বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/নবম প্রবাহ
নবম প্রবাহ
দামেস্ক-রাজপুরীমধ্যে পুরবাসিগণ, দাসদাসীগণ মহা ব্যতিব্যস্ত। সকলেই বিষাদিত। মাবিয়ার জীবন সঙ্কটাপন্ন—বাক্রোধ হইয়াছে, চক্ষুতারা বিবর্ণ হইয়া ঊর্দ্ধে উঠিয়াছে, কথা কহিবার শক্তি নাই: এজিদের জননী নিকটে বসিয়া স্বামীর মুখে সরবত দিতেছেন, দাসদাসীগণ দাঁড়াইয়া কঁদিতেছে, আত্মীয়স্বজনেরা মাবিয়ার দেহ বেষ্টন করিয়া একটু উচ্চস্বরে ঈশ্বরের নাম করিতেছেন। হঠাৎ মাবিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া “লা—এলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মদর রসুলাল্লাহ্” এই শব্দ করিয়া উঠিলেন। সকলে গোলযোগ করিয়া ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে বলিয়া উঠিলেন, “এবার রক্ষা পাইলেন; এবার আল্লাহ্ রেহাই দিলেন।” আবার কিঞ্চিৎ বিলম্বে ঐ কয়েকটি কথা ভক্তির সহিত উচ্চারিত হইল। সেবার আর বিলম্ব হইল না। অমনি আবার ঐ কয়েকটি কথা পূনর্ব্বার উচ্চারণ করিলেন। কেহ আর কিছুই দেখিলেন না। কেবল ওষ্ঠ দুইখানি একটু সঞ্চালিত হইল মাত্র। ঊর্দ্ধ-চক্ষু নীচে নামিল। নামিবার সঙ্গে সঙ্গেই চক্ষের পাতা অতি মৃদু-মৃদুভাবে আসিয়া চক্ষুর তারা ঢাকিয়া ফেলিল। নিশ্বাস বন্ধ হইল; এজিদের জননী মাবিয়ার বক্ষে হস্ত দিয়া স্পর্শ করিয়াই কাঁদিয়া উঠিলেন। সকলেই মাবিয়ার জন্য কাঁদিতে লাগিলেন। এজিদ অশ্ব হইতে নামিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া দেখিলেন: মাবিয়ার চক্ষু নিমীলিত, বক্ষস্থল অস্পন্দ! একবার তাঁহার মস্তকে, একবার বক্ষে হাত দিয়াই এজিদ চলিয়া গেলেন। কিন্তু কেহই এজিদের চক্ষে জল দেখিতে পাইল না। এজিদ পিতার মৃতদেহ যথারীতি স্নান করাইয়া “কাফন”[১] দ্বারা শাস্ত্রানুসারে আপাদমস্তক আবৃত করিয়া মৃতদেহের সদ্গতি উপাসনা (জানাজা) করাইতে তাবুতশায়ী[২] করাইয়া সাধারণের সম্মুখে আনয়ন করিলেন। বিনা আহ্বানে শত শত ধার্ম্মিক পুরুষ আসিয়া জানাজাক্ষেত্রে মাবিয়ার বস্ত্রাবৃত শবদেহের সমীপে ঈশ্বরের আরাধনার নিমিত্ত দণ্ডায়মান হইলেন। সকলেই করুণাময় ভগবানের উদ্দেশে দুই হস্ত তুলিয়া মাবিয়ার আত্মার মুক্তির জন্য প্রার্থনা করিলেন। পরে নির্দ্দিষ্ট স্থানে “দাফন” (মৃত্তিকাপ্রোথিত) করিয়া সকলেই স্ব স্ব গৃহে চলিয়া গেলেন।
মাবিয়ার জীবনের লীলাখেলা একেবারে শেষ হইল। ঘটনা এবং কার্য্য স্বপ্নবৎ কাহারও কাহারও মনে জাগিতে লাগিল। হাসান-হোসেন মদিনা হইতে দামেস্কের নিকট পর্য্যন্ত আসিয়াই মাবিয়ার মৃত্যুসংবাদ শ্রবণে আর নগরে প্রবেশ করিলেন না। মাবিয়ার জন্য অনেক দুঃখ প্রকাশ করিয়া পুনর্ব্বার মদিনায় যাত্রা করিলেন। মাবিয়া জগতের চক্ষু হইতে অদৃশ্য হইয়াছেন; রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া যে স্থানে গিয়াছেন, তথা হইতে আর ফিরিবেন না, এজিদের মুখও আর দেখিবেন না, এজিদকে পাপ-কার্য্য হইতে বিরত এবং হাসান-হোসেনের প্রতি নিষ্ঠুরাচরণ নিবারণ করিতেও আর আসিবেন না, এজিদকে ভর্ৎসনাও আর করিবেন না—এজিদ মনে মনে এই স্থির সিদ্ধান্ত করিয়া দামেস্ক রাজসিংহাসনে উপবেশন করিলেন। রাজমুকুট তাঁহার শিরে শোভা পাইতে লাগিল। সত্যবাদী, নিরপেক্ষ ও ধার্ম্মিক মহাত্মাগণ, যাঁহারা হজরত মাবিয়ার স্বপক্ষে ছিলেন, তাঁহাদের হৃদয় কঁপিয়া উঠিল। আমরাও বিষাদ-সিন্ধুর তটে আসিলাম। এজিদ এক্ষণে স্বাধীন রাজ্যের রাজা। কখন কাহার ভাগ্যে কি হয়, ইহা ভাবিয়া সকলেই ব্যাকুল। রাজ-দরবার লোকে লোকারণ্য। পূর্ব্বদিন ঘোষণা করা হইয়াছে, যেন শহরের সম্ভ্রান্ত লোকমাত্রেই দরবারে উপস্থিত হন। অনেকের মনেই অনেক কথা উঠিল। কি করেন, রাজাজ্ঞা! নিয়মিত সময়ে সকলেই “আম” দরবারে উপস্থিত হইলেন। এজিদও উপযুক্ত বেশভূষায় ভূষিত হইয়া সিংহাসনোপরি উপবেশন করিলেন। প্রধান মন্ত্রী মারওয়ান দরবারস্থ সমুদয় সম্ভ্রান্ত মহোদয়গণকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “আজ আমাদের সুখের দিন, আজ আমরা এই দামেস্কসিংহাসনে নবীন রাজের অধিবেশন দেখিলাম। উপযুক্ত পাত্রেই আজ রাজসিংহাসন সুশোভিত হইয়াছে। সম্ভ্রান্ত মহোদয়গণ! আজ হইতে আপনাদের দুঃখ ঘুচিল। দামেস্ক রাজ্যে আজ হইতে যে সুখ-সূর্য্যের উদয় হইল, তাহা আর অস্তমিত হইবে না। আপনারা এই নবোদিত সূর্য্যকে কায়মনে পুনরায় অভিবাদন করুন!” সভাস্থ সকলেই নতশিরে এজিদকে অভিবাদন করিলেন। মারওয়ান পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “মহোদয়গণ! আমার একটি কথা আছে। আজ মহারাজ এজিদ সবেমাত্র রাজদণ্ড হস্তে করিয়াছেন, এবং আজই একটি গুরুতর বিচারভার ইঁহাকে বহন করিতে হইতেছে। আপনাদের সম্মুখেই রাজদ্রোহীর বিচার করিবেন বলিয়া তিনি আপনাদিগকে আহ্বান করিয়াছেন।”
মারওয়ানের পূর্ব্ব আদেশানুসারে প্রহরীরা মোস্লেমকে বন্ধন অবস্থায় রাজসভায় আনিয়া উপস্থিত করিল। সভাস্থ সকলে মোস্লেমের দুরবস্থা দেখিয়া একেবারে বিস্ময়াপন্ন হইলেন। মাবিয়ার এত বিশ্বাসী প্রিয়পাত্র এত সম্মানাস্পদ, এত স্নেহাস্পদ, সেই মোস্লেমের এই দুরবস্থা! কি আশ্চর্য্য! আজিও মাবিয়ার দেহ ভূগর্ভে বিলীন হয় নাই, অনেকেই আজ পর্য্যন্ত শোকবস্ত্র পরিত্যাগ করেন নাই, মাবিয়ার নাম এখনও সকলের জিহ্বাগ্রেই রহিয়াছে, আজ সেই মাবিয়ার প্রিয় বন্ধুর এই দুর্দ্দশা! কি সর্ব্বনাশ! এজিদের অসাধ্য কি আছে? অনেকেই মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন—আর মঙ্গল নাই। দামেস্ক রাজ্যের আর মঙ্গল নাই। কি পাষাণহৃদয়? উঃ!! এজিদ কি পাষাণহৃদয়!! কিন্তু কাহারও মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিবার সাহস হইল না; সকলেই কেবল মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপ করিতে লাগিলেন। মোস্লেম চিন্তায় ও মনস্তাপে ক্ষীণকায় হইয়াছেন। এজিদ বলিয়াছেন—মাবিয়ার মৃত্যুতেই তাঁহার মুক্তি, কিন্তু মাবিয়া আছেন কি না, মোস্লেম তাহাও স্থির করিতে পারিলেন না। কে কোন কথা তাঁহাকে বলিতে পারিবে না এবং তাঁহার কথাও কেহ জানিতে পারিবে না,—পূর্ব্ব হইতেই এজিদের এই আজ্ঞা ছিল। সুতরাং মোস্লেমকে কোন কথা বলে, কাহার সাধ্য?
নগরের প্রায় সমুদয় ভদ্রলোককে একত্র দেখিয়া মোস্লেম কিছু আশ্বস্ত হইলেন। তিনি মনে মনে জানেন: কোন অপরাধে তিনি অপরাধী নহেন। রাজাজ্ঞা প্রতিপালন করিয়াছেন, ইহাতে যদি এজিদ অন্যায়াচরণ করেন, তবে একমাত্র ঈশ্বর ভিন্ন আর কাহাকেও তিনি কিছু বলিবেন না, মুক্তিলাভের প্রার্থনাও করিবেন না। তিনি মাবিয়ার আজ্ঞাক্রমেই হাসান-হোসেনের নিকট মদিনায় যাইতেছিলেন; ইহাই যদি অপরাধের কার্য্য হয়, আর সেই অপরাধেই যদি প্রাণ যায়, তাহাও স্বীকার, তথাপি তিনি চিত্ত বিচলিত করিবেন না। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করিয়া মোস্লেম দাঁড়াইয়া রহিলেন। সভ্যগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক মারওয়ান কহিলেন, “এই ব্যক্তি রাজদ্রোহী, আজ ইহারই বিচার হইবে। আমাদের নব দণ্ডধর আপনাদের সম্মুখে ইহার বিচার নিষ্পত্তি করিবেন, ইহাই তঁহার অভিপ্রায়।”
এজিদ বলিলেন, “এই কাসেম বিশ্বাসী নহে। যাহারা ইহাকে বিশ্বাসী বলিয়া স্থির করিয়াছে, এবং ইহার অনুকূলে যাহারা কিছু বলিবে, তাহারাও বিশ্বাসী নহে। আমার বিবেচনায় ইহার স্বপক্ষের লোকমাত্রেই অবিশ্বাসী, রাজদ্রোহী।”
সকলের শরীর রোমাঞ্চিত হইল, ভয়ে হৃদয় কাঁপিতে লাগিল, আকণ্ঠ শুকাইয়া গেল। যাঁহারা মোস্লেমের সম্বন্ধে কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মুখ একেবারে বন্ধ হইয়া গেল।
এজিদ পুনর্ব্বার বলিতে লাগিলেন: “এই মিথ্যাবাদী বিশ্বাসঘাতক আমার বিবাহ-পয়গাম লইয়া জয়নাবের নিকট গিয়াছিল। আমার পয়গাম গোপন করিয়া আমার চিরশত্রু হাসান,—যাহার নাম শুনিলে আমার দিগবিদিক জ্ঞান থাকে না, সেই হাসানের পয়গাম জয়নাবের নিকট বলিয়া জয়নাবের সহিত তাহার বিবাহ দিয়াছে। আমি নিশ্চয় জানি, আমার পয়গাম জয়নাবের কর্ণগোচর হয় নাই। আমার নাম শুনিলে জয়নাব কখনই হাসানকে ‘কবুল’ করিত না। হাসানের অবস্থা সম্বন্ধে জয়নাবের অবিদিত কিছুই নাই। কেবল মিথ্যাবাদীর চক্রান্তে জয়নাব-রত্ন শত্রুহস্তে পতিত হইয়াছে। আরও কথা আছে—এই মিথ্যাবাদী যাহা বলে, তাহাই যদি সত্য বিবেচনা করিয়া লওয়া যায়, তাহা হইলে ইহার অপরাধ আরও গুরুতর হইয়া দাঁড়ায়। সে আমার চিরশত্রুর আজ্ঞা প্রতিপালন করিয়া আমারই সর্ব্বনাশ করিয়াছে। হাসানের পয়গাম জয়নাবের নিকট লইয়া যাইতে আমি ইহাকে নিয়োজিত করি নাই। ইহার অপরাধের শাস্তি হওয়া আবশ্যক। সে না জানিয়া এই কার্য্য করিয়াছে তাহাও বলিতে পারি না। জয়নাব-লাভের জন্য আমি যাহা করিয়াছি, তাহা কে না জানে? মোস্লেম কি জানে না যে, জয়নাবের জন্য আমি সর্ব্বস্ব পণ করিয়া শেষে জীবন পর্য্যন্ত বিসর্জ্জন দিতে প্রস্তুত ছিলাম? সেই জয়নাবের বিবাহে সে আমার পক্ষে উকীল নিযুক্ত হইয়া অপরের সঙ্গে বিবাহ স্থির করিয়া আসিল, ইহা অপেক্ষা বিশ্বাসঘাতকতা আর কি আছে? আরও একটি কথা—এই সকল কুকার্য্য করিয়াও এই ব্যক্তি ক্ষান্ত হয় নাই; আমারই সর্ব্বনাশের জন্য, আমাকেই রাজ্য হইতে বঞ্চিত করিবার নিমিত্ত, আমাকেই পথের ভিখারী করিবার আশায় মাবিয়ার পত্র লইয়া হাসানের নিকট মদিনায় যাইতেছিল। অতএব আমার এই আজ্ঞা যে, অবিলম্বেই মোস্লেমের শিরচ্ছেদন করা হউক।” সরোষে কাঁপিতে কাঁপিতে এজিদ পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “সে দণ্ড বধ্যভূমিতে হইবে না, অন্য কোনও স্থানে হইবে না; এই সভাগৃহে— আমার সম্মুখেই আমার দণ্ডাজ্ঞা প্রতিপালিত হউক।”
মারওয়ান বলিলেন, “রাজাজ্ঞা শিরোধার্য। কিন্তু প্রকাশ্য দরবারে দণ্ডবিধান রাজনীতির বিরুদ্ধ।”
এজিদ বলিলেন, “আমার আজ্ঞা অলঙ্ঘনীয়। যে ইহার বিরোধী হইবে তাহারও ঐ শাস্তি। মারওয়ান সাবধান।”
সকলের চক্ষু যেন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল। এজিদের মুখের কথা মুখে থাকিতে থাকিতেই হতভাগ্য মোস্লেমের ছিন্নশির ভূতলে লুণ্ঠিত হইতে লাগিল। জিঞ্জিরাবদ্ধ দেহ শোণিতাক্ত হইয়া সভাস্থলে পড়িয়া সভ্যগণের মোহ ভঙ্গ করিল। তাঁহারা চাহিয়া দেখিলেন: মোস্লেম আর নাই। রক্তমাখা দেহ মস্তক হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ধরাতলে গড়াগড়ি যাইতেছে। মোস্লেমের পবিত্র শোণিতবিন্দুর পরমাণু অংশে দামেস্ক-রাজভবনের পবিত্রতা, সিংহাসনের পবিত্রতা, দরবারের পবিত্রতা, ধর্ম্মাসনের পবিত্রতা, মাবিয়া যাহা বহুকষ্টে সঞ্চয় করিয়াছিলেন সেই সমস্ত পবিত্রতাআজ মোস্লেমের ঐ শোণিতবিন্দুর প্রতি পরমাণুতে মিশিয়া বিকট অপবিত্রতার আসন পাতিয়া দিল। মোস্লেমের দেহবিনির্গত রক্তধারে “এজিদ! ইহার শেষ আছে!”—এই কথা কয়টি প্রথমে অঙ্কিত হইয়া রক্তস্রোত সভাস্থলে বহিয়া চলিল। এজিদ সগর্ব্বে বলিতে লাগিলেন, “অমাত্যগণ! প্রধান প্রধান সৈনিক ও সৈন্যাধ্যক্ষগণ! এবং সভাস্থ মহোদয়গণ! আপনারা সকলেই মনোযোগপূর্ব্বক শ্রবণ করুন। আমার আজ্ঞা যে কেহ অমান্য করিবে, যে কেহ অণুমাত্র অবহেলা করিবে, সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই মোস্লেমের ন্যায় শাস্তি ভোগ করিবে। আমার অভাব নাই। হাসান-হোসেনের যাহা আছে, তাহাও কাহার অজ্ঞাত নাই। সেই হাসানের এত বড় সাহস! এত বড় স্পর্ধা! ভিখারিণীর পুত্র হইয়া রাজরাণীর পাণিগ্রহণ! যে জয়নাব রাজরাণী হইত, সে-ই ভিখারিণী-পুত্র তাহারই পাণিগ্রহণ করিয়াছে। আমি উহার বিবাহের সাধ মিটাইয়া দিব। জয়নাবকে লইয়া সুখভোগ করিবার সমুচিত প্রতিফল দিব। কে রক্ষা করিবে? কাহার আশ্রয় গ্রহণ করিবে? এজিদ জগতে থাকিতে জয়নাবকে লইয়া সে কখনই সুখী হইতে পারিবে না। এখনও আমার অন্তরে আশা আছে, যদিও সে আশায় একপ্রকার নিরাশ হইয়াছি। হাসান বাঁচিয়া থাকিতে জয়নাব-লাভ হইবার আর সম্ভাবনা নাই। তথাপি মহা-আসক্তি আগুনে এজিদের অন্তর সর্ব্বদা জ্বলিতেছে। যদি আমি মাবিয়ার পুত্র হই, তবে হাসান-হোসেনের বংশ একেবারে নিপাত না করিয়া জগৎ পরিত্যাগ করিব না। শুধু হাসানের মৃতদেহ দেখিয়াই যে, সে মহাগ্নি নির্ব্বাপিত হইবে তাহা নহে, হাসান বংশের সকলের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করিয়াই যে এজিদ ক্ষান্ত হইবে তাহাও নহে; মোহাম্মদের বংশের একটি প্রাণীও বাঁচিয়া থাকিতে এজিদ ক্ষান্ত হইবে না; তাহার মনোবেদনাও মন হইতে বিদূরিত হইবে না। আমার অভাব কি? কাহারও সাহায্য চাহি না; হিতোপদেশ অথবা পরামর্শের প্রত্যাশা রাখি না। যাহা করিব, তাহা মনেই থাকিল। তবে এইমাত্র বলি যে, হাসান-হোসেনের এবং তাঁহাদের বংশানুবংশ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের প্রতি এজিদ যে দৌরাত্ম্য-অগ্নি জ্বালাইয়া দিবে, যদি তাহা কখন নিবিয়া যায়, যাইতে পারে, কিন্তু সে তাপ ‘রোজ-কেয়ামত’ (জগতের শেষ দিন) পর্য্যন্ত মোহম্মদীয়গণের মনে একই ভাবে জাগরিত থাকিবে। আবার যাহারা হাসান-হোসেনের বেশী ভক্ত, তাহার আজন্মকাল ছাতি পিটিয়া[৩] ‘হায় হাসান! হায় হোসেন?’ বলিয়া কাঁদিতে থাকিবে।”
সভ্যগণকে এই সকল কথা বলিয়া এজিদ পুনরায় মারওয়ানকে বলিলেন, “হাসান-হোসেনের নিকট যে পত্র পাঠাইবে, সেই পত্রখানা পাঠ করিয়া ইঁহাদিগকে একবার শুনাইয়া দাও, ইঁহাদিগের মধ্যে মোহাম্মদভক্ত অনেক আছেন।”
মারওয়ান পত্র পাঠ করিতে লাগিলেন,—
“হাসান! হোসেন!
তোমরা কি এপর্য্যন্ত শুন নাই যে, মহারাজাধিরাজ এজিদ নামদার মধ্যাহ্নকালীন সূর্য্যসম দামেস্ক সিংহাসনে বিরাজ করিতেছেন? অধীনস্থ রাজা-প্রজামাত্রেই তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিয়া কেহ বা উপঢৌকন প্রেরণ, কেহ বা স্বয়ং আসিয়া অবনত শিরে চির-অধীনতা স্বীকার করিয়াছেন, এবং আপন আপন রাজ্যের নির্দ্ধারিত দেয় করে দামেস্ক-রাজভাণ্ডার পূর্ণ করিয়াছেন। তোমাদের মক্কা-মদিনার খাজানা আজ পর্য্যন্ত না আসিবার কারণ কি? স্বয়ং মহারাজাধিরাজ দামেস্কাধিপতির আম-দরবারে উপস্থিত হইয়া নতশিরে ন্যূনতা স্বীকারে সিংহাসন চুম্বন কর। আর এই পত্র প্রাপ্তিমাত্রই এজিদ নামদারেরর নামে খোৎবা[৪] পাঠ করিবে। ইহার অন্যথাচরণ করিলেই রাজদ্রোহীর শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
পত্র পাঠ শেষ হইল। তখনি উপযুক্ত কাসেদের হস্তে পত্র দিয়া রাজা সভাভঙ্গের আজ্ঞা দিলেন। অনেকেই বিষাদপূর্ণনেত্রে অশ্রুপাত করিতে করিতে সভাগৃহ হইতে বহির্গত হইলেন।
- ↑ কাফন—শবাচ্ছাদন-বসন
- ↑ তাবুত—শেষ শয়নাসন
- ↑ মহরমের সময়ে শিয়াগণকে অনেকেই বক্ষে করাঘাত করিতে দেখিয়াছেন, তাহাকেই ‘ছাতিপেটা’ কহে।
- ↑ ঈদলফেতর, ইদুজ্জোহা,—এই দুই ঈদ এবং জুমার নামাজ (উপাসনা) যাহা প্রতি শুক্রবারে দুই প্রহরের পর হইয়া থাকে, ঐ তিন উপাসনার পর আরবী ভাষায় ঈশ্বরের গুণানুবাদের পর উপাসনা বর্ণনা, পরে স্বজাতীয় রাজার নাম উচ্চারণ করিয়া তাঁহার দীর্ঘায়ু ও রাজ্যের স্থায়িত্ব কামনা করা হয়। ভারতীয় মুসলমানগণ পুর্ব্বে দিল্লীর মোগল সম্রাটগণের নামে খোৎবা পাঠ করিতেন।