে কত প্রকার শাস্তিভোগ করিতেছে। বন্দীখানার তুল্য কোন স্থানই জগতে নাই। প্রহরীদল মানবাকার হইলেও স্বভাব ও ব্যবহারে পশু হইতেও নীচ। তাহাদের শরীর যে, রক্ত-মাংস-হৃদয় সংঘোগে গঠিত, ইহা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। চতুষ্পার্শে প্রাচীরবেষ্টিত স্থানটুকুই তাহাদের রাজ্য। এ রাজ্যের অধীশ্বর তাহারা। প্রবল প্রতাপে আধিপত্য করার কল্যাণে রাক্ষসভাব, পশুভাব, অমানুষিক-ভাব আসিয়া তাহাদের মস্তকে নির্ভর করিয়াছে। দয়া, মায়া, অনুগ্রহ, স্নেহ, ভালবাসা তাহাদের অন্তর হইতে একেবারে সরিয়া পড়িয়াছে; মুখখানিও রসনা-সহকারে এমনই বিকট ভাব ধারণ করিয়াছে যে, কর্কশ, নীরস, অন্তর্ঘাতী, মর্ম্মপীড়িত নিদারুণ বাক-প্রয়োগে সর্ব্বদা তাহারা বন্দীদিগকে জর্জ্জরিত করিতে থাকে। তদুপরি যথা-অযথা যন্ত্রণা—পদাঘাত, দণ্ডাঘাত—বন্দীভাগ্যে কথায় কথায় হইতে থাকে। দামেস্ক নগরে এজিদের বন্দীগৃহ নরক হইতেও ভয়ানক। শাস্তির মাত্রাও সেই প্রকার। ক্রমে দেখিতে পাইবেন,—বিধির বিধানে এজিদ-অজ্ঞায়, মারওয়ানের মন্ত্রণায়, প্রভু হোসেন-পরিবার, জয়নাল আবেদীন প্রভৃতি সকলেই ঐ বন্দীখানায় বন্দী। কিন্তু ইঁহাদের প্রতি কোনরূপ শাস্তির বিধান নাই। পৃথক খণ্ডে,—ভিন্ন কক্ষে ইহাদের স্থান নির্দ্ধারিত হইয়াছে। দৈনিক আহারের ব্যবস্থা বন্দীগৃহের প্রধান অধ্যক্ষ-হস্তে। তিনি যে সময় বিবেচনা করেন, সেই সময় শুষ্ক রুটি এবং এক পাত্র জল, যাহা বরাদ্দ আছে, তাহাই তাঁহাদিকে দিতে অনুমতি করেন।অন্য অন্য বন্দীর ভাগ্যে তাহাও নাই।

 পাঠক, ঐ দেখুন! দামেস্ক-বন্দীগৃহে শাস্তির চিত্র দেখুন! অধিকক্ষণ দেখাইব না। কোন্ চক্ষু এই অমানুষিক ব্যাপার দেখিতে ইচ্ছা করে?— তবে মহারাজ এজিদের বিচারের চিত্র অনেক দেখিয়াছেন, বন্দী খানার চিত্রও কিছু দেখুন।

 ঐ দেখুন, জীবন্ত নরদেহ লৌহপিঞ্জরে আবদ্ধ হইয়া কি ভয়াবহ রূপ ধারণ করিয়াছে। অত্যাচারে, অনাহারে, অনিয়মে শরীর—জীর্ণ, বর্ণবিবর্ণ, চক্ষু—কোটরে, জিহ্বা-তালু—শুষ্ক, কণ্ঠ—নিরস,—মুখাকৃতি —বিকৃত, শরীর-অন্তঃসারশূন্য অস্থিপুঞ্জের সমাবেশ! কাহারও হস্তপদে জিঞ্জির, আবার কাহারও বা হস্তপদ মৃত্তিকার সহিত জিঞ্জিরে আবদ্ধ। কোন কোন বন্দী মৃত্তিকা-শয্যায় শায়িত, অথচ তাহাদের হস্ত-পদ লৌহশৃঙ্খলে লৌহ-পেরেকে ভূতলে আবদ্ধ। কাহারও বক্ষঃস্থল পর্য্যন্ত ভূগর্ভে নিহিত, কাহারও বা গলদেশ পর্য্যন্ত মৃত্তিকায় প্রোথিত। ঐ দিকে দেখুন! নরাকার রাক্ষসগণ হাসিতে হাসিতে জীবন্ত জীবের অঙ্গ হইতে সুতীক্ষ ছুরিকা দ্বারা চর্ম্ম ছাড়াইতেছে, লবণ মাখাইতেছে, সাঁড়াশি দিয়া চক্ষু কেমন করিয়া টানিয়া বাহির করিতেছে। দেখুন, দেখুন,—লৌহশলাকা—উত্তপ্ত লৌহশলাকা—মানুষের হাতে পায়ে হাতুড়ীর আঘাত বসাইয়া মৃত্তিকার সহিত কি ভাবে আঁটিয়া দিতেছে! এ সময়ে তাহাদের প্রাণে কি বলিতেছে, তাহা কি ভাবা যায়, না সহজ জ্ঞানে বোঝা যায়? কাহারও বা হস্ত-পদ মৃত্তিকার সহিত লৌহ পেরেকে আবদ্ধ, বক্ষে পাষাণ চাপা, চক্ষু ঊর্দ্ধে, কোন দিকে দৃষ্টির ক্ষমতা নাই, দৃষ্টি কেবল অনন্ত আকাশে। আরও দেখুন, কাহারও পা দু’খানি কঠিনরূপে ঊর্দ্ধে বাঁধা, মস্তক নিম্নে, হস্তদ্বয় ঝুলিয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে; জিহ্বা মুখ হইতে বাহির হইয়া নাসিকা ঢাকিয়া চক্ষুর উপরে হেলিয়া পড়িয়াছে; চক্ষু উল্টাইয়া ফাটিয়া রক্ত পড়িবার উপক্রম হইতেছে; ইহাতেও নিস্তার নাই, সময়ে সময়ে দোর্‌রার আঘাতে শরীরের চর্ম্ম ফাটিতেছে! রক্ত পড়িতেছে! কি মর্ম্মঘাতী অন্তরভেদী ভীষণ ব্যাপার। আর দেখা যায় না। চলুন, অন্য দিকে যাই।

 ঐ যে বৃদ্ধ বন্দী—লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ, নিবিষ্টচিত্তে ধ্যানে মগ্ন, হাব-ভাব দেখিয়া যেন ইহাকে চেনা-চেনা বোধ হইতেছে। কোথায় যেন দেখিয়াছি, মনে পড়ে! অনুমান মিথ্যা নহে। এই সেই মহাত্মা মন্ত্রিপ্রবর হামান, হজরত মাবিয়ার প্রধান মন্ত্রী, এজিদের পুণ্যাত্মা পিতার প্রিয় সচিব! মহাজ্ঞানী বৃদ্ধ হামান, এজিদ-আজ্ঞায় বন্দী—লৌহ-শৃঙ্খলে আবদ্ধ। বৃদ্ধবয়সে এই যন্ত্রণা! মন্ত্রী-প্রধান হামান কি যথার্থ বিচারে বন্দী? মহারাজ এজিদ কি অপরাধে ইঁহাকে কারাগারে নিক্ষেপ করিয়াছেন, তাহা কি মনে হয়। হানিফার সহিত যুদ্ধে তাঁহার অমত, দামেস্কাধিপতির স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে গমনে তাঁহার অমত প্রকাশ, এজিদের মতের সহিত তাঁহার মতের অনৈক্য—সুতরাং তিনি এজিদ-আজ্ঞায় বন্দী! দামেস্ক নগরের ভূতপূর্ব্ব দণ্ডধর হজরত মাবিয়ার দক্ষিণ-হস্তই ছিলেন—এই হামান। এজিদের হস্তে পড়িয়া মহাঋষির এই দুর্দ্দশা! হায় রে জগৎ! হায় রে স্বার্থ! দামেস্ক-সিংহাসনের চির গৌরব-সূর্য্য এজিদ-কল্যাণে আজ অস্তমিত!

 পিতার,—মাননীয় পিতার ভালবাসার পাত্রকে কোন্ পুত্র অবজ্ঞা করিয়া থাকে? হামানের চিন্তা ভ্রম-সঙ্কুল ছিল না,—আশা ও দুরাশার পথে অযথা দণ্ডায়মান হইয়া কুহকে মাতিয়াছিল না—কারণ, এ আশা মানুষেরই হয়: মানুষের দৃষ্টান্তেই মানুষ শিক্ষা পায়। আশা ছিল, —মন্ত্রি প্রবরের মনে আশা ছিল,—এজিদ মাবিয়ার সন্তান; পিতৃ-অনুগৃহীত বলিয়া অবশ্যই সে তাঁহাকে দয়া করিবে; বৃদ্ধ বয়সে নবীন রাজপ্রসাদে সুখী হইয়া নিশ্চিন্তভাবে ঈশ্বর আরাধনায় তাঁহার জীবনের অবশিষ্ট অংশ কাটিয়া যাইবে। নিয়তির বিধানে তাহা ঘটিল না। অথচ এজিদের স্বেচ্ছাচারবিচারে বৃদ্ধ বয়সে লৌহ-নিগড়ে তাঁহাকে আবদ্ধ হইতে হইল! শুনুন, মন্ত্রিপ্রবর মৃদু মৃদু স্বরে কি কথা বলিতেছেন,—

 রাজার অভাব হইলে রাজা পাওয়া যায়, রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটিলে তাহারও শাস্তি হয়, রাজ্যমধ্যে ঘোর বিদ্রোহানল প্রজ্জ্বলিত হইলেও যথাসময়ে অবশ্যই তাহার নির্ব্বাণ হয়, উপযুক্ত দাবী বুঝাইয়া দিলে সে দুর্দ্দমনীয় তেজও একেবারে বিলীন হইয়া উড়িয়া যায়। মহামারী, জলপ্লাবন ইত্যাদি দৈবদুর্বিপাকে রাজ্যধ্বংসের উপক্রম বোধ হইলেও নিরাশ-সাগরে ভাসিতে হয় না—আশা থাকে। রাজা মজ্জা-দোষে, কি মন্ত্রণার অভাবে রাজ্যশাসনে অকৃতকার্য্য হইলেও আশা থাকে। মূর্খ রাজার প্রিয় পাত্র হইবার আশায়, মন্ত্রণাদাতাগণ অবিচার, অত্যাচার নিবারণে উপদেশ না দিয়া অহরহঃ তোষামোদের ডালি মাথায় করিয়া প্রতিটি রাজাজ্ঞা অনুমোদন করাতেই যদি রাজায় প্রায় মনান্তর ঘটে, তাহাতেও আশা আছে—সে ক্ষেত্রেও আশা থাকে। কিন্তু স্বাধীনতা-ধনে একবার বঞ্চিত হইলে সহজে সে মহামণির মুখ আর দেখা যায় না। বহু আয়াসেও সে মহামুল্য রত্ন আর হস্তগত হয় না। স্বাধীনতা-সূর্য্য একবার অস্তমিত হইলে তাহার পুনরুদয় হওয়া বড়ই ভাগ্যের কথা।

 “রাজা আর রাজ্য, এই দুইটি পৃথক কথা—পৃথক ভাব—পৃথক সম্বন্ধ। রাজা নিজ বুদ্ধি-দোষে অপদস্থ হউন, সদ্‌যুক্তি, সুমন্ত্রণা অবহেলা করিয়া পর-পদতলে দলিত হউন, স্বেচ্ছাচারিত্ব দোষে অধঃপাতে যাউন, তাহাতে রাজ্যের কি? কার্য্যানুরূপ ফল, পাপানুযায়ী শাস্তি। স্বেচ্ছাচারী, সুমন্ত্রণা-বিদ্বেষী, নীতি-বর্জ্জিত, উচিত কথায় বিরক্ত,—এমন রাজার রাজ্যপাট যত সত্বর ধ্বংস হয়, ততই মঙ্গল, ততই রাজ্যের শনিক্ষয় ও ভবিষ্যৎ মঙ্গলের আশা। দামেস্ক-রাজ্যের আর মঙ্গল নাই। বিনা কারণে, প্রেমের কূহকে, পিরিতের দায়ে, প্রণয়-বাসনায়, পরিণয়-ইচ্ছায়, যদি এই রাজ্য যথার্থই পরকরতলস্থ হয়, পরপদভরে দলিত হয়, আমাদের স্বাধীনতা লোপ হয়, তবে সে দুঃখের আর সীমা থাকিবে না, সে মনঃকষ্টের আর ইতি হইবে না। রাজা প্রজা-রক্ষক, বিচারক, প্রজাপালক এবং করগ্রাহক। কিন্তু রাজ্যের যথার্থ অধিকারী প্রজা। দায়িত্ব প্রজারই অধিক। রাজ্য রক্ষার দায়িত্ব প্রজার—বাসিন্দা মাত্রেরই। যদি রাজ্য মধ্যে মানুষ থাকে, হৃদয়ে বল থাকে, স্বদেশ বলিয়া জ্ঞান থাকে, পরাধীন শব্দের যথার্থ অর্থবোধ থাকে, জন্মভূমির মূল্যের পরিমাণ জ্ঞান থাকে, একতা-বন্ধনে আস্থা থাকে, ধর্ম্মবিদ্বেষে মনে মনে পরস্পর বৈরীভার না থাকে, জাতিভেদ-হিংসা, ঈর্ষা এবং ঘৃণার ছায়া না থাকে, অমূল্য সময়ের প্রতি সর্ব্বদা লক্ষ্য থাকে, আলস্যে অবহেলা এবং শৈথিল্যে বিরোধী যদি কেহ থাকে, বিদ্যার চর্চ্চা থাকে, আর সর্ব্বোপরি ঈশ্বরে ভক্তি থাকে, তবে যুগ যুগান্তরে হউক, শতাব্দী পরেই হউক, সহস্রাধিক বর্ষ গতেই হউক, কোন কালেই হউক, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরাধীনতা-গগনে স্বাধীনতা-সূর্য্যের পুনরুদয় আশা একবার করিলেও করা যাইতে পারে। কিন্তু দামেস্ক-রাজ্যে সে আশা—আশা-মরীচিকা। দামেস্ক বীরশূন্য! দামেস্ক চিন্তাশীল দেশহিতৈষী মহোদয়গণের অনুগ্রহ হইতে বঞ্চিত। সে উপকরণে গঠিত কোন মস্তক আছে কি না, তাহাতেই বিশেষ সন্দেহও হইবে কি না,— তাহাতেও নানা সন্দেহ।”

 “যে দিন রমণী-মুখচন্দ্রিমার সামান্য আভায় ধরণীপতির মস্তক ঘুরিয়াছে, মহীপাল এজিদের মহাশক্তিসম্পন্ন মজ্জা, পরকর-শোভিত মর্দ্দিত কমলদলের মুমুর্ষু অবস্থার ঈষৎ আভায় গলিয়া বিপরীত ভাব ধারণ করিয়াছে, সেই দিনই নিরাশার সঞ্চার হইয়া স্বাধীনতাধনে বঞ্চিত হওয়ার সূত্রপাত ঘটিয়াছে। রাজার আচার, রাজার ব্যবহার,—প্রজার আদর্শ এবং শিক্ষার স্থল। যে রাজচক্ষু কোমলপ্রাণা কামিনীর কমলাক্ষির কোমল তেজ সহ্য করিতে অক্ষম, সে চক্ষু মোহাম্মদ হানিফার সুতীক্ষ্ণ তরবারির জ্বলন্ত তেজ সহ্য করিতে কখনই সক্ষম হইবে না। সে অসীম বলশালী মহাবীরের অস্ত্রাঘাত কি রূপজ মোহে ঘূর্ণিত মস্তক সহ্য করতে পারে?—কখনই নহে। আর আর আশা কি?—কামিনী-কটাক্ষশরে জর্জ্জরিত হৃদয়ের আশ্বাসের জন্য রাজনীতি উপেক্ষা করিয়া অকারণ রণবাদ্য বাজাইতে যে মন্ত্রী মন্ত্রণা দেয়, সে মন্ত্রী গাজী রহ্‌মানের মন্ত্রণা ভেদ করিয়া কৃতকার্য্য হইতে কোন কালেও সক্ষম হইবে না, কখনও গাজী রহ মানের সমকক্ষ হইতে পারে না। যদি যুদ্ধই ঘটিয়া থাকে, তবে নিশ্চয়ই পরাজয়— নিশ্চয়ই দামেস্কের অধঃপতন— নিশ্চয়ই দামেস্কের সিংহাসনে জয়নাল আবেদীন—নিশ্চয়ই এজিদের মৃত্যু, মারওয়ানের মনোগত আশা বিফল! পিরিত, প্রণয়, প্রেম,—এই তিন কারণেই আজ দামেস্কের এই দুর্দ্দশা। কি ঘৃণা! কি লজ্জা!”

 “বৃদ্ধ বয়সে অবিচারে পিঞ্জরাবদ্ধ হইয়া আকুলিত হই নাই। যতদূর বুঝিয়াছি, বলিয়াছি। আমার ভ্রম দর্শাইয়া ইহা অপেক্ষা শত গুণ শাস্তি দিলেও ক্ষোভের কারণ ছিল না। উচিত কথায় আহাম্মক রুষ্ট, এ কথা নূতন নহে। প্রকাশ্য দরবারে মত জিজ্ঞাসা করায়, বুদ্ধি-বিবেচনায় যাহা আসিয়াছে, বলিয়াছি। ইহাই ত অপরাধ, ইহাতেই বন্দী, ইহাতেই পিঞ্জরে আবদ্ধ। কিছুমাত্র দুঃখ নাই; কারণ,—মূর্খ, স্বার্থপর, মিথ্যাবাদী, পরশ্রীকাতর পরস্ত্রী-আকাঙক্ষী, স্বেচ্ছাচারী এবং রোষপরবশ রাজার নিকট ইহা অপেক্ষা আর কি আশা করা যাইতে পারে? প্রাণদণ্ডের আদেশ হয় নাই, ইহাতে আমার শত লাভ। সহস্র প্রকারে ঈশ্বরে ধন্যবাদ!”

 “ভাল কথা,—ওমর আলীর বন্দী হওয়ার কথাই শুনিলাম, প্রাণরধের কথা ত শুনিলাম না। শূলে জয়নাল আবেদীনের প্রাণদণ্ড হইবে, এই ঘোষণার কথাই কানে প্রবেশ করিল, শেষ কথাটা আর কেই বলিল না। সংবাদ কি? এ অন্যায় যুদ্ধের পরিণাম কি? কি হইতেছে, কি ঘটিতেছে, কোন বীর কেমন তরবারি চালাইতেছে,—বর্শা উড়াইতেছে,—তীর চালাইতেছ, কৈ—কেহই ত কিছুই বলে না। আমাদের পক্ষের অতি সামান্য সামান্য শুভসংবাদও লোকের মুখে ক্রমে অসামান্য হইয়া উঠে। কৈ—এ কয়েক দিন ভালমন্দ কোন সংবাদই ত শুনিতে পাইলাম না। মন্দ কথা কানে আসিবার কথা নহে—ভাল কথার যখন একটা বর্ণও প্রকাশ হইতেছে না, তখন আর কি বলি!”

 “যুদ্ধকাণ্ড বড়ই কঠিন। সামান্য বিবেচনার ত্রুটিতে সর্ব্বস্ব বিনাশ,— লক্ষ লক্ষ প্রাণীর প্রাণ মুহুর্ত্তে ধ্বংস! বড়ই কঠিন ব্যাপার! দামেস্ক রাজ্যের যে সময় উপস্থিত, এ সময় যুদ্ধ করাই অন্যায়। যুদ্ধের কারণ দেখিতে হইবে, লাভালাভের প্রতিও লক্ষ্য রাখিতে হইবে, আপন আপন ক্ষমতার পরিমাণও বুঝিতে হইবে, ধনাগারের অবস্থাও ভাবিতে হইবে। আত্মীয়, স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পুরবাসী, প্রতিবেশী, সমকক্ষ, সমশ্রেণী, জাতি, কুটুম্ব এবং রাজ্যের গণ্যমান্য ধনী ও সাধারণ প্রজার মনের ভাব বিশেষ করিয়া অতি গোপনে কৌশলে পরীক্ষা করিতে হইবে। কেবল ধনভাণ্ডার খুলিয়া দিয়াই চক্ষু শীতল করিলেই চলিবে না। আহার্য্য-সামগ্রী—কেবল মানুষের নয়, গরু ঘোড়া ইত্যাদি পালিত জীবজন্তুসহ নগরস্থ প্রাণীমাত্রেরই কত দিনের আহার মজুত, প্রাণীর পরিমাণ, আহার্য্য সামগ্রীর পরিমাণ, আনুমানিক যুদ্ধকালের পরিমাপ করিয়া সমুদয় সাব্যস্ত-বন্দোবস্ত, আমদানী-রপ্তানি, পানীয় জলের সুবিধা পর্য্যন্ত করিয়া—তবে অন্য কথা।”

 “এ যুদ্ধে এ কথাটা অগ্রেই ভাবা উচিত ছিল: মহাবীর মোহাম্মদ হানিফা বহুদুর হইতে আক্রমণ আশায় আসিয়াছেন। দামেস্ক—ভিন্ন দেশ, তাঁহার পক্ষে সহসা এখানে প্রবেশই দুঃসাধ্য। ইহার পর নগর-আক্রমণে আশা—রাজবন্দী-গৃহ হইতে পরিজনগণকে উদ্ধারের আশা—এজিদ-বধ করিয়া দামেস্কসিংহাসন অধিকার করিবার আশা—এক একটি আশা কম পরিমাণের আশা নহে—কথাচ্ছলে আমি ইহাকে এক প্রকার দুরাশাও বলিতে পারি, কারণ, রাজ্যের সীমাই যুদ্ধের সীমা। সে সীমা অতিক্রম করিয়া নগর-প্রান্তভাগের প্রান্তরে এজিদের মহাকাল স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত। এক গাজী রহ্‌মানের বুদ্ধি-কৌশলে সকল বিষয়ে সুন্দর বন্দোবস্ত। যাহা তাহাদের পক্ষে কঠিন ছিল, তাহাও তাহারা অনায়াসেই সুসিদ্ধ করিয়াছে। রাজ্য-সীমায় প্রবেশ দূরে থাকুক, নগরের প্রান্তসীমায় রণভূমি—আর আশা কি?”

 “অন্যায় সমরে রাজা স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে। কি পরিতাপ। যে রাজা রাজনীতির বাধ্য নহে, সমরনীতির অধীন নহে, স্বেচ্ছাচারিতাই যাহার মস্তিষ্কের বল, তাহার কি আর মঙ্গল আছে? প্রণয়ে, প্রেমে যে রাজা আসক্ত, তাহার কি আর শ্রীবৃদ্ধি আছে? যুদ্ধবিগ্রহে পিরিত—প্রণয়ের প্রসঙ্গ আসিতেই পারে না। মুল কারণ হওয়া দুরে থাকুক, সে নামেই সর্ব্বনাশ! রাজনীতি, সমরনীতি, এই দুইটি নীতির অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া যতই জ্ঞানলাভ হইবে, যতই অভিজ্ঞতা জন্মিবে, ততই বুঝিতে পারা যাইবে যে, ইহার মধ্যে কি না আছে! জগতের সমুদয় ভাব, স্বভাব, ব্যবহার ও কার্য্য-প্রণালী সমুদয়ই ঐ দুই নীতির মধ্যগত। কিন্তু ব্যবহারের ক্ষমতা, পরিচালনার বল, কার্য্যে পরিণত করিবার অধিকার সম্পূর্ণরূপে জগতে কোন প্রাণীর মস্তকে আছে কি না সন্দেহ!”

 “এ ধর্ম্মনীতির কথা নহে যে, ঘাড় নেয়াইয়া বিশ্বাস করিতেই হইবে। পাপের প্রায়শ্চিত্ত নহে যে, কালে হইবেই হইবে। এ প্রসূতির প্রসব-বিষয়ের চিন্তা নহে যে, দশ মাস দশ দিন পরে যাহা হয় একটা হইবেই হইবে, এ অদৃষ্ট-লিপির প্রতি নির্ভরের কার্য্য নহে যে, যাহা কপালে লেখা আছে, তাহাই ঘটিবে। এ রাজ-চক্র, ইহার মর্ম্মভেদ করা বড়ই কঠিন। বিশেষতঃ, সমর-কাণ্ড যেমন কুটিল, তেমনি জটিল। যখনই প্রশ্ন তখনই উত্তর, যে মুহূর্ত্তে চিন্তা, সেই মুহূর্ত্তেই কার্য্য, তখনই কার্য্যফল! দ্রুতগতি সময়ের সহিত সমরকাণ্ডের কার্য্য-সম্বন্ধ-বুদ্ধির কৌশল,—বিবেচনার ফল। জয়-পরাজয়ের সময় অতি সংক্ষেপ। একদিকে দক্ষিণ চক্ষু দেখিল: বীরবরের হস্তস্থিত তরবারি বিদ্যুত-লতায় চমকাইতেছে-অন্যদিকে বাম চক্ষু দেখিল: ঐ মহাবীরের রঞ্জিত দেহ ভূতলে গড়াইতেছে, রঞ্জিতহস্তে রঞ্জিত তরবারি বদ্ধমুষ্টিতে ধরাই রহিয়াছে। বর্ত্তমান যুদ্ধে যে কি ঘটিবে, তাহা ভগবানই জানেন। আমার সময় মন্দ। কাহারও নিকট কিছু জিজ্ঞাসা করিতে সাহস হয় না, কাহারও মুখে কিছু শুনিতে পাই না। মহারাজ আজ্ঞা করিয়াছেন—বন্দী হইয়াছি। লৌহশৃঙ্খল গলায় পরিতে হুকুম দিয়াছেন, হুকুম তামিল করিয়াছি। ইহাতে দুঃখমাত্র নাই, অন্তরেও বেদনা বোধ করি নাই। তবে বেদনা লাগিয়াছে যে, এই সঙ্কট সময়ে অকারণ যুদ্ধে অগ্রসর—স্বয়ং রাজার অগ্রসর,— স্বয়ং রাজার অস্ত্রধারণ। বড়ই দুঃখের কথা। এ যুদ্ধের পরিণাম ফল কি হইবে? কে হারিবে, কে জিতিবে। সন্ধি—অসম্ভব। যুদ্ধ অনিবার্য্যরূপে চলিতেছে, সমরগগনে লোহিত নিশান বায়ুর সহিত এখনও খেলা করিতেছে,—ইহাতে সন্দেহমাত্র নাই। আমার ত এই বিশ্বাস যে, দামেস্ক-প্রান্তরই রঞ্জিত হইতেছে। দামেস্ক-ভূমি দামেস্ক-বীর-শিরেই পরিপূর্ণ হইতেছে। এ অবৈধ সমরে সন্ধির নামই আসিতে পারে না। এজিদ-হানিফার রণক্ষেত্রে শুভ্র নিশান উড়িতেই পারে না! বড়ই শক্ত কথা!”

 মন্ত্রীবর হামান মনের কথা এইরূপে অকপটে মুখে প্রকাশ করিতেছেন, এমন সময় দ্বাররক্ষক দ্রুতপদে মন্ত্রীপ্রবরের নিকট আসিয়া, চুপে চুপে কি কথা বলিতে লাগিল। বন্দী সচিব! তাঁহার মুখে কোন কথাই প্রকাশ হইল না। দেখিবার মধ্যে দেখা গেল,—তাঁহার চক্ষে জল। আর শুনিবার মধ্যে শুনা গেল,—তাঁহার দীর্ঘ নিঃশ্বাস। পাঠক! চুপি চুপি কথা আর কিছুই নহে, সে আমাদের জানা কথা—গত কথা, যুদ্ধের বিবরণ এবং এজিদের পলায়ন—এই সংবাদ।

 চলুন, অন্যদিকে যাওয়া যাক্। শুনিতেছেন?—শুনিতে পাইতেছেন?— স্ত্রী-কণ্ঠ। বুঝিতে পারিতেছেন? কি কথা, একটু অগ্রসর হইয়া শুনুন।

 “বাবা জয়নাল! তুই যে বন্দীখানা হইতে পলাইয়াছিস—বুদ্ধির কাজ করিয়াছি বাপ। আর দেখা দিস্ না। কখনও কাহারও নিকট দেখা দিস্ না! তুই যে আমার প্রাণের প্রাণ! তোকে বুকে করিলে বুক শীতল হয়—চক্ষু জুড়ায়! তুই আমাকেও দেখা দিস্ না! (উচ্চৈঃস্বরে) জয়নাল! তুই আমার—তুই আমার কোলে আয়। এ বন্দীখানায় কি অপরাধে অপরাধী হইয়া বন্দী হইয়াছি—দয়াময় ঈশ্বরই জানেন! কত কাল এ ভাবে থাকিতে হইবে, তাহাও তিনিই জানেন!? জয়নাল! তোর মুখখানির প্রতি চাহিয়াই এত দিন বাঁচিয়া আছি! তুই ইমামবংশের একমাত্র সম্বল,—মদিনার রাজরত্ন। তোর ভরসাতেই আজও পর্য্যন্ত দামেস্ক-বন্দীগৃহে তোর চিরদুঃখিনী মা প্রাণ ধরিয়া বাঁচিয়া আছে। পবিত্র ভূমি মদিনা পরিত্যাগ করিয়া যে দিন কুফায় গমন করিতে পথে বাহির হইয়াছি, সেই দিন হইতেই সর্ব্বনাশের সূচনা হইয়াছে। কত পথিক দূর দেশে যাইতেছে, কত রাজা সৈন্যসামন্তসহ বন, জঙ্গল, মরুভূমি অতিক্রম করিয়া গিরিগুহা অনায়াসে পার হইয়া নির্দ্দিষ্ট স্থানে নির্ব্বিঘ্নে যাইতেছে। তাহাদের ভ্রম নাই—পথশ্রান্তি নাই—স্বচ্ছন্দে যাইতেছে— আসিতেছে—কোনরূপ পথ-বিঘ্ন নাই, বিপদ নাই, কোন কথাই নাই! হায় হয়, আমাদের কি দুর্ভাগ্য। দিনে দুই প্রহরে ভ্রম। মহাভ্রম। কোথায় কুফা!—আর কোথায় কারবালা। সেখানে যাহা ঘটিবার ঘটিল। আত্মঘাতী হইলাম না, প্রাণও যহির হইল না। কেন হইল না?—বাপ! তোর মুখের প্রতি চাহিয়াই—বন্দীখানাতেও তোরই মুখখানি দেখিয়াই কিছু করি নাই। তুই দুঃখিনীর ধন!—দুঃখিনীর হৃদয়ের ধন!—অঞ্চলের নিধি। তোর দশা কি ঘটিল? হায়! হায়!! কেন তুই ওমর আলীর প্রাণবধের ঘোষণা শুনিয়া বন্দীগৃহ হইতে বাহির হইলি? আমার মন অস্থির—বিকারগ্রস্ত।—কি বলিতে কি বলি, তাহার স্থিরতা নাই। বন্দীখানায় থাকিলে দুর্দ্দান্ত পিশাচ মারওয়ানের হস্ত হইতে তোকে কখনই রক্ষা করিতে পারিতাম না, আমার ক্রোড় হইতে সে তোকে কাড়িয়া লইয়াই যাইত। হায়! হায়!! তোর মুখের দিকে চাহিয়া আমার কি দশা ঘটিত বাপ! তুই বুদ্ধিৱই কাজ করিয়াছিস! এজিদ জীবিত থাকিতে লোকালয়ে আর আসিস্ না। বনে, জঙ্গলে, গিরিগুহায় লুকাইয়া থাকিস্।—বনের ফল, মূল, পাতা খাইয়া জীবন ধারণ করিস্।—কখনও লোকালয়ে আসিস না। আর না হয়, যে দেশে এজিদের নাম নাই—তোরও নাম নাই—সে দেশে যাইয়া ভিক্ষা করিয়া জীবন কাটাস্। তাহাতেও শাহ্‌রেবানুর প্রাণ শীতল থাকিবে।”

 এ কি! প্রহরিগণ ছুটাছুটি করে কেন? প্রহরিগণ উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়াছে। যে যেখানে ছিল, সে সেই স্থান হইতে ছুটিয়াছে। পরস্পর দেখা হইতেছে, কথা হইতেছে—কিন্তু বড় সাবধানে—চুপে চুপে। কথা কহিতেছে—পরামর্শ করিতেছে—সাবধান হইতেছে—আত্মরক্ষার উপায় দেখিতেছে।—কেন?—কি সংবাদ? দেখুন—আশ্চর্য্য দেখুন! একজন প্রহরী ছুটিয়া আসিয়া বৃদ্ধ মন্ত্রী হামানের কানে কানে চুপি চুপি কি কহিয়া, ঐ দেখুন কি করিল। দ্রুতহস্তে লৌহশৃঙ্খল কাটিয়া ফেলিল এবং হোসেনপরিবার ব্যতীত অন্য অন্য বন্দীগণকে কারাগার হইতে মুক্ত করিয়া সত্বরে বাহির করিয়া দিল। বন্দীগণ অবাক্।—কেহ কোন কথা কহিতেছে না। সকলেই যেন ব্যস্ত। পলাইতে পারিলেই রক্ষা!—জীবন রক্ষা।