বিষাদ-সিন্ধু/মহরম পর্ব্ব/প্রথম প্রবাহ

মহরম পর্ব্ব

প্রথম প্রবাহ

 “তুমি আমার একমাত্র পুত্র। এই অতুল বিভব, সুবিস্তৃত রাজ্য এবং অসংখ্য সৈন্যসামন্ত সকলই তােমার। দামেস্করাজমুকুট অচিরে তােমারই শিরে শােভা পাইবে। তুমি এই রাজ্যের কোটি কোটি প্রজার অধীশ্বর হইয়া তাহাদিগকে রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিপালন এবং জাতীয় ধর্ম্মের উৎকর্ষ সাধন করিয়া সর্ব্বত্র পূজিত এবং সকলের আদৃত হইবে। বলত, তােমার কিসের অভাব? কি মনস্তাপ? আমি ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। তুমি সর্ব্বদাই মলিনভাবে বিষাদিত চিত্তে বিকৃতমনার ন্যায় অযথা চিন্তায় অযথা স্থানে ভ্রমণ করিয়া দিন দিন ক্ষীণ ও মলিন হইতেছ। সময়ে সময়ে যেন একেবারে বিষাদ-সিন্ধুতে নিমগ্ন হইয়া জগতের সমুদয় আশায় জলাঞ্জলি দিয়া আত্মবিনাশে প্রস্তুত হইতেছ—ইহারই বা কারণ কি? আমি পিতা, আমার নিকট কিছুই গােপন করিও না। মনের কথা অপকটে প্রকাশ কর। যদি অর্থের আবশ্যক হইয়া থাকে, ধনভাণ্ডার কাহার জন্য? যদি রাজসিংহাসনে উপবেশন করিয়া রাজ্যভার স্বহস্তে গ্রহণ করিবার বাসনা হইয়া থাকে—বল, আমি এই মুহূর্ত্তে তােমাকে মহামূল্য রাজবেশে সুসজ্জিত করাইয়া রাজমুকুট তােমার শিরে অর্পণ করাইতেছি—এখনই তােমাকে সিংহাসনে উপবেশন করাইতেছি। আমি স্বচক্ষে তােমাকে রাজকার্য্যে নিয়ােজিত দেখিয়া নশ্বর বিশ্ব-সংসার পরিত্যাগ করিতে পারিলে তাহা অপেক্ষা ঐহিকের সুখ আর কি আছে? তুমি আমার একমাত্র পুত্ররত্ন। অধিক আর কি বলিব—তুমি আমার অন্ধের যষ্টি, নয়নের পুত্তলী, মশুকের অমূল্য মণি, হৃদয়ভাণ্ডারের মহামূল্য রত্ন, জীবনের জীবনীশক্তি, আশা-তরু অসময়ে মঞ্জুরিত, আশা-মুকুল অসময়ে মুকুলিত, আশা-কুসুম অসময়ে প্রস্ফুটিত। বাছা, সদা-সর্ব্বদাই তােমার মলিন মুখ ও বিমর্ষ ভাব দেখিয়া আমি একেবারে হতাশ হইয়াছি, জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াছি। ঈশ্বর তােমার মঙ্গল করুন, মনের কথা অকপটে আমার নিকট প্রকাশ কর। আমি পিতা হইয়া মনের বেদনায় আজ তোমার হস্তধারণ করিয়া বলিতেছি, সকল কথা মন খুলিয়া আমার নিকট কি জন্য প্রকাশ কর না?” মাবিয়া নির্জ্জনে আগ্রহসহকারে এজিদকে এই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।

 এজিদ্ দীর্ঘ নিঃশ্বাস পরিত্যাগ-পূর্ব্বক বলিতে অগ্রসর হইয়াও কোন কথা বলিতে পারিলেন না; কণ্ঠরােধ হইয়া জিহ্বায় জড়তা আসিল। মায়ায় আসক্তির এমনি শক্তি যে, পিতার নিকট মনােভাব প্রকাশ করিবার অবসর প্রাপ্ত হইয়াও মনােভাব প্রকাশ করিতে পারিলেন না। সাধ্যাতীত চেষ্টা করিয়াও মুক্ত হৃদয়ে প্রকৃত মনের কথা পিতাকে বুঝাইতে পারিলেন না। যদিও বহুকষ্টে “জয়” শব্দটি উচ্চারণ করিলেন, কিন্তু সে শব্দ মাবিয়ার কর্ণগােচর হইল না। কথা যেন নয়নজলেই ভাসিয়া গেল, শব্দটি কেবল জলমাত্রই সার হইল। গণ্ডস্থল হইতে বক্ষঃস্থল পর্য্যন্ত বিষাদ-বারিতে সিক্ত হইতে লাগিল। সেই বিষাদ-বারি-প্রবাহ দর্শন করিয়া অনুতপ্ত মাবিয়া আরও অধিকতর দুঃখানলে দগ্ধীভূত হইতে লাগিলেন। জলে অগ্নি নির্ব্বাপিত হয়, কিন্তু প্রেমাগ্নি অন্তরে প্রজ্জ্বলিত হইয়া প্রথমে নয়ন দুইটির আশ্রয়ে বাষ্প সৃষ্টি করে, পরিণামে জলে পরিণত হইয়া স্রোতে বহিতে থাকে। সে জলে হয়ত বাহ্যবহ্নি সহজে নির্ব্বাপিত হইতে পারে; কিন্তু মনের আগুন দ্বিগুণ, চতুর্গুণ, শতগুণ জ্বলিয়া উঠে। এজিদ্ রাজ্যের প্রয়াসী নহেন, সৈন্যসামন্ত এবং রাজমুকুটের প্রত্যাশী নহেন, রাজসিংহাসনের আকাঙ্ক্ষীও নহেন। তিনি যে রত্নের প্রয়াসী, তিনি যে মহামূল্য ধনের প্রত্যাশী, তাহা তাঁহার পিতার মনের অগােচর, বুদ্ধির অগােচর। পুত্রের ঈদৃশী অবস্থা দেখিয়া মাবিয়া যারপর নাই দুঃখিত ও চিন্তিত হইলেন। শেষে অশ্রুসম্বরণে অক্ষম হইয়া বাষ্পাকুল লােচনে পুনর্ব্বার বলিতে লাগিলেন, “এজিদ্! তােমার মনের কথা খুলিয়া আমার নিকট ব্যক্ত কর। অর্থে হউক বা সামর্থ্যে হউক, বুদ্ধিকৌশলে হউক, যে কোন প্রকারেই হউক, তােমার মনের আশা আমি পূর্ণ করিবই করিব। তুমি আমার যত্নের রত্ন, অদ্বিতীয় স্নেহধার। তুমি পাগলের ন্যায় হতবুদ্ধি, অবিবেকের ন্যায় সংসারবর্জ্জিত হইয়া পিতামাতাকে অসীম দুংখসাগরে ভাসাইবে, বনে বনে পর্ব্বতে পর্ব্বতে, বেড়াইয়া বেড়াইয়া অমূল্য জীবনকে তুচ্ছজ্ঞানে হয়ত কোন দিন আত্মঘাতী হইয়া এই কিশাের বয়সে মৃত্তিকাশায়ী হইবে, ইহা ভাবিয়া আমার প্রাণ নিত্যই আকুল হইতেছে; কিছুতেই স্থির হইতে পারিতেছি না। জীবন যেন দেহ ছাড়িয়া যাই যাই করিতেছে, প্রাণপাখী যেন দেহ-পিঞ্জর ছাড়িয়া উড়ি উড়ি করিতেছে। বল দেখি, বৎস! কোন্ প্রাণে মাবিয়া তােমার মৃতদেহে শেষ বসন (কাফন) পরাইয়া মৃত্তিকায় প্রােথিত করিবে?”

 এজিদ্ করজোড়ে বলিতে লাগিলেন, “পিতঃ! আমার দুঃখ অনন্ত। দুঃখের সীমা নাই, উপশমের উপায় নাই। আমি নিরুপায় হইয়াই জগতের আশা হইতে একেবারে বহুদূরে দাঁড়াইয়া আছি। আমার বিষয়-বিভব, ধনজন, ক্ষমতা, সমস্তই অতুল তাহা আমি জানি। আমি অবােধ নই; কিন্তু আমার অন্তর যে মােহিনী মূর্ত্তির সুতীক্ষ্ম নয়ন-বাণে বিদ্ধ হইতেছে, সে বেদনার উপশম নাই। পিতঃ! সে বেদনার প্রতিকারের উপায় নাই। যদি থাকিত, তবে বলিতাম। আর বলিতে পারি না। এতদিন অতি গােপনে মনে মনে রাখিয়াছিলাম, আজ আপনার আজ্ঞা শিরােধার্য্য করিয়া মনের কথা যতদূর সাধ্য বলিলাম। আর বলিবার সাধ্য নাই। হয় দেখিবেন, না হয় শুনিবেন,—এজিদ্ বিষপান করিয়া যেখানে শােকতাপের নাম নাই, প্রণয়ে হতাশা নাই, অভাব নাই এবং আশা নাই, এমন কোন নির্জ্জন স্থানে এই পাপময় দেহ রাখিয়া সেই পবিত্রধামে চলিয়া গিয়াছে। আর অধিক বলিতে পারিতেছি না, ক্ষমা করিবেন।” এই কথা শেষ হইতে না হইতেই বৃদ্ধা মহিষী একগাছি সুবর্ণ যষ্ঠি-আশ্রয়ে ঐ নির্জ্জন গৃহমধ্যে আসিয়া একপার্শ্বে দণ্ডায়মান হইলেন। এজিদ্ শশব্যস্তে উঠিয়া জননীর পদচুম্বন করিয়া পিতার পদধুলি গ্রহণান্তর সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।

 দামেস্কাধিপতি মহিষীকে অভ্যর্থনা করিয়া অতি যত্নে মসনদের[১] পার্শ্বে বসাইয়া বলিতে লাগিলেন, “মহিষি! তোমার কথাক্রমে আজ বহু যত্ন করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারিলাম না; মনের কথা কিছুতেই ভাঙ্গিল না। পরিশেষে আপনিও কঁদিল, আমাকেও কাঁদাইল! সে রাজ্যধনের ভিখারী নহে, অবিনশ্বর ঐশ্বর্য্যের ভিখারী নহে; কেবল এই মাত্র বলিল যে, আমার আশা পূর্ণ হইবার নহে। আর শেষে যাহা বলিল তাহা মুখে আনা যায় না; বোধ হইতেছে, যেন কোন মায়াবিনী মোহিনীর মোহনীয় রূপে মুগ্ধ হইয়া এইরূপ মোহময় অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে।”

 রাজমহিষী অতি কষ্টে মস্তক উত্তলোন করিয়া কম্পিতকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “মহারাজ! আমি অনেক সন্ধানে জানিয়াছি, আর এজিদ্‌ও আমার নিকটে আভাসে বলিয়াছে;—আবদুল জব্বারকে বোধ হয় জানেন?”

 মাবিয়া কহিলেন, “তাহাকে ত অনেক দিন হইতে জানি।”

 “সেই আবদুল জব্বারের স্ত্রীর নাম জয়নাব।”

 হাঁ হাঁ ঠিক হইয়াছে! আমার সঙ্গে কথা কহিবার সময় ‘জয়’ পর্য্যন্ত বলিয়া আর বলিতে পারে নাই।” একটু অগ্রসর হইয়া মাবিয়া আবার কহিলেন, হাঁ! সেই জয়নাব কি?”

 আমার মাথা আর মুণ্ডু! সেই জয়নাবকে দেখিয়াই ত এজিদ্ পাগল হইয়াছে। আমার নিকট কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল, মা! যদি আমি জয়নাবকে না পাই, তবে আর আমাকে দেখিতে পাইবেন না, নিশ্চয়ই জানাজাক্ষেত্রে[২] কাফনবস্ত্রের তাবুতাসনে ধরাশায়ী দেখিবেন।” এই পর্য্যন্ত বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে মহিষী পুনরায় কহিলেন, “আমার এজিদ্ যদি না বাঁচিল, তবে আর এই জীবনে ও বৃথা ধনে ফল কি?”

 যেন একটু সয়োষে মাবিয়া কহিলেন, “মহিষি! তুমি আমাকে কি করিতে বল?”

 “আমি কি করিতে বলিব? যাহাতে এজিদের প্রাণরক্ষা হয় তাহারই উপায় করুন। আপনি বর্ত্তমান থাকিতে আমার সাধ্যই বা কি কথাই বা কি?”

 মাবিয়া রােষভরে উঠিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন, বৃদ্ধা মহিষী হস্ত ধরিবামাত্র অমনি বসিয়া পড়িলেন ও বলিতে লাগিলেন, “পাপী আর নারকীরা ওকার্য্যে যোগ দিবে। আমি ওকথা আর শুনিতে চাই না। তুমি আর ওকথা বলিয়া আমার কর্ণকে কলুষিত করিও না। আপনার জিহ্বাকে ওপাপ কথায় আর অপবিত্র করিও না। ভাবিয়া দেখ দেখি, ধর্ম্ম-পুস্তকের উপদেশ কি? পরস্ত্রীর প্রতি কুভাবে যে একবার দৃষ্টি করিবে, কোন প্রকার কুভাবের কথা মনােমধ্যে যে একবার উদিত করিবে, তাহারও প্রধান নরক ‘জাহান্নামে’ বাস হইবে। আর ইহকালের বিচার ত দেখিতে পাইতেছি। লৌহদণ্ড দ্বারা শত আঘাতে পরস্ত্রীহারীর অস্থি চূর্ণ, চর্ম্ম ক্ষয় করিয়া জীবনান্ত করে। ইহা কি একবারও এজিদের মনে হয় না? প্রজার ধন, প্রাণ, মান, জাতি, এসমুদয়ের রক্ষাকর্ত্তা রাজা। রাজার কর্ত্তব্য কর্ম্মই তাহা। এই কর্ত্তব্য অবহেলা করিলে রাজাকে ঈশ্বরের নিকট দায়ী হইতে হয়, পরিণামে নরকের তেজোময় অগ্নিতে দগ্ধীভূত হইয়া ভস্মসাৎ হইতে হয়। তাহাতেও নিস্তার নাই। সে ভস্ম হইতে পুনরায় শরীর গঠিত হইয়া পুনরায় শাস্তিভােগ করিতে হয়। এমন গুরু পাপের অনুষ্ঠান করা দূরে থাকুক, শুনিতেও পাপ। এজিদ্ আত্মবিনাশ করিতে চায় করুক, তাহাতে দুঃখিত নহি। এমন শত এজিদ—শত কেন সহস্র এজিদ এই কারণে প্রাণত্যাগ করিলেও মাবিয়ার চক্ষে এক বিন্দু জল পড়া ত দূরে থাকুক, বরং সন্তুষ্ট হৃদয়ে সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিবে। একটি পাপী জগৎ হইতে বহিস্কৃত হইল বলিয়া ঈশ্বরের সমীপে এই মাবিয়া সেই জগৎ-পিতার নামে সহস্র সহস্র সাধুবাদ সমর্পণ করিবে। পুত্রের উপরােধে, কি তাহার প্রাণরক্ষার কারণে ঈশ্বরের বাক্য লঙ্ঘন করিয়া মাবিয়া কি মহাপাপী হইবে, তুমি কি ইহাই মনে কর, মহিষি? আমার প্রাণ থাকিতে তাহা হইবে না, মাবিয়া জগতে থাকিতে তাহা ঘটিবে না, কখনই না।”

 বৃদ্ধা মহিষী একটু অগ্রসর হইয়া মহারাজের হস্ত দৃঢ়রূপে ধারণ করিয়া কাতরভাবে বলিতে লাগিলেন, “দেখুন মহারাজ! এজিদ যে ফাঁদে পড়িয়াছে, সে ফাঁদে জগতের অনেক ভাল লোক বাঁধা পড়িয়াছেন। শত শত মুনি-ঋষি, ঈশ্বরভক্ত কত শত মহাতেজস্বী, জিতেন্দ্রিয়, মহাশক্তিবিশিষ্ট মহাপুরুষ এই ফাঁদে পড়িয়া তত্ত্বজ্ঞান হারাইয়াছেন, তাহার সংখ্যা নাই। আসক্তি, প্রেম ও ভালবাসার কথা ধর্ম্মপুস্তকেও রহিয়াছে। ভাবিয়া দেখিলে প্রতীত হয়, মানুষের মনেই ভালবাসার জন্ম; ইহাকে শিক্ষা দিতে হয় না, দেখাদেখিও কেহ শিক্ষা করে না, ভালবাসা স্বভাবতঃই জন্মে। বাদশা নামদার! ইহাতে নূতন কিছুই নাই। আপনি যদি মনোযোগ দিয়া শুনেন, তবে আমি এই প্রণয়প্রসঙ্গ অনেক শুনাইতে পারি, দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইতেও পারি। জগতে শত শত ভালবাসার জন্ম হইয়াছে, অনেকেই ভালবাসিয়াছে, তাহাদের কীর্ত্তিকলাপ আজ পর্য্যন্ত কেন, জগৎ বিলয় না হওয়া পর্য্যন্ত মানবহৃদয়ে সমভাবে অঙ্কিত থাকিবে। বলিবেন, পাত্রাপাত্র বিবেচনা চাই। ভালবাসারূপ সমুদ্র যখন হৃদয়াকাশে মানসচন্দ্রের আকর্ষণে স্ফীত হইয়া উঠে, তখন আর পাত্রাপাত্র জ্ঞান থাকে না। পিতা, মাতা, সংসার, ধর্ম্ম, এমন কি ঈশ্বরকেও মনে থাকে কিনা সন্দেহ। ইহাতে এজিদের দোষ কি বলুন দেখি? এই নৈসর্গিক কার্য্য নিবারণ করিতে এজিদের কি ক্ষমতা আছে? না, আমার ক্ষমতা আছে? না, আপনারই ক্ষমতা আছে? যাহাই বলুন মহারাজ। ভালবাসার ক্ষমতা অসীম।

 মাবিয়া বলিলেন, “আমি কি ভালবাসার দোষ দিতেছি? ভালবাসা ত ভাল কথা। মানব-শরীর ধারণ করিয়া যাহার হৃদয়ে ভালবাসা নাই, সে কি মানুষ? প্রেমশূন্য হৃদয় কি হৃদয়? এজিদের ভালবাসা ত সেরূপ ভালবাসা নয়। তুমি কিছুই বুঝিতে পার নাই।” মহিষী কহিলেন, “আমি বুঝিয়াছি, আপনি বুঝিতে পারেন নাই। দেখুন মহারাজ, আমার এই অবস্থাতেই ঈশ্বর সদয় হইয়া পুত্র দিয়াছেন। এ জগতে সংসারী মাত্রেই পুত্র কামনা করিয়া থাকে। বিষয়-বিভব ধন-সম্পত্তি অনেকেরই আছে; কিন্তু উপযুক্ত পুত্ররত্ন কাহার ভাগ্যে কয়টি ফলে বলুন দেখি? পুত্রকামনায় লোকে কি না করে? ঈশ্বরের উপাসনা, ঈশ্বরভক্ত এবং ঈশ্বরপ্রেমিক লোকের অনুগ্রহের প্রত্যাশা, যথাসাধ্য দীনদুঃখীর ভরণপোষণে সাহায্য প্রভৃতি যত প্রকার সৎকার্য্যে মনের আনন্দ জন্মে, সন্তান কামনায় লোকে তাহা সকলই করিয়া থাকে। আপনি ঈশ্বরের নিকট কামনা করিয়া পুত্রধন লাভ করেন নাই। আমিও পুত্রলাভের জন্য এই বৃদ্ধ বয়সে বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া এই শোণিতবিন্দু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করি নাই। দয়াময় ভগবানের প্রসাদে অযাচিত এবং বিনাযত্নে আমরা উভয়ে এই পুত্ররত্ন লাভ করিয়াছি। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া ক্রোধ প্রকাশ করিতে হয়। যে এজিদের মুখ এক মুহূর্ত্ত না দেখিলে একেবারে জ্ঞানশূন্য হন, যে এজিদকে সর্ব্বদা নিকটে রাখিয়াও আপনার দেখিবার সাধ মিটে না, অন্তর দিয়া আপনি কি তাহার অমঙ্গল কামনা করিতে পারেন? আমি ত সকলই জানি; কোন সময়ে এই এজিদকে প্রাণে মারিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাহা পারিলেন কৈ? ঐ মুখ দেখিয়াই ত হাতের অস্ত্র হাতেই রহিয়া গেল! অস্ত্রাঘাতে পুত্রের প্রাণবধ সঙ্কল্প সাধন দূরে থাকুক, ক্রোড়ে লইয়া শত শত বার মুখচুম্বন করিয়াও মনের সাধ মিটাইতে পারেন নাই।”

 মাবিয়া বলিলেন, “আমাকে তুমি কি করিতে বল?”

 মহিষী বলিলেন, “আর কি করিতে বলিব? যাহাতে ধর্ম্ম রক্ষা পায়, লোকের নিকটে নিন্দনীয় না হইতে হয়, অথচ এজিদের প্রাণরক্ষা হয়, এমন কোন উপায় অবলম্বন করাই উচিত।”

 “উচিত বটে, কিন্তু উপায় আসিতেছে না। মূল কথা, যাহাতে ধর্ম্ম রক্ষা পায়, ধর্ম্মোপদেষ্টার আজ্ঞা লঙ্ঘন না হয়, অথচ প্রাণাধিক পুত্রের প্রাণরক্ষা হয়, ইহা হইলেই যথেষ্ট হইল। লোকনিন্দার ভয় কি? যে মুখে লোকে একবার নিন্দা করে, সে মুখে সুখ্যাতির গুণগান করাইতে কতক্ষণ লাগে?”

 মহিষী বলিলেন, “আপনাকে কিছুই করিতে হইবে না, কিছু বলিতেও হইবে না; কিন্তু কোন কার্য্যে বাধা দিতেও পারিবেন না। মারওয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করিয়াই আমি সকল কার্য্য করিব। যেখানে ধর্ম্মবিরূদ্ধ, ধর্ম্মের অবমাননা, কি ধর্ম্মোপদেষ্টার আজ্ঞালঙ্ঘনের অণুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতে পান, বাধা দিবেন, আমরা ক্ষান্ত হইব।”

 মহারাজ মহাসন্তোষে হস্ত চুম্বন করিয়া বলিলেন, “তাহা যদি পার, তবে ইহা অপেক্ষা সন্তোষের বিষয় আর কি আছে? এজিদের অবস্থা দেখিয়া আমার মনে যে কি কষ্ট হইতেছে, তাহা ঈশ্বরই জানেন। যদি সকল দিক রক্ষা করিয়া কার্য্য উদ্ধার করিতে পার, তবেই সর্ব্বপ্রকার মঙ্গল, এজিদও প্রাণে বাঁচে, আমিও নিশ্চিতভাবে ঈশ্বর-উপাসনা করিতে পারি।”

 শেষ কথাগুলি শ্রবণ করিয়া বৃদ্ধা মহিষী অনুকূলভাবে বিজ্ঞাপনসূচক মস্তক সঞ্চালন করিলেন। তখন তাঁহার মনে যে কথা ছিল, রসনা তাহা প্রকাশ করিল না। আকার-ইঙ্গিতে পতিবাক্যে সায় দিয়া মৌনাবলম্বন করিলেন। মৌন যেন কথা কহিয়া কহিল, ‘এই সংকল্পই স্থির’।

  1. মস্‌নদ পারস্য শব্দ। অনেকে যে মসনন্দ শব্দ ব্যবহার করেন, তাহা সম্পূর্ণ ভ্রম।}}
  2. জানাজা-মৃত শরীরের সদ্গতির উপাসনা।