বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/অষ্টম প্রবাহ
অষ্টম প্রবাহ
মাবিয়া পীড়িত। এক্ষণে নিজবশে আর উঠিবার শক্তি তাঁহার নাই। তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, এজিদের মুখ দেখিবেন না। দামেস্বরাজ্য যাঁহাদের পৈতৃক রাজ্য, তাঁহাদিগকে দিয়া যাইবেন, মনে মনে স্থির করিয়া হাসানহোসেনকে আনিবার জন্য তিনি কাসেদ পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহারা এ পর্য্যন্ত আসিতেছেন না, সে জন্য তিনি মহাব্যস্ত ও চিন্তিত। সেই কাসেদের অদৃষ্টে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা এ পর্য্যন্ত তিনি কিছুই জানিতে পারেন নাই। তিনি প্রধান উজীর হামানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাসান-হোসেনের এত দিন না আসিবার কারণ কি?”
হামান্ উত্তর করিলেন, “কাসেদ যদি নির্ব্বিঘ্নে মদিনায় যাইয়া থাকে, তবে হাসান-হোসেনের না আসিবার কারণ আমার বুদ্ধিতে আসিতেছে না। আপনার পীড়ার সংবাদ পাইয়া তাঁহারা যে নিশ্চিন্তভাবে রহিয়াছেন, ইহা কখনই বিশ্বস্ত নহে। আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে, কাসেদের কোন অমঙ্গল ঘটিয়া থাকিবে।”
এজিদ সেই রাত্রি হইতে আর মাবিয়ার সম্মুখে যাইতেন না, গুপ্তভাবে অর্থাৎ মাবিয়ার দৃষ্টির অগোচরে কোনস্থানে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া তাঁহার প্রতিও বিশেষ লক্ষ্য রাখিতেন। মাবিয়া হামানের সঙ্গে যে কথা কহিতেছেন, তাহাও তিনি তাঁহার নির্দ্দিষ্ট স্থানে থাকিয়া সমুদয় শুনিতেছেন। মাবিয়া ক্ষণকাল পরে আবার মৃদু-মৃদু স্বরে বলিতে লাগিলেন, এ রাজ্যে মঙ্গলের আর সম্ভাবনা নাই। নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, কাসেদ কোন বিপদে পড়িয়াছে। তাঁহারা মদিনায় না থাকিলে, অবশ্যই কাসেদ ফিরিয়া আসিত। যাহাই হউক, আমার চিরবিশ্বাসী বহুদর্শী মোস্লেমকেই পুনরায় মদিনায় পাঠাও। আর হাসান-হোসেনের নিকট আমার পক্ষ হইতে একখানি প্রার্থনাপত্র লিখিয়া মোস্লেমের সঙ্গে দাও। তাহাতে লিখিয়া দাও আমার বাঁচিবার আশা নাই। পাপময় জগৎ পরিত্যাগের পূর্ব্বে আপনাদের উভয় ভ্রাতাকে একবার স্বচক্ষে দেখিতে ইচ্ছা করি। আরও একটি কথা আমি স্থির-সঙ্কল্পে মনস্থ করিয়াছি। আপনাদের এই পৈতৃক দামেস্ক রাজ্য আপনাদিগকে প্রত্যর্পণ করিব, আমার আর রাখিবার সাধ নাই। এ কথাও লিখিও আপনাদিগকে এই সিংহাসনে বসিতে দেখিলেই আমার জীবন সার্থক হইবে। হামান্! মোস্লেমকে বিশেষ সাবধানে মদিনায় পাঠাইও। নানা প্রকারের সন্দেহ আমার মনে উপস্থিত ও উদয় হইয়াছে; (এজিদ এই মাত্র শুনিয়া হামানের অদৃশ্যে তথা হইতে অতি ত্রস্তে প্রস্থান করিলেন।) এত গোপনে মোস্লেমকে পাঠাইবে যে, তাহার সন্ধান যেন আর একটি প্রাণীও না জানিতে পারে।” হামান বিদায় হইলেন, এবং রাজাদেশ প্রতিপালন করিয়া তখনি মোস্লেমকে মদিনায় পাঠাইলেন।
এমামভক্ত মোস্লেম উর্দ্ধশ্বাসে মদিনাভিমুখে চলিলেন। মোস্লেম পাঠকগণের অপরিচিত নহেন। ক্রমে রাজধানী ছাড়িয়া তিনি একটি প্রশস্ত বালুকাময় প্রান্তরমধ্য দিয়া যাইতেছেন। বালুকাময় ভূমি রৌদ্রের উত্তাপে অগ্নিময় হইয়া মোস্লেমের গমনে বিশেষ বাধা দিতেছে। কি করেন? শীঘ্র যাইতে হইবে, কোন দিকে লক্ষ্য নাই, অবিশ্রান্তভাবে চলিতেছেন। অনেক স্থলেই ভূমি সমতল নহে, স্থানে স্থানে প্রস্তরকণার ন্যায় স্তূপাকার বালুকারাশি প্রস্তরে পরিণত হইবে বলিয়া ভূমি হইতে শিরোত্তোলন করিয়া রহিয়াছে। মোস্লেম দেখিলেন: তাঁহার দক্ষিণ পার্শ্বস্থ স্তূপাকারের আড়াল হইতে চারিজন অস্ত্রধারী পুরুষ বেগে আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। ঐ আক্রমণকারীদিগের মুখ বস্ত্র দ্বারা এরূপে আবৃত যে, তাহাদের স্বরূপ এবং আকৃতি কিছুই দেখা যাইতেছিল না। মোস্লেম জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “তোমরা কে? কেনই বা আমার গমনে বাধা দিতেছ?” তাহাদের মধ্য হইতে এক জন গম্ভীরস্বরে বলিতে লাগিল, “মোস্লেম! তোমার সৌভাগ্য যে, আজ তুমি কাসেদ-পদে বরিত হইয়াছ। তাহা না হইলে জিজ্ঞাসা করার অবসর পাইতে না,—“তোমরা কে?” এ কথা উচ্চারিত হইবার পূর্ব্বেই তোমার শির বালুকায় গড়াগড়ি যাইত, দেহটিও দিব্যি লোহিত রঙে রঞ্জিত হইয়া ধরাশায়ী হইত; পরিশ্রম করিয়া আর হাঁটিয়া কষ্ট করিতে হইত না। যাহা হউক, যদি কিছু দিন জগতের মুখ দেখিতে চাও, তবে আর এক পদও অগ্রসর হইও না।”
“কেন হইব না; আমি রাজ-কাসেদ, হজরত মাবিয়ার পীড়ার সংবাদ লইয়া মদিনা শরীফে এমাম হাসান-হোসেনের নিকট যাইতেছি, কাহার সাধ্য আমার গতিরোধ করে?”—এই বলিয়া মোস্লেম যাইতে অগ্রসর হইলেন। তাহারাও বাধা দিতে লাগিল। মোস্লেম অসি নিষ্কোষিত করিয়া বলিলেন, “কার সাধ্য? কে মোস্লেমের পথরোধ করে। গমনে কে বাধা দেয়?” এই বলিয়া মোস্লেম চলিলেন। এত দ্রুতবেগে মোস্লেমের তরবারি সঞ্চালিত হইতে লাগিল যে, পরিষ্কৃত অসির চাকচিক্যে সকলের চক্ষে ধাঁধা লাগিয়া গেল, এক পদও আর মোস্লেমের দিকে কেহ অগ্রসর হইতে পারিল না। উহার মধ্য হইতে এক জন হঠাৎ মুখের বস্ত্র খুলিয়া বলিতে লাগিল, “মোস্লেম, তোমার চক্ষু কোথায়?” মোস্লেমের চক্ষু যেমন তাহার মুখের প্রতি পড়িল, অমনি তিনি তরবারি হস্ত হইতে নিক্ষেপ করিয়া অভিবাদনপূর্ব্বক করজোড়ে দণ্ডায়মান রহিলেন। এজিদের আদেশে সঙ্গীরা মোস্লেমের অঙ্গ হইতে অস্ত্র-শস্ত্র কাড়িয়া লইল। মাবিয়ার পত্রখানি এজিদ স্বহস্তে খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিলেন, বলিলেন, “যত দিন মাবিয়ার মৃত্যু না হয়, তত দিন তোমাকে বন্দী অবস্থায় নির্জ্জন কারাবাসে থাকিতে হইবে। তুমি ত বড় ঈশ্বরভক্ত, মাবিয়ার মৃত্যু-কামনাই তোমার আজ হইতে প্রার্থনার এক প্রধান অঙ্গ করিয়া দিলাম। যাও, ঐ লৌহশৃঙ্খল পরিয়া অনুচরদিগের সহিত মহানন্দে নাচিতে নাচিতে যেখানে উহারা লইয়া যায়, সেইখানে গমন কর।”
মোস্লেম কিছুই বলিলেন না, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া যেন কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় এজিদের সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অনুচরেরা লৌহশৃঙ্খলে মোস্লেমের হস্তপদ বন্ধন করিল, শেষে গলদেশে শিক বঁধিয়া লইয়া চলিল— হায় রে স্বার্থ!
এজিদ বংশীবাদন করিয়া সঙ্কেত করিবামাত্র একটি বৃহৎ বালুকাস্তুপের পার্শ্ব হইতে এক ব্যক্তি অশ্ব লইয়া উপস্থিত হইল। এজিদ অশ্বারোহণে নগরাভিমুখে চলিয়া আসিলেন। চারি জন প্রহরী মোস্লেমকে বন্দী করিয়া ঘিরিয়া লইয়া চলিল।